Ashraf’s Column

Sunday, March 30, 2014

ক্যাডেট কলেজের টুকরো স্মৃতি: ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজ: পর্ব ৬: ঠিকাদারের চ্যালেঞ্জ

কলেজে যোগদানের সপ্তাহখানিকের মধ্যে লক্ষ্য করলাম, প্রিন্সিপালসহ কিছু কর্মকর্তা এবং কর্মচারি ঠিকাদারের কাছ থেকে ফ্রেশ রেশন, যেমন গোস্ত, মাছ, তরকারি, তাজা ফল ইত্যাদি ক্রয় করতেন। মাসের শেষে ঠিকাদারের বিল পরিশোধ করতেন। আরও লক্ষ্য করলাম, প্রিন্সিপালের বাসায় সরবরাহকৃত মাছ-গোস্তের ওজন চাহিদকৃত পরিমানের চাইতে সবসময় বেশি। তরি-তরকারি, ফল-মূলের গুণগত মান ক্যাডেট মেসে সরবরাহকৃত আইটেমের চেয়ে অনেক ভালো, এবং পরিমানও চাহিদার চাইতে বেশি। কোনো কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারি মাসের পর মাস ঠিকাদারের বিল পরিশোধ না করে বাকি রাখছেন। এ নিয়ে ঠিকাদার কোনো আভিযোগও করছেন না। আমার বুঝতে বাকি রইলো না, প্রিন্সিপাল এবং কর্মকর্তা-কর্মচারিদের বাসায় অন-পেমেন্ট রেশন সাপ্লাইয়ের নামে বড় রকমের দুর্নীতি হচ্ছে। এসব লোকদের পরিমানে বেশি এবং উন্নততর মানের রেশন সাপ্লাই করে ঠিকাদারের যে লোকসান হচ্ছে, তা তিনি ক্যাডেট মেসে ওজনে কম এবং খারাপ রেশন সাপ্লাই করে পুষিয়ে নিচ্ছেন। ব্যাপারটি সম্পূর্ণ অনৈতিক হবার কারণে সাথেসাথে ঠিকাদারের কাছ থেকে প্রিন্সিপালসহ অন্য সকলের রেশন নেয়া নিষিদ্ধ করে দিলাম। ঝিনাইদহ শহরের কাঁচা বাজার কলেজ গেইট থেকে মাত্র সোয়া মাইল দূরে। বাস, রিক্সা বা সাইকেলে করে যাওয়াআসা করা কোনো কঠিন কাজ ছিলো না। ক্যাডেটদের জন্য নিকটস্থ আর্মি ইউনিট অথবা এসএসডি (স্টেশন সাপ্লাই ডেপো) থেকে সরকার-নির্ধারিত মূল্যে চাল, আটা, চিনি ও ভোজ্য তেল সরবরাহ করা হতো। ফ্রেশ এবং ড্রাই রেশনের বাকি সব আইটেম ঠিকাদারের কাছ থেকে নিতে হতো। সকল আইটেম সাপ্লাই করার জন্য একজন ঠিকাদার ওপেন টেন্ডারের মাধ্যমে বারো মাসের জন্য নিয়োগ পেতেন। রাজনৈতিকভাবে অতি প্রভাবশালী এবং পেশীশক্তিতে অত্যন্ত বলীয়ান ঝিনাইদহ শহরের একই ব্যক্তি প্রতি বছর ছলে-বলে-কৌশলে ঠিকিাদারির একাজটি বাগিয়ে নিতেন। ভয়ে কেউ কোনো প্রতিবাদ করতে সাহস পেতো না। বাইরে থেকে এসে অন্য কোনো ঠিকাদার ভয়ে টেন্ডার জমা দিতে পারতেন না। তাছাড়া, টেন্ডারে কিছুকিছু আইটেম ছিলো যা কখনই কেনা হতো না। যেমন, গুড় এবং নারিকেল। কলেজ অফিস থেকে এসব আইটেমের চাহিদাও দেখানো হতো অনেক বেশি করে। যেমন, গুড়ের বাৎসরিক চাহিদা ছিলো ৩০ মণ, নারিকেলের চাহিদা ছিলো ৫০০০। আমার মনে আছে, গুড়ের দাম কোট করা হয়েছিলো কেজিপ্রতি দুই পয়সা, আর নারিকেল প্রতিটির দাম ছিলো এক পয়সা ! ক্যাডেট মেসে গুড়ের ব্যবহার একেবারেই ছিলো না। সকল প্রয়োজনে চিনি ব্যবহার করা হতো। কখনও কখনও নারিকেলের প্রয়োজন হলে কলেজের নিজস্ব গাছ থেকে নারিকেল পেরে ব্যবহার করা হতো। প্রভাবশালী ঠিকাদারটি এরকম সব আইটেমের অবিশ্বাস্য রকম কম দাম কোট করতেন। অন্যদিকে যেসব আইটেম প্রায় প্রতিদিন লাগতো সেগুলোর দাম অসম্ভব বেশি করে কোট করতেন। যেমন, রুই মাছের কেজি তখন বাজারে ছিলো ৩০ থেকে ৪০ টাকা। টেন্ডারে কোট করা হতো ৭০ থেকে ৮০ টাকা, বা তারও বেশি। একইভাবে মুরগি, গরু এবং খাসির গোস্তসহ অন্যান্য আইটেমের দাম আকাশচুম্বি অবাস্তব রেটে কোট করা হতো। এর মধ্যে কতো বড় অসাধু চতুরতা আছে, তা যাঁরা সাপ্লাইয়ের ব্যবসার সাথে জড়িত তাঁরা সবাই জানেন। তবে যাঁরা ব্যবসা করেন না, তাঁদের জন্য বিষয়টি একটু খোলাসা করে বলছি। টেন্ডারে উল্লিখিত প্রতিটি আইটেমের ইউনিট প্রাইস কোট করে চাহিদাকৃত সকল আইটেমের, আইটেমওয়াইজ, মোট পরিমানের দাম কোট করা হতো। সবশেষে সব আইটেমের সর্বসাকুল্যে যা দাম হতো তা কোট কর হতো। নিত্য প্রয়োজনীয় আইটেমগুলোর দাম আকাশচুম্বি হলেও গুড় এবং নারিকেলের মতো আপ্রয়োজনীয় আইটেমের হাস্যকর কম দামের কারণে সর্বসাকুল্য দাম অনেক কমে আসতো। বাহির থেকে কোনো ঠিকাদার এলে তাঁর পক্ষে এ চালাকি করা সম্ভব হতো না। তাঁরা গুড় এবং নারিকেলসহ সব আইটেমের স্বাভাবিক দাম কোট করতেন। যারফলে তাঁদের কোট করা সর্বসাকুল্য দাম প্রভাবশালী ঠিকাদারের কোট করা দামের চাইতে বেশি হতো। ঝিনাইদহ শহরের সেই একই প্রভাবশালী ঠিকাদার বছরের পর বছর, আইনের কোনো ব্যত্যয় না ঘটিয়ে, এভাবে সাপ্লাইয়ের কাজটি হস্তগত করতেন। বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করে উভয় পক্ষের জন্য গ্রহণযোগ্য একটি সমাধান বের করার জন্য ঠিকাদারকে অফিসে আসতে অনুরোধ করলাম। অফিসে এলে আমি তাঁকে নিশ্চয়তা দিলাম, যেসব আইটেমের অস্বাভাবিক বেশি দাম ধরা হয়েছে সেগুলো কমিয়ে সহনীয় পর্যায়ে আনা হলে আমি গুড় বা নারিকেল জাতীয় আইটেমের জন্য কোনো ডিমান্ড দেবো না। চাইলে তাঁকে আমি লিখিত নিশ্চয়তা দিতে রাজি আছি। তিনি কোনো সিদ্ধান্ত না দিয়ে পরে জানাবেন বলে চলে গেলেন। পরে লোক মারফত জানালেন, তাঁর পক্ষে এখন কিছু করা সম্ভব নয়। পরবর্তী অর্থ বছরে কোটেশন সাবমিট করার সময় তিনি কথাটা বিবেচনায় রাখবেন। শুনে আমার খুব মন খারাপ হলো, রাগও হলো ঠিকাদারের উপর। নিজের সন্তানের বয়সী বাচ্চা ছেলেদের কল্যাণের কথা বিবেচনা না করে বছরের পর বছর নাজায়েয মুনাফা লুটে খাচ্ছেন। অথচ, ৩০ জুন পর্যন্ত, মাত্র দু’তিন মাসের জন্য কোনো বিবেচনা করতে রাজি নন। ভাবলাম, এই জালিমকে অন্তত: একবার উচিৎ শিক্ষা দিতে হবে। আমি সর্বোচ্চ পরিমান গুড় এবং নারিকেল সাপ্লাই করার জন্য ঠিকাদারকে অর্ডার দিলাম। এবার তাঁর টনক নড়লো। লোক পাঠিয়ে অনেক অনুনয়-বিনয় করলো গুড় এবং নারিকেলের অর্ডার বাতিল করার জন্য। আমার এক জবাব, সময়মত গুড় এবং নারিকেল সরবরাহ করুন। নইলে চুক্তির শর্ত অনুযায়ী আর্নেস্ট মানি ৩০ হাজার টাকা বাজেয়াপ্ত করা হবে। কলেজের কেউকেউ মন্তব্য করলেন, প্রিন্সিপাল সাহেবের কি মাথা খারাপ হয়ে গেলো ? এত গুড় আর নারিকেল কে খাবে ? তাঁদেরকে বললাম, গুড় ডেইরি ফার্মের গাভীদের খাওয়ানো হবে। নারিকেল ক্যাডেট মেসে দেওয়ার পর যা অতিরিক্ত থাকবে তা কলেজের কর্মকর্তা-কর্মচারিদের কাছে কেনাদামে বিক্রি করা হবে। করেছিলামও তাই ! ঠিকাদার আমাকে বিভিন্ন চ্যানেলে হুমকি-ধামকি দিলেন। শেষ পর্যন্ত ‘রক্ত’ (আসলে আলতা !) দিয়ে চিঠি লিখে হত্যা করার হুমকিও দিতে বাকি রাখলেন না। আমার শুভাকাঙ্খীরা আমাকে সতর্ক হয়ে চলাফেরা করার পরামর্শ দিলেন। বিশেষ করে রাতবিরাতে গাড়িতে করে একা শুধু ড্রাইভার নিয়ে ৩০ মাইল দূরে যশোর ক্যান্টনমেন্টে যাতায়াতে নিষেধ করলেন। সেসময়ে ঝিনাইদহ অঞ্চল উগ্র রাজনৈতিক কর্মকান্ডের জন্য পরিচিত ছিলো। প্রায়ই দু’য়েকটা রাজনৈতিক হত্যাকান্ড সংঘটিত হতো। যাহোক, আমি এসবে কর্ণপাত করিনি। আমার বিশ্বাস ছিলো, এবং আজও আছে, হায়াত-মউতের মালিক আল্লাহ। আর, যারা এরকম হুমকি দেয় তারা সাধারণত: কাপুরুষ হয়ে থাকে। যাদের সাহস থাকে তারা হুমকি দেয় না, কাজটাই করে ফেলে। তখন সম্ভবত: মার্চ মাসের শেষ ভাগ। এপ্রিল মাসে পরবর্তী অর্থ বছরের জন্য নতুন দরপত্র আহ্বানের সময় হবে। সংশ্লিষ্ট সকল ছোটোছোটো সাব-কন্ট্রাক্টরকে আফিসে ডাকলাম। তাঁরা সবাই যা একবাক্যে বললেন তা হলো: সরবরাহকৃত সকল আইটেমের কনসলিডেটেড মূল্য প্রায় ৩০ লক্ষ টাকা। যার জন্য টেন্ডারের সাথে ৩০ হাজার টাকার বেশি আর্নেস্ট মানি জমা দিতে হয়। তাঁরা প্রত্যেকে অতি ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। এতো টাকা আর্নেস্ট মানি দেওয়া তাঁদের কারও একার পক্ষে সম্ভব নয়। শ্রেণী অনুযায়ী আইটেমগুলো ভাগভাগ করে প্রতি ৬ মাসে যদি টেন্ডার ডাকা হয় তবে তাঁরা তাতে অংশ নিতে পারবেন। সেক্ষেত্রে প্রতি শ্রেণীর আইটেমসমূহের জন্য ৫ থেকে ১০ হাজার টাকার মতো আর্নেস্ট মানি দিতে হবে। তবে একাজ করতে গেলে বড় একটা সমস্যা হবে। সেজন্য তাঁরা আমার সাহায্য চাইলেন। প্রভাবশালী বড় ঠিকাদার ক্ষেপে গিয়ে নিজস্ব গুন্ডা দিয়ে, অথবা থানাপুলিশ দিয়ে তাঁদের হেনস্থা করতে চাইবেন। আমি আমার পক্ষ থেকে সকল প্রকার সাহায্য-সহযোগিতার নিশ্চয়তা দিলাম। কেনো আমি ফ্রেশ এবং ড্রাই রেশনের দরপত্র ভেঙ্গেভেঙ্গে ছোটো করতে চাই তা ব্যাখ্যা করে চেয়ারম্যানের অফিসে চিঠি দিলাম। চেয়ারম্যান অনুমোদন দিয়ে দিলেন। ঝিনাইদহের এসডিও এবং এসডিপিও-কে (তখনও ঝিনাইদহ জেলা হয়নি) ক্ষুদ্র ঠিকাদারদের নিরাপত্তার কথা বলে, তাঁদের সহযোগিতা চাইলাম। তাঁদের দু’জনকেই আমার কাছে অত্যন্ত ভালো অফিসার বলে মনে হয়েছে। দু’জনেই সানন্দে রাজি হলেন সর্বপ্রকার সহযোগিতা প্রদানের জন্য। এতোদিন পর তাঁদের নাম মনে করতে পারছিনা বলে আমি দু:খিত। আসলে, স্থানীয় প্রশাসনিক অফিসারদের সহযোগিতা ছাড়া কোনো প্রতিষ্ঠান, বিশেষ করে মফস্বল অঞ্চলে, পরিচালনা করা খুবই কঠিন। সে যায়গায় তাঁরা যদি অন্যায় হস্তক্ষেপ করেন তাহল কাজটি করা প্রায় অসম্ভব হয়ে যায়। পরবর্তী জুলাই মাস থেকে ক্যাডেটদের খাওয়াদাওয়া নিয়ে বড় কোনো সমস্যা রইলো না। নবনিযুক্ত ক্ষুদ্র ঠিকাদাররা অত্যন্ত উৎসাহের সাথে ভালো মানের ফ্রেশ এবং ড্রাই রেশন সরবরাহ করতে লাগলেন। বড় একটা ঝামেলা থেকে বাঁচা গেলো !

Tuesday, March 25, 2014

ক্যাডেট কলেজের টুকরো স্মৃতি: ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজ: পর্ব ৫: ক্যাডেট কলেজে অশান্তি এড়াতে হলে

আপনা র ঘরে যদি তিনটি ছেলেকে দিনের চব্বিশ ঘন্টা মাসের পর মাস আটকে রাখা হয় তাহলে কেমন অরাজক পরিস্থিতি হতে পারে, আশা করি, তা বুঝিয়ে বলতে হবে না। কমবেশি তিন’শ ছেলেকে (বা মেয়েকে), যাদের বয়স ১২ থেকে ১৮ বছর, যদি কঠিন শৃঙ্খলার মধ্যে আটকে রাখা হয় এবং সেখানে যদি শান্তিশৃঙ্খলা বজায় না থাকে তাহলে পরিস্থিতি কোন পর্যন্ত যেতে পারে, তা কল্পনাও করা যায় না। অথচ, ক্যাডেট কলেজগুলো অনেক দিন ধরে এই আপাত: অসম্ভব কাজটিই সার্থকতার সাথে করে সবার প্রশংসা কুড়াচ্ছে। যদি কেউ প্রশ্ন করেন, এর কোনো গোপন রহস্য আছে কি না। যদি থাকে তাহলে সেটা কী ? এ প্রশ্নের জবাব হলো: কোনো রহস্য নেই। যে চারটি বিষয়ে মনোযোগ দিলে পরিস্থিতি আপনার নিয়ন্ত্রণে থাকবে তা হলো: (১) ছেলেদেরকে সময়মতো ভালো খাবার পরিবেশন করুন। (২) রুটিনমতো কাজকর্মে ব্যস্ত রাখুন। (৩) পর্যাপ্ত বিনোদনের ব্যবস্থা রাখুন। (৪) রাতে নিরবচ্ছিন্ন ঘুমেরে যাতে ব্যাঘাত না হয়, তা নিশ্চিত করুন। দেখবেন, বড় কোনো অশান্তি হবে না। ছোটোখাটো কিছু সমস্যা হতেই পারে। প্রশাসন যদি সজাগ থেকে সময়মতো সঠিক ব্যবস্থা নেয় তাহলে এসব ছোটো সমস্যা কোনো বড় অসুবিধা করে না। কেউ হয়তো প্রশ্ন করতে পারেন, তাহলে পড়ালেখা কোথায় গেলো ? ক্যাডেট কলেজের কোনো ক্যাডেটকে পড়ালেখা করার জন্য বলতে হয় না। একাজটি ওরা নিজ থেকেই খুব সিরিয়াসলি করে থাকে। এমনকি অনেকে লাইটস আউটের (রাতে আবশ্যিকভাবে বাতি নেভাবার সময়) পর ডিউটি মাস্টারের নজর এড়িয়ে চুপিচুপি পড়শুনা করে থাকে, বিশেষ করে পরীক্ষার আগে। শিক্ষকগণ শুধু নির্দেশণা দিয়ে সাহায্য করেন। কেউ কোনো বিষয়ে অতি দূর্বল হলে তাকে ক্লাসের বাইরে অতিরিক্ত সময়ে টিউটরিং করে থাকেন। স্পুনফিডিংয়ের কোনো প্রয়োজন হয় না। যখন ক্যাডেটরা ভেকেশনে বাড়ি যেতো তখন যাবার আগে হাউস মাস্টাররা ছেলেদের ব্যাগ-সুটকেইস রীতিমতো তল্লাশি করে সকল পাঠ্যবই হাউসে রেখে দিতেন। কোনো হোম ওয়ার্ক দেওয়া হতো না। ছেলেদের বলা হতো: বাড়ি গিয়ে আনন্দ করো, ঘুরে বেড়াও, খেলাধুলা করো, সিলেবাসের বাইরের বইপত্র পড়ো, মা-বাবার ঘরের কাজে সাহায্য করো ইত্যাদি। আড়াই-তিন মাস একনাগারে কলেজে থাকলে এক ধরনের একঘেয়েমি এসে যায়। তা থেকে মুক্তি পাবার জন্যই এমন পরামর্শ দেওয়া হতো। আজকাল শুনছি, ভেকেশনে যাবার সময় ক্যাডেটদের পাঠ্যবই সঙ্গে নিতে অনেকটা বাধ্য করা হয়। প্রচুর হোম ওয়ার্ক দেওয়া হয়। বাড়িতে থাকতে কোন কোন বিষয়ে প্রাইভেট টিউটরের কাছে পড়তে হবে সে সম্পর্কে অভিভাবককে চিঠি দিয়ে জানানো হয়। যে দর্শন ও নীতির উপর ভিত্তি করে শুধুমাত্র জাতীয় ভিত্তিতে মেধাবীদের জন্য ক্যাডেট কলেজ শুরুতে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিলো, এসব কাজ তার পরিপন্থি। যেসব ছেলেমেয়েদের জন্য এমন করা প্রয়োজন তারা ক্যাডেট কলেজে ভর্তি হবার জন্য উপযুক্ত নয়, অন্তত: মেধার দিক থেকে। শোনা যায়, আজকাল ভর্তির জন্য নির্বাচন প্রক্রিয়ায় আপোষ করা হচ্ছে। কথাটা সত্য হলে এটা কঠোরভাবে বন্ধ করতে হবে। আর যদি ভর্তির জন্য নির্বাচন প্রক্রিয়ায় কোনো ত্রুটি থাকে, বিশেষজ্ঞদের দিয়ে নির্বাচন প্রক্রিয়াকে সংষ্কার করতে হবে। তা নাহলে ক্যাডেট কলেজের সুনাম, ঐতিহ্য ও কার্যকারিতা ধরে রাখা যাবে না ক্যাডেট কলেজের জন্য জনগণের ট্যাক্স থেকে যে বিপুল পরিমান অর্থ ব্যয় করা হয়, তার যৌক্তিকতা ধরে রাখা যাবে না। এবার আসা যাক ক্যাডেট কলেজে ক্যাডেটদের খাবার ব্যবস্থা প্রসঙ্গে। সকালের পিটি/প্যারেডের পর ব্রেকফাস্ট, সকাল দশটার দিকে মিল্ক ব্রেকে দুধ আর বিস্কুট, দুপুর একটার দিকে লাঞ্চ, বিকেলে গেইমস পিরিয়ডের পর চা-টিফিন, সর্বশেষ রাতে ডিনার। ক্যাডেট কলেজে মাথাপ্রতি একজন ক্যাডেটকে কোন বেলায় কোন খাবার কতটুকু দিতে হবে তা পুষ্টিবিজ্ঞানী নির্ধারণ করে দেন। যেমন, বলা হয় না, এক বেলায় একজন ক্যাডেটকে এতো টাকার মুরগির গোস্ত দিতে হবে। বলা হয়, এতো গ্রাম মুরগির গোস্ত দিতে হবে, দাম যতোই হোক না কেনো। যার ফলে বাজারে খাদ্যদ্রব্যের দাম বাড়লে ক্যাডেট কলেজের বাজেটও আবশ্যিকভাবে বাড়াতে হয়। যে কোনো রান্না করা খাবার খেতে ভালো লাগবে কি না তা বহুলাংশে নিভর্র করে রান্নার উপকরণের গুণগত মান, রান্নার প্রক্রিয়া এবং পরিবেশের মানের উপর। এসব দেখার জন্য ডিউটি মাস্টার এবং ডিউটি এনসিওকে তাঁদের পর্যবেক্ষণে সর্বোচ্চ মনোযোগী হবার জন্য অনুরোধ করলাম। আমি নিজেও সময়ে-অসময়ে ক্যাডেট মেসের কুকহাউস ভিজিট করতে লাগলাম। সুযোগ পেলেই খাবার সময়, আগাম খবর না দিয়ে, মেসে গিয়ে ক্যাডেটদের সাথে বসে খাবার টেস্ট করতে লাগলাম। পরিবেশিত খাবারের মান এবং স্বাদ সম্পর্কে ক্যাডেটদের মতামত নিয়ে খোলাখুলি আলোচনা করতাম। একথা সত্য, ক্যাডেটদের মন্তব্যে বাড়াবাড়ি ছিলো, এ ধরনের কম্যুনিটি কিচেনের রান্না সম্পর্কে সাধারণত: যা হয়ে থাকে। তারপরও অত্যন্ত পরিতাপের সাথে লক্ষ্য করলাম: (১) অধিকাংশ ছেলে টিফিনে পরিবেশিত দুধ না খেয়ে টেবিলের উপর দুধভর্তি কাপ ছেড়ে যাচ্ছে। জিজ্ঞাসা করাতে ছেলেরা জবাব দিলো, স্যার, দুধ খেতে ভালো লাগে না। (২) যে বেলায় গরু, খাসি বা মুরগির গোস্ত থাকতো ছেলেরা সব গোস্ত না খেয়ে প্লেটে ফেলে রেখে যেতো। জিজ্ঞেস করলে ছেলেরা একবাক্যে জবাব দেতো, মরা গরুর (খাসি বা মুরগির) গোস্ত। খাওয়া যায় না। (৩) বাজে রান্নার জন্য সব্জিও অনেকে খেতে পসন্দ করতো না। শুধু ডাল দিয়ে ভাত খেয়ে উঠে যেতো। এসব দেখে ও শুনে মনেমনে কষ্ট পেতাম। সরকার ছেলেদের খাওয়াদাওয়ার জন্য এতো টাকা খরচ করছে। অথচ, ছেলেরা খেতে পারছে না। নিজের ছেলেবেলার কথা মনে হলো। মা যখন গ্লাসে করে গরম দুধ খেতে দিতেন তখন কী মজা করেই না তা খেতাম ! আর গোস্ত ! মা যে বেলায় গোস্ত রান্না করতেন সে বেলায় শুরু থেকেই সব ভাইবোন মিলে আনন্দে লাফাতাম ! খেতে বসার আগেই জিহ্বায় পানি এসে জেতো ! যাহোক, ছেলেদের মেসের খাবারে অরুচির কারণ খুঁজতে বেশি দূর যেতে হলো না। কলেজের নিজস্ব ডেইরি ফার্মে পর্যাপ্ত সংখ্যক গাভী ছিলো। যার বেশির ভাগ ছিলো ‘সিন্ধি’ প্রজাতির। অল্প কিছু ছিলো ‘ফ্রিজিয়ান’। দেশি জাতের কোনো গরু ছিলো না। তা সত্বেও মেসের চাহিদা মেটাবার মতো পর্যাপ্ত দুধ সেখানে উৎপন্ন হতো না। ফলে পুরোটাই বাইরের ঠিকাদারের কাছ থেকে কিনতে হতো। বাংলাদেশের বাস্তবতায় কোনো ঠিকাদারের কাছ থেকে খাঁটি দুধ আশা করা তখনও যেতো না, এখনও যায় না। ছেলেদেরকে খাঁটি দুধ খাওয়াতে হলে যে কোনো মূল্যে কলেজের নিজস্ব ডেইরি ফার্মের উন্নতি করা ছাড়া গত্যন্তর রইলো না। খুলনা থেকে সরকারি পশুপালন বিভাগের উপ-পরিচালক মহোদয়কে পরামর্শের জন্য দাওয়াত দিলাম। ভদ্রলোক খুব খুশিমনে এলেন। সঙ্গে ঝিনাইদহের সাবডিভিশনাল পশুপালন অফিসারকে আনলেন। সরজমিনে ডেইরি ফার্ম দেখলেন। ফার্মে রাখা রেজিস্টার খুলে প্রতিটি গাভীর বয়স, রোগ প্রতিরোধক টিকা দেওয়ার রেকর্ড, সবশেষ কবে ডিওয়ার্মিং (কৃমিমুক্ত) করা হয়েছে, খাবারের মেনু, নিয়মিত ব্যায়ামের রুটিন, এসব তথ্য পরীক্ষা করলেন। সাবডিভিশনাল পশুপালন অফিসারকে বিস্তারিত নির্দেশ প্রদান করে তাঁকে ফার্মের দায়িত্ব নিতে বললেন । সাবডিভিশনাল পশুপালন অফিসার বিষয়টিকে ব্যক্তিগত চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিলেন। প্রতি সপ্তাহে দু’তিনবার কলেজে এসে ফার্মের দেখভাল করতে লাগলেন। ফার্মের কর্মীদের পরামর্শ দিতে লাগলেন। কলেজের কৃষি ফার্মে অন্য ফসলের চাষ কমিয়ে দিয়ে সেখানে গাভীর দুধ বাড়ে এমন খাদ্য যথা নেপিয়ার ঘাস, জার্মান ঘাস, ভুট্টা ইত্যাদির চাষ শুরু হলো। ক্যাডেট মেসের ভাতের মাড় অন্য কোথাও না গিয়ে পুরোটা ডেইরি ফার্মে আসতে লাগলো। তিন মাসের মধ্যে, গাভীর সংখ্যা না বাড়িয়ে, দুধের পরিমান এতটা বেড়ে গেলো যে, ক্যাডেট মেসের চাহিদা মিটিয়ে কলেজের কর্মকর্তা-কর্মচারীদেরকে, বিশেষ করে যাদের দুগ্ধপোষ্য শিশু এবং ছোটো বাচ্চা ছিলো তাদেরকে, ভর্তুকিমূল্যে দুধ সরবরাহ করা সম্ভব হলো। ভেকেশনের সময় শহরের মিষ্টির দোকানদাররা সারপ্লাস দুধ সানন্দে কিনে নিয়ে যেতো। শত হলেও খাঁটি দুধ তো ! ক্যাডেটরা বেজায় খুশি হলো। এবার আর টেবিলে খালি দুধের গ্লাস দেখা গেলো না। ডেইরি ফার্মের কথা অসম্পূর্ণ রয়ে যাবে যদি তার এক সদস্যের কথা না বলা হয়। তার নাম ‘মন্টু’। কলেজের সবাই তাকে এই নামে চিনতো। পরিচিত রাখাল নাম ধরে ডাকলে মন্টু যেখানই থাকতো ছুটে আসতো। সে ছিলো ফার্মের প্রবীনতম ষাঁড়। জাতে ছিলো ‘সিন্ধি’। গায়ের রং টকটকে লাল। দেখতে অত্যন্ত স্বাস্থ্যবান, হ্যান্ডসাম এবং স্মার্ট ! গত তিন বছর যাবত নিকটস্থ ভাটুই বাজারের কোরবানির হাটে নিয়ে বিক্রি করার চেষ্টা করা সত্বেও বিক্রি করা যায়নি। প্রতিবারই সকল বাধা এবং রশি ছিন্ন করে মন্টু হাট থেকে পালিয়ে এক দৌড়ে কলেজে ফিরে এসে ফার্মে ঢুকে নিজ অবস্থানে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতো। যেহেতু আমাদের ফার্মটি ছিলো মূলত: দুধের জন্য, এঁড়ে বাছুর বড় হয়ে গেলে সেটিকে রাখার ব্যবস্থা ছিলো না। সিদ্ধান্ত নিলাম, কষ্ট হলেও, মন্টুকে এবার যে করে হোক বিদায় করতে হবে। এবার কোরবানির সময় কলেজের পিকআপে চড়িয়ে মন্টুকে ঢাকার গাবতলি গরুর হাটে পাঠিয়ে দেওয়া হলো। এবার আর মন্টু হাট থেকে মন্টু ফিরে এলো না। মন্টুকে যখন ঢাকা নেবার জন্য পিকআপে উঠানো হয় ফার্মের রাখালসহ অনেকের চোখে পানি দেখে আমি নিজেও বিচলিত হয়ে পড়েছিলাম বৈকি। ক্যাডেট মেসে রান্না করা গোস্তের স্বাদ ও মান উন্নয়ন করা অতটা সহজ ছিলো না। কুকহাউস থেকে যাতে কেউ কোনো মশলা, বিশেষ করে অতি দামি গরম মশলা, রান্নার তেল-ঘি চুরি করে বাইরে নিতে না পারে সেজন্য কুকহাউসের স্টাফদের আচমকা শরীর তল্লাসি শুরু করা হলো। প্যান্টের পকেটে ভরে গড়ম মশলা চুরি করে নেবার সময় ধরা পড়ায় দু’একজনকে চাকুরি থেকে বরখাস্ত করা হলো। এদের মধ্যে কেউকেউ স্থানীয় হবার কারণে বাইরের মাস্তানদের সাথে নিয়ে প্রিন্সিপালকে একহাত দেখে নেবার হুমকি দিলো। এতো সবের পরও গোস্তের মান বাড়ানো গেলো না। একেবারে মৃত না হলেও মৃতপ্রায় এবং অতিশয় রুগ্ন পশুর গোস্ত সরবরাহ বন্ধ করা যাচ্ছিলো না। গোস্তের ঠিকাদারকে ডেকে প্রথমে অনুরোধ পরে সতর্ক করলাম। কোনো কাজ হলো না। ঠিকাদারের এক জবাব, তাঁর নিজের কোনো কসাইখানা বা গোস্তের ব্যবসা নাই। কসাইদের কাছ থেকে কিনে তিনি গোস্ত সাপ্লাই দেন। কলেজের মেডিক্যাল অফিসার ছিলেন মেজর (পরে লে: কর্নেল, বর্তমানে মরহুম) কফিলউদ্দিন আহমদ (চলচ্চিত্র পরিচালক তৌকীর আহমদের পিতা)। ঠিকাদার ফ্রেশ রেশন নিয়ে এলে তিনি প্রতিবার গোস্তসহ সব আইটেমের গুণগত মান পরীক্ষা করতে লাগলেন। কোনো কিছুতেই কাজ হচ্ছিলো না। সর্বশেষ উপায় হিসেবে আমাকে নিজ দায়িত্বে একটি অসাধারণ পদক্ষেপ নিতে হলো। বিল্ডিং সুপারভাইজারকে ডেকে বললাম মেসের পাশে একটি ‘বুচারি’ অর্থাৎ কসাইখানা বানাতে হবে। যাতে একটা বা দু’টো গরু একসাথে জবাই করে গোস্ত বানানো যেতে পারে। তার জন্য সম্ভাব্য নির্মাণ ব্যয় কতো হবে তা আইটেমওয়ারি লিখে আমাকে এস্টিমেট দিতে বললাম। এস্টিমেট দেখে চিন্তায় পড়ে গেলাম। প্রিন্সিপালের ফিনান্সিয়াল পাওয়ারের চাইতে অনেক বেশি টাকার প্রয়োজন। যদি অনুমোদন চেয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে উর্ধতন কতৃর্পক্ষকে চিঠি লিখি, আর যদি কোনো কারণে সে অনুরোধ প্রত্যাখ্যাত হয়, তাহলে ‘বুচারি’ আর কখনও বানানো যাবে না। অথচ ‘বুচারি’ না বানিয়ে সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। কলেজের সামনে যশোর-কুষ্টিয়া হাইওয়ে। তার পাশে, আল্লাহ জানেন কবে থেকে, প্রচুর অব্যবহৃত উদ্বৃত্ত ইট পড়ে ছিলো। কলেজের পাম্প হাউস বানানোর সময়ে ঠিকাদার কর্তৃক লেবারদের জন্য নির্মিত টিনশেড বহুদিন যাবত পড়ে ছিলো। বিল্ডিং সুপারভাইজারকে আদেশ দিলাম, যতো শীঘ্র সম্ভব হাইওয়ের পাশ থেকে অব্যবহৃত ইট, এবং পাম্প হাউসের পাশ থেকে টিন নিয়ে এসে ‘বুচারি’ বানিয়ে ফেলতে। ক্যাডেট মেস থেকে পানি ও বিদ্যুতের সংযোগ নিতে। মেইনটিন্যান্স খাত থেকে বাকি নির্মাণ সামগ্রী কিনে নিতে। তাড়াতাড়ি এইজন্য করছিলাম যে, ‘বুচারি’ বানালে যাদের স্বার্থে আঘাত লাগবে তাদের কেউ যাতে উপরওয়ালা কাউকে দিয়ে আমার এ ‘ষড়যন্ত্র’ অংকুরেই নস্যাত না করে দেয়। যেমন আদেশ, তেমন কাজ। প্রচুর আলোবাতাসের ব্যবস্থা রেখে, চারদিকে ফ্লাইপ্রুফ নেটের ঘেরা দিয়ে, প্রায় রাতারাতি টিনের চালওয়ালা ‘বুচারি’ তৈরী হয়ে গেলো। এবার ঠিকাদারকে বলা হলো গরু, খাসি এবং মুরগি, সব জীবীত অবস্থায় কলেজে আনতে হবে। কলেজের মেডিক্যাল অফিসার পরীক্ষা করে দেখে ‘গ্রহণযোগ্য’ বলে সার্টিফিকেট দিলে কলেজের ‘বুচারি’তে জবাই করে গোস্ত সরবরাহ করতে হবে। কলেজ মসজিদের ইমাম সাহেব বিনা পারিশ্রমিকে পশু জবাইর কাজ করে দিবেন। মজার ব্যাপার হলো, জ্যান্ত মুরগি খাচায় ভরে আনলেও, ঠিকাদারকে জ্যান্ত গরু ও খাসি সকাল বেলা একাডেমিক ব্লকের সামনে দিয়ে হাটিয়ে আনতে বলা হলো। ক্যাডেটরা ক্লাসরুমে বসেই নিজের পায়ে হেটে যাওয়া গরু ও খাসির অবয়ব দেখতে পেতো। এবার আর খাবার টেবিলে কোনো গোস্তের চিহ্ন রইলো না। ছেলেরা পরিতৃপ্তির সাথে পরিবেশিত প্রতিটি গোস্তের টুকরা খেয়ে শেষ করতে লাগলো। এই ঘটনার কিছুদিন পর ঢাকায় কোনো কাজে গেলে আর্মি হেডকোর্য়াটার্সে ক্যাডেট কলেজ গভর্নিং বডিজের চেয়ারম্যান জে: এরশাদের সাথে দেখা। তিনি অনেকের সামনে আমাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ওয়েলডান, আশরাফ। ‘বুচারি’ বানিয়ে খুব ভালো কাজ করেছো। আমি বললম, স্যার, আপনি কেমন করে জানলেন ? আমি তো আপনাকে জানাইনি। তিনি মুচকি হেসে বললেন, বেনামী চিঠি থেকে জেনেছি ! তোমরা তো জানোনা, প্রতিদিন প্রিন্সিপালদের বিরুদ্ধে আমার কাছে প্রচুর বেনামী চিঠি আসে। প্রিন্সিপালদের মধ্যে যারা খুব ভালো করছে, এবং যারা খুব খারাপ করছে তাদের বিরুদ্ধে বেশি বেনামী চিঠি আসে। ডোন্ট ওরি, তুমি অবশ্যই ভালো করছো। কীপ ইট আপ।

ক্যাডেট কলেজের টুকরো স্মৃতি: ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজ: পর্ব ৪: সেকুলারিজম নিয়ে বিভ্রান্তি

পেরেন্টস ভিজিটিং ডে’তে অফিসে বসে আছি। অভিভাবকরা এক এক করে আসছেন। কেউ আসছেন শুধু শুভেচ্ছা জানাতে। কেউ আসছেন নিজ ছেলের কোনো সমস্যা নিয়ে আলোচনা করতে। কেউ বা আসছেন কলেজ কর্তৃপক্ষের কোনো সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করে তা প্রত্যাহার করার অনুরোধ জানাতে। নানা বয়সের, নানা পেশার, নানা ব্যাকগ্রাউন্ডের লোক আসছেন। প্রত্যেকে আমার সম্মানিত ক্লায়েন্ট। সেভাবেই সবার সাথে কথা বলে আসছিলাম। হঠাৎ করে এক ভদ্রলোক কিছুটা উত্তেজিত অবস্থায় আমার অফিসে এসে বসলেন। মনে হলো, আমার অফিসে আসার আগে উনি কোনো বিষয় নিয়ে কারো সাথে কথা বলছিলেন। উত্তেজনাটা সেখানেই ঘটেছে। বাংলা একাডেমির একজন সিনিয়র অফিসার হিসেবে নিজের পরিচয় দিলেন। আরও জানালেন, বাজারে উনার লেখা এবং অনুবাদ করা অনেক বই আছে। বাংলাদেশের শিল্প, সাহিত্য এবং সংস্কৃতি জগতের একজন সিনিয়র মোড়ল বলেও নিজেকে তুলে ধরলেন। ধরা যাক ভদ্রলোকের নাম মাসুদ সাহেব। কোনো প্রকার ভূমিকা না করে মাসুদ সাহেব বললেন: তাঁর ছেলে ক্লাস নাইনে পড়ে। তাকে জোর করে কলেজ কর্তৃপক্ষ মসজিদে নিয়ে নামাজ পড়তে বাধ্য করছে। উল্লেখ করা যেতে পারে যে, প্রতিদিন মাগরিবের ওয়াক্তে সকল মুসলমান ছেলেদের জন্য সারিবদ্ধ হয়ে মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়া বাধ্যতামূলক। একইভাবে শুক্রবার জুমার নামাজ মসজিদে গিয়ে আদায় করা বাধ্যতামূলক। অন্যান্য ওয়াক্তিয়া নামাজ পড়ার জন্য প্রত্যেক হাউসে প্রেয়াররুম আছে। মাসুদ সাহেব পবিত্র কুর’আনের সুরা বাকারার ২৫৬ নম্বর আয়াতের প্রথম অংশ উদ্ধৃত করে বললেন, ইসলামে ধর্ম নিয়ে জবরদস্তি নেই। যার খুশি সে নামাজ পড়বে। যার খুশি সে পড়বে না। তিনি আরও বললেন, বাংলাদেশ একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। এখানে কাউকে ইচ্ছার বিরুদ্ধে নামাজ পড়ানো যাবে না। ভদ্রলোক একই আয়াতের ঠিক পরের অংশটি বেমালুম চেপে গেলেন, যেমনটি আমাদের দেশের একধরনের সেকুলারিস্ট রাজনৈতিক নেতারা করে থাকেন। এধরনের লোকদের সাথে তর্ক করে লাভ হয় না। আমি আমার অফিস সুপারিনটেনডেন্ট নাজির সাহেবকে বললাম মাসুদ সাহেবের ছেলের পার্সোনাল ফাইল আনতে। ফাইলের একেবারের প্রথম পাতাটি ছিলো দু’বছর আগে পাঠানো তাঁর ছেলের ভর্তির দরখাস্ত। যার নিচের দিকে মাসুদ সাহেবের নিজের দস্তখত। দরখাস্তে প্রার্থীর ধর্ম হিসেবে ‘ইসলাম’ কলম দিয়ে লেখা ছিলো। আমি কথা না বাড়িয়ে দরখাস্তটি মাসুদ সাহেবের দিকে এগিয়ে দিয়ে বরলাম, ‘ইসলাম’ কথাটি কেটে দিন। পরিবর্তে ‘নাস্তিক’ বা ‘নাই’ যা খুশি লিখে নিচে আজকের তারিখসহ ইনিশিয়াল করে দিন। আপনার ছেলেকে আর আমি জোর করে নামাজ পড়তে নেবো না। ভদ্রলোক মনে হলো বজ্রাহত হলেন। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন, তা কি সম্ভব ? আমি বললাম, যদি সম্ভব না হয়, তাহলে দয়া করে এবার যান। আমাকে আমার কাজ করতে দিন। মাসুদ সাহেব আর কথা না বাড়িয়ে উঠে গেলেন। এই ঘটনার পর কোনো পেরেন্টস ডে’তে ওনার সাথে আর দেখা হয়েছে বলে পড়ে না। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পর ক্যাডেট কলেজকে লোকচোখে হেয় প্রতিপন্ন করার জন্য কিছু মতলববাজ লোক এক ধরনের প্রপাগান্ডা শুরু করে। তারা বলতে শুরু করে, নতুন সংবিধানে সেকুলারিজম অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। সুতরাং স্কুলের বাচ্চাদের আর ধর্মীয় শিক্ষা দেওয়ার প্রয়োজন নেই। ক্যাডেট কলেজসহ সকল স্কুল থেকে অবিলম্বে ধর্মীয় শিক্ষা উঠিয়ে দেওয়া হোক। সংবিধানে যা-ই লেখা থাক না কেনো, বাস্তব সত্য হচ্ছে, একজন মুসলমান আল্লাহ কর্তৃক নির্দেশিত এবং রাসুল পাক (সা:) কর্তৃক প্রদর্শিত পথে আল্লাহর ইবাদত করেন। নিজে নামাজ-রোজা করেন, সন্তানকে নামাজ-কালিমা শেখান। পিতামাতা বা কারো মৃত্যু হলে তাঁর জন্য জানাযা পড়েন, দোয়া করেন। শতকরা নব্বইভাগ মুসলমানের দেশে এসবই তো স্বাভাবিক। কীভাবে এসব কতর্ব্য পালন করতে হয়, অর্থাৎ দৈনন্দিন জীবনে কীভাবে ইসলাম চর্চা করতে হয় এবং তার অনুশাসন মেনে চলতে হয়, তা একজন মুসলমানের সন্তানকে শিশুকাল থেকে শিক্ষা দেওয়া অতীব জরুরি। কয়েক যুগ আগে নিজ বাড়িতে ধর্মীয় শিক্ষক রেখে, অথবা নিকটস্থ মকতবে পাঠিয়ে মুসলমানের শিশু সন্তানদের এসব শেখানো হতো। আজকাল নানা কারণে পিতামাতার পক্ষে এই দায়িত্ব পালন করা কঠিন হয়ে পড়েছে। তাই সংগত কারণে সেই দায়িত্ব রাষ্ট্র নিজে গ্রহণ করেছে। স্কুল পর্যায়ে তাই ধর্মীয় শিক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। শুধু ইসলাম নয়, অন্য ধর্মালম্বীদের সন্তানদেরও নিজনিজ ধর্ম শিক্ষার ব্যবস্থা স্কুলে রাখা হয়েছে। ক্যাডেট কলেজেও ইসলামসহ সকল ধর্ম শিক্ষা দেওয়া হয়ে থাকে। নৈতিক শিক্ষাকে সব সময় সাধারণ শিক্ষার অপরিহার্য অঙ্গ হিসেবে ধরা হয়। নৈতিক শিক্ষা ছাড়া শিক্ষা কখনও পূর্ণতা লাভ করে না। শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য একটি মানব শিশুকে আলোকিত মানুষে, পরিপূর্ণ মানুষরূপে গড়ে তোলা। যে মানুষের নৈতিক গুণাবলী নাই তাকে আর যা-ই বলা যায় না কেনো, আলোকিত বা পরিপূর্ণ মানুষ বলা যায় না। পৃথিবীর সকল সমাজে ধর্মীয় শিক্ষাকে, শিক্ষক থেকে ছাত্রের মধ্যে, নৈতিক শিক্ষা স্থানান্তরের সর্বোৎকৃষ্ট কনডুইট (Conduit) বলে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। যেসব লোক স্কুল থেকে ধর্মীয় শিক্ষার মূলোৎপাটন করতে চান তাঁরা নৈতিক শিক্ষা প্রদানের কনডুইটের বিকল্প হিসেবে স্কুল পর্যায়ে কী ব্যবহার করবেন, তা কিন্তু বলেন না। ধর্মীয় শিক্ষার নৈতিক এবং আধ্যাত্মিক গুরুত্ব ছাড়াও সামাজিক গুরুত্ব অপরিসীম। ধরা যাক, আমাদের দেশে মুসলমান বলে পরিচিত একজন লোক কোনো প্রতিষ্ঠানের নেতৃস্থানীয় পদে আছেন। তিনি হতে পারেন বেসামরিক বা সামরিক সার্ভিসের অফিসার, অথবা কোনো ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের একজন বড়কর্তা। তাঁর প্রতিষ্ঠানের কেউ একজন মারা গেলো। কর্তাব্যাক্তিটি এই বলে জানাযায় যোগ দিলেন না যে, তিনি জানাযার নামায পড়তে জানেন না। তা হলে ঐ প্রতিষ্ঠানের লোকেরা কি তাঁকে মনেপ্রাণে নেতা হিসাবে মেনে নিতে পারবেন ? নিশ্চয়ই না। মাসুদ সাহেবের কথা শোনার পর থেকে অনেকদিন বিষয়টি নিয়ে ভেবেছি। বন্ধুবান্ধব ও সহকর্মীদের সাথে আলোচনা করেছি। আসলে ইংরেজি সেকুলারিজম শব্দটির অর্থ কি ? ধর্মনিরপেক্ষতা না ধর্মহীনতা ? যদি ধর্মহীনতা হয়, তাহলে অর্থ খুব পরিষ্কার। সেকুলার সমাজে বা রাষ্ট্রে ধর্মের কোনো স্থান নেই। সহজ কথা। এ নিয়ে অতিরিক্ত আলোচনার প্রয়োজন নেই। কিন্তু যদি অর্থ হয় ধর্মনিরপেক্ষতা, তা হলে বিষয়টি অবশ্যই বিভ্রান্তির সৃষ্টি করে। ধরা যাক, আমাকে বলা হলো: ইসলামধর্ম, সনাতনধর্ম, খৃষ্টধর্ম, বৌদ্ধধর্ম, এসবের মধ্য থেকে যেকোনো একটি ধর্ম পসন্দ করে নেও। বলা বাহুল্য, একজন মুসলমান হিসেবে ইসলামই হবে আমার শেষ এবং একমাত্র চয়েস। একইভাবে একজন হিন্দু, খৃষ্টান বা বৌদ্ধ নিজনিজ ধর্মকে বেছে নিবেন। এখানে তো কারো পক্ষে নিরপেক্ষ থাকার সুযোগ নেই। তাহলে কথাটা দাড়ালো, সেকুলারিজমের অর্থ ধর্মনিরপেক্ষতা করা যায় না। আজকাল কেউ কেউ সেকুলারিজমের অর্থ অসাম্প্রদায়িকতা বলে চালাবার চেষ্টা করছেন। আমি মনে করি, সেটাও ঠিক নয়। ধর্ম আর সম্প্রদায় এক কথা নয়। একই ধর্মের মধ্যে একাধিক সম্প্রদায় বিরাজ করে। পশ্চিমা বিশ্বে, এমন কি আমাদের পাশের দেশ ভারতে, সেকুলারিজম বলতে সকল ধর্মের সমান মর্যাদা ও গুরুত্বকে বুঝানো হয়। সঠিক অর্থ প্রকাশ করা জন্য এর বাংলা প্রতিশব্দ হিসেবে ‘ পরধর্মসহিষ্ঞুতা’ বলা যেতে পারে। আশা করি, যাঁরা বাংলাভাষার শব্দ বা ওয়ার্ডের উৎস এবং অর্থ নিয়ে গবেষণা করেন ( Etymologist) তাঁরা যদি একটি যুৎসই প্রতিশব্দ চালু করতে পারেন তাহলে সেকুলারিজমের অর্থ নিয়ে সকল বিভ্রান্তি দূর হবে। আজকের পর্ব শেষ করার পূর্বে আমাদের দেশের সেকুলারিজমের অন্ধ ভক্তদের উদ্দেশ্যে কয়েকটি কথা নিবেদন করতে চাই। ১৯৭৬ সনের ২২ সেপ্টেম্বর তারিখে আমি, আরও দু’জন সহকর্মীর সাথে, প্রথম চীনদেশে যাই। ১৯৭১ সনে দেশ স্বাধীন হবার আগে ইসলামাবাদে অবস্থিত ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব মডার্ন ল্যাঙ্গুয়েজেজ নামক প্রতিষ্ঠানে সরকারি ব্যবস্থায় দেড় বছর চীনা ভাষা পড়াশুনা করি। যুদ্ধ শুরু হবার কারণে পাকিস্তানিরা আমাদের তিনজন বাংগালিকে ফাইনাল পরীক্ষা দিতে না দিয়ে প্রথমে বিভিন্ন ইউনিটে, পরে বন্দিশিবিরে পাঠিয়ে দেয়। চীন কর্তৃক বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার পরপরই বাংলাদেশ আর্মি আমাদের তিনজনকে চীনা বৃত্তির অধীনে সে দেশে চীনা ভাষার কোর্সটি শেষ করে ডিগ্রি নেবার জন্য পাঠিয়ে দেয়। মূল কোর্স তিন বছরের হলেও পূর্ববর্তী পাঠকাল বিবেচনা করে দশ মাসের একটি সেসনের পর আমাদের তিনজনকে চীনের বিশ্ববিদ্যালয়টি ফাইনাল পরীক্ষায় অংশ নেবার অনুমতি দেয়। আগের থেকে চীনা ভাষায় অনেকটা দক্ষতা থাকার কারণে সেখানে পৌছে, ইন্টারপ্রেটরের মাধ্যমে নয়, আমরা নিজেদের চোখ-কান দিয়ে চীনা সমাজ এবং রাষ্ট্রকে দেখতে পেরছি। সর্বপ্রথম যে বিষয়টা আমাদের মনে গভীর রেখাপাত করলো, তা হলো নিজেরা কট্টর কম্যুনিস্ট হওয়া সত্বেও অন্যের ধর্মের প্রতি তাদের শ্রদ্ধাবোধ। আমাদের ক্যাফেটেরিয়ায় মুসলমান ছাত্রদের জন্য আলাদা ডাইনিং হল ছিলো। যেখানে মুসলমান শেফ দিয়ে রান্না করা একমাত্র হালাল খাবার পরিবেশন করা হতো। তখন এবং পরবর্তীকালে চীনে থাকার সময় চীনের বিভিন্ন অঞ্চলে অনেক শহর এবং গ্রাম ভিজিট করেছি। সবখানে একই রকম অবস্থা দেখেছি। মসজিদসহ সকল ধর্মের উপাসনালয় রাষ্ট্রের টাকায় চালানো হচ্ছে। সরকারি কোষাগারের অর্থ দিয়ে কুর’আন শরীফ ছাপিয়ে মুসলমানদের মধ্যে বিতরণ করা হচ্ছে, মসজিদের ইমামদের বেতন দেওয়া হচ্ছে। এমনকি সরকারি টাকায় প্রতি বছর মুসলমানদের হজ্জ করতে পাঠানো হচ্ছে। ইসলাম সম্বন্ধে পড়াশুনা করার জন্য ইমামদের মিশরের আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠানো হচ্ছে। ছোটোবড় সকল শহরে হালাল গোস্তের দোকান রয়েছে। প্রায় সব রেস্টুরেন্টে হালাল খাবার পরিবেশনের ব্যবস্থা রয়েছে, যা রেস্টুরেন্টের বাইরে সাইনবোর্ডে লেখা রয়েছে। একবার বিশেষ ট্রেনে করে আমাদের কোথাও নিয়ে যাওয়া হচ্ছিলো। পথে খাবারের জন্য একটি স্টেশনে ট্রেন থেমেছিলো। আমরা কিছু মুসলমান যাত্রী খাবার শেষ হলে ওয়াক্তিয়া নামাজের জন্য প্ল্যাটফর্মের উপর দাঁড়ালাম। চীনারা বিন্দুমাত্র বিরক্তি প্রকাশ না করে নামাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করে পরে ট্রেন ছাড়লো। আরেকবার, তখন আমি আমাদের পেইচিং দূতাবাসে চাকুরি করি, রমজান মাসে পেইচিং থেকে অনেক দূরে এক শহরে কাজে গিয়েছি। সেখানে পৌছার পর আমার হোস্টকে জানালাম, আমি রোজা রাখছি, শেষরাতে সেহরির ব্যবস্থা করা যাবে কিনা। হোস্ট, পিএলএ’র একজন কর্নেল, হেসে দিয়ে বললেন, আমি তোমাদের রোজা সম্বন্ধে জানি। আমার ইউনিটে কিছু মুসলিম সোলজার আছে যারা নিয়মিত রোজা রাখে। তুমি এ নিয়ে ভেবো না। ভোর রাতে দরজায় নক্ শুনে জেগে দেখলাম মেসের দু’জন কর্মীকে সাথে নিয়ে চীনা কর্নেল সাহেব ইউনিফর্ম পরিহিত অবস্থায় নিজে সেহরির খাবার হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। এ দৃশ্য দেখে বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে গেলাম। কর্নেল সাহেব অনুমতি নিয়ে ঘরে এসে টেবিলে খাবার সাজিয়ে রেখে চলে গেলেন। যাবার সময় বলে গেলেন, সকাল বেলা প্লেট-পেয়ালা নিয়ে যাবেন। দু’তিন দিন সেখানে ছিলাম। প্রতিদিন সেহরি এবং ইফতারির সময় একইভাবে আমাকে খাবার সার্ভ করা হয়েছিলো। কম্যুনিস্ট দেশের মানুষের অপরের ধর্মের প্রতি সম্মান দেখার পর আমার দেশে মুসলমানের ঘরে জন্ম নেয়া সেকুলারিজমের ফেরিওয়ালাদের কথা শুনে ভাবি, এরা আসলে কী চায় ?

ক্যাডেট কলেজের টুকরো স্মৃতি: ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজ: পর্ব ৩: মায়ের মন মানে না মানা

সন্তানের প্রতি বাংগালি মায়ের প্রবাদতুল্য বাৎসল্য সম্পর্কে আমরা সবাই অবগত আছি। এজন্য আমরা বাংগালিরা নিজেদেরকে ভাগ্যবান মনে করি। কন্তু কখনও যে এই বাৎসল্য অশান্তির কারণ হতে পারে তেমন অভিজ্ঞতা ক’জনের হয় ? ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজে প্রিন্সিপালের দায়িত্ব পালনকালে আমাকে এমন একটি অশান্তির মোকাবিলা করতে গিয়ে বেশ বেগ পেতে হয়েছিলো। এখানে বলে রাখা ভালো, ছোটোবেলায় নিজের মাকে হারিয়েছিলাম। তাই মায়েদের ব্যাপারে সবসময় খুব ষ্পর্শকাতর ছিলাম, এখনও আছি। আমি যখন দেখি একজন মা তাঁর সন্তানকে কোলে নিয়ে চুমু খাচ্ছেন, সন্তানের মাথায় হাত রেখে দোয়া করছেন, অথবা নিজহাতে সন্তানের মুখে খাবার তুলে দিচ্ছেন, তখন আমার মনে হয় পৃথিবীর একটি সুন্দরতম দৃশ্য আল্লাহ আমাকে দেখাচ্ছেন। আমার কোনো কাজে বা কথায় কোনো মা কষ্ট পান তা আমি কখনও চাই না। তারপরও ক্যাডেটদের বৃহত্তর স্বার্থে আমাকে এমন একটা সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিলো যাতে তাদের মায়েরা আহত বোধ করেছিলেন। পেরেন্টস ভিজিটিং ডে’তে আগত সকল মা তাঁর ছেলের জন্য একাধিক টিফিন ক্যারিয়ার এবং ব্যাগ ভরে খাবার নিয়ে আসতেন। রান্না করা নানাবিধ খাবার, পিঠাপায়েস থেকে শুরু করে যাবতীয় মৌসুমী ফল, কোমল পানীয় কোনোকিছু বাদ যেতো না। বিশেষ করে নিচের ক্লাসের ছেলেদের মায়েদের মধ্যে প্রবণতাটা লক্ষ্যণীয়ভাবে বেশি ছিলো। মা ছেলেকে নিজের পাশে বসিয়ে ‘ডাকফিডিং’ করতেন। যার ফলে পরদিন সকালে কলেজের হাসপাতালে ডায়রিয়াজনিত কারণে সিক রিপোর্টের সংখ্যা অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যেতো। তবে সবচেয়ে খারাপ পরিণতি ছিলো বিষয়টির ইমশেনাল দিক। যাদের মায়েরা আসতেন সেসব ক্যাডেট সবার সামনে প্রকাশ্যে হাপুসহুপুস করে খেলেও, যাদের মায়েরা আসতে পারতেন না তাদের চোখেমুখে যে বঞ্চনার করুণভাব ফুঠে উঠতো তা আমাকে ব্যাথিত করে তুলতো। এমন অনেক ছেলে ছিলো যাদের মায়েরা দূরত্ব অথবা অসুস্থতার কারণে কখনই আসতে পারতেন না। এদের অবস্থা চিন্তা করে আমার নিজের মনও খারাপ হয়ে যেতো। একদিন কৌতহল বশত: ছেলেকে খাওয়াচ্ছেন এমন একজন মায়ের পাশে গিয়ে বসে আলাপ শুরু করলাম। দেখলাম তিনি পরম আদরের সাথে আস্ত মুরগির রোস্ট ভেঙ্গে ছেলের মুখে তুলে দিচ্ছেন। জানতে পারলাম, ছেলেটির বাবা খুলনায় স্বল্প বেতনে একটি চাকুরি করেন। তাঁদের আরও তিনটি ছেলেমেয়ে বাড়িতে আছে। জিজ্ঞাসা করলাম, বাসায় সপ্তাহে ক’বার মুরগির রোস্ট রান্না করেন ? জবাবে তিনি জানালেন, সপ্তাহ তো দূরের কথা। মাসেও একবার করেন না। সামর্থ্যে কুলায় না। মেহমান-অতিথি এলে কালেভদ্রে মুরগির রোস্ট রান্না করেন। জিজ্ঞাসা করলাম, আপনি কী জানেন, আপনার এই ছেলে ক্যাডেট কলেজে সপ্তাহে কতবার মুরগির গোস্ত খায় ? মা কিছুক্ষণ নীরবে মাথা নিচু করে থেকে বললেন, কী করবো স্যার। মনটা যে মানে না। প্রত্যেকবার পেরেন্টস ডে’তে আসার সময় টাকা ধার করে মুরগি কিনে রোস্ট বানিয়ে আনি। আমি তাঁর ক্যাডেট ছেলেকে দেখিয়ে বললাম, এই ছেলে সপ্তাহে চার বেলা মুরগির গোস্ত, চার বেলা গরু বা খাসির গোস্ত, চার বেলা বড় মাছ এবং দুই বেলা শাকশব্জি দিয়ে ভাত বা পোলাও খায়। এছাড়া নিয়মিত ডিম, দুধ, ফলমূলসহ অনেক রকম পুষ্টিকর খাবার খেয়ে থাকে। আপনি তো আপনার চারটি সন্তানের সকলরই মা। বাড়িতে আপনার সাথে যে তিনজন থাকে তাদেরকে মাসে একবার মুরগি খাওয়াতে পারেন না। অথচ, যে ছেলে ক্যাডেট কলেজে থেকে সপ্তাহে চারদিন মুরগিসহ আরও অনেক পুষ্টিকর খাবার খাচ্ছে তার জন্য ধার করা টাকা দিয়ে মুরগি রান্না করে আনছেন, আপনারই অন্য বাচ্চাদের বঞ্চিত করে। মা হয়ে সন্তানদের মধ্যে এ ধরনের পক্ষপাতিত্ব করা কি ঠিক কাজ হলো ? আমি মায়ের চোখে পানি দেখলাম। তিনি বললেন, আজই শেষ। ভবিষ্যতে এমন আর হবে না। আমি মায়ের চোখের পানিতে সমস্যার সমাধান খুঁজে পেলাম। সহকর্মীদের সাথে আলাপ করে পেরেন্টস ভিজিটিং ডে’তে ক্যাডেটদের জন্য সকল প্রকার খাবার এবং পানীয় আনা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ করা হলো। এবার অনেক মা ভীষণ ক্ষেপে গেলেন। তাঁদের বক্তব্য, আমরা নিজেদের টাকা দিয়ে নিজেদের ছেলেদের জন্য খাবার আনি। তাতে প্রিন্সিপাল সাহেবের আপত্তি করার কী আছে ? একদিন চারপাঁচজন মা মিলে একটি ডেলিগেশন নিয়ে আমার অফিসে এলেন। আমার সিদ্ধান্ত বাতিল করার জন্য জোর অনুরোধ জানালেন। আমি আমার পক্ষ থেকে বিষয়টি বুঝিয়ে বললাম। উপরে বর্ণিত মায়ের ছেলেকে মুরগির রোস্ট খাওয়ানের ঘটনা বললাম। সবশেষে বললাম, তবে হ্যাঁ, আমার তিন’শ ছেলের সবার জন্য যদি খাবার আনতে পারেন তা হলে মোস্ট ওয়েলকাম। আমাকে আগে থাকতে জানাবেন। আমি আনন্দের সাথে পরিবেশনের সব ব্যবস্থা করে দেবো। এরপর এমন অনুরোধ নিয়ে কেউ আর অমার কাছে আসেননি।

ক্যাডেট কলেজের টুকরো স্মৃতি: ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজ: পর্ব ২: প্রিন্সিপাল তো নয় যেনো আই জি প্রিজন !

ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজে যোগদান করার পরপরই নজর দিলাম ক্যাডেটদেরকে বাইরের সকল প্রকার অশুভ প্রভাব ও হস্তক্ষেপ থেকে সুরক্ষা প্রদানের দিকে। কারণ, আমার মনে হয়েছে, ভিতরে আমি যতো ভালো কাজই করি না কেনো, বাইরের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে তাকে রক্ষা না করতে পারলে সে ভালো কাজ সফল হবে না। মাসে একটি নির্দিষ্ট দিনে পেরেন্টস ভিজিটিং ডে ছিলো। বিধি অনুযায়ী ঐদিন শুধুমাত্র ক্যাডেটদের পিতামাতা এবং অনুমোদিত স্থানীয় আভিভাবকরা ক্যাডেটদের সাথে দেখা করতে আসতে পারতেন। ক্যাম্পাসের অভ্যন্তরে একটা নির্দিষ্ট স্থানে একটা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য দেখাসাক্ষাতের ব্যবস্থা ছিলো। লক্ষ্য করলাম, ঐদিন কলেজের মেইন গেইট দিয়ে জলের স্রোতের মতো লোকজন ঢুকতো। কে কার সাথে দেখা করলো তার কোনো হিসাব ছিলো না। খবর নিয়ে জানলাম, ক্যাডেটদের পিতামাতা ছাড়াও, আত্মীয় নয় এমন লোকজন আত্মীয় পরিচয় দিয়ে প্রবেশ করতো। যার মধ্যে উগ্র রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী, ধর্মীয় গুরু, এলাকার মাস্তান, সিনিয়র ক্লাসের ক্যাডেটদের গার্লফ্রেন্ডসহ আরো অনেকে ছিলো। এ ছাড়া পেরেন্টস ভিজিটিং ডে নয় এমন দিনেও কিছুকিছু লোক, বিশেষ করে কিছু উচ্চপদস্থ সরকারি অফিসার এবং তাঁদের পত্নীগণ, ভিতরে এসে ক্যাডেটদের সাথে দেখা করতো। একদিন ক্লাস টুয়েলভের একটি ছেলের বাবা আমাকে ঢাকা থেকে টেলিফোন করলেন। ধরা যাক ছেলেটির নাম বাবর। অত্যন্ত কাতর কন্ঠে আমাকে বাবরের বাবা যা বললেন তার সারাংশ হলো: তিনি একটি সরকারি প্রতিষ্ঠানের মাঝারি পর্যায়ের অফিসার। আগে যশোর শহরে পোস্টেড ছিলেন তখন পেরন্টেস ভিজিটিং ডে’তে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে এসে বাবরের সাথে দেখা করতেন। ঢাকায় থাকার কারণে গত ছ’মাস যাবত তিনি বা পরিবারের অন্য কেউ ঐদিনগুলোতে বাবরকে দেখতে আসতে পারছেন না। এই সুযোগ নিয়ে তাঁদের যশোরের এক প্রাক্তন পড়শী মহিলা বাবরের খালার পরিচয় দিয়ে বাবরকে দেখতে আসছে। আমি সরল মনে জানতে চাইলাম তাতে দোষের কী হলো। জবাবে ভদ্রলোক যা বললেন তাতে আমার দিব্যদৃষ্টি খুলে গেলো ! তথাকথিত খালার একটি ১৫/১৬ বছর বয়সী মেয়ে আছে যে ক্লাস টেনে পড়ে। মহিলা চাচ্ছে বাবর যাতে তার মেয়ের সাথে প্রেম করতে থাকে। বাবর ক্যাডেট কলেজের ছাত্র, পড়াশুনাসহ সবদিক দিয়ে ভালো। জামাই হিসেবে খুব ভালো হবে। তাই এখন থেকে ‘হুক’ করে রাখতে চাচ্ছে। বাবর অনেকটা পটে গেছে বলে বাবরের মা-বাবার ধারণা। কলেজে লম্বা ছুটি হলে বাবর এখন আর সরাসরি ঢাকা চলে যায় না। যশোরে ‘খালা’র বাসায় দু’য়েক দিন বেড়িয়ে পরে ঢাকা যায়। বিষয়টি বাবরের বাবা এবং মা কেউই মেনে নিতে পারছেন না। কাঁদোকাঁদো হয়ে তিনি বললেন, যেভাবেই হোক বাবরের সাথে ঐ ‘খালা’ এবং তার মেয়ের দেখাসাক্ষাত বন্ধ করতেই হবে। কলেজে ভেকেশন শুরু হলে বাবরকে সরাসরি ঢাকাতে আসতে হবে। যশোরে ‘খালা’র বাড়ি যাওয়া চলবে না। আমি মনেমনে ভাবলাম, আল্লাহ জানেন, এমন আর কতো বাবর আছে আমার কলেজে ! আমি বাবরের বাবাকে এই বলে আস্বস্ত করলাম, আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন। অবশ্যই কিছু একটা করবো। মাসিক হা্‌উস ইন্সপেকশনের সময় কোনোকোনো ক্যাডেটের কাবার্ড থেকে উগ্র রাজনৈতিক দলের প্রচারমূলক পুস্তিকা, লিফলেট পাওয়া গেলো। শুক্রবার জুমার নামাজে ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দলের সদস্যরা নামাজ পড়ার অছিলায় কলেজ মসজিদে এসে ছেলেদের সাথে রাজনৈতিক আলোচনা করতো। কিছু উগ্র বামপন্থী দলের কর্মীরাও সুযোগ বুঝে কলেজে ঢুকে একই কাজ করছে বলে জানতে পারললাম। টি-ব্রেকের সময় আমি স্টাফ রুমে গিয়ে ফ্যাকাল্টি মেম্বারদের সাথে একত্রে চা-নাস্তা খেতাম । এটা আমার প্রতিদিনের অভ্যাস ছিলো। অভ্যাসটি শিখেছিলাম আর্মি থেকে। ইউনিট পর্যায়ে আর্মিতে এটির চর্চা খুব জনপ্রিয়। অফিসে বা বাইরে খুব জরুরি কিছু না থাকলে এটা মিস করতাম না। চা-নাস্তা খেতেখেতে হাল্কা পরিবেশে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের অবতারণা করে সকলের মতামত ও সুপারিশ জেনে নিতাম। মতানৈক্য হলে বেশ বিতর্ক জমে উঠতো। টি-ব্রেকের নির্ধারিত সময় শেষ হয়ে গেলে যাঁদের ক্লাস বা কাজ থাকতো তাঁরা উঠে চলে যেতেন। আমি অন্যদের নিয়ে আলাপ করতাম। ফর্মাল স্টাফ মিটিংয়ে অনেকে, বিশেষ করে জুনিয়র সহকর্মীরা, সহজে মুখ খুলতে চান না। কিন্তু ইনফর্মাল চায়ের টেবিলে হাল্কা পরিবেশের কারণে সবাই মনের কথা বলতে উৎসাহিত বোধ করতেন। অনেকটা আড্ডার মতো পরিবেশ হতো, যেখানে আমি বলতাম খুব কম, শুনতাম বেশি। নেপথ্যে থেকে আলোচনার বিষয় ও গতি নিয়ন্ত্রণ করতাম। প্রায় সকল ক্ষেত্রে আলোচনায় গৃহীত সিদ্ধান্ত আমার নিজস্ব সিদ্ধান্ত থেকে ভিন্নতর হতো না। এ ধরনের আলোচনায় আরও একটা সুবিধা ছিলো। আলোচনার মাধ্যমে যে সিদ্ধান্ত বেরিয়ে আসতো তা, প্রিন্সিপালের সিদ্ধান্ত হিসেবে অফিস অর্ডারের মাধ্যমে প্রকাশিত হলেও, উপস্থিত সকলে যৌথ সিদ্ধান্ত হিসেবে মেনে নিয়ে তা আন্তরিকভাবে পালন করতেন। সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে সবাই নিজেকে অংশীদার মনে করতেন। প্রিন্সিপালকে কমান্ডার বা বস হিসেবে না দেখে টীমলিডার হিসেবে দেখতেন। নির্দেশ প্রদান ও পালনের ক্ষেত্রে এই বিশেষ পদ্ধতিটি খুবই কার্যকর হয়েছিলো। ঐতিহ্যগতভাবে বাংলাদেশিরা এন্টি এস্টাবলিশমেন্ট। যার কারণে, শিক্ষিতরা বসের আদেশ মানার চাইতে টীমলিডারের আদেশ মানতে আধিকতর সাচ্ছ্যন্দ বোধ করেন বলে আমি মনে করি। যাহোক, পেরেন্টস ভিজিটিং ডে’তে সৃষ্ট এসব অরাজকতা দূর করার জন্য টি-রুমে আলোচনার ভিত্তিতে বেশ কিছু সিদ্ধান্ত নেয়া হলো। যা ক্যাডেটদেরকে সাপ্তাহিক সমাবেসে, এবং তাদের পিতামাতা/অভিভাবকদেরকে লিখিতভাবে জানিয়ে দেওয়া হলো। কলেজ গেইটে কড়াকড়ি আরোপ করা হলো। কলেজ চত্বরে ঢোকার সময় এবং বের হবার সময় সকল ভিজিটরক তার নাম, ঠিকানা, প্রবেশের সময় এবং কারণ, এবং বের হবার সময় লিপিবদ্ধ করার নিয়ম চালু করা হলো। শুক্রবার ক্যাডেট ও ক্যাম্পাসে বসবাসকারী ছাড়া অন্যদের কলেজ মসজিদে জুমার নামাজের জন্য আসা বন্ধ করা হলো। ক্যাডেটদের আবাসিক এলাকায় প্রবেশের পথে প্রয়োজনীয় চেকপোস্ট বসানো হলো। মসজিদে কর্মকর্তা-কর্মচারীর কোনো বহিরাগত মেহমান আসতে চাইলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীকে বলা হলো মেহমানকে নিজে সঙ্গে করে আনতে। সকল পিতামাতা ও অনুমোদিত অভিভাবককে কলেজের অফিস থেকে ছবিসহ পরিচয়পত্র প্রদান করা হলো। পেরেন্টস ভিজিটিং ডে’তে পরিচয়পত্র দেখিয়ে প্রবেশ করা বাধ্যতামূলক করা হলো। কোনো পিতামাতা বা অনুমোদিত অবিভাবক পরিচয়পত্র আনতে ভুলে গেলে সংশ্লিষ্ট ক্যাডেটের হাউস মাস্টার/টিউটর গেইটে এসে পরিচয় জেনে নিয়ে তাঁকে ভিতরে আসতে দিতেন। এতো সব করার পরও বাবরের বাবার সমস্যা পুরোপুরি সমাধান হলো না। বাবরের যশোর যাওয়া বন্ধ করতে হবে। ঝিনাইদহ বাস মালিক সমিতির কর্মকর্তাদেরকে চায়ের দাওয়াত দিয়ে আমার অফিসে ডেকে এনে সহযোগিতা চাইলাম। সিদ্ধান্ত হলো, ভেকেশন শুরুর কয়েকদিন আগে জানালে তাঁরা ঢাকা, খুলনা, কুষ্টিয়া, যশোর, মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গা এসব শহরের জন্য রিজার্ভড বাসের ব্যবস্থা করে দিবেন। এসব বাস গন্তব্য ছাড়া রাস্তায় কোথাও থামবে না। কোনো ক্যাডেট নির্ধারিত গন্তব্য ছাড়া অন্য কোথাও যেতে চাইলে আগেভাগে অভিভাবকের কাছ থেকে লিখিত অনুরোধ আনতে হবে। এরপর থেকে বাবরের পক্ষে আর যশোরে ‘খালা’র বাড়ি যাওয়া আমার জানামতে সম্ভব হয়নি। তবে শেষ পর্যন্ত সেই ‘খালা’র মেয়েটির সাথে বাবরের প্রেম কতদূর এগিয়েছিলো, তা আমি জানতে পারিনি ! ইতোমধ্যে একটি ঘটনা ঘটলো যা আমার জন্য কষ্টদায়ক হলেও আমার কাজ কিছুটা হলেও সহজ করে দিলো। একদিন দুপুর বেলা আমার বড় মামা গ্রামের বাড়ি থেকে কলেজে এলেন আমার পরিবারের সবার সাথে দেখা করতে। ছোটো বেলায় আমার মা মারা যাবার পর থেকে, যেখানেই থাকতাম না কেনো, উনি প্রায়ই এমন আসতেন। বিকেল বেলা মামা ইচ্ছে প্রকাশ করলেন উনার গ্রামের একটি ক্যাডেটকে উনি দেখবেন। ওর বাবাকে উনি কথা দিয়ে এসেছেন। আমি পড়লাম মহা বিপদে। কলেজের আইন ভঙ্গ করে আমার পক্ষে উনার ইচ্ছা পূরণ করা কিছুতেই সম্ভব নয়। অন্যদিকে জীবনে কখনও মামার কথা অমান্য করিনি। তখনই সরাসরি জবাব দিলে, আমি জানি, মামা আমার বাসা ছেড়ে রাগ করে চলে যাবেন। কিছুটা সময় নেবার জন্য বললাম, এই তো এলেন। রেস্ট করেন। দেখি কাল সকালে কী করা যায়। পরদিন সকাল বেলা নাস্তার টেবিলে মামা পুনরায় অনুরোধ জানালেন ছেলেটিকে দেখার জন্য। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ক্যাডেটদের সাথে বহিরাগতদের দেখাসাক্ষাতের নিয়মকানুন সম্পর্কে ছেলেটির বাবা আপনাকে কিছু বলেননি ? তিনি জানালেন, না। আমি তখন অনেক কষ্টে তাকে বুঝিয়ে বললাম, কেনো কলেজের আইন অনুযায়ী তাঁর সাথে ছেলেটিকে দেখা করতে দেওয়া যায় না। তিনি বললেন, প্রিন্সিপাল আনুমতি দিলেও দেখা করা যাবে না ? আমি বললাম, না। খুব জরুরি কারণ ছাড়া প্রিন্সিপালের অনুমতি দেওয়ার এখতিয়ার নেই। আপনার সাথে ঐ ছেলেটির দেখা করার কোনো জরুরি প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করি না। আমি খোঁজ নিয়েছি। ছেলেটি ভালো আছে। বাড়ি ফিরে ওর বাবাকে জানিয়ে দিবেন। যদি ওর বাবা প্রশ্ন করেন কেনো দেখা হলো না, তবে তাঁকে কি জবাব দেবো, মামা জানতে চাইলেন। বলবেন, ভাগ্নে খুব আদর যত্ন ও সম্মান করেছে। তবে প্রিন্সিপাল বেটা খুব নিষ্ঠুর ! কোনোমতেই আপনার ছেলের সাথে দেখা করার অনুমতি দিলো না। আমার একথা শুনে মনে হলো মামা নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। মুখ অত্যন্ত বেজার করে মামা উঠে গেলেন। কোনো রকমে চা-নাস্তা খেয়ে চলে গেলেন। তারপর রাগ করে প্রায় তিনচার মাস আমার বাসায় আসেননি। ঘটনাটি কেমন করে যেনো সারা কলেজে ছড়িয়ে গেলো। হয়তো প্রিন্সিপালের বাসার স্টাফদের কাছ থেকে জানতে পেরে থাকবে। এখানে একটা কথা বলে রাখি। ক্যাডেট কলেজের প্রিন্সিপালের ব্যক্তিগত জীবনে প্রাইভেসি বলতে কিছু নেই। সারাক্ষণ তাঁকে এবং তাঁর পরিবারের সদস্যদেরকে প্রায় ১৫০ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীর তীক্ষ্ন নজরদারিতে থাকতে হয়। ভালো বা মন্দ উল্লেখযোগ্য কিছু ঘটলে তা সাথেসাথে সবার কানে পৌঁছে যায়। ক্যাডেটরাও জেনে ফেলে। এজন্য প্রিন্সিপালকে, এমনকি তাঁর পরিবারের সদস্যদেরকে, প্রতিটি কাজে এবং কথায় অনগার্ড থাকা খুবই জরুরি। কিছুকিছু পিতামাতা/অভিভাবক, বিশেষ করে মায়েরা, উপরে উক্ত ব্যবস্থা নেবার কারণে প্রথম দিকে প্রিন্সিপালের উপর খুব রাগ করেছিলেন। তাঁদের নানারকম মন্তব্য, যা মোটেও সুখকর ছিলো না, ঘুরেফিরে আমার কানে আসতে লাগলো। তাঁরা কেউকেউ এমন মন্তব্যও করলেন, প্রিন্সিপাল তো নয় যেনো আই জি প্রিজন এসেছেন। তবে অনেকে ব্যাপারটি প্রশংসার চোখেও দেখেছিলেন। কিছুদিন পরে অবশ্য সবাই নিয়মটি মন থেকে মেনে নিয়েছিলেন।

ক্যাডেট কলেজের টুকরো স্মৃতি: ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজ: পর্ব ১: প্রিন্সিপাল পদে যোগদান

১৯৭৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের ৮ তারিখে ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজের প্রিন্সিপাল পদে যোগদান করি। তখন আমার বয়স কতোই বা হবে। সার্টিফিকেট অনুযায়ী বত্রিশ বছর কয়েক মাস। বাস্তবে তেত্রিশ বছর। প্রসঙ্গত: বর্তমান প্রজন্মের তরুণ-তরুণীদের জন্য একটা কথা বলা প্রয়োজন মনে করছি। এখন থেকে ষাট-সত্তর বছর আগে, আমাদের ছোটোবেলায়, এখনকার মতো জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধনের কোনো রেওয়াজ এবং ব্যবস্থা ছিলো না। প্রায় সকলের দু’টো করে জন্মদিন থাকতো। একটা ছিলো আসল জন্মদিন। আর একটা অফিসিয়াল জন্মদিন। ক্লাস নাইনে উঠার পর সকলকে দু’বছর পর মেট্রিকুলেশন পরীক্ষার জন্য শিক্ষা বোর্ডে নাম রেজিস্ট্রি করতে হতো। কাজটি নিজনিজ স্কুলের মাধ্যমে করতে হতো। তখন, মাস্টার্স পাশ করে সরকারি চাকুরিতে ঢোকার সর্বনিম্ন বয়স বিবেচনায় রেখে, স্কুলের হেড স্যার একটা জন্মদিন ঠিক করে লিখে দিতেন। যাতে রিটায়ার করার আগ পর্যন্ত সর্বোচ্চ বেশিদিন চাকুরি করা সম্ভব হয়। আমার বেলায়ও তেমনটি হয়েছিলো। এ নিয়ে একবার জেদ্দা এয়ারপোর্টে বেশ বিব্রত হয়েছিলাম। আমার পাসপোর্ট দেখতেদেখতে ইমিগ্রেশন অফিসার হঠাৎ আমাকে প্রশ্ন করলেন, আচ্ছা বলোতো তোমার দেশের প্রায় সব লোকের জন্মদিন পহেলা জানুয়ারি হয় কেনো ? সৌদি ইমিগ্রেশন অফিরারটি হঠাৎ আমাকে কেনো এমন প্রশ্ন করলেন তা বুঝতে পারলাম না। আমার পাসপোর্টে অবশ্য আমার সরকারি জন্মদিন পহেলা জানুয়ারি ছিলো না। উপরে বর্ণিত আমার জবাব শুনে ভদ্রলোক অবাকই হয়েছিলেন বৈ কি ! যাহোক, আগের কথায় আসি। বলা হয়েছিলো এতো কম বয়সে, অর্থাৎ চল্লিশের চাইতে কম বয়সে,উপমহাদেশে আমার আগে আর কেউ পাবলিক স্কুল বা ক্যাডেট কলেজে প্রিন্সিপাল পদে নিয়োগ পাননি। আজকে ছত্রিশ বছর পর, ২০১৪ সালে, যখন ফিরে তাকাই তখন মনে হয়, আমার মতো এতো অল্প বয়সের একজনকে এমন গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ দেবার পেছনে দু’টি কারণ ছিলো। এক, ১৯৭১ সনের পূর্বে সশস্ত্রবাহিনীর শিক্ষা বিভাগ থেকে পশ্চিম পাকিস্তানি অফিসাররা চাকুরিতে সিনিয়র হবার কারণে প্রিন্সিপাল পদে নিয়োগ পেতেন। তখন পর্যন্ত মাত্র একজন বাংগালি অফিসার এই পদে নিয়োগ পেয়েছিলেন। তাঁর নাম শহীদ লে: কর্নেল এম এম (মোহাম্মদ মঞ্জুরুর) রহমান এইসি (আর্মি এডুকেশন কোর), যিনি কর্নেল রহমান নামে অধিক পরিচিত ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় নিজ কর্মস্থল ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজে কনের্ল রহমান পাকিস্তান আর্মির হাতে নিমর্মভাবে, একজন সত্যিকারের বীরের মত, শহীদ হন। দু:খের বিষয়, আমাদের আর্মি তথা দেশ আজ পর্যন্ত এই বীরের প্রতি যথাযথ সম্মান দেখাতে পারেনি। দুই, তখন দেশের প্রসিডেন্ট হিসেবে চীফ এক্সিকিউটিভ ছিলেন শহীদ জেনারেল জিয়াউর রহমান, বীর উত্তম। ডিফেন্স মিনিস্ট্রির দায়িত্বও তাঁর হাতে ছিলো। জে: জিয়া পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমিতে সরাসরি ইন্সট্রাক্টর হিসেবে আমাকে পড়িয়েছেন, ট্রেইনিং দিয়েছেন। ১৯৭৩ সালে আর্মি হেডকোর্য়াটার্সে বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমি (বি এম এ) প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে, প্রস্তুতিমূলক কাজগুলো দ্রুত সম্পন্ন করার জন্য, একটি সেল গঠন করা হয়েছিলো। অনেক কাজের মধ্যে যার প্রধান কাজ ছিলো বি এম এ’র জন্য টেবল অব অর্গানাইজেশন এন্ড ইকুইপমেন্ট (টি ও এন্ড ই) প্রনয়ণ করা। এই সেলে প্রথম যে চারজন অফিসারের কাজ করার গৌরব হয়েছিলো তার মধ্যে আমি একজন ছিলাম। জে: জিয়া আর্মির ডেপুটি চীফ অব স্টাফ হিসেবে সেলের কাজ তত্বাবধান করতেন। তখন আর একবার আমার সুযোগ হয়েছিলো জে: জিয়ার প্রত্যক্ষ সাহচর্যে আসার। পরে আরও একবার জে: জিয়ার ব্যক্তিগত তত্বাবধানে কাজ করার সৌভাগ্য আমার হয়েছিলো। ১৯৭৫ সালে মার্শাল ল’ জারি হবার পর রাস্ট্রের সকল গোয়েন্দা সংস্থার কাজকর্ম কেন্দ্রীয়ভাবে নিয়ন্ত্রণ ও সমন্বয় করার জন্য কোঅর্ডিনেশন এন্ড কন্ট্রোল সেল ফর ন্যাশনাল সিকিউরিটি নামে প্রেসিডেন্টের অধীনে একটি শীর্ষ প্রতিষ্ঠান স্থাপন করা হয়। সেখানে আর্মি থেকে প্রাথমিকভাবে যে চারজন অফিসারকে নিয়োগ দেওয়া হয় তার মধ্যে আমাকে রাখা হয়েছিলো। ব্যক্তিগতভাবে জে: জিয়া এই সেলের কাজ তত্বাবধান করতেন। বলতে গেলে এসব কারণে আমি সম্ভবত: ব্যক্তিগতভাবে জে: জিয়ার স্নেহভাজন এবং আস্থাভাজন হয়ে উঠেছিলাম। ১৯৭১ সালে দেশ পাকিস্তানি হানাদার মুক্ত হবার পর দেখা গেলো বাঁচিয়ে রাখতে হলে, অন্যান্য রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের মতো, ক্যাডেট কলেজগুলোরও পুনর্গঠন করা জরুরি। তখনকার ডেপুটি আর্মি চীফ জে: জিয়াকে ক্যাডেট কলেজগুলোর গভর্নিং বডির চেয়ারম্যান নিয়োগ করে তাঁকে এই দায়িত্ব অর্পণ করা হয়। জে: জিয়ার নির্দেশনায় প্রিন্সিপাল নিয়োগের জন্য একটি প্রক্রিয়া নির্ধারণ করা হয়। প্রক্রিয়া অনুযায়ী ক্যাডেট কলেজের প্রিন্সিপাল হবার যোগ্য এমন প্রার্থীদের নাম আর্মি, নেভী, এয়ার ফোর্স ও ক্যাডেট কলেজের সিভিলিয়ান শিক্ষকদের পক্ষ থেকে ডিফেন্স মিনিস্ট্রিতে পাঠানো হয়। সেবার তালিকাতে আমার নামও ছিলো। পরবর্তীকালে নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে জানতে পারি যে, নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ ক্যাডেট কলেজ কাউন্সিলের চেয়ারম্যন আমার ব্যাপারে আপত্তি জানিয়েছিলেন বয়স কম হবার কারণে। কিন্তু জে: জিয়া এই বলে সে আপত্তি নাকোচ করে দিয়েছিলেন, Don’t worry. I know this boy. He will not let you down. যাঁদের জে: জিয়ার সাথে কাজ করার অভিজ্ঞতা আছে তাঁরা জানেন, জে: জিয়ার কথা এবং কাজের স্টাইলই এমন ছিলো। ১৯৬৩ সনে ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৬৪ সন থেকে রেগুলার ক্যাডেট ভর্তি এবং ক্লাস শুরু হয়। তৎকালীন পাকিস্তান আর্মি এডুকেশন কোরের অত্যন্ত দক্ষ, মেধাবী এবং চৌকশ অফিসার লে: কর্নেল এন ডি হাসানকে প্রতিষ্ঠাতা প্রিন্সিপাল হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সদ্য পাশ করা একঝাঁক অত্যন্ত মেধাবী ও ডেডিকেটেড যুবককে অতি যত্ন সহকারে নির্বাচন করে লেকচারার হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। যাঁরা শুধু নিজনিজ একাডেমিক বিষয়ে ভালো জ্ঞান রাখতেন না, নানা প্রকার শিক্ষাসহায়ক (কো-কারিকুলার) বিষয়েও পারদর্শী ছিলেন। প্রত্যেকে বালকদের জন্য অনুকরণীয় ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন। এখানে উল্লেখ্য, তখন ক্যাডেট কলেজের একজন লেকচারের বেসিক পে, সরকারি কলেজ এবং পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন লেকচারের বেসিক পে থেকে বেশি ছিলো। চাকুরির সুযোগ-সুবিধাও উন্নততর ছিলো। মুক্তিযুদ্ধের পর এসব পার্থক্য আর ধরে রাখা সম্ভব হয়নি। কর্নেল হাসানের সুযোগ্য নেতৃত্বে শুরুতেই নবনিযুক্ত ফ্যাকাল্টি মেম্বররা এক অসাধারণ ট্রেন্ড সেট করতে, অর্থাৎ ধারা প্রবর্তন করতে, সমর্থ হন। ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজের ইতিহাসে এঁদের অবদান স্বর্ণাক্ষরে চিরদিন লেখা থাকবে। যে কোনো প্রতিষ্ঠানের, বিশেষ করে তা যদি হয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, প্রতিষ্ঠাতা প্রধান নিয়োগের ক্ষেত্রে নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষকে সর্বোচ্চ যত্নশীল হওয়া প্রয়োজন। তিনি শুরুতে ভালো বা মন্দ যে ট্রেন্ড সেট করবেন প্রতিষ্ঠানটিকে সেটাই অনেকদিন, এমনকি চিরদিন, বহন করতে হয়। কর্নেল হাসানের পর, কর্নেল রহমানসহ চারজন অত্যন্ত দক্ষ প্রিন্সিপাল আমার আগে সুনামের সাথে দায়িত্ব পালন করেন। এসব গুণী ব্যক্তিদের পর আমার মতো একজন অনভিজ্ঞ তরুনের প্রিন্সিপালের দায়িত্ব গ্রহণ সত্যিকার অর্থেই বিরাট চ্যালেঞ্জ ছিলো। ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজের অন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্টের কথা উল্লেখ করার দাবি রাখে। তা হলো, চতুর্থ শ্রেণীর সর্বকনিষ্ঠ কর্মচারি থেকে শুরু করে প্রথম শ্রেণীর সর্বজ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা পর্যন্ত, সকলে ব্যক্তিগতভাবে এবং সমষ্টিগতভাবে কলেজের প্রতি প্রচন্ডভাবে অনুগত ছিলেন। আমি দেখেছি, প্রিন্সিপালের সকল আদেশ তাঁরা কীভাবে শিরোধার্য মনে করে সর্বোচ্চ আন্তরিকতার সাথে পালন করতেন। কলেজটি প্রত্যন্ত এলাকায় অবস্থিত হবার কারণে বড় শহরের সামাজিক, রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ক্ষতিকর প্রভাব ও ঝামেলা থেকে মুক্ত ছিলো। বেশিরভাগ ক্যাডেট আসতো গ্রামীণ অঞ্চল অথবা ছোটো মফস্বল শহর থেকে। ক্যাডেটদের এবং তাদের অভিভাবকদের মধ্যে একরকম গ্রামীণ সারল্য লক্ষ্য করে আমি মাঝেমাঝে হতবাক হয়ে যেতাম। যেমন, কোনো কোনো অভিভাবক প্রিন্সিপালের অফিসে ঢোকার সময় জুতা খুলে ঢুকতেন। আমি চেয়ার থেকে উঠে গিয়ে হাত ধরে বারণ করার আগেই কাজটি করে ফেলতেন। ক্যাডেটদের অভিভাবকরা ছিলেন, শিক্ষিত-অশিক্ষিত এবং ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে, অত্যন্ত ভদ্র ও বিনয়ী। অপসন্দ হলেও কলেজ কর্তৃপক্ষের সকল আদেশ-উপদেশ হাসিমুখে পালন করতেন। তাঁরা বিশ্বাস করতেন, কলেজ কর্তৃপক্ষ যা কিছু করছে তা সবই তাঁদের সন্তানের মঙ্গলের জন্য। যে কারো জন্য ফার্স্ট টাইম প্রিন্সিপাল হিসেবে কাজ করার জন্য ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজ একটি আদর্শ প্রতিষ্ঠন ছিলো। সে জন্য প্রিন্সিপাল হিসেবে ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজে প্রথম নিয়োগ পাবার জন্য আমি নিজেকে অনেক ভাগ্যবান মনে করি। কলেজের সহকর্মীরা আমাকে অনেক ট্রিক্স অব দি ট্রেইড শিখতে সাহায্য করেছেন। যা বই পড়ে শেখা যায় না। ১৯৫০ দশকের শেষভাগে তৎকালীন পাকিস্তানে বৃটিশ পাবলিক স্কুলের আদলে ক্যাডেটট কলেজ স্থাপনের কাজ শুরু হয়। মূল উদ্দেশ্য ছিলো, ১১/১২ বছরের ছেলেদেরকে বোর্ডিং স্কুলের পরিবেশে রেখে ক্লাস সেভেন থেকে ক্লাস টুয়েলভ পর্যন্ত, অর্থাৎ এইচএসসি পযর্ন্ত শিক্ষাদান করা। সেইসাথে কিছু এলিমেন্টারি মিলিটারি ট্রইনিং দেওয়া, এবং নেতৃত্বের জন্য প্রয়োজনীয় মৌলিক কিছু গুণাবলী বিকাশে সহায়তা করা। যাতে পাশ করে ছেলেরা সশস্ত্রবাহিনীতে কমিশন্ড র্যাং কে যোগদানের জন্য উপযুক্ত এবং উৎসাহিত হয়। সেদিক থেকে বিচার করলে বলা যায়, বাংলাদেশের ক্যাডেট কলেজগুলো সর্বাংশে না হলেও অনেকাংশে সফল হয়েছে, এখনও হচ্ছে বলে আমি মনে করি। ক্যাডেট কলেজ থেকে পাশ করে একটি ছেলে (বা বর্তমানে মেয়েও) যদি সশস্ত্রবাহিনীতে যোগদান করতে আগ্রহী না হয় তা হলেও ক্ষতি নেই বলে আমি মনে করি। অন্য যেকোনো পেশাতেই সে যোগদান করুক না কেনো, সেখানে সে ক্যাডেট কলেজে অর্জিত গুণাবলী দ্বারা অন্যদের তুলনায় অধিকতর অবদান রাখবে বলে আমার বিশ্বাস। যদি কেউ তা না পারে তবে সেটা ক্যাডেট কলেজের ব্যর্থতা নয়, তার ব্যক্তিগত ব্যর্থতা। সেজন্য অনেক কারণ থাকতে পারে। পৃথিবীর অনেক দেশেই স্কুল পর্যায়ের ছেলেমেয়েদের জন্য ক্যাডেট কলেজের মতো রাষ্ট্র পরিচালিত উন্নত মানের স্কুল আছে। যেগুলোকে সেন্টার্স অব এক্সেলেন্স বলা হয়ে থাকে। আমি নিজে চীনদেশে এমন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দেখেছি। অন্যান্য সমাজতান্ত্রিক দেশেও এমন ব্যবস্থা আছে বলে জেনেছি। রাষ্ট্র এবং সমাজ পরিচালনায় নেতৃত্ব প্রদান করা ডাফার বা অকর্মণ্যদের কাজ নয়। এজন্য দরকার মেধাবী, দক্ষ এবং দেশেপ্রমিক কর্মীর। যারা সকল ক্ষেত্রে যোগ্য নেতৃত্ব প্রদান করবে। এসব সেন্টার্স অব এক্সেলেন্সে ছেলেমেয়েদের নেতৃত্বের প্রয়োজনীয় গুনাবলী, ইংরেজিতে যাকে বলা হয় কোয়ালিটিজ অব হেড, হার্ট এন্ড হ্যান্ড, শিক্ষা দেওয়া হয়। বলে রাখা ভালো, এখানে নেতৃত্ব বলতে শুধু রাজনৈতিক নেতৃত্ব বুঝায় না। যেকোনো পেশায় উৎকর্ষ অর্জনের জন্য প্রয়োজন সুযোগ্য নেতৃত্বের। যদি একমাত্র মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে সকলের সন্তানের জন্য এসব প্রতিষ্ঠানের দরজা সমানভাবে উন্মুক্ত রাখা হয়, তাহলে রাষ্ট্রীয় খরচে ক্যাডেট কলেজ পরিচালনাতে কারও আপত্তি থাকার কথা নয়। বাংলাদেশে কিছু লোক আছেন যাঁরা ক্যাডেট কলেজের কঠোর সমালোচনা করে থাকেন। এঁদের বেশিরভাগই বিত্তশালী ও শক্তিশালী, যাঁরা নিজেদের বিত্ত ও শক্তি দিয়ে বাংলাদেশে নিজ ইচ্ছামতো সব কিছু কিনতে পারেন বা করিয়ে নিতে পারেন। সুপারিশ বা অর্থের জোরে নিজ সন্তানের জন্য ভর্তির ব্যবস্থা করতে না পেরে এরা ক্যাডেট কলেজের সমালোচনা করেন। অন্য কিছু লোক আছেন যাঁরা নীতিগত প্রশ্ন তুলে ক্যাডেট কলেজের বিরোধিতা করেন। যাঁদের সমালোচনা, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অজ্ঞতাপ্রসূত। বহু বছর আগে, পাকিস্তান আমলে, একজন জ্ঞানী লোকের মুখে আমাদের একটি সামাজিক ব্যাধি সম্পর্কে একটা দামি কথা শুনেছিলাম। কথাটা বর্তমানে মনে হয় অধিকতর প্রযোজ্য। কথাটা হলো: Too many people talk too much on subjects they know too little. আমি ১৯৭৮ সনের ফেব্রুয়ারি থেকে ১৯৮০ সনের মে মাসের প্রথম ভাগ পর্যন্ত ঝিনাইদহে দায়িত্ব পালন করি। সময়টা অল্প হলেও এ সময়ে বেশ কিছু ঘটনা ঘটে যা পাঠকের কাছে আকর্ষণীয় হতে পারে। সব ঘটনা তো বলা যাবে না। পরবর্তীত তার মধ্য থেকে কয়েকটি মাত্র উল্লেখ করার ইচ্ছা রাখি।