Ashraf’s Column

Tuesday, March 25, 2014

ক্যাডেট কলেজের টুকরো স্মৃতি: ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজ: পর্ব ৩: মায়ের মন মানে না মানা

সন্তানের প্রতি বাংগালি মায়ের প্রবাদতুল্য বাৎসল্য সম্পর্কে আমরা সবাই অবগত আছি। এজন্য আমরা বাংগালিরা নিজেদেরকে ভাগ্যবান মনে করি। কন্তু কখনও যে এই বাৎসল্য অশান্তির কারণ হতে পারে তেমন অভিজ্ঞতা ক’জনের হয় ? ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজে প্রিন্সিপালের দায়িত্ব পালনকালে আমাকে এমন একটি অশান্তির মোকাবিলা করতে গিয়ে বেশ বেগ পেতে হয়েছিলো। এখানে বলে রাখা ভালো, ছোটোবেলায় নিজের মাকে হারিয়েছিলাম। তাই মায়েদের ব্যাপারে সবসময় খুব ষ্পর্শকাতর ছিলাম, এখনও আছি। আমি যখন দেখি একজন মা তাঁর সন্তানকে কোলে নিয়ে চুমু খাচ্ছেন, সন্তানের মাথায় হাত রেখে দোয়া করছেন, অথবা নিজহাতে সন্তানের মুখে খাবার তুলে দিচ্ছেন, তখন আমার মনে হয় পৃথিবীর একটি সুন্দরতম দৃশ্য আল্লাহ আমাকে দেখাচ্ছেন। আমার কোনো কাজে বা কথায় কোনো মা কষ্ট পান তা আমি কখনও চাই না। তারপরও ক্যাডেটদের বৃহত্তর স্বার্থে আমাকে এমন একটা সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিলো যাতে তাদের মায়েরা আহত বোধ করেছিলেন। পেরেন্টস ভিজিটিং ডে’তে আগত সকল মা তাঁর ছেলের জন্য একাধিক টিফিন ক্যারিয়ার এবং ব্যাগ ভরে খাবার নিয়ে আসতেন। রান্না করা নানাবিধ খাবার, পিঠাপায়েস থেকে শুরু করে যাবতীয় মৌসুমী ফল, কোমল পানীয় কোনোকিছু বাদ যেতো না। বিশেষ করে নিচের ক্লাসের ছেলেদের মায়েদের মধ্যে প্রবণতাটা লক্ষ্যণীয়ভাবে বেশি ছিলো। মা ছেলেকে নিজের পাশে বসিয়ে ‘ডাকফিডিং’ করতেন। যার ফলে পরদিন সকালে কলেজের হাসপাতালে ডায়রিয়াজনিত কারণে সিক রিপোর্টের সংখ্যা অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যেতো। তবে সবচেয়ে খারাপ পরিণতি ছিলো বিষয়টির ইমশেনাল দিক। যাদের মায়েরা আসতেন সেসব ক্যাডেট সবার সামনে প্রকাশ্যে হাপুসহুপুস করে খেলেও, যাদের মায়েরা আসতে পারতেন না তাদের চোখেমুখে যে বঞ্চনার করুণভাব ফুঠে উঠতো তা আমাকে ব্যাথিত করে তুলতো। এমন অনেক ছেলে ছিলো যাদের মায়েরা দূরত্ব অথবা অসুস্থতার কারণে কখনই আসতে পারতেন না। এদের অবস্থা চিন্তা করে আমার নিজের মনও খারাপ হয়ে যেতো। একদিন কৌতহল বশত: ছেলেকে খাওয়াচ্ছেন এমন একজন মায়ের পাশে গিয়ে বসে আলাপ শুরু করলাম। দেখলাম তিনি পরম আদরের সাথে আস্ত মুরগির রোস্ট ভেঙ্গে ছেলের মুখে তুলে দিচ্ছেন। জানতে পারলাম, ছেলেটির বাবা খুলনায় স্বল্প বেতনে একটি চাকুরি করেন। তাঁদের আরও তিনটি ছেলেমেয়ে বাড়িতে আছে। জিজ্ঞাসা করলাম, বাসায় সপ্তাহে ক’বার মুরগির রোস্ট রান্না করেন ? জবাবে তিনি জানালেন, সপ্তাহ তো দূরের কথা। মাসেও একবার করেন না। সামর্থ্যে কুলায় না। মেহমান-অতিথি এলে কালেভদ্রে মুরগির রোস্ট রান্না করেন। জিজ্ঞাসা করলাম, আপনি কী জানেন, আপনার এই ছেলে ক্যাডেট কলেজে সপ্তাহে কতবার মুরগির গোস্ত খায় ? মা কিছুক্ষণ নীরবে মাথা নিচু করে থেকে বললেন, কী করবো স্যার। মনটা যে মানে না। প্রত্যেকবার পেরেন্টস ডে’তে আসার সময় টাকা ধার করে মুরগি কিনে রোস্ট বানিয়ে আনি। আমি তাঁর ক্যাডেট ছেলেকে দেখিয়ে বললাম, এই ছেলে সপ্তাহে চার বেলা মুরগির গোস্ত, চার বেলা গরু বা খাসির গোস্ত, চার বেলা বড় মাছ এবং দুই বেলা শাকশব্জি দিয়ে ভাত বা পোলাও খায়। এছাড়া নিয়মিত ডিম, দুধ, ফলমূলসহ অনেক রকম পুষ্টিকর খাবার খেয়ে থাকে। আপনি তো আপনার চারটি সন্তানের সকলরই মা। বাড়িতে আপনার সাথে যে তিনজন থাকে তাদেরকে মাসে একবার মুরগি খাওয়াতে পারেন না। অথচ, যে ছেলে ক্যাডেট কলেজে থেকে সপ্তাহে চারদিন মুরগিসহ আরও অনেক পুষ্টিকর খাবার খাচ্ছে তার জন্য ধার করা টাকা দিয়ে মুরগি রান্না করে আনছেন, আপনারই অন্য বাচ্চাদের বঞ্চিত করে। মা হয়ে সন্তানদের মধ্যে এ ধরনের পক্ষপাতিত্ব করা কি ঠিক কাজ হলো ? আমি মায়ের চোখে পানি দেখলাম। তিনি বললেন, আজই শেষ। ভবিষ্যতে এমন আর হবে না। আমি মায়ের চোখের পানিতে সমস্যার সমাধান খুঁজে পেলাম। সহকর্মীদের সাথে আলাপ করে পেরেন্টস ভিজিটিং ডে’তে ক্যাডেটদের জন্য সকল প্রকার খাবার এবং পানীয় আনা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ করা হলো। এবার অনেক মা ভীষণ ক্ষেপে গেলেন। তাঁদের বক্তব্য, আমরা নিজেদের টাকা দিয়ে নিজেদের ছেলেদের জন্য খাবার আনি। তাতে প্রিন্সিপাল সাহেবের আপত্তি করার কী আছে ? একদিন চারপাঁচজন মা মিলে একটি ডেলিগেশন নিয়ে আমার অফিসে এলেন। আমার সিদ্ধান্ত বাতিল করার জন্য জোর অনুরোধ জানালেন। আমি আমার পক্ষ থেকে বিষয়টি বুঝিয়ে বললাম। উপরে বর্ণিত মায়ের ছেলেকে মুরগির রোস্ট খাওয়ানের ঘটনা বললাম। সবশেষে বললাম, তবে হ্যাঁ, আমার তিন’শ ছেলের সবার জন্য যদি খাবার আনতে পারেন তা হলে মোস্ট ওয়েলকাম। আমাকে আগে থাকতে জানাবেন। আমি আনন্দের সাথে পরিবেশনের সব ব্যবস্থা করে দেবো। এরপর এমন অনুরোধ নিয়ে কেউ আর অমার কাছে আসেননি।

0 Comments:

Post a Comment

Subscribe to Post Comments [Atom]



<< Home