Ashraf’s Column

Friday, July 05, 2013

বংশ পরিচয়

১৯৬৮ সালের শেষ দিকের ঘটনা। আমি তখন পাকিস্তানের কোয়েটা ক্যান্টনমেন্টে একটি ব্রিগেড হেডকোয়ার্টারে জুনিয়র ক্যাপ্টেন হিসেবে কমর্রত ছিলাম। আজকাল যেমন হয়, তখনও পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমিতে লং কোর্সের ক্যাডেট নির্বাচনের জন্য সবার আগে বিভিন্ন স্টেশনে প্রিলিমিনারি ইন্টারভিউ হতো। প্রতিটি ইন্টারভিউ কমিটির প্রেসিডেন্ট হতেন একজন ব্রিগেডিয়ার। সদস্য থাকতেন দু’জন লে: কর্নেল। একজন সিনিয়র মেজর সদস্য সচিবের দায়িত্ব পালন করতেন। সেবার এমন একটি কমিটির সদস্য সচিব হিসেবে আমাকে নিয়োগ দেয়া হলো। শীতকালীন কালেক্টিভ ট্রেইনিংয়ের জন্য স্টেশনের প্রায় সব অফিসার ক্যান্টনমেন্টের বাইরে ছিলেন। তাই আমার মত একজন জুনিয়র অফিসারের উপর এমন গুরুদায়িত্ব দেয়া হয়েছিলো বলে আমাকে জানানো হয়েছিলো। জীবনে এই প্রথম এমন গুরুত্বপূর্ণ কাজ করার সুযোগ এলো। স্বভাবতই মনের মধ্যে কিছুটা উত্তেজনা কাজ করছিলো। ইন্টারভিউ শুরু হবার দু’তিন দিন আগে আমার নামে জেনারেল হেডকোর্য়াটার্স, রাওয়ালপিন্ডি থেকে একটি ব্যক্তিগত গোপনীয় সরকারি চিঠি এলো। খামটি খোলার পর দেখা গেলো তার ভেতর একখানা ছোট্ট চিঠি। তার সাথে সিলগালা করা মোটা একটি খাম। চিঠিতে বলা হয়েছে, সিলগালা করা খামটি ইন্টারভিউ শুরু হবার পূর্বমুহূর্তে খুলতে হবে, তার আগে কিছুতেই নয়। সিলগালা করা খামটির ভেতরে প্রদত্ত নির্দেশাবলী ইন্টারভিউ কমিটির প্রেসিডেন্ট ও সদস্যদের পাঠ করে শুনিয়ে, চিঠর উপর তাঁদের দস্তখত নিয়ে, সাথে সাথে প্রদত্ত সেলফ এড্রেসড খামে ভরে প্রেরককে ফেরত পাঠাতে হবে। জেনারেল হেডকোর্য়াটার্সের সেই অতি গোপনীয় চিঠির মূলকথা আমার আজকের লেখার বিষয়বস্তু। ইন্টারভিউর জন্য মোট নম্বর ছিলো ১০০। পাশের নম্বর ৪০। ইন্টারভিউতে আগত প্রার্থীদের কীভাবে প্রশ্ন করতে হবে, কী কী প্রশ্ন করা যাবে, কী কী প্রশ্ন করা যাবে না ইত্যাদির উপর বিশদ নির্দেশনা ছিলো সেই চিঠিতে। সবশেষে, এবং সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা হিসেবে বলা হয়েছিলো, “কমিনা” বংশের কোনো প্রার্থীকে যেনো কোনোভাবেই নির্বাচন না করা হয়। “কমিনা” বংশের ব্যাখ্যায় বলা ছিলো: ধোপা, নাপিত, কসাই, ঢুলি, বেলদার, পাটনি ইত্যাদি তথাকথিত নিচু বংশকে “কমিনা” বংশ বলে বিবেচনা করতে হবে। পক্ষান্তরে প্রার্থীর পরিবারের আপন কোনো সদস্য (বাবা, দাদা, চাচা, মামা, ভাই) যদি বর্তমানে সশস্ত্রবাহিনীতে অফিসার পদে কর্মরত থাকেন, অথবা অতীতে ছিলেন, তাহলে এমন প্রতি সদস্যের জন্য অতিরিক্ত ১০ নম্বর করে প্রদান করতে হবে, তবে একজন প্রার্থীকে এবাবদ ৩০ নম্বরের বেশি দেয়া যাবে না। বয়স তখন নিতান্তই কম ছিলো, পঁচিশেরও নিচে। নির্দেশনাটি মনে মনে পাঠ করে ভীষণ হোচট খেলাম। ভাবলাম, ইসলামিক রিপাবলিকের এ কোন ইসলামী ন্যায় বিচার এবং গণতন্ত্রের রূপ দেখছি ! চিঠিতে অবশ্য স্বীকার করা হয়েছিলো, এই নির্দেশনাটি ইসলামী ন্যায় বিচার এবং গণতন্ত্রের মর্মবাণী উভয়ের সাথে সাংঘর্ষিক। তারপরও বহু বছরের বাস্তব অভিজ্ঞতার আলোকে সেনাবাহিনীকে বাধ্য হয়ে এমন সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। অনেক বিস্তারিত ব্যাখ্যা ও উদাহরণ দেওয়া হয়েছে। সংক্ষেপ যা বলা হয়েছে তা হলো: সশস্ত্র যুদ্ধের ময়দান এমন একটি স্থান যেখানে যুদ্ধরত অবস্থায় সকল কমান্ডারকে পৃথিবীর নিষ্ঠুরতম কঠোরতা ও বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হয়। এখানে তত্বের কচকচানি, রাগ-বিরাগ বা ভাবাবেগের কোনো যায়গা নেই। অভিজ্ঞতা থেকে দেখা গেছে, আমাদের উপমহাদেশের “কমিনা” বংশের ছেলেমেয়েরা শৈশব ও বাল্যকালে এক ধরনের বিশেষ আর্থসমাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিবেশে বড় হয়ে উঠে। নেতৃত্ব প্রদানের জন্য যেসব মানবিক ও মানসিক (পার্সোনালিটি এন্ড ক্যারাক্টার ট্রেইটস) গুণাবলীর অবশ্য প্রয়োজন, তা সাধারনত: তাদের মধ্যে প্রস্ফুটিত হতে দেখা যায় না। তাদের কেতাবি বিদ্যা যতোই হোক না কেনো। যে ব্যক্তির মধ্যে এসব বিশেষ গুণাবলীর অভাব আছে সে স্বাভাবিক কারণে সশস্ত্রবাহিনীতে, কমান্ডার হলেও, লীডার হতে পারে না। ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে। এদের মধ্যে অনেকে আবার বড় হয়ে এসব দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে পারে। কিন্তু সশস্ত্রবাহিনীতে অফিসার নির্বাচনের সময় এ বিষয়ে চান্স নেয়ার কোনো সুযোগ নেই। আরও একটি কারণ উল্লেখ করা হয়েছে। নিজেদের আর্থসমাজিক ও সাংস্কৃতিক ব্যাকগ্রাউন্ডের কারণে এতদাঞ্চলের সাধারন সৈনিকরা “কমিনা” বংশ থেকে আগত কোনো অফিসারকে মন থেকে নিজেদের লীডার হিসেবে মেনে নিতে চায় না। এমন লীডারের হুকুমে স্বেচ্ছায় প্রাণ দিতে রাজি হতে চায় না। প্রথম দিনের ইন্টারভিউ শেষ করে রাতে অফিসার্স মেসে ফেরার পরও মাথার মধ্যে বিষয়টি ঘুরপাক খাচ্ছিল। এমন সময় আমার আব্বার বলা একটা কথা মনে পড়লো। একটি উদার ও প্রগতিশীল মনের মানুষ ছিলেন তিনি। আর্মিতে জয়েন করার আগে যখন ঢাকা ইউনিভার্সিটির ছাত্র ছিলাম তখন ছুটিতে আব্বার কাছে গেলে এমন অনেক বিষয় নিয়ে আমার সাথে আলাপ করতেন যা তখনকার দিনে পিতা-পুত্রের মাঝে অনুচ্চার্য বিষয় ছিলো। তাঁর আমাকে নিয়ে চিন্তা ছিলো, ছেলেদের স্কুল এবং ছেলেদের কলেজ থেকে পাশ করা ছেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের কো-এডুকেশনে গিয়ে কোনো মন্দ বংশের মেয়ের প্রেমেট্রেমে জড়িয় না পড়ি। তাই তিনি আমাকে কাছে ডেকে বললেন: বাবা, তুই এখন বড় হয়েছিস। এই বয়সে বিয়ে-শাদী বা প্রেম করার জন্য কোনো ময়ে পসন্দ হওয়াটা অস্বাভাবিক নয়। মনে তেমন কোনো ভাবনা উদয় হলে একটা কথা অবশ্যই মনে রাখবি। মেয়েটি যেনো আজেবাজে ফ্যামিলির না হয়। আজেবাজে ফ্যামিলি বলতে তিনি দরিদ্র পরিবারকে বুঝাননি। বুঝিয়েছিলেন সাংস্কৃতিকভাবে নিম্নমানের, নিম্নরুচির পরিবারকে। তাঁর কথার পক্ষে অনেক যুক্তি ও উদাহরণ দিয়েছিলেন। আমি তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ইস্ট পাকিস্তান স্টুডেন্টস ইউনিয়নের একজন সক্রিয় কর্মী। চেতনায় উদার এবং বামপন্হী। আব্বার কথাগুলু মনে হচ্ছিল প্রচন্ড প্রতিক্রিয়াশীল। তবে প্রতিবাদ করে বলার অনেক কিছু থাকলেও কিছু বলতে সাহস হয়নি। অনেক কাল পর আমার নিজের ছেলেমেয়ের যখন বিয়ে দেওয়ার সময় হলো তখন আব্বার কথার তাত্পর্য পুরোটা বুঝতে পেরেছিলাম। ২৮ বছর পর ১৯৯০ দশকের মাঝামাঝি সময়ে, বাংলাদেশ ইন্টার সার্ভিসেস সিলেকশন বোর্ডের (আইএসএসবি) প্রেসিডন্ট হিসেবে সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনীর একাডেমিগুলোর জন্য ক্যাডেট সিলেকশনের চূড়ান্ত দায়িত্ব আমার ঘাড়ে এসে পড়ে। ১৯৬৮ সালে পাকিস্তানের জেনারেল হেডকোর্য়াটার্সের পাঠানো সেই অতি গোপনীয় চিঠির কথা মনে পড়লো। খুঁজে দেখলাম, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সরকারের পক্ষ থেকে আমাদের আইএসএসবি-কে তেমন কোনো নির্দেশনা দিয়ে চিঠি কখনও দেওয়া হয়নি। কারণ সহজবোধ্য। নীতিগতভাবে সরকার সঠিক কাজটিই করেছেন, তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু কয়েক সপ্তাহ যেতেই সন্দেহ দেখা দিলো। কোনো এক ইউনিটের এক মেজর, ধরা যাক তার নাম তানিম (সঙ্গত কারণে আসল নাম-ঠিকানা গোপন রাখা হলো), এমন কান্ড ঘটিয়ে ফেললেন যাতে সবাই স্তম্ভিত হয়ে গেলো। গভীর রাত্রে, ছোট দু’টি বাচ্চা যখন ঘুমিয়ে ছিলো, নিজের বাসার জিনিষপত্র ছড়িয়ে-ছিটিয়ে লন্ডভন্ড করে, লোহার রড দিয়ে পিটিয়ে নিজের স্ত্রীকে হত্যা করলেন মেজর তানিম। হৈ-চৈ করে পাড়ার সবাইকে ডেকে এনে বললেন তাঁর বাসায় ডাকাতি হয়েছে। ডাকাত তার স্ত্রীকে মেরে ফেলে ঘরের সব মূল্যবান জিনিষপত্র নিয়ে গেছে। যথাযথ তদন্তের পর এসব তথ্য বেড়িয়ে আসে। স্ত্রীটি ছিলেন অত্যন্ত ধনী পিতামাতার একমাত্র সন্তান। পিতামাতার মৃত্যুর পর তিনি স্বাভাবিকভাবেই তাঁদের সকল সম্পত্তির মালিকানা লাভ করেন। শ্বশুর বাড়ির সম্পত্তি আত্মসাত করার জন্য মেজর তানিম এমন জঘণ্য অপরাধ করেছিলেন। বিচারে দীর্ঘ দিনের কারদন্ড হয়েছিলো। সম্ভবত শিশু সন্তান দু’টির কথা বিবেচনা করে বিচারক প্রাণদন্ড দেননি। বিষয়টি নিয়ে আর্মি হেডকোর্য়াটার্সে প্রচন্ড আলোড়ন সৃস্টি হলো। চিঠি দিয়ে আমার কাছে জানতে চাওয়া হলো, কেমন করে এমন জঘণ্য ক্রিমিনালকে আইএসএসবি কোয়ালিফাই করেছিলো। ১২/১৪ বছর আগের ফাইলপত্র খুঁজে যা পাওয়া গেলো তা সংক্ষেপে এরকম: মেজর তানিমের জন্ম হয়েছিলো বাংলাদেশে দুর্নীতি ও দুষ্কর্মের জন্য অতি বিখ্যাত একটি ডিপার্টমেন্টের সর্বনিম্ন পর্যায়ের এক কর্মচারির ঘরে। দুর্নীতি ও দুষ্কর্মের পরিবেশে সেখানেই তাঁর বেড়ে উঠা। সদ্য উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে যখন তিনি আইএসএসবি-তে এসেছিলেন তখন তাঁর ক্রিমিনাল মেন্টালিটি টেস্টিং অফিসারদের কাছে ঠিকই ধরা পড়েছিলো। তখন বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমিতে ক্যাডেটদের এতটা অভাব ছিলো যে একডেমি, তথা আর্মি, চালানো কঠিন হয়ে পড়েছিলো। তাই অনেকটা আপোস করে উক্ত মেজরকে, তার রিপোর্টে দুর্বল দিকগুলো উল্লেখ করে, একাডেমিতে পাঠানো হয়েছিলো। আশা করা হয়েছিলো, একাডেমিতে দীর্ঘ ট্রেইনিংয়ের সময়ে তিনি তাঁর দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে পারবেন। না পারলে, কমিশন না দিয়ে একাডেমি থেকে বহিস্কার করা হবে। কে জানে, বিধাতা তখন হয়তো মানুষের দুরাশা দেখে মুচকি হেসেছিলেন। ক’দিন আগে, ২০১৩ সনের জুন মাসের মাঝামাঝি সময়ে, বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ অধিবেশনে কয়েকজন মাননীয় সংসদ সদস্য যে কদর্যতম অশ্লীল ভাষায় একে অপরকে গালাগাল করলেন, তা সুদূর আমেরিকার স্যান হোসেতে বসে ঢাকার টেলিভিশনের বদৌলতে আমার দেখা এবং শোনার বদকিসমত হয়েছে। শুনতে শুনতে মনে পড়ে গেলো ১৯৬৮ সালে পাওয়া পাকিস্তানী জেনারেল হেডকোর্য়ার্টাস থেকে পাওয়া চিঠির কথা। কপি হাতে থাকলে সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক দল দু’টির সর্বোচ্চ নেতা-নেত্রীদের কাছে পাঠিয়ে দেওয়া যেতো। আরও মনে পড়ে গেলো আমার মরহুম আব্বার কথা। আমার সাত বছর বয়সী নাতনি, যার জন্ম ও বেড়ে উঠা আমেরিকাতে, আমার পাশে বসে ঢাকার টিভি দেখে। সেখান থেকে অতি উত্সাহ নিয়ে বাংলাভাষা শেখার চেস্টা করে। খুব ভালো বাংলা বলতে পারে। অপিরিচিত কোনো শব্দ বা বাক্য শুনলেই সে আমাকে সাথে সাথে প্রশ্ন করে, “দাদা, এই কথাটার অর্থ কী ?” সেদিন খবর শোনার সময় মাননীয় সংসদ সদস্যদের কুত্সিততম কথাবার্তা শুনে সে আমাকে একই প্রশ্ন করলো। সহৃদয় পাঠক, আপনিই বলুন এই কচি শিশুটিকে আমি কী জবাব দেবো ? বাধ্য হয়ে মিথ্যা কিছু বলে তাকে শান্ত করেছিলাম। একজন সংসদ সদস্য, তা তিনি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ যেভাবেই নির্বাচিত হয়ে এসে থাকুন না কেনো, তিনি তো আমাদের, আ’ম জনতার, লীডার। আর সেজন্যই আমরা “মাননীয়” বলে সম্বোধন করি। না করলে বেয়াদবি হয়। একজন সংসদ সদস্য নিজে নিজে সংসদে আসেননি। তাঁকে তো তাঁর দলের সর্বোচ্চ নেতা বা নেত্রী মনোনয়ন দিয়ে সংসদে এনেছেন। ইংরেজিতে একটা বহুল প্রচলিত কথা আছে যার বাংলা করলে এমন হয়: একজন মানুষের সঙ্গী-সাথীদের কথা-বার্তা, স্বভাব-চরিত্র, অভ্যাস-রুচি দেখে মানুষটির নিজের কথা-বার্তা, স্বভাব-চরিত্র, অভ্যাস-রুচি সম্পর্কে ধারণা করা যায়। এসব কুত্সিত কথা বলা “মাননীয়দের” যেসব বড় নেতা-নেত্রীরা আদর করে সংসদে ঠাঁই দিয়েছেন, আমরা তাঁদেরকেই বা কতটা প্রাপ্য সম্মান দিতে পারি ? কথাটা ভাবার সময় কি এখনও হয়নি ?