ক্যাডেট কলেজের টুকরো স্মৃতি: ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজ: পর্ব ১০: ক্যাডেটের কান্না
রবীন্দ্রনাথের ‘ছুটি’ নামক ছোটো গল্পটি যাঁরা পড়ছেন তাঁদের গল্পেটির প্রধান চরিত্র ফটিকের কথা নিশ্চয়ই মনে আছে। ক্যাডেট কলেজে ছেলেরা যখন প্রথম এসে ভর্তি হয় তখন তাদের বয়স, স্বভাব এবং অনুভূতি ফটিকের মতোই থাকে। এই বয়সের বাচ্চারা ভীষণ স্নেহের কাংগাল হয়। মাবাবা, ভাইবোন থেকে দূরে চলে গেলে অল্প দিনের মধ্যেই তাদের জন্য কাতর হয়ে পড়ে। ক্যাডেট কলেজে রাত্রি সারে দশটায় (শীতকালে দশটায়) লাইটস আউট হয়। অর্থাৎ হাউসের সিকিউরিটি লাইট ছাড়া বাকি সকল বাতি নিভিয়ে ফেলতে হয়। ডিউটি মাস্টাররা একটা রাউন্ড দিয়ে যারযার ঘরে ফিরে যান। নাইটগার্ডরা পাহারায় থাকে। প্রায় প্রতি রাত্রে এগারোটার দিকে আমি পায়ে হেঁটে রাউন্ড দিতে বের হতাম। সংগে কাউকে রাখতাম না। ঝিনাইদহে রাতের বেলা সাঁপের খুব উপদ্রব ছিলো। সাঁপের আক্রমণ থেকে বাঁচার জন্য হাতে একটি টর্চ এবং ছোটো লাঠি রাখতাম। কারও ঘুমের যাতে ব্যাঘাত না হয় সেজন্য পায়ে নরম রাবার সোলের জুতা থাকতো। ক্যাডেটদের ডর্মিটরির ভেতর দিয়ে হেটে যাবার সময় লেপের তল থেকে প্রায়ই জুনিয়র ক্যাডেটদের, বিশেষ করে নবাগতদের, ফুঁপিয়েফুঁপিয়ে কান্নার শব্দ শুনতে পেতাম। তখন আমার মনটা খুব খারাপ হয়ে যেতো। মনে পড়ে যেতো, আমি নিজেও বাইশ বছর বয়সে সুদূর কাকুলের মিলিটারি একাডেমিতে গিয়ে প্রথম প্রথম লাইটস আউটের পর বিছানায় শুয়ে বাড়ির কথা মনে করে কত না কেঁদেছি। কান্ন্ররত ছেলেটির হাউস মাস্টারকে পরদিন সকালে অনুরোধ করতাম ছেলেটির বিশেষ যত্ন নিতে। অবশ্য ছেলেটি যাতে জানতে না পারে আমি তার কান্না শুনেছি।
ব্যাক্তিগতভাবে আমার আরও একটি কাজ করতে ভালো লাগতো। তা হলো, কলেজ হাসপাতালে ভর্তি ক্যাডেটদের দেখতে যাওয়া। সব সময় প্রায় দশবারোজন অসুস্থ ক্যাডেট হাসপাতালে ভর্তি থাকতো। আমার মনে পড়তো, ছোটো বেলায় অসুস্থ হলে আমার মা কতো কাতর হতেন। আমার মায়ের ফ্রিজ ছিলো না। আমার পসন্দ হতো না বলে একটার পর একটা কতো কী ফ্রেশ রান্না করে আমাকে খেতে দিতেন। আদর করে গায়েমাথায় কতো হাত বুলিয়ে দিতেন। যেমনটি সব বাংগালি মা আবহমান কাল ধরে করে আসছেন। অথচ অসুস্থ ক্যাডেটরা শুয়েশুয়ে হাসপাতলের ছাদ দেখছে। কেউবা বই পড়ে সময় কাটাচ্ছে। মেস থেকে রান্না করা যে খাবার আসে তা-ই খাচ্ছে, ইচ্ছা হোক বা না হোক। বিষয়টি নিয়ে আমার স্ত্রীর সাথে আলাপ করলাম।
প্রসঙ্গত: বলা যেতে পারে ক্যাডেট কলেজে যখন আসি তখন আমার স্ত্রী রুমী ক্যাডেট কলেজের পরিবেশ-পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে নিজের লাইফস্টাইল সম্পূর্ণ বদলে ফেলে। যতো সৌখিন কাপড় আর গয়নাপাতি ছিলো, যা কলেজে পড়া ঠিক হবে, না তা সব সুটকেসে বন্ধ করে রেখে দেয়। তার যুক্তি, ছেলেরা প্রিন্সিপালের স্ত্রীকে মায়ের মতো দেখতে চাইবে, সিনমার নায়িকাদের মতো নিশ্চয়ই নয়। ছাত্রীজীবনে নিজের কলেজের প্রিন্সিপাল আপাদের কথা মনে করে তার মনে এমন চিন্তা এসেছে। সে যে এতো সহজে নিজেকে একজন সিনিয়র আর্মি অফিসারের স্ত্রীর অবস্থান থেকে একজন সাদামাটা বাংগালি মায়ের অবস্থানে নিয়ে আসবে, তা ভাবতে পারিনি। বিষয়টি কলেজের সকল কর্মকর্তা-কর্মচারি, বিশেষ করে ক্যাডেটদের, মনোযোগ আকর্ষণ করেছিলো। কলেজের সকল চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারিদের বলা হলো, প্রিন্সিপালের স্ত্রীকে “ম্যাডাম” বা “বেগম সাহেবা” বলে সম্বোধন করা যাবে না। “আম্মা” বলে ডাকতে হবে। শিক্ষাটি রুমী, যার বাবা বৃটিশ আমল থেকে একজন প্রথম শ্রেণীর গেজেটেড অফিসার ছিলেন, তার মার কাছ থেকে পেয়েছিলো।
প্রথম যেদিন বিকেল বেলা রুমীকে নিয়ে কলেজ হাসপাতালে গেলাম সেদিন সে রোগীদের জন্য নিজহাতে বানিয়ে কিছু কেইক-বিস্কুট সংগে নিয়ে গিয়েছিলো। হাসপাতালের ছেলেরা সেগুলো পেয়ে এতো খুশি হয়েছিলো যে তা দেখার মতো ছিলো। এর পর থেকে প্রায় প্রতিদিন হাসপাতালে ভর্তি ছেলেদের দেখতে যেতো। তাদের সাথে তাদের বাড়ির গল্প করতো। কেউ মাথা ব্যাথা করছে বললে তার মাথায় সস্নেহে হাত বুলিয়ে দিতো, বিশেষ করে ছোটো বাচ্চাদের। কার কী খেতে মন চাইছে জেনে নিয়ে বাসায় ফিরে সে অনুযায়ী বাজার করিয়ে পরের দিন রান্না করে নিয়ে যেতো। কেউ ট্যাংরা মাছের তরকারি, কেউ কেচকি মাছের চর্চরি, কেউবা শুটকির ভর্তা, এমন সব খেতে চাইতো যা ক্যাডেট মেসে রান্না হয় না। এরপর, কোনো ক্যাডেট অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হলে তার বন্ধুরা ঠাট্টা করে বলতো, যা যা কয়েকদিন আরাম করে প্রিন্সিপাল স্যারের বাসার রান্না খেয়ে আয় ! কখনও কখনও, প্রয়জোন মনে হলে, কোনো বাচ্চার অসুখ নিয়ে রুমী মেডিকেল অফিসারের সাথেও আলাপ করতো। অল্প দিনের মধ্যে ক্যাডেটরা রুমীকে নিজ পরিবারের একজন সদস্য বলে মনে করতে লাগলো। ব্যাপারটি আমার কাছেও ইন্টারেস্টিং মনে হয়েছে ! একজন মা চিরদিনই মা, তা তিনি যেখানই থাকুন না কেনো।
0 Comments:
Post a Comment
Subscribe to Post Comments [Atom]
<< Home