ক্যাডেট কলেজের টুকরো স্মৃতি: শেষ পর্ব : ৯ কিছু পরামর্শ
বিভিন্ন সময়ে আত্মীয়-স্বজন এবং পরিচিত জনেরা আমার কাছে পরামর্শ চেয়ে থাকেন, তাঁর ছেলে বা মেয়েকে ক্যাডেট কলেজে পড়তে পাঠাবেন কিনা। ক্যাডেট কলেজের একাডেমিক সিলেবাস সম্বন্ধে সবাই জানলেও এর কারিকুলাম, অর্থাৎ এর পাঠ্যসূচির দার্শনিক ভিত্তি, সম্পর্কে বেশিরভাগ লোকের স্বচ্ছ ধারণা নেই। এ সম্পর্কে জানার জন্য বাজারে বইপত্র আছ বলে আমার জানা নেই। মানুষ তাই ক্যাডেট কলেজ কোচিং সেন্টার, ক্যাডেট কলেজের পরিচিত প্রাক্তন ছাত্র বা শিক্ষক, অথবা আর্মি অফিসারের কাছ থেকে এ সম্পর্কে জানতে চান। সহজবোধ্য কারণে কোচিং সেন্টার কখনও সঠিক তথ্য সরবরাহ করে না। বাকিদের সাথে যোগাযোগ করা অনেকের পক্ষে সম্ভব হয় না। যাহোক, এ বিষয়ে আমার ব্যক্তিগত বিশ্বাস থেকে বলে নিতে চাই। যদিও অনেকে আমার বক্তব্যকে মানতে চাইবেন না। অনেকে ভুল বুঝবেন।
প্রথম কথা হলো, আমি বিশ্বাস করি, বর্তমানে যেমনটা আছে তাতে, আমি মেয়েদেরকে ক্যাডেট কলেজে পড়তে পাঠানোর বিরোধী। ক্যাডেট কলেজে একটি ছেলে বা মেয়ে সাড়ে এগারো বা বারো বছর বয়স থেকে সাড়ে সতেরো বা আঠারো বছর বয়স পর্যন্ত অবস্থান করে। বয়সসীমা আভিন্ন হলেও এই বয়সের একটি ছেলে ও একটি মেয়ের শারীরিক এবং মানসিক গঠন ও ডিভেলাপমেন্টের মধ্যে আকাশ-পাতাল পার্থক্য বিরাজ করে। পাঠকদের মধ্যে যাঁরা ইতোমধ্যে মা-বাবা হয়েছেন, আশা করি তাঁদেরকে বিষয়টি বুঝিয়ে বলতে হবে না। আমাদের সমাজে এই বয়সের একটি মেয়েকে ভবিষ্যত সংসার জীবনে সার্থক ও সুখী হবার জন্য অনেক ট্রিক্স অব দি ট্রেইড শিখতে হয়। আর এটা শেখার জন্য কোনো পাঠশালা বা পাঠ্যবই নেই। আবহমান কাল থেকে আমাদের মেয়েরা এ কৌশলগুলো নিজনিজ মায়ের কাছ থেকে, এবং পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের কাছ থেকে, রপ্ত করে থাকে। আমাদের সমাজে এখনও একটি মেয়ে, জীবনের অন্যন্য ক্ষেত্রে অসাধারণ কৃতিত্ব অর্জন করলেও, যদি সংসার জীবনে কৃতকার্য না হতে পারে, তাহলে সে জীবনে সুখী হতে পারে না। আমাদের দেশে ক্যাডেট কলেজের কারিকুলাম মূলত: ডিজাইন করা হয়েছিলো শুধুমাত্র নির্দিষ্ট বয়সের ছেলেদের জন্য, মেয়েদের জন্য নয়। ক্যাডেট কলেজের যে পরিবেশ তাতে একটি কিশোরী মেয়ে আর্মি থেকে আসা মেজর হাবিলদার/নায়েকদের কাছ থেকে কী শিখবে তা আমি বুঝতে পারি না। আপনার মেয়েকে ক্যাডেট কলেজে ভর্তি করার আগে কথাগুলো ভেবে দেখবেন।
এবার অশা যাক ছেলেদের কথায়। উপরে যে বয়সসীমা উল্লেখ করা হয়েছে তাতে একটি ছেলে ‘ছেলেমানুষ’ থাকে। তাকে গড়েপিটে একাধিক ‘ম্যানলি’ গুণাবলী শেখানো হয়। তবে মনে রাখার বিষয়, সব ছেলে জন্মগতভাবে ‘ক্যাডেট কলেজ টাইপ’ নয়। আল্লাহ সব ছেলেকে ‘ক্যাডেট কলেজ টাইপ’ করে সৃষ্টি করেন না। সব ছেলে বড় হয়ে জেনারেল হয় না, হবার দরকারও নেই। সমাজের সার্বিক উন্নতির জন্য সকল পেশায় মেধাবী ও সৃজনশীল কর্মীর প্রয়োজন। যে ছেলেটি বড় হয়ে একজন অধ্যাপক সত্যেন বসু, একজন ড: ইউনুস, একজন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন, একজন ড: এফ আর খান, বা একজন কবি নজরুল ইসলাম হবে, সে তো ক্যাডেট কলেজের শৃঙ্খলিত জন্য ‘মিসফিট’ হবে। ক্যাডেট কলেজ শিক্ষা পদ্ধতির সবথেকে বড় দোষ হলো, এখানে ক্রিয়েটিভিটি বা সৃজনশীলতা বিকাশের সুযোগ অতি সীমিত। এখানে ভালো করতে হলে একটি ছেলেকে কনফর্মিস্ট (Conformist) বা নির্বাক আজ্ঞাবহ হয়ে থাকতে হয়। প্রচলিত ধ্যানধারণার বাইরে বা বিরুদ্ধে কিছু ভাবা বা বলার সুযোগ নাই বললেই চলে। এলিমেন্টারি মিলিটারি ট্রেইনিংয়ের অংশ হিসেবে এমনটা করা হয়। এখান থেকে পাশ করা বেশিরভাগ ছেলে, দেখা গেছে, প্রাণের টানের চাইতে কর্তব্যবোধ থেকে তাড়িত হয়ে মানবিক কাজে অংশ গ্রহণ করে। একটি মানব শিশুর মধ্যে মানবিক গুণগুলোর স্ফুরণ, বর্ধণ ও উন্নয়নের জন্য একটা বয়স পর্যন্ত প্যারেন্টাল লাভ এন্ড কেয়ার, অর্থাৎ মা-বাবার আদর-ভালোবাসা ও যত্ন, খুব জরুরি। সে স্বর্গীয় আদর-ভালোবাসা ও যত্ন থেকে কী মূল্যে আপনি আপনার ছেলেকে বঞ্চিত করে পরিবার থেকে দূরে সড়িয়ে দিয়ে ক্যাডেট কলেজে দিবেন, তা ভালো করে ভেবে দেখা উচিৎ। ক্যাডেট কলেজগুলো মূলত: বৃটিশ পাবলিক স্কুলের আদলে স্থাপন করা হয়েছে। কলোনিয়াল যুগে অনেক বৃটিশ নাগরিককে বিভিন্ন কলোনিতে চাকুরি করতে হতো। সেসব কলোনিতে তাদের সন্তানদের জন্য উপযোগী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছিলো না। তাই এসব সন্তানদের জন্য বিলেতে, ক্ষতিকারক দিকগুলো মেনে নিয়ে, আবাসিক পাবলিক স্কুল স্থাপন করা হয়। পরের দিকে ভারতে এরকম প্রতিষ্ঠান স্থাপন করা হয়। বিশেষ করে চা বাগানে, সমূদ্রগামী জাহাজে, বন বিভাগে এবং বিদেশে কর্মরত লোকদের সন্তানদের জন্য এসব পাবলিক স্কুল জনপ্রিয় হতে থাকে। ব্রোকেন ফ্যামিলির, অর্থাৎ যেসব পরিবারে বাবা-মা তালাক বা অন্য কারণে একত্রে বাস করে না তাদের, বাচ্চাদের জন্যও এসব স্কুল জনপ্রিয় হয়। আপনার যদি এমন বাধ্যবাধকতা থাকে, অথবা আপনার ছেলে যদি ‘ক্যাডেট কলেজ টাইপ’ হয় তাহলে তাকে ক্যাডেট কলেজে পাঠাতে পারেন। তা না হলে, ছেলেকে একটি ভালো স্কুলে পাঠান, বাড়িতে ছেলের বেড়ে উঠার উপর নজর রাখুন। দেখবেন, আপনার ছেলে স্বাভাবিকভাবে বেড়ে উঠবে।
পাঠক আমাকে প্রশ্ন করতে পারেন, আপনার নিজের ছেলেমেয়েদের স্কুল পর্যায়ে কোথায় পড়িয়েছেন। আমাদের একটি মেয়ে এবং দু’টি ছেলে। মেয়েকে ক্যাডেট কলেজে দেওয়ার কথা কখনও আমার এবং আমার স্ত্রীর মাথায় আসেনি। বড় ছেলে সহপাঠীদের পাল্লায় পড়ে নিজ উদ্যোগে ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে কোনো একটি ক্যাডেট কলেজে গিয়েছিলো। কিন্তু সে ক্যাডেট কলেজ টাইপ না হওয়াতে দু’বছর না যেতেই তাকে বাড়ি ফিরিয়ে আনতে হয়েছিলো। ছোটো ছেলেও ক্যাডেট কলেজ টাইপ ছিলো না। তাছাড়া ও যখন ক্লাস সেভেনে তখন আমি পরিবারসহ বিদেশে কর্মরত ছিলাম। সুতরাং তাকেও ক্যাডেট কলেজে পাঠানো হয়নি। তবে আল্লাহ ওদের প্রতি, এবং বাবা-মা হিসেবে আমাদের প্রতি, অত্যন্ত সদয় ছিলনে এবং আছেন। কখনও ওদের কারও জন্য প্রাইভেট টিউটর রাখতে হয়নি। কোনো বিষয় বুঝতে না পারলে বন্ধুদের কাছ থেকে, অথবা ক্লাশের পরে শিক্ষকের কাছ থেকে বুঝে নিতো। বাড়িতে প্রাইভেট টিউটর নাই, সেজন্য ক্লাসে বাধ্য হয়ে মনোযোগী থাকতো। একবার ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে অবস্থিত বিখ্যাত একটি স্কুলের একজন শিক্ষক তাঁর কাছে প্রাইভেট নাপড়ার জন্য আমার মেয়েকে ইচ্ছাকৃতভাবে কম নম্বর দিয়েছিলো। মেয়েকে অনেক কষ্ট করে শেষমেষ বুঝাতে পেরেছিলাম যে তোমার বোর্ডের পরীক্ষার খাতা অবশ্যই এই শিক্ষক দেখবেন না। আমার মেয়ে বোর্ডের পরীক্ষায় মাত্র ৬ নম্বরের জন্য মেধা তালিকায় স্থান মিস করেছিলো ! উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করার পর ওদের লেখাপড়ার জন্য আমাকে কোনো অর্থ ব্যয় করতে হয়নি। তিনজনই ১০০% স্কলারশিপ নিয়ে দেশে এবং বিদেশে উচচ শিক্ষা শেষ করে যারযার পেশায় সাফল্যের সাথে নিয়োজিত আছে। সেজন্য আল্লাহর কাছে হাজার শুকরিয়া আদায় করছি। চাকুরি জীবনের প্রথম দিকে শিশু, কিশোর এবং প্রাপ্তবয়স্কদের শিক্ষাদান এবং শিক্ষাগ্রহণের উপর ট্রেইনিং নিতে হয়েছিলো। সেখানে যা কিছু শেখানো হয়েছিলো তা নিজের ছেলেময়েদের উপর প্রয়োগ করে এমন সুফল পাওয়া গেছে বলে আমি মনে করি। এজন্য কখনও কখনও আপনজনদের সমালোচনা সইতে হয়েছে। যেমন, বাচ্চাদের জন্য প্রাইভেট টিউটর না রাখার জন্য, বিশেষ করে মাধ্যমিক এবং উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার পূর্বে, আমাকে অনেকে কৃপণ বলে আখ্যায়িত করেছিলো। তাই বলে আমি নিজে ওদের পড়াইনি। শুধু বলা ছিলো, যদি মনে করো কোনো বিষয় বুঝতে কষ্ট হচ্ছে এবং সে বিষয়ে আমি তোমাকে সাহায্য করতে পারি, তাহলে দিনরাত্রি যে কোনো সময়ে আমার কাছে চলে আসবে। খুব কম সময়ই ওরা আমার কাছে আসতো। ব্যক্তিগত এসব কথা বলার জন্য ক্ষমা চাইছি। কথাগুলো কোনো প্রকার বড়াই করার জন্য বলছি না। বিনয়ের সাথে বলছি। আমার অভিজ্ঞতা থেকে হয়তো আমার মতো অন্য কোনো অভিভাবক উপকৃত হতে পারেন, এই আশায়।
0 Comments:
Post a Comment
Subscribe to Post Comments [Atom]
<< Home