Ashraf’s Column

Tuesday, June 10, 2014

ক্যাডেট কলেজের টুকরো স্মৃতি: ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজ: পর্ব ১১: কিছু উল্লেখযোগ্য ঘটনা

(এক) আর্মিতে অনেক মজার মজার জোক বা চুটকি প্রচলিত আছে। জোকগুলেো সৃষ্টি হয়েছে মূলত: আর্মি জীবনের সুখদু:খের অভিজ্ঞতা থেকে। প্রায় প্রতিটি জোকেরই কিছু-না-কিছু শেখার বিষয় থাকে। এমন একটি বহুল প্রচলিত জোক: One can do a job in three ways. They are the right way, the wrong way, and the army way. The last one is neither right nor wrong but serves the purpose. যার সরল অর্থ করলে দাঁড়ায়, যেকোনো কাজ তিনভাবে করা যেতে পারে। শুদ্ধভাবে, ভুলভাবে এবং আর্মির মতো করে। শেষের প্রক্রিয়াটি শুদ্ধও নয়, ভুলও নয়, তবে কাজ চলে যায় ! সেবার তেমন একটি অভিজ্ঞতা হলো। সকল শ্রেণীর কর্মকর্তা-কর্মচারিদের নিয়ে কলেজ চত্বরে অন্যান্য গাছের চারার সাথে অনেক কাঁঠাল গাছের চারা লাগিয়েছিলাম। ছোটোবেলা থেকে কাঁঠাল গাছের প্রতি আমার প্রচন্ড রকমের দূর্বলতা ছিলো, এখনও আছে। কাঁঠাল, কাঁচা অথবা পাকা, খাদ্য হিসেবে মানুষের জন্য অত্যন্ত পুষ্টিকর। এর ‘বুচরা’ দুগ্ধবতী গাভীর জন্য খুব পুষ্টিকর। ঘরবাড়ি, ফার্নিচার এমনকি কাঠের সিন্দুক বানাবার জন্য মজবুতি, আঁশ এবং টেক্সচারের দিক থেকে সেগুনের পরই এর স্থান। আর কাঁঠালের পাতা তো গরু এবং ছাগল, বিশেষ করে ছাগলের জন্য প্রবাদসম খাদ্য। ঝিনাইদহ অঞ্চলের মাটি ও জলবায়ু কাঁঠাল গাছের জন্য খুবই উপযোগী। কর্মকর্তা-কর্মচারিদের প্রায় সবাই গরু-ছাগল পুষতেন। তাই সবাইকে ‘দরবারে’ কঠোরভাবে সতর্ক করে দিলাম যেনো কারও গরু-ছাগল দ্বারা কাঁঠালের চারার কোনো ক্ষতি না হয়। মালি ও চৌকিদারদের আদেশ দেওয়া হলো কড়া নজর রাখার জন্য। কয়েকদিন না যেতেই হেড মালি দৌড়ে এসে জানালো অমুক সিনিয়র শিক্ষকের ছাগলকে কাঁঠাল চারার পাতা ভক্ষণরতো অবস্থায় আটক করা হয়েছে। পরবর্তী আদেশ চাই। কলেজের দেয়ালের বাইরে স্থানীয় পৌরসভা পরিচালিত খোঁয়াড় আছে। ধৃত ছাগলটি সেখানে জমা দিলে কিছু নগদ টাকা জরিমানা দিয়ে মালিক সেটা ছাড়িয়ে আনতে পারবে। এতো কিছু বলার পরেও ছাগলের (মালিকের নয়) এমন বেয়াদবি সহ্য হলো না। মনেমনে ভবালাম, এখনই সুযোগ ! বিড়াল পহেলা রাতেই মারতে হবে ! এমন এক্সাম্পল সেট করতে হবে যাতে ক্যাম্পাসের সব গরু-ছাগলের মালিক হেদায়েত হয়ে যায়। হুকুম দিলাম, এখনই জবাই করে ছাগলের গোস্ত পুরোটা ক্যাডেট মেসে দিয়ে দাও। চামড়া বাজারে বিক্রি করে টাকাটা ক্যাডেট মেসের পেটি ক্যাশে জমা করে দাও। যেই কথা সেই কাজ। ছাগলের মালিক বিষয়টি জানার আগেই ছাগলটি গোস্ত হয়ে মেসের ফ্রিজে স্থান পেলো। ছাগলের মালিক যখন জানলেন তখন তিনি আর এ নিয়ে কোনো রা করলেন না। তবে ঘটনাটি ওয়াইল্ড ফায়ারের মতো মানুষের মুখেমুখে শুধু ক্যাম্পসে নয়, ঝিনাইদহ শহরে পৌছে গেলো। সপ্তাহ দু’য়েক পরে মেস ম্যানেজারকে ডেকে জব্দকৃত ছাগলের গোস্তের পরিমান এবং কনট্র্যাক্ট রেটে তার দাম, এবং চামড়ার বিক্রয় মূল্য জেনে নিয়ে পুরো টাকাটা ছাগলের মালিককে দিয়ে দিতে বললাম। টাকাটা পাবার পর ছাগলের মালিক ভদ্রলোক একদিন এসে অতি লজ্জিতভাবে আমার সাথে দেখা করে ক্ষমা চাইলেন। ততোদিনে আমার উদ্দেশ্য হাসিল হয়ে গেছে। এর পর যতোদিন ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজে ছিলাম, কারও গরু বা ছাগলে ক্যাম্পাসের কোনো ফুল বা ফল গাছের পাতা খেয়েছে, এমন খবর কানে আসেনি। (দুই) ১৯৮০ এর দশকের মাঝামাঝি সময়ের কথা। আমি তখন আর্মি হেডকোয়ার্টার্সে কাজ করি। একদিন দুপুর বেলা, তখনও অফিস ছুটি হতে কিছুটা সময় বাকি, আমার স্ত্রী বাসা থেকে টেলিফোন করে জানালেন, ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজ থেকে একজন স্টাফ একটি বিশাল পাকা কাঁঠাল নিয়ে এসেছে। বলছে, প্রিনসইপিাল সাহেব পাঠিয়েছেন। এখন কী করবো ? এখানে উল্লেখ্য যে, আমার পুরো চাকুরি জীবনে নিজের ভাইবোন বা নিকট আত্মীয় ছাড়া অন্য কারও আমার বাসায় কোনো মিষ্টির প্যাকেট, ফলের ঝুড়ি বা অন্য কিছু নিয়ে আসা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ছিলো। না জেনে যদি কেউ এনে ফেলে তবে তা বিনয়ের সাথে প্রত্যাখ্যান করা হতো, আমি বাসায় থাকি বা না থাকি। বাংলাদেশের প্রক্ষিতে এর কারণ ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না। আমার ছেলেমেয়েদের বিয়ের অনুষ্ঠানে বা জন্মদিনে আমি সতর্কতার সাথে সেসব লোকদের আমন্ত্রণ জানাতে বিরত থেকেছি যাদের সাথে আমার অফিসের দূরতম কোনো ব্যাবসায়িক সম্পর্ক ছিলো। কাঁঠাল বহনকারিকে বারান্দায় বসিয়ে রাখতে বলে আমি টেলিফোনে ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজের তৎকালীন প্রিন্সিপাল লে: কর্নেল নূরুন্নবীকে (পরে কর্নেল, বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত। ঢাকার মাইলস্টোন স্কুল ও কলেজের প্রতিষ্ঠাতা।) টেলিফোন করে বিষয়টি জানতে চাইলাম। প্রিন্সিপাল আমারই কোরের অতি ঘনিষ্ট জুনিয়র কলিগ ছিলো। টেলিফোনে প্রথমেই তাকে প্রচন্ড কিছু বকা (ঝাড়ি) দিলাম। বললাম, তুমি তো ভালো করে জানো আমি আমার বাসায় কারো এসব আমকাঁঠাল আনা একেবারে অনুমেোদন করি না। তারপরও সব জেনেশুনে কেনো আমার বাসায় কাঁঠাল পাঠিয়েছো ? পাঠাবার আগে কেনো আমার অনুমতি নেওনি ? আমার পক্ষ থেকে বকাঝকা শেষ হলে নবী বললো, স্যার, আপনার সব কথা মেনে নিলাম। এবার দয়া করে আমার কথা একটু শুনুন। আপনি প্রিন্সিপাল থাকার সময় যে কাঁঠালের চারা লাগিয়ে গিয়েছিলেন সেগুলোতে এবার প্রথম ফল ধরেছে। কলেজের চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারিদেরকে তাদের পরিশ্রমের স্বীকৃতি হিসেবে প্রথম ফলনের সব কাঁঠাল নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নিতে বললাম। তারা সবাই এক বাক্যে বললো, এসব কাঁঠাল গাছ প্রাক্তন প্রিন্সিপাল আশরাফ স্যার নিজ উদ্যোগে আমাদের উৎসাহ ও প্রেরণা দিয়ে লাগিয়েছিলেন। এর মধ্যে আনেক গাছ তিনি নিজ হাতে লাগিয়েছিলেন। এসব গাছের কাঁঠাল তাঁকে না দিয়ে আমারা খেতে পারবো না। উনি এখন ঢাকায় আছেন। ওনার জন্য অন্তত: একটি কাঁঠাল হলেও পাঠিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হোক। নবী আরও বললো, এটা কর্মচারিদের আন্তরিক আনুরোধ ছিলো, যা ফেলে দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব ছিলো না। আপনার প্রাক্তন কর্মচারিদের আপনার প্রতি সম্মান ও ভালোবাসার প্রতীক হিসেবে কাঁঠালটি আপনাকে পাঠিয়েছে। এতে আমার কোনো ভূমিকা নেই। এখন রাখা না রাখা আপনার ইচ্ছে। রাখতে না চাইলে বহনকারির হাতে ফেরত পাঠিয়ে দিন। আমি কর্মচারিদের সেভাবে বলে দেবো। আর পূর্বানুমতির কথা যদি বলেন, তাহলে বলবো, কাজটি আমি জেনেশুনে করেছি। অনুমতি চাইলে আপনি কখনও তা দিতেন না। এরপর আমার পক্ষে কাঁঠালটি ফিরিয়ে দেওয়া আর সম্ভব হলো না। ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজের কর্মচারিদের প্রতি কৃতজ্ঞতায় আমার মন ভরে গেলো। নবীকে বললাম, কাঁঠাল রেখে দিলাম। ওদেরকে আমার কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ জানিয়ে দিও। আমার ও আমার পরিবারের সদস্যদের জন্য দোয়া করতে বলো। অফিস থেকে বাসায় এসে কাঁঠাল বহনকারিকে নিয়ে একসাথে লাঞ্চ করে একই কথা বলে তাকে বিদায় জানালাম। জীবনে অনেক কাঁঠাল খেয়েছি। কন্তু সেদিনের মতো তৃপ্তি নিয়ে কোনো কাঁঠাল খেয়েছি বলে মনে পড়ে না। (তিন) তখনকার ক্যাডেট কলেজের ক্যাডেটদের জন্য নির্ধারিত দন্ডবিধিতে অপরাধকে দুই শ্রেণীতে ভাগ করা ছিলো। এক, মেজর অফেন্স অর্থাৎ বড় অপরাধ। দুই, মাইনর অফেন্স অর্থাৎ ছোটো অপরাধ। কোনো ক্যাডেট বড় কোনো অপরাধ করলে তাকে কলেজ থেকে অবশ্যই ‘উইথড্র’ বা বহিস্কার করার হুকুম ছিলো। ধূমপান বড় অপরাধ বলে গণ্য হতো। একাদশ শ্রেণীর একটি ছেলে ধূমপান করে ধরা পড়লো। দন্ডবিধি অনুযায়ী তাকে কলেজ থেকে ‘উইথড্র’ করার আদেশ দিলাম। ছেলেটির বাবা নিকটস্থ কোনো এক জেলা বারের এডভোকেট ছিলেন। তিনি এসে ভাইস প্রিন্সিপাল মি: রবকে এসে ধরলেন। যখন দেখলেন কোনো যুক্তিতে কাজ হচ্ছে না তখন তিনি এক মজার যুক্তি দেখালেন। বললেন, আজকাল পৃথিবীর সবাই সিগারেট খায়। আমার ছেলে না হয় একটু খেয়েছে। তাতে এমন কী হয়েছে ? তাই বলে আপনারা তাকে কলেজ থেকে বের করে দেবেন ! এটা অন্যায়। মি: রব জবাবে যা বলেছিলেন তা আজও আমার মনে আছে। তিনি বলেছিলেন, পৃথিবীর সবাই বিয়ে করে। যান, আপনার ছেলেকেও এখনই বিয়ে দিয়ে দিন ! (৪) বেয়াদবি করার জন্য হাউস মাস্টার একটি ছেলেকে বকা দিলেন। ছেলেটি ক্ষেপে গিয়ে হাউস মাস্টারকে খুব অভদ্র ভাষায় পাল্টা গালি দিলো। ছেলেটির আপন চাচা আর্মির সিনিয়র অফিসার ছিলেন। সে ভেবেছিলো তাকে কোনো কঠোর সাজা দেওয়া যাবে না। ছেলেটিকে পত্রপাঠ ‘উইথড্র’ বা বহিস্কার করে বাড়ি পাঠিয়ে দিলাম। ছেলেটির চাচা, যিনি আমার সিনিয়র এবং পরিচিত ছিলেন, আমাকে টেলিফোনে বহুবার অনুরোধ করলেন ‘উইথড্রয়াল’ বাতিল করার জন্য। তাঁকে আমি বুঝালাম, ক্যাডেট কলেজ বিধি অনুযায়ী একবার কোনো ক্যাডেটকে কলেজ থেকে বহিস্কার করা হলে তাকে ফিরিয়ে আনার কোনো বিধান নেই। ছেলেটির বাবা যিনি যশোর জেলা বারের উকিল ছিলেন জেলা জজের আদালতে আমার বিরুদ্ধে মামলা করে দিলেন। প্রথমে আমি মামলার খবর জানতাম না। একদিন অন্য আর একজন যশোরের গার্ডিয়ান, যিনি নিজে উকিল ছিলেন, আমার অফিসে এসে মামলার খবর জানিয়ে বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চাইলেন। সব শোনার পর তিনি খুব দু:খ প্রকাশ করে মামালার জন্য কোনো চিন্তা না করতে বললেন। মামলার দিন আমার আদালতে হাজির হবার প্রয়োজন নেই। আমার পক্ষ নিয়ে তিনি বিনা পারিশ্রমিকে মামলায় লড়বেন বলে আশ্বস্ত করলেন। পরে শুনেছিলাম জজ সাহেব মামালা কোনো শুনানি না করে এই বলে খারিজ করে দেন যে, কোনো শিক্ষক যদি তাঁর ছাত্রকে বেয়াদবির জন্য শাস্তি দিয়ে থাকেন তাহলে যথার্থ কাজটিই করেছেন। এজন্য শিক্ষকদেরকে যদি আমরা বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে শুরু করি তাহলে দেশটি শিক্ষিত বয়াদবে ভরে যাবে। সমাজে শিক্ষিত ভদ্রলোক আর পাওয়া যাবে না। (৫) দুর্ঘটনায় স্থানীয় সরকার পক্ষীয় এম পি সাহেবের ভাগ্নে আহত হয়েছে। তাকে যশোর সদর হাপাতালে নিয়ে যেতে হবে। ভাইস প্রিন্সিপাল মি: রব তাঁর পরিচিত হওয়ায় এম পি সাহেব টেলিফোন করে কলেজের এম্বুলেন্স দ্রুত পাঠাতে বললেন। মি: রব জানালেন, কলেজের এম্বুলেন্স শুধুমাত্র অসুস্থ ক্যাডেটদের পরিবহনের জন্য। বিধি অনুযায়ী অন্যদের প্রয়োজনে এটা ব্যবহার করা নিষিদ্ধ। তারপরও এম পি সাহেব আমাকে টেলিফোন করলেন। আমিও একই জবাব দিলাম। এম পি সাহেব ভীষণ ক্ষেপে গিয়ে আমাকে অভদ্র ভাষায় গালি দিয়ে বললেন, আমাকে তিনি দেখে নিবেন। মহামান্য প্রেসিডেন্টের কাছে আমার বিরুদ্ধে নালিশ করবেন। আমি তাঁকে ঠান্ডা মাথায় স্মরণ করিয়ে দিলাম, মহামান্য প্রসিডেন্ট আমাকে কাকুল মিলিটারি একাডেমি থেকে চিনেন। উনিই আমাকে প্রিন্সিপাল হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন। আমাদের দুর্ভাগ্য শুধুমাত্র রাজনীতি করার জন্য তাঁর মতো একজন ভালো মানুষকে আপনার মতো একজন বাজে লোকের সাথে রাজনৈতিক সম্পর্ক রাখতে হচ্ছে। যাহোক, বিষয়টির এখানে সমাপ্তি ঘটে। মহামান্য প্রেসিডেন্টের অফিস থেকে কেউ কোনো দিন এ নিয়ে আমাকে কোনো প্রশ্ন করেনি। (৬) আমার বড় মামার ছোটো ছেলে ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজে ভর্তি হবার জন্য লিখিত পরীক্ষা দিলো। তখনকার রেওয়াজ অনুযায়ী ৫০ জন প্রার্থীকে চূড়ান্তভাবে সিলেক্ট করার জন্য লিখিত পরীক্ষার ফলের ভিত্তিতে কমবেশি ১৫০ জন প্রার্থীকে মৌখিক পরীক্ষা এবং মেডিক্যাল টেস্টের জন্য ডাকা হতো। দেখা গেলো আমার মামাতো ভাইটি মাত্র তিন নম্বর কম হবার কারণে মৌখিক পরীক্ষার জন্য কোয়ালিফাই করছে না। এখানে বলা যেতে পারে, তখনকার দিনে আমাদের কোনো কম্প্যুটার ছিলো না। দাদার আমলের টাইপরাইটার ছিলো সকল দাপ্তরিক কাজের জন্য একমাত্র ভরষা। ভর্তি পরীক্ষার টেবুলেশন করা, মেধা তালিকা প্রস্তুত করা, ইত্যাদি সকল কাজ নিরাপত্তা বজায় রেখে নিজ দায়িত্বে প্রিন্সিপালকে করতে হতো। সাধারণত: এ কাজে কেরানিদের সম্পৃক্ত করা হতো না। প্রিন্সিপাল নিজে অতি বিশ্বস্ত এক-দুজন শিক্ষককে সাথে নিয়ে কাজটি করতেন। সেবার আমার মামাতো ভাই ভর্তি পরীক্ষা দিয়েছিলো, এ কথা আমি ছাড়া আর কারও জানা ছিলো না। আমি ইচ্ছে করলে লিখিত পরীক্ষার মেধা তালিকায় তিন নম্বর নিচে নেমে আমার ভাইকে মৌখিখ পরীক্ষার জন্য ডাকতে পারতাম। সেটা করলে মৌখিক পরীক্ষার জন্য ১৫০ জনের বদলে ১৫৭/১৫৮ জন কোয়ালিফাই করতো। কখনও কখনও, বিশেষ যোগ্যতাসম্পন্ন প্রার্থীকে (যেমন ভালো খেলোয়াড়, অভিনেতা ইত্যাদি) সুযোগ দেওয়ার জন্য, এমন করা যে হতো না, তা নয়। প্রক্রিয়াগত দিক থেকে কাজটা করা তেমন অনিয়ম বা অন্যায় হতো না। কারও চোখেও পড়তো না। পরে মৌখিক পরীক্ষায় অনেক বেশি নম্বর প্রদান করে ভাইকে চূড়ান্তভাবে সিলেক্ট করা যেতো। কিন্তু আমার বিবেক সায় দিলো না। সবাইকে না হয় ফাঁকি দিলাম, আল্লাহকে তো ফাঁকি দেওয়া যাবে না ! যাহোক, কাজটি করিনি। এ নিয়ে কারও সাথে কথাও বলিনি। আমার কোনো অনুশোচনাও ছিলো না। রেজাল্ট বের হবার পর বড় মামা যখন দেখলেন তাঁর ছেলে পাশ করেনি, তখন তিনি মনে খুব আঘাত পেয়েছিলনে। গ্রামের লোকেরা ইতোমধ্যে মামাকে কংগ্রাচ্যুলেট করতে শুরু করেছিলো। আপন ভাগ্নে ক্যাডেট কলেজের প্রিন্সিপাল। তাঁর ছেলেকে আটকায় কে ? এ ঘটনার পর মামা আমার উপর অভিমান করে প্রায় এক বছর আমার বাসায় আসেননি। পরবর্তী কালে আমার সেই মামাতো ভাইটি ঢাকা কলেজ থেকে অত্যন্ত কৃতিত্বের সাথে এইচ এস সি পাশ করে আর্মিতে কমিশন লাভ করে। বর্তমানে সে একজন কর্মরত সিনিয়র অফিসার।

Monday, June 02, 2014

ক্যাডেট কলেজের টুকরো স্মৃতি: ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজ: পর্ব ৮: দুষ্টামির পক্ষে ওকালতি !

ক্যাডেট কলেজের টুকরো স্মৃতি: ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজ: পর্ব ৮ দুষ্টামির পক্ষে ওকালতি ! আমাকে যাঁরা ব্যক্তিগতভাবে চেনেন তাঁরা হয়তো এই লেখার শিরোনাম দেখে বলবেন, বুঝেছি, নিজে দাদা-নানা হয়েছো তো, তাই ছোটোদের হয়ে ওকালতি করতে এসেছো ! কথাটা পুরো না হলেও অনেকটা সত্যি। বিষয়টি গভীরে গিয়ে বুঝার জন্য আমাকে কিছুটা বুড়ো হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছে বৈ কি! কিছুটা নিজের নাতিনাতনিদের দেখে, কিছুটা মাস্টারি জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে এবং বাকিটা পড়াশুনা করে যা জেনেছি, আজকে তা-ই পাঠকদের সাথে শেয়ার করতে চাই। ছোটোদের যে ক’টি সহজাত প্রবৃত্তি আছে তার মধ্যে দুষ্টামি অন্যতম। মোটামুটি পাঁচ বছর বয়স থেকে শিশুদের বুদ্ধিবৃত্তির বিকাশ ঘটে। এজন্য শিক্ষা মনোবিজ্ঞানীরা পাঁচ বছর বয়স হবার আগে বাচ্চাদের আনুষ্ঠানিক শিক্ষাদান অনুমোদন করেন না। পাঁচ বছর বয়স থেকে শিশুরা অল্পঅল্প ভালোমন্দ, কী করলে কী হতে পারে এসব বুঝতে শেখে। আর তখন থেকে দুষ্টামি করা শুরু হয়। দুষ্টামি করার নানা উদ্দেশ্য হতে পারে। নির্দোষ আনন্দ বা তামাসা করার জন্য হতে পারে। কোনো কঠিন কাজ বা চালাকি করে নিজের বাহাদুরি দেখাবার জন্য হতে পারে। কখনও বড়দের উপর রাগ প্রকাশ করার জন্য, বা প্রতিশোধ নেবার জন্য হতে পারে। মায়ের উপর রাগ করে সব আচার খেয়ে ফেলে বয়াম খালি করে ফেলা আমাদের ছোটোবেলায় খুব কমন দুষ্টামি ছিলো। উদ্দেশ্য যা-ই হোক, দুষ্টামি করতে হলে বুদ্ধি লাগে। দুষ্টামি করতে হলে লক্ষ্য নির্ধারণ করতে হয়। প্ল্যান করতে হয়। প্ল্যান কার্যকর করার একাধিক পন্থা থেকে সবচাইতে কার্যকরটি বেছে নিতে হয়। এসব কিছু করার জন্য চিন্তাধারার মধ্যে সংগতি (coherence) ও ধারাবাহিকতা (continuity) রাখতে হয়। দুষ্টামির পরিণতি দেখার জন্য বা উপভোগ করার জন্য অবশ্যই কাউকে না কাউকে টার্গেট বা লক্ষ্য স্থীর করা হয়। বোকারা দুষ্টামি করতে পারে না। করলেও তা দুষ্টামি না হয়ে বোকামি হয়। ছোটোদের মধ্যে যার যতো বেশি বুদ্ধি তার দুষ্টামি ততো তীক্ষ্ন ও ফলপ্রসূ হয়। বড়দের উচিত হবে, দুষ্টামি যাতে নিরাপত্তা ও ভদ্রতার সীমার মধ্যে থাকে সে সম্পর্কে ছোটোদের সচেতন করা। এজন্য মারধর বা বকাঝকা না করে বন্ধুর মতো প্রয়োজনীয় পরামর্শ ও উৎসাহ দেওয়া। একটা কথা মনে রাখা জরুরি, দুষ্টামি বখাটে হবার লক্ষণ নয়, বুদ্ধিমত্তার লক্ষণ। ইস্, আমাদের ছোটো বেলায় মাবাবারা যদি বিষয়টা জানতেন! তাহলে অনেক মারপিট থেকে রক্ষা পেতাম ! ছোটোবেলায় লেখাপড়ার জন্য মারপিট খেতে হয়নি। যা খেয়েছি তার সবটাই ছিলো দুষ্টামি করার জন্য। এখন কথা হলো, ছোটোরা কতো বয়সে বড় হয় ? এ প্রশ্নের কোনো সুনির্দিষ্ট উত্তর নেই। স্থান, কাল, সমাজ ভেদে ছোটোদের মধ্যে বুদ্ধি বিকাশের তারতম্য ঘটে। বাংলাদেশের বারো বছর বয়সী একটি ছেলে একটি নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে সাধারনভাবে যে প্রতিক্রিয়া দেখাবে, ইউরোপ, আমিরিকা বা আফ্রিকার একই বয়সী একটি ছেলে অভিন্ন পরিস্থিতিতে সে প্রতিক্রিয়া দেখাবে না। আমাদের সমাজে বর্তমানে ছোটোদের বয়স কমবেশি ১৫/১৬ বছর হয়ে গেলে তারা দুষ্টামির বয়স পার করে ফেলে বলে মনে করা হয়। এবার আসা যাক দুষ্টামির সীমানা কতদূর গিয়ে শেষ হয়ে সেটা বদমাশির পর্যায়ে চলে যায়। দুষ্টামির উদ্দেশ্য যদি হয় কাউকে শারীরিক বা মানসিকভাবে কষ্ট দেওয়া বা ক্ষতিগ্রস্ত করা তাহলে সেটা আর দুষ্টামি থাকে না, বদমাশি হয়ে যায়। বদমাশিকে কখনও হাল্কাভাবে নেবার উপায় নেই। কেউ বদমাশি করলে তাকে সেজন্য কমবেশি সাজা পেতে হবে। সে সাজা সামান্য ভর্ৎসনা থেকে শুরু হতে পারে। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর থেকে আমাদের উঠতি বয়সের ছেলেরা অনেকে একটি বিশেষ ধরনের বদমাশি কাজ করে আসছে। আর তা হলো মেয়েদের নানাভাবে উত্যক্ত করা। এমনকি রাস্তাঘাটে প্রকাশ্যে মেয়েদের কাছে জোর করে প্রেম নিবেদন করা, তাদের গায়ে হাত দেওয়া, মেরে জখম করা, ডিজিটাল টেকনোলজির মাধ্যমে ইন্টারনেটে আপত্তিকর ছবি প্রকাশ করা ইত্যাদি। আমাদের সময়ের দেখেছি, উঠতি বয়সের ছেলেরা কেউকেউ খেলাধুলা, লেখালেখি, গানবাদ্য, নাটক-থিয়েটার, বিতর্ক-আবৃত্তি প্রতিযোগিতা, এসব বিভিন্ন কর্মকান্ডসহ নানা সৃজনশীল কর্মে অংশ গ্রহণ করে এবং তাতে উৎকর্ষ অর্জন করে সমবয়সী মেয়েদের মন জয় করার চেষ্টা করতো। তাতে কপাল ভালো হলে কোনো কোনো মেয়ে পটে যেতো, প্রেমে পড়ে যেতো। কোনো একজন মেয়ে প্রেমে না পড়তে চাইলে, তার পিছে ঘুরে সময় নষ্ট না করে, ছেলেটি অন্য মেয়ের কাছে প্রেম নিবেদন করতো। কিন্তু প্রেমের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করার কারণে একটি মেয়ের সর্বনাশ করা, জীবননাশ হোক এমন বদমাশি করা তো দূরের কথা, কাউকে এমন ভাবতেও দেখিনি। একটি ছেলে যদি নিজের ব্যক্তিগত সাফল্য এবং অর্জন দিয়ে কোনো মেয়ের মন জয় করার যোগ্যতা লাভ করে তাহলে তাকে কোনো মেয়ের মন পাবার জন্য মেয়েদের স্কুল-কলেজের গেইটে তীর্থর কাকের মতো দাঁড়িয়ে থাকতে হতো না। অথবা, মোটর সাইকেলে চড়ে মেয়েদের রিক্সার পেছনে ঘুরঘুর করতে হতো না, রিক্সার ফাক দিয়ে বেড়িয়ে আসা মেয়েদের ওড়না ধরে টানাটানি করতে হতো না। এসব কারণে আমরা বড়রা শুধু ছেলেদের মন্দ বলি, গালাগালি করি। কিন্তু বয়সের কারণে জাগ্রত তাদের প্রেমের বাসনা চরিতার্থ করার কোনো সুস্থ শালীন আউটলেটের বা পথের সন্ধান দিতে পারছি না। যাঁরা রাষ্ট্র ও সমাজ পরিচালনার দায়িত্বে আছেন, আশা করি, বিষয়টি ভেবে দেখবেন। স্কুল-কলেজগুলিকে শুধুমাত্র জিপিএ ফাইভ পাবার কারখানা না বানিয়ে সেখানে যাতে সকল প্রকার কো-কারিকুলার এক্টিভিটির চর্চা করা হয় তার ব্যবস্থা করলে এসব বদমাশি বহুলাংশে কমে যাবে। তারুণ্যের অমিত শক্তি ও সম্ভাবনাকে শুধু লেখাপড়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে তাকে চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ার সুযোগ করে দিতে হবে। ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজে আমার থাকাকালীন সময়ে সংঘটিত ছেলেদের একটি দুষ্টামির ঘটনা বলে এবারের লেখা শেষ করতে চাচ্ছি। ক্যাডেট মেসের সামনে একটি ছোট্ট সবুজ লন ছিলো। ক্যাডেটদের মনোরঞ্জনের জন্য তাতে বিভিন্ন রংয়ের কিছু গার্ডেন লাইট লাগিয়েছিলাম। একদিন সকাল বেলা হঠাৎ রিপোর্ট পেলাম কে বা কারা সবগুলো লাইট ভেংগে ফেলেছে। বুঝতে অসুবিধা হলো না, ছেলেরা প্রশাসনের কারো কোনো কথায় বা কাজে রুষ্ট হয়ে এমনটি করেছে। ছেলেরা ভাবলো, প্রিন্সিপাল সাহেব নিশ্চয়ই রেগেমেগে ভয়ংকর কিছু একটা করবেন। পক্ষান্তরে আমি কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালাম না। ভাবখানা এমন দেখালাম যে কিছুই হয়নি। খবর পেলাম, একাদশ শ্রেণীর ক্যাডেটরা মেসের ভারপ্রাপ্ত অফিসারকে অনুরোধ করেছিলো মেনুর বাইরে কিছু খাবার আইটেম দেওয়ার জন্য, যা তিনি যথার্থ কারণে দিতে অস্বীকার করেন। যাহোক, পরবর্তী সাপ্তাহিক সমাবেশে আমি বিষয়টি উল্লেখ করে ক্যাডেটদের উদ্দেশ্যে বললাম, আমি তোমাদের মনোরঞ্জনের জন্য মেসের লনে গার্ডন লাইট লাগিয়েছিলাম। তোমাদের কেউকেউ সেটা পসন্দ করোনি। তাই ভেংগে ফেলেছো। কষ্ট করে ভাংগার দরকার ছিলো না। আমাকে বললে আমিই খুলে ফেলতাম। আর যদি তোমাদের মধ্যে কারো আত্মীয়ের ঝিনাইদহ শহরে ইলেকট্রিক সরঞ্জামের দোকান থেকে থাকে, এবং তার পৃষ্ঠপোষকতা করার জন্য কেউ লাইটগুলো ভেংগে থাকো, তাহলে জেনে রাখো, আমি নতুন করে আর এসব লাইট লাগাবো না। তাছাড়া নতুন লাইট লাগাবার জন্য যে টাকা খরচ হবে সে টাকা নতুন করে সরকার কলেজকে দেবে না। বাজেটে যা টাকা দেওয়া হয়েছে সেখান থেকে এ অতিরিক্ত খরচ মেটাতে হবে। তাতে তোমাদের অন্যান্য প্রয়োজন মেটাবার জন্য যেমন খাবার, জামাকাপড়, বইপত্র, খেলার সামগ্রী ইত্যাদি ক্রয়ের জন্য যে টাকা বরাদ্দ আছে সেটাতে টান পড়বে। কোনোরকম চমক ছাড়া সেদিনের সমাবেশ শেষ হলো। তিনচার দিন পরের কথা। একাদশ শ্রেণীর পক্হ থেকে পাঁচছ’জন ক্যাডেট এলো আমার অফিসে দেখা করতে। তারা বললো, স্যার, গার্ডেন লাইটগুলো আমরা ভেংগেছি। মেসের ভারপ্রাপ্ত আফিসারকে আমরা একটা অনুরোধ করেছিলাম। তিনি তা রাখেননি। আমরা খুব ক্ষুদ্ধ হয়ে লাইটগুলো ভংগেছি। কাজটি করা আমাদের উচিত হয়নি। আমরা দু:খিত। এবারের মতো আমাদের মাফ করে দিন। দয়া করে লাইগুলো লাগিয়ে দিন। ভবিষ্যতে আর এমন হবে না। আমি ছেলেদের চোখেমুখে আন্তরিক অনুতাপের ছায়া দেখলাম। হেসে দিয়ে বললাম, বিষয়টি বুঝতে পারার জন্য ধন্যবাদ। মন্দ কাজ করার পর নিজ থেকে অনুতপ্ত হওয়ার পর আর বলার কিছু থাকে না। এবার ক্লাসে যাও। আগামীকালের মধ্যে লাইটগুলো যাতে লেগে যায় সে ব্যবস্থা করা হবে। এ ঘটনার পর কোনো ক্যাডেট সচেতনভাবে কলেজের কোনো সম্পত্তি বিনষ্ট করেছে বলে শুনিনি।

ক্যাডেট কলেজের টুকরো স্মৃতি: ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজ: পর্ব ১০: ক্যাডেটের কান্না

রবীন্দ্রনাথের ‘ছুটি’ নামক ছোটো গল্পটি যাঁরা পড়ছেন তাঁদের গল্পেটির প্রধান চরিত্র ফটিকের কথা নিশ্চয়ই মনে আছে। ক্যাডেট কলেজে ছেলেরা যখন প্রথম এসে ভর্তি হয় তখন তাদের বয়স, স্বভাব এবং অনুভূতি ফটিকের মতোই থাকে। এই বয়সের বাচ্চারা ভীষণ স্নেহের কাংগাল হয়। মাবাবা, ভাইবোন থেকে দূরে চলে গেলে অল্প দিনের মধ্যেই তাদের জন্য কাতর হয়ে পড়ে। ক্যাডেট কলেজে রাত্রি সারে দশটায় (শীতকালে দশটায়) লাইটস আউট হয়। অর্থাৎ হাউসের সিকিউরিটি লাইট ছাড়া বাকি সকল বাতি নিভিয়ে ফেলতে হয়। ডিউটি মাস্টাররা একটা রাউন্ড দিয়ে যারযার ঘরে ফিরে যান। নাইটগার্ডরা পাহারায় থাকে। প্রায় প্রতি রাত্রে এগারোটার দিকে আমি পায়ে হেঁটে রাউন্ড দিতে বের হতাম। সংগে কাউকে রাখতাম না। ঝিনাইদহে রাতের বেলা সাঁপের খুব উপদ্রব ছিলো। সাঁপের আক্রমণ থেকে বাঁচার জন্য হাতে একটি টর্চ এবং ছোটো লাঠি রাখতাম। কারও ঘুমের যাতে ব্যাঘাত না হয় সেজন্য পায়ে নরম রাবার সোলের জুতা থাকতো। ক্যাডেটদের ডর্মিটরির ভেতর দিয়ে হেটে যাবার সময় লেপের তল থেকে প্রায়ই জুনিয়র ক্যাডেটদের, বিশেষ করে নবাগতদের, ফুঁপিয়েফুঁপিয়ে কান্নার শব্দ শুনতে পেতাম। তখন আমার মনটা খুব খারাপ হয়ে যেতো। মনে পড়ে যেতো, আমি নিজেও বাইশ বছর বয়সে সুদূর কাকুলের মিলিটারি একাডেমিতে গিয়ে প্রথম প্রথম লাইটস আউটের পর বিছানায় শুয়ে বাড়ির কথা মনে করে কত না কেঁদেছি। কান্ন্ররত ছেলেটির হাউস মাস্টারকে পরদিন সকালে অনুরোধ করতাম ছেলেটির বিশেষ যত্ন নিতে। অবশ্য ছেলেটি যাতে জানতে না পারে আমি তার কান্না শুনেছি। ব্যাক্তিগতভাবে আমার আরও একটি কাজ করতে ভালো লাগতো। তা হলো, কলেজ হাসপাতালে ভর্তি ক্যাডেটদের দেখতে যাওয়া। সব সময় প্রায় দশবারোজন অসুস্থ ক্যাডেট হাসপাতালে ভর্তি থাকতো। আমার মনে পড়তো, ছোটো বেলায় অসুস্থ হলে আমার মা কতো কাতর হতেন। আমার মায়ের ফ্রিজ ছিলো না। আমার পসন্দ হতো না বলে একটার পর একটা কতো কী ফ্রেশ রান্না করে আমাকে খেতে দিতেন। আদর করে গায়েমাথায় কতো হাত বুলিয়ে দিতেন। যেমনটি সব বাংগালি মা আবহমান কাল ধরে করে আসছেন। অথচ অসুস্থ ক্যাডেটরা শুয়েশুয়ে হাসপাতলের ছাদ দেখছে। কেউবা বই পড়ে সময় কাটাচ্ছে। মেস থেকে রান্না করা যে খাবার আসে তা-ই খাচ্ছে, ইচ্ছা হোক বা না হোক। বিষয়টি নিয়ে আমার স্ত্রীর সাথে আলাপ করলাম। প্রসঙ্গত: বলা যেতে পারে ক্যাডেট কলেজে যখন আসি তখন আমার স্ত্রী রুমী ক্যাডেট কলেজের পরিবেশ-পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে নিজের লাইফস্টাইল সম্পূর্ণ বদলে ফেলে। যতো সৌখিন কাপড় আর গয়নাপাতি ছিলো, যা কলেজে পড়া ঠিক হবে, না তা সব সুটকেসে বন্ধ করে রেখে দেয়। তার যুক্তি, ছেলেরা প্রিন্সিপালের স্ত্রীকে মায়ের মতো দেখতে চাইবে, সিনমার নায়িকাদের মতো নিশ্চয়ই নয়। ছাত্রীজীবনে নিজের কলেজের প্রিন্সিপাল আপাদের কথা মনে করে তার মনে এমন চিন্তা এসেছে। সে যে এতো সহজে নিজেকে একজন সিনিয়র আর্মি অফিসারের স্ত্রীর অবস্থান থেকে একজন সাদামাটা বাংগালি মায়ের অবস্থানে নিয়ে আসবে, তা ভাবতে পারিনি। বিষয়টি কলেজের সকল কর্মকর্তা-কর্মচারি, বিশেষ করে ক্যাডেটদের, মনোযোগ আকর্ষণ করেছিলো। কলেজের সকল চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারিদের বলা হলো, প্রিন্সিপালের স্ত্রীকে “ম্যাডাম” বা “বেগম সাহেবা” বলে সম্বোধন করা যাবে না। “আম্মা” বলে ডাকতে হবে। শিক্ষাটি রুমী, যার বাবা বৃটিশ আমল থেকে একজন প্রথম শ্রেণীর গেজেটেড অফিসার ছিলেন, তার মার কাছ থেকে পেয়েছিলো। প্রথম যেদিন বিকেল বেলা রুমীকে নিয়ে কলেজ হাসপাতালে গেলাম সেদিন সে রোগীদের জন্য নিজহাতে বানিয়ে কিছু কেইক-বিস্কুট সংগে নিয়ে গিয়েছিলো। হাসপাতালের ছেলেরা সেগুলো পেয়ে এতো খুশি হয়েছিলো যে তা দেখার মতো ছিলো। এর পর থেকে প্রায় প্রতিদিন হাসপাতালে ভর্তি ছেলেদের দেখতে যেতো। তাদের সাথে তাদের বাড়ির গল্প করতো। কেউ মাথা ব্যাথা করছে বললে তার মাথায় সস্নেহে হাত বুলিয়ে দিতো, বিশেষ করে ছোটো বাচ্চাদের। কার কী খেতে মন চাইছে জেনে নিয়ে বাসায় ফিরে সে অনুযায়ী বাজার করিয়ে পরের দিন রান্না করে নিয়ে যেতো। কেউ ট্যাংরা মাছের তরকারি, কেউ কেচকি মাছের চর্চরি, কেউবা শুটকির ভর্তা, এমন সব খেতে চাইতো যা ক্যাডেট মেসে রান্না হয় না। এরপর, কোনো ক্যাডেট অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হলে তার বন্ধুরা ঠাট্টা করে বলতো, যা যা কয়েকদিন আরাম করে প্রিন্সিপাল স্যারের বাসার রান্না খেয়ে আয় ! কখনও কখনও, প্রয়জোন মনে হলে, কোনো বাচ্চার অসুখ নিয়ে রুমী মেডিকেল অফিসারের সাথেও আলাপ করতো। অল্প দিনের মধ্যে ক্যাডেটরা রুমীকে নিজ পরিবারের একজন সদস্য বলে মনে করতে লাগলো। ব্যাপারটি আমার কাছেও ইন্টারেস্টিং মনে হয়েছে ! একজন মা চিরদিনই মা, তা তিনি যেখানই থাকুন না কেনো।

ক্যাডেট কলেজের টুকরো স্মৃতি: ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজ: পর্ব ৯

ভালো ছেলের সহসা মন্দ হয়ে যাওয়া ধরা যাক ছেলেটির নাম রফিক, ক্যাডেট রফিক (সংগত কারণে এটি তার আসল নাম নয়)। পড়াশুনায় অত্যন্ত মেধাবী। মাধ্যমিক পরীক্ষায় সম্মিলিত মেধা তালিকায় প্রথম দশজনের মধ্যে ছিলো। কলেজ হকি, ক্রিকেট এবং বাস্কেটবল টীমের অপরিহার্য খেলোয়াড়। ইংরেজি এবং বাংলা বক্তৃতা ও আবৃত্তিতে অসাধারন পারফর্মার। একজন দক্ষ ও কার্যকর ফর্ম (ক্লাস) লীডার। এক কথায়, আউটস্ট্যান্ডিং ক্যাডেট। মনেমনে ঠিক করেছিলাম একাদশ শ্রেণীতে উঠলে রফিককে এসিস্ট্যান্ট হাউস প্রিফেক্ট বানাবো। দ্বাদশ শ্রেণীতে উঠলে কলেজ প্রিফেক্ট হবার সকল সম্ভাবনা ছিলো। হঠাৎ করে রফিকের যেনো কী হয়ে গেলো। মাধ্যমিক পরীক্ষা শেষে নিয়মানুযায়ী তিন প্রায় মাসের জন্য লম্বা ছুটিতে বাড়িতে গিয়েছিলো। রেজাল্ট বের হবার পর কলেজে ফিরে আসার পর সবাই বিস্ময়ের সাথে লক্ষ্য করলো রফিক আর আগের রফিক নেই। লেখাপড়া, খেলাধুলাসহ কোনো কাজে রফিকের আগের মতো উৎসাহ এবং মনোযোগ কোনোটাই নেই। বন্ধুদের কাছ থেকে নিজেকে দূরে সড়িয়ে রাখছে। জুতার ফিতা বাঁধতে, জামার বোতাম লাগাতে ভুলে যাচ্ছে। শিক্ষকদের উপদেশ, বকাঝকা এমনকি এক্সট্রা ড্রিল কিছুতেই কাজ হচ্ছে না। ক্যাডেট কলেজে একটা বাজে নিয়ম আছে, যা আমার কখনও পসন্দ হয়নি। মাধ্যমিক পরীক্ষা শেষ হতেই ছেলেদেরকে ছুটি দিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয়। ফল বের হলে প্রায় তিন মাস পর কলেজে ফিরিয়ে আনা হয়। দীর্ঘ তিন মাস বাড়িতে থেকে বেশিরভাগ ছেলে কোনো কাজকর্ম না করে, সংগদোষে দুষ্টু হয়ে, মাবাবার অতিরিক্ত প্রশ্রয়ে অলস সময় কাটিয়ে মাথাটাকে শয়তানের কারখানা বানিয়ে নিয়ে আসে। ক্যাডেট কলেজ এবং বাড়ির পরিবেশের মধ্যে এতটাই তফাৎ যে, কলেজে ফিরে এসে কলেজের দৈনন্দিন জীবনের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে এদের বেশ কষ্ট হয়। এসব ছেলেকে পুনরায় লাইনে ফিরিয়ে আনতে শিক্ষকদের অনেক পরিশ্রম করতে হয়। কেউকেউ লাইনে আসতে ব্যর্থ হবার কারণে কলেজ থেকে বহিস্কৃত পর্যন্ত হয়ে যায়। যেসব অভিন্ন বড় বদভ্যাস এসময়ে অনেক ছেলের মধ্যে লক্ষ্য করা যায় সেগুলো হলো, ছোটোদের মারধর করা, কথায়কথায় অশ্লীল বাক্য উচ্চারণ করা, ধূমপানে আসক্ত হওয়া, লম্বা চুল রাখতে চেষ্টা করা, জামাকাপড় আগোছালো করে পরিধান করা, সুযোগ পেলেই পেরন্টেস ভিজিটিং ডে’তে আগত মেয়েদের বিরক্ত করা ইত্যাদি। দু’একজন ড্রাগেও আসক্ত হয়ে পড়ে। ব্যাপারগুলো অবশ্যই দু:খজনক। পঞ্চাশজন ক্যাডেটের তিন মাসের ভরণপোষণের খরচ বাঁচাবার লক্ষ্যে কাজটি করা হয়ে থাকে। কিন্তু এতে যে ক্ষতি হয় তা তো কখনও টাকা দিয়ে পূরণ করা যায় না। কর্তৃপক্ষ এক্ষেত্রে ছুটিটা কমিয়ে একমাস করে বাকি দুই মাস ছেলেদের কলেজে রাখলে অনেক দিক থেকে ভালো হতো। যাহোক, রফিকের বিষয়টি আমার নজরে এলো। ওর হাউস মাষ্টার অনেক চেষ্টা করেও রফিকের এমন দূ:খজনক পরিবর্তনের কারণ উদ্ধার করতে পারলেন না। সে মন খুলে কারও সাথে নিজের অশান্তির কথা বলতে চাইলো না। আমার মনে হলো, ছুটির সময় বাড়িতে এমন কিছু ঘটেছে যার জন্য আজকে সে এমন অস্বাভাবিক আচরণ করছে। অবশেষে আমি রফিকের বাবার শরণাপন্ন হলাম। রফিকের বাবা যশোর শহরের একজন গন্যমান্য ধনী ব্যাবসায়ী। ধর্মভীরু, ভদ্র ও বিনয়ী বলে সুখ্যাতি আছে। তিনি খবর পেয়ে সাথেসাথে আমার অফিসে এসে দেখা করলেন। তাঁর কাছ থেকে যা শুনলাম তাতে আমার সন্দেহ সত্য প্রমাণিত হলো। রফিকের যখন মাত্র পাঁচ বছর বয়স তখন ওর মা ওকে এবং ওর বড় একজন বোনকে রেখে মারা যান। তারপর রফিকের বাবা দুই সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে দ্বিতীয়বার আর বিয়ে করেননি। মাহারা ছেলে ও মেয়েকে বুকে আগলে ধরে সকল প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে লড়াই করে এতোদিন সংসার আগলে রেখেছিলেন। রফিক বড় হয়ে ক্যাডেট কলেজে ভর্তি হয়েছে। মেয়ে ধীরেধীরে বড় হয়ে লেখাপড়ার সাথেসাথে বাবার সংসারের হাল ধরে রেখেছে। মেয়ে বড় হয়ে উঠলে তার বিয়ে দেওয়ার বিষয়টি সামনে চলে এলো। কিন্তু মেয়ের এক কথা, আমি বিয়ে করে শ্বশুর বাড়ি চলে গেলে আমার বাবার কী হবে ? তাঁকে কে দেখবে ? সংসারের কী হবে ? বাবা অনেক বুঝালেন। কাজ হলো না। অবশেষে মেয়ে অনেক পীড়াপিড়ির পর এক শর্তে বিয়ে করতে রাজী হলো। তার বিয়ের আগে বাবাকে বিয়ে করে ঘরে নতুন মা আনতে হবে। তার হাতে সংসারের ভার বুঝিয়ে দিয়ে তবেই মেয়ে বিয়ে করতে রাজী আছে। মেয়ে নিজেই দেখেশুনে একজন বয়স্ক নি:সন্তান বিধবা মহিলার সাথে বাবার বিয়ে দিয়ে নতুন মা ঘরে আনলো। ঘটনাটি যখন ঘটে তখন রফিক কলেজে। সামনে ওর এসএসসি পরীক্ষা। ডিসটার্ব হবে বলে রফিককে কিছু জানানো হলো না। মেয়ে বললো, রফিক পরীক্ষা শেষে বাড়ি আসলে ওকে সব বুঝিয়ে বলার দায়িত্ব আমার। বাবা, তুমি এ নিয়ে ভেবো না। পরীক্ষা শেষে রফিক বাড়ি এসে নতুন মাকে দেখে হতবাক হয়ে গেলো, প্রচন্ড মানসিক আঘাত পেলো। ওর জীবনের সব হিসাব কোথায় যেনো এলোমেলো হয়ে গেলো। বড় বোন, যে নাকি মায়ের মতো আদরস্নেহ দিয়ে রফিককে বড় করেছে, অনেক বুঝালো। কিন্তু রফিক নতুন মায়ের আগমন কিছুতেই মেনে নিতে পারলো না। বাবাকে মনে হলো অনেক দূরের কেউ। তখন থেকে শুরু হয় রফিকের এলোমেলো পথচলা। বলতে বলতে রফিকের বাবার দু’চোখের পাতা আর্দ্র হয়ে গেলো। আমার দিকে তাকিয়ে করুণ কন্ঠে প্রশ্ন করলেন, আমি কি ভুল করলাম ? আমি শান্ত হবার জন্য অনুরোধ জানিয়ে বললাম, না, আপনি ভুল করেননি, ঠিকই করেছেন। আমি ওর সাথে কথা বলবো। আশা করি আমি রফিককে বুঝাতে পারবো। পরের দিন গেইমস পিরিয়ডে রফিককে আমার অফিসে ডেকে এনে বসালাম। ওর বাবার কাছ থেকে যা শুনেছি তা বললাম। তাকে নানাভাবে বুঝিয়ে বললাম যে তার বাবা দ্বিতীয়বার বিয়ে করে কোনো ভুল কাজ করেননি। বিষয়টি বুঝার বয়স এখনও তার হয়নি। আরও একটু বয়স হলে সে নিজেই বুঝবে, এছাড়া বাবার কিছু করার ছিলো না। তাছাড়া, ব্যাক্তি হিসেবে বিয়ে করা বা না করা তাঁর মৌলিক অধিকার। তাঁকে বাধা দেবার কোনো নৈতিক অধিকার তার, বা অন্য কারও, নেই। আমি আরও বললাম, তোমার বাবা তোমাদের দুই ভাইবোনকে পাগলের মতো ভালোবাসেন। তারপরও এসব কারণে তুমি অমনোযোগী হতে পারো না। তোমার ভবিষ্যত জীবন ধ্বংস করতে পারো না। বাবাকে কষ্ট দিতে পারো না। এখন থেকে কলেজের কাজকর্মে আগের মতো উৎসাহের সাথে অংশ নাও। অবশ্যই আল্লাহ তোমার সহায় থাকবেন। ইনশাল্লাহ সব ঠিক হয়ে যাবে। ধীরে ধীরে রফিক কলেজ জীবনের সাথে আবার তাল মিলিয়ে চলতে শুরু করলো। প্রায় বিশ বছর পর রফিকের সাথে ঢাকা সিএমএইচে স্টাফ সার্জনের ওয়েটিং রুমে দেখা। বাংলাদেশ এয়ারফোর্সের ইউনিফর্ম পড়া। সে তখন উইং কমান্ডার রফিক, জিডিপি। বাংলাদেশ এয়ার ফোর্সের একজন গর্বিত টেস্ট পাইলট।