Ashraf’s Column

Monday, June 02, 2014

ক্যাডেট কলেজের টুকরো স্মৃতি: ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজ: পর্ব ৯

ভালো ছেলের সহসা মন্দ হয়ে যাওয়া ধরা যাক ছেলেটির নাম রফিক, ক্যাডেট রফিক (সংগত কারণে এটি তার আসল নাম নয়)। পড়াশুনায় অত্যন্ত মেধাবী। মাধ্যমিক পরীক্ষায় সম্মিলিত মেধা তালিকায় প্রথম দশজনের মধ্যে ছিলো। কলেজ হকি, ক্রিকেট এবং বাস্কেটবল টীমের অপরিহার্য খেলোয়াড়। ইংরেজি এবং বাংলা বক্তৃতা ও আবৃত্তিতে অসাধারন পারফর্মার। একজন দক্ষ ও কার্যকর ফর্ম (ক্লাস) লীডার। এক কথায়, আউটস্ট্যান্ডিং ক্যাডেট। মনেমনে ঠিক করেছিলাম একাদশ শ্রেণীতে উঠলে রফিককে এসিস্ট্যান্ট হাউস প্রিফেক্ট বানাবো। দ্বাদশ শ্রেণীতে উঠলে কলেজ প্রিফেক্ট হবার সকল সম্ভাবনা ছিলো। হঠাৎ করে রফিকের যেনো কী হয়ে গেলো। মাধ্যমিক পরীক্ষা শেষে নিয়মানুযায়ী তিন প্রায় মাসের জন্য লম্বা ছুটিতে বাড়িতে গিয়েছিলো। রেজাল্ট বের হবার পর কলেজে ফিরে আসার পর সবাই বিস্ময়ের সাথে লক্ষ্য করলো রফিক আর আগের রফিক নেই। লেখাপড়া, খেলাধুলাসহ কোনো কাজে রফিকের আগের মতো উৎসাহ এবং মনোযোগ কোনোটাই নেই। বন্ধুদের কাছ থেকে নিজেকে দূরে সড়িয়ে রাখছে। জুতার ফিতা বাঁধতে, জামার বোতাম লাগাতে ভুলে যাচ্ছে। শিক্ষকদের উপদেশ, বকাঝকা এমনকি এক্সট্রা ড্রিল কিছুতেই কাজ হচ্ছে না। ক্যাডেট কলেজে একটা বাজে নিয়ম আছে, যা আমার কখনও পসন্দ হয়নি। মাধ্যমিক পরীক্ষা শেষ হতেই ছেলেদেরকে ছুটি দিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয়। ফল বের হলে প্রায় তিন মাস পর কলেজে ফিরিয়ে আনা হয়। দীর্ঘ তিন মাস বাড়িতে থেকে বেশিরভাগ ছেলে কোনো কাজকর্ম না করে, সংগদোষে দুষ্টু হয়ে, মাবাবার অতিরিক্ত প্রশ্রয়ে অলস সময় কাটিয়ে মাথাটাকে শয়তানের কারখানা বানিয়ে নিয়ে আসে। ক্যাডেট কলেজ এবং বাড়ির পরিবেশের মধ্যে এতটাই তফাৎ যে, কলেজে ফিরে এসে কলেজের দৈনন্দিন জীবনের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে এদের বেশ কষ্ট হয়। এসব ছেলেকে পুনরায় লাইনে ফিরিয়ে আনতে শিক্ষকদের অনেক পরিশ্রম করতে হয়। কেউকেউ লাইনে আসতে ব্যর্থ হবার কারণে কলেজ থেকে বহিস্কৃত পর্যন্ত হয়ে যায়। যেসব অভিন্ন বড় বদভ্যাস এসময়ে অনেক ছেলের মধ্যে লক্ষ্য করা যায় সেগুলো হলো, ছোটোদের মারধর করা, কথায়কথায় অশ্লীল বাক্য উচ্চারণ করা, ধূমপানে আসক্ত হওয়া, লম্বা চুল রাখতে চেষ্টা করা, জামাকাপড় আগোছালো করে পরিধান করা, সুযোগ পেলেই পেরন্টেস ভিজিটিং ডে’তে আগত মেয়েদের বিরক্ত করা ইত্যাদি। দু’একজন ড্রাগেও আসক্ত হয়ে পড়ে। ব্যাপারগুলো অবশ্যই দু:খজনক। পঞ্চাশজন ক্যাডেটের তিন মাসের ভরণপোষণের খরচ বাঁচাবার লক্ষ্যে কাজটি করা হয়ে থাকে। কিন্তু এতে যে ক্ষতি হয় তা তো কখনও টাকা দিয়ে পূরণ করা যায় না। কর্তৃপক্ষ এক্ষেত্রে ছুটিটা কমিয়ে একমাস করে বাকি দুই মাস ছেলেদের কলেজে রাখলে অনেক দিক থেকে ভালো হতো। যাহোক, রফিকের বিষয়টি আমার নজরে এলো। ওর হাউস মাষ্টার অনেক চেষ্টা করেও রফিকের এমন দূ:খজনক পরিবর্তনের কারণ উদ্ধার করতে পারলেন না। সে মন খুলে কারও সাথে নিজের অশান্তির কথা বলতে চাইলো না। আমার মনে হলো, ছুটির সময় বাড়িতে এমন কিছু ঘটেছে যার জন্য আজকে সে এমন অস্বাভাবিক আচরণ করছে। অবশেষে আমি রফিকের বাবার শরণাপন্ন হলাম। রফিকের বাবা যশোর শহরের একজন গন্যমান্য ধনী ব্যাবসায়ী। ধর্মভীরু, ভদ্র ও বিনয়ী বলে সুখ্যাতি আছে। তিনি খবর পেয়ে সাথেসাথে আমার অফিসে এসে দেখা করলেন। তাঁর কাছ থেকে যা শুনলাম তাতে আমার সন্দেহ সত্য প্রমাণিত হলো। রফিকের যখন মাত্র পাঁচ বছর বয়স তখন ওর মা ওকে এবং ওর বড় একজন বোনকে রেখে মারা যান। তারপর রফিকের বাবা দুই সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে দ্বিতীয়বার আর বিয়ে করেননি। মাহারা ছেলে ও মেয়েকে বুকে আগলে ধরে সকল প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে লড়াই করে এতোদিন সংসার আগলে রেখেছিলেন। রফিক বড় হয়ে ক্যাডেট কলেজে ভর্তি হয়েছে। মেয়ে ধীরেধীরে বড় হয়ে লেখাপড়ার সাথেসাথে বাবার সংসারের হাল ধরে রেখেছে। মেয়ে বড় হয়ে উঠলে তার বিয়ে দেওয়ার বিষয়টি সামনে চলে এলো। কিন্তু মেয়ের এক কথা, আমি বিয়ে করে শ্বশুর বাড়ি চলে গেলে আমার বাবার কী হবে ? তাঁকে কে দেখবে ? সংসারের কী হবে ? বাবা অনেক বুঝালেন। কাজ হলো না। অবশেষে মেয়ে অনেক পীড়াপিড়ির পর এক শর্তে বিয়ে করতে রাজী হলো। তার বিয়ের আগে বাবাকে বিয়ে করে ঘরে নতুন মা আনতে হবে। তার হাতে সংসারের ভার বুঝিয়ে দিয়ে তবেই মেয়ে বিয়ে করতে রাজী আছে। মেয়ে নিজেই দেখেশুনে একজন বয়স্ক নি:সন্তান বিধবা মহিলার সাথে বাবার বিয়ে দিয়ে নতুন মা ঘরে আনলো। ঘটনাটি যখন ঘটে তখন রফিক কলেজে। সামনে ওর এসএসসি পরীক্ষা। ডিসটার্ব হবে বলে রফিককে কিছু জানানো হলো না। মেয়ে বললো, রফিক পরীক্ষা শেষে বাড়ি আসলে ওকে সব বুঝিয়ে বলার দায়িত্ব আমার। বাবা, তুমি এ নিয়ে ভেবো না। পরীক্ষা শেষে রফিক বাড়ি এসে নতুন মাকে দেখে হতবাক হয়ে গেলো, প্রচন্ড মানসিক আঘাত পেলো। ওর জীবনের সব হিসাব কোথায় যেনো এলোমেলো হয়ে গেলো। বড় বোন, যে নাকি মায়ের মতো আদরস্নেহ দিয়ে রফিককে বড় করেছে, অনেক বুঝালো। কিন্তু রফিক নতুন মায়ের আগমন কিছুতেই মেনে নিতে পারলো না। বাবাকে মনে হলো অনেক দূরের কেউ। তখন থেকে শুরু হয় রফিকের এলোমেলো পথচলা। বলতে বলতে রফিকের বাবার দু’চোখের পাতা আর্দ্র হয়ে গেলো। আমার দিকে তাকিয়ে করুণ কন্ঠে প্রশ্ন করলেন, আমি কি ভুল করলাম ? আমি শান্ত হবার জন্য অনুরোধ জানিয়ে বললাম, না, আপনি ভুল করেননি, ঠিকই করেছেন। আমি ওর সাথে কথা বলবো। আশা করি আমি রফিককে বুঝাতে পারবো। পরের দিন গেইমস পিরিয়ডে রফিককে আমার অফিসে ডেকে এনে বসালাম। ওর বাবার কাছ থেকে যা শুনেছি তা বললাম। তাকে নানাভাবে বুঝিয়ে বললাম যে তার বাবা দ্বিতীয়বার বিয়ে করে কোনো ভুল কাজ করেননি। বিষয়টি বুঝার বয়স এখনও তার হয়নি। আরও একটু বয়স হলে সে নিজেই বুঝবে, এছাড়া বাবার কিছু করার ছিলো না। তাছাড়া, ব্যাক্তি হিসেবে বিয়ে করা বা না করা তাঁর মৌলিক অধিকার। তাঁকে বাধা দেবার কোনো নৈতিক অধিকার তার, বা অন্য কারও, নেই। আমি আরও বললাম, তোমার বাবা তোমাদের দুই ভাইবোনকে পাগলের মতো ভালোবাসেন। তারপরও এসব কারণে তুমি অমনোযোগী হতে পারো না। তোমার ভবিষ্যত জীবন ধ্বংস করতে পারো না। বাবাকে কষ্ট দিতে পারো না। এখন থেকে কলেজের কাজকর্মে আগের মতো উৎসাহের সাথে অংশ নাও। অবশ্যই আল্লাহ তোমার সহায় থাকবেন। ইনশাল্লাহ সব ঠিক হয়ে যাবে। ধীরে ধীরে রফিক কলেজ জীবনের সাথে আবার তাল মিলিয়ে চলতে শুরু করলো। প্রায় বিশ বছর পর রফিকের সাথে ঢাকা সিএমএইচে স্টাফ সার্জনের ওয়েটিং রুমে দেখা। বাংলাদেশ এয়ারফোর্সের ইউনিফর্ম পড়া। সে তখন উইং কমান্ডার রফিক, জিডিপি। বাংলাদেশ এয়ার ফোর্সের একজন গর্বিত টেস্ট পাইলট।

0 Comments:

Post a Comment

Subscribe to Post Comments [Atom]



<< Home