Ashraf’s Column

Tuesday, March 25, 2014

ক্যাডেট কলেজের টুকরো স্মৃতি: ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজ: পর্ব ৫: ক্যাডেট কলেজে অশান্তি এড়াতে হলে

আপনা র ঘরে যদি তিনটি ছেলেকে দিনের চব্বিশ ঘন্টা মাসের পর মাস আটকে রাখা হয় তাহলে কেমন অরাজক পরিস্থিতি হতে পারে, আশা করি, তা বুঝিয়ে বলতে হবে না। কমবেশি তিন’শ ছেলেকে (বা মেয়েকে), যাদের বয়স ১২ থেকে ১৮ বছর, যদি কঠিন শৃঙ্খলার মধ্যে আটকে রাখা হয় এবং সেখানে যদি শান্তিশৃঙ্খলা বজায় না থাকে তাহলে পরিস্থিতি কোন পর্যন্ত যেতে পারে, তা কল্পনাও করা যায় না। অথচ, ক্যাডেট কলেজগুলো অনেক দিন ধরে এই আপাত: অসম্ভব কাজটিই সার্থকতার সাথে করে সবার প্রশংসা কুড়াচ্ছে। যদি কেউ প্রশ্ন করেন, এর কোনো গোপন রহস্য আছে কি না। যদি থাকে তাহলে সেটা কী ? এ প্রশ্নের জবাব হলো: কোনো রহস্য নেই। যে চারটি বিষয়ে মনোযোগ দিলে পরিস্থিতি আপনার নিয়ন্ত্রণে থাকবে তা হলো: (১) ছেলেদেরকে সময়মতো ভালো খাবার পরিবেশন করুন। (২) রুটিনমতো কাজকর্মে ব্যস্ত রাখুন। (৩) পর্যাপ্ত বিনোদনের ব্যবস্থা রাখুন। (৪) রাতে নিরবচ্ছিন্ন ঘুমেরে যাতে ব্যাঘাত না হয়, তা নিশ্চিত করুন। দেখবেন, বড় কোনো অশান্তি হবে না। ছোটোখাটো কিছু সমস্যা হতেই পারে। প্রশাসন যদি সজাগ থেকে সময়মতো সঠিক ব্যবস্থা নেয় তাহলে এসব ছোটো সমস্যা কোনো বড় অসুবিধা করে না। কেউ হয়তো প্রশ্ন করতে পারেন, তাহলে পড়ালেখা কোথায় গেলো ? ক্যাডেট কলেজের কোনো ক্যাডেটকে পড়ালেখা করার জন্য বলতে হয় না। একাজটি ওরা নিজ থেকেই খুব সিরিয়াসলি করে থাকে। এমনকি অনেকে লাইটস আউটের (রাতে আবশ্যিকভাবে বাতি নেভাবার সময়) পর ডিউটি মাস্টারের নজর এড়িয়ে চুপিচুপি পড়শুনা করে থাকে, বিশেষ করে পরীক্ষার আগে। শিক্ষকগণ শুধু নির্দেশণা দিয়ে সাহায্য করেন। কেউ কোনো বিষয়ে অতি দূর্বল হলে তাকে ক্লাসের বাইরে অতিরিক্ত সময়ে টিউটরিং করে থাকেন। স্পুনফিডিংয়ের কোনো প্রয়োজন হয় না। যখন ক্যাডেটরা ভেকেশনে বাড়ি যেতো তখন যাবার আগে হাউস মাস্টাররা ছেলেদের ব্যাগ-সুটকেইস রীতিমতো তল্লাশি করে সকল পাঠ্যবই হাউসে রেখে দিতেন। কোনো হোম ওয়ার্ক দেওয়া হতো না। ছেলেদের বলা হতো: বাড়ি গিয়ে আনন্দ করো, ঘুরে বেড়াও, খেলাধুলা করো, সিলেবাসের বাইরের বইপত্র পড়ো, মা-বাবার ঘরের কাজে সাহায্য করো ইত্যাদি। আড়াই-তিন মাস একনাগারে কলেজে থাকলে এক ধরনের একঘেয়েমি এসে যায়। তা থেকে মুক্তি পাবার জন্যই এমন পরামর্শ দেওয়া হতো। আজকাল শুনছি, ভেকেশনে যাবার সময় ক্যাডেটদের পাঠ্যবই সঙ্গে নিতে অনেকটা বাধ্য করা হয়। প্রচুর হোম ওয়ার্ক দেওয়া হয়। বাড়িতে থাকতে কোন কোন বিষয়ে প্রাইভেট টিউটরের কাছে পড়তে হবে সে সম্পর্কে অভিভাবককে চিঠি দিয়ে জানানো হয়। যে দর্শন ও নীতির উপর ভিত্তি করে শুধুমাত্র জাতীয় ভিত্তিতে মেধাবীদের জন্য ক্যাডেট কলেজ শুরুতে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিলো, এসব কাজ তার পরিপন্থি। যেসব ছেলেমেয়েদের জন্য এমন করা প্রয়োজন তারা ক্যাডেট কলেজে ভর্তি হবার জন্য উপযুক্ত নয়, অন্তত: মেধার দিক থেকে। শোনা যায়, আজকাল ভর্তির জন্য নির্বাচন প্রক্রিয়ায় আপোষ করা হচ্ছে। কথাটা সত্য হলে এটা কঠোরভাবে বন্ধ করতে হবে। আর যদি ভর্তির জন্য নির্বাচন প্রক্রিয়ায় কোনো ত্রুটি থাকে, বিশেষজ্ঞদের দিয়ে নির্বাচন প্রক্রিয়াকে সংষ্কার করতে হবে। তা নাহলে ক্যাডেট কলেজের সুনাম, ঐতিহ্য ও কার্যকারিতা ধরে রাখা যাবে না ক্যাডেট কলেজের জন্য জনগণের ট্যাক্স থেকে যে বিপুল পরিমান অর্থ ব্যয় করা হয়, তার যৌক্তিকতা ধরে রাখা যাবে না। এবার আসা যাক ক্যাডেট কলেজে ক্যাডেটদের খাবার ব্যবস্থা প্রসঙ্গে। সকালের পিটি/প্যারেডের পর ব্রেকফাস্ট, সকাল দশটার দিকে মিল্ক ব্রেকে দুধ আর বিস্কুট, দুপুর একটার দিকে লাঞ্চ, বিকেলে গেইমস পিরিয়ডের পর চা-টিফিন, সর্বশেষ রাতে ডিনার। ক্যাডেট কলেজে মাথাপ্রতি একজন ক্যাডেটকে কোন বেলায় কোন খাবার কতটুকু দিতে হবে তা পুষ্টিবিজ্ঞানী নির্ধারণ করে দেন। যেমন, বলা হয় না, এক বেলায় একজন ক্যাডেটকে এতো টাকার মুরগির গোস্ত দিতে হবে। বলা হয়, এতো গ্রাম মুরগির গোস্ত দিতে হবে, দাম যতোই হোক না কেনো। যার ফলে বাজারে খাদ্যদ্রব্যের দাম বাড়লে ক্যাডেট কলেজের বাজেটও আবশ্যিকভাবে বাড়াতে হয়। যে কোনো রান্না করা খাবার খেতে ভালো লাগবে কি না তা বহুলাংশে নিভর্র করে রান্নার উপকরণের গুণগত মান, রান্নার প্রক্রিয়া এবং পরিবেশের মানের উপর। এসব দেখার জন্য ডিউটি মাস্টার এবং ডিউটি এনসিওকে তাঁদের পর্যবেক্ষণে সর্বোচ্চ মনোযোগী হবার জন্য অনুরোধ করলাম। আমি নিজেও সময়ে-অসময়ে ক্যাডেট মেসের কুকহাউস ভিজিট করতে লাগলাম। সুযোগ পেলেই খাবার সময়, আগাম খবর না দিয়ে, মেসে গিয়ে ক্যাডেটদের সাথে বসে খাবার টেস্ট করতে লাগলাম। পরিবেশিত খাবারের মান এবং স্বাদ সম্পর্কে ক্যাডেটদের মতামত নিয়ে খোলাখুলি আলোচনা করতাম। একথা সত্য, ক্যাডেটদের মন্তব্যে বাড়াবাড়ি ছিলো, এ ধরনের কম্যুনিটি কিচেনের রান্না সম্পর্কে সাধারণত: যা হয়ে থাকে। তারপরও অত্যন্ত পরিতাপের সাথে লক্ষ্য করলাম: (১) অধিকাংশ ছেলে টিফিনে পরিবেশিত দুধ না খেয়ে টেবিলের উপর দুধভর্তি কাপ ছেড়ে যাচ্ছে। জিজ্ঞাসা করাতে ছেলেরা জবাব দিলো, স্যার, দুধ খেতে ভালো লাগে না। (২) যে বেলায় গরু, খাসি বা মুরগির গোস্ত থাকতো ছেলেরা সব গোস্ত না খেয়ে প্লেটে ফেলে রেখে যেতো। জিজ্ঞেস করলে ছেলেরা একবাক্যে জবাব দেতো, মরা গরুর (খাসি বা মুরগির) গোস্ত। খাওয়া যায় না। (৩) বাজে রান্নার জন্য সব্জিও অনেকে খেতে পসন্দ করতো না। শুধু ডাল দিয়ে ভাত খেয়ে উঠে যেতো। এসব দেখে ও শুনে মনেমনে কষ্ট পেতাম। সরকার ছেলেদের খাওয়াদাওয়ার জন্য এতো টাকা খরচ করছে। অথচ, ছেলেরা খেতে পারছে না। নিজের ছেলেবেলার কথা মনে হলো। মা যখন গ্লাসে করে গরম দুধ খেতে দিতেন তখন কী মজা করেই না তা খেতাম ! আর গোস্ত ! মা যে বেলায় গোস্ত রান্না করতেন সে বেলায় শুরু থেকেই সব ভাইবোন মিলে আনন্দে লাফাতাম ! খেতে বসার আগেই জিহ্বায় পানি এসে জেতো ! যাহোক, ছেলেদের মেসের খাবারে অরুচির কারণ খুঁজতে বেশি দূর যেতে হলো না। কলেজের নিজস্ব ডেইরি ফার্মে পর্যাপ্ত সংখ্যক গাভী ছিলো। যার বেশির ভাগ ছিলো ‘সিন্ধি’ প্রজাতির। অল্প কিছু ছিলো ‘ফ্রিজিয়ান’। দেশি জাতের কোনো গরু ছিলো না। তা সত্বেও মেসের চাহিদা মেটাবার মতো পর্যাপ্ত দুধ সেখানে উৎপন্ন হতো না। ফলে পুরোটাই বাইরের ঠিকাদারের কাছ থেকে কিনতে হতো। বাংলাদেশের বাস্তবতায় কোনো ঠিকাদারের কাছ থেকে খাঁটি দুধ আশা করা তখনও যেতো না, এখনও যায় না। ছেলেদেরকে খাঁটি দুধ খাওয়াতে হলে যে কোনো মূল্যে কলেজের নিজস্ব ডেইরি ফার্মের উন্নতি করা ছাড়া গত্যন্তর রইলো না। খুলনা থেকে সরকারি পশুপালন বিভাগের উপ-পরিচালক মহোদয়কে পরামর্শের জন্য দাওয়াত দিলাম। ভদ্রলোক খুব খুশিমনে এলেন। সঙ্গে ঝিনাইদহের সাবডিভিশনাল পশুপালন অফিসারকে আনলেন। সরজমিনে ডেইরি ফার্ম দেখলেন। ফার্মে রাখা রেজিস্টার খুলে প্রতিটি গাভীর বয়স, রোগ প্রতিরোধক টিকা দেওয়ার রেকর্ড, সবশেষ কবে ডিওয়ার্মিং (কৃমিমুক্ত) করা হয়েছে, খাবারের মেনু, নিয়মিত ব্যায়ামের রুটিন, এসব তথ্য পরীক্ষা করলেন। সাবডিভিশনাল পশুপালন অফিসারকে বিস্তারিত নির্দেশ প্রদান করে তাঁকে ফার্মের দায়িত্ব নিতে বললেন । সাবডিভিশনাল পশুপালন অফিসার বিষয়টিকে ব্যক্তিগত চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিলেন। প্রতি সপ্তাহে দু’তিনবার কলেজে এসে ফার্মের দেখভাল করতে লাগলেন। ফার্মের কর্মীদের পরামর্শ দিতে লাগলেন। কলেজের কৃষি ফার্মে অন্য ফসলের চাষ কমিয়ে দিয়ে সেখানে গাভীর দুধ বাড়ে এমন খাদ্য যথা নেপিয়ার ঘাস, জার্মান ঘাস, ভুট্টা ইত্যাদির চাষ শুরু হলো। ক্যাডেট মেসের ভাতের মাড় অন্য কোথাও না গিয়ে পুরোটা ডেইরি ফার্মে আসতে লাগলো। তিন মাসের মধ্যে, গাভীর সংখ্যা না বাড়িয়ে, দুধের পরিমান এতটা বেড়ে গেলো যে, ক্যাডেট মেসের চাহিদা মিটিয়ে কলেজের কর্মকর্তা-কর্মচারীদেরকে, বিশেষ করে যাদের দুগ্ধপোষ্য শিশু এবং ছোটো বাচ্চা ছিলো তাদেরকে, ভর্তুকিমূল্যে দুধ সরবরাহ করা সম্ভব হলো। ভেকেশনের সময় শহরের মিষ্টির দোকানদাররা সারপ্লাস দুধ সানন্দে কিনে নিয়ে যেতো। শত হলেও খাঁটি দুধ তো ! ক্যাডেটরা বেজায় খুশি হলো। এবার আর টেবিলে খালি দুধের গ্লাস দেখা গেলো না। ডেইরি ফার্মের কথা অসম্পূর্ণ রয়ে যাবে যদি তার এক সদস্যের কথা না বলা হয়। তার নাম ‘মন্টু’। কলেজের সবাই তাকে এই নামে চিনতো। পরিচিত রাখাল নাম ধরে ডাকলে মন্টু যেখানই থাকতো ছুটে আসতো। সে ছিলো ফার্মের প্রবীনতম ষাঁড়। জাতে ছিলো ‘সিন্ধি’। গায়ের রং টকটকে লাল। দেখতে অত্যন্ত স্বাস্থ্যবান, হ্যান্ডসাম এবং স্মার্ট ! গত তিন বছর যাবত নিকটস্থ ভাটুই বাজারের কোরবানির হাটে নিয়ে বিক্রি করার চেষ্টা করা সত্বেও বিক্রি করা যায়নি। প্রতিবারই সকল বাধা এবং রশি ছিন্ন করে মন্টু হাট থেকে পালিয়ে এক দৌড়ে কলেজে ফিরে এসে ফার্মে ঢুকে নিজ অবস্থানে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতো। যেহেতু আমাদের ফার্মটি ছিলো মূলত: দুধের জন্য, এঁড়ে বাছুর বড় হয়ে গেলে সেটিকে রাখার ব্যবস্থা ছিলো না। সিদ্ধান্ত নিলাম, কষ্ট হলেও, মন্টুকে এবার যে করে হোক বিদায় করতে হবে। এবার কোরবানির সময় কলেজের পিকআপে চড়িয়ে মন্টুকে ঢাকার গাবতলি গরুর হাটে পাঠিয়ে দেওয়া হলো। এবার আর মন্টু হাট থেকে মন্টু ফিরে এলো না। মন্টুকে যখন ঢাকা নেবার জন্য পিকআপে উঠানো হয় ফার্মের রাখালসহ অনেকের চোখে পানি দেখে আমি নিজেও বিচলিত হয়ে পড়েছিলাম বৈকি। ক্যাডেট মেসে রান্না করা গোস্তের স্বাদ ও মান উন্নয়ন করা অতটা সহজ ছিলো না। কুকহাউস থেকে যাতে কেউ কোনো মশলা, বিশেষ করে অতি দামি গরম মশলা, রান্নার তেল-ঘি চুরি করে বাইরে নিতে না পারে সেজন্য কুকহাউসের স্টাফদের আচমকা শরীর তল্লাসি শুরু করা হলো। প্যান্টের পকেটে ভরে গড়ম মশলা চুরি করে নেবার সময় ধরা পড়ায় দু’একজনকে চাকুরি থেকে বরখাস্ত করা হলো। এদের মধ্যে কেউকেউ স্থানীয় হবার কারণে বাইরের মাস্তানদের সাথে নিয়ে প্রিন্সিপালকে একহাত দেখে নেবার হুমকি দিলো। এতো সবের পরও গোস্তের মান বাড়ানো গেলো না। একেবারে মৃত না হলেও মৃতপ্রায় এবং অতিশয় রুগ্ন পশুর গোস্ত সরবরাহ বন্ধ করা যাচ্ছিলো না। গোস্তের ঠিকাদারকে ডেকে প্রথমে অনুরোধ পরে সতর্ক করলাম। কোনো কাজ হলো না। ঠিকাদারের এক জবাব, তাঁর নিজের কোনো কসাইখানা বা গোস্তের ব্যবসা নাই। কসাইদের কাছ থেকে কিনে তিনি গোস্ত সাপ্লাই দেন। কলেজের মেডিক্যাল অফিসার ছিলেন মেজর (পরে লে: কর্নেল, বর্তমানে মরহুম) কফিলউদ্দিন আহমদ (চলচ্চিত্র পরিচালক তৌকীর আহমদের পিতা)। ঠিকাদার ফ্রেশ রেশন নিয়ে এলে তিনি প্রতিবার গোস্তসহ সব আইটেমের গুণগত মান পরীক্ষা করতে লাগলেন। কোনো কিছুতেই কাজ হচ্ছিলো না। সর্বশেষ উপায় হিসেবে আমাকে নিজ দায়িত্বে একটি অসাধারণ পদক্ষেপ নিতে হলো। বিল্ডিং সুপারভাইজারকে ডেকে বললাম মেসের পাশে একটি ‘বুচারি’ অর্থাৎ কসাইখানা বানাতে হবে। যাতে একটা বা দু’টো গরু একসাথে জবাই করে গোস্ত বানানো যেতে পারে। তার জন্য সম্ভাব্য নির্মাণ ব্যয় কতো হবে তা আইটেমওয়ারি লিখে আমাকে এস্টিমেট দিতে বললাম। এস্টিমেট দেখে চিন্তায় পড়ে গেলাম। প্রিন্সিপালের ফিনান্সিয়াল পাওয়ারের চাইতে অনেক বেশি টাকার প্রয়োজন। যদি অনুমোদন চেয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে উর্ধতন কতৃর্পক্ষকে চিঠি লিখি, আর যদি কোনো কারণে সে অনুরোধ প্রত্যাখ্যাত হয়, তাহলে ‘বুচারি’ আর কখনও বানানো যাবে না। অথচ ‘বুচারি’ না বানিয়ে সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। কলেজের সামনে যশোর-কুষ্টিয়া হাইওয়ে। তার পাশে, আল্লাহ জানেন কবে থেকে, প্রচুর অব্যবহৃত উদ্বৃত্ত ইট পড়ে ছিলো। কলেজের পাম্প হাউস বানানোর সময়ে ঠিকাদার কর্তৃক লেবারদের জন্য নির্মিত টিনশেড বহুদিন যাবত পড়ে ছিলো। বিল্ডিং সুপারভাইজারকে আদেশ দিলাম, যতো শীঘ্র সম্ভব হাইওয়ের পাশ থেকে অব্যবহৃত ইট, এবং পাম্প হাউসের পাশ থেকে টিন নিয়ে এসে ‘বুচারি’ বানিয়ে ফেলতে। ক্যাডেট মেস থেকে পানি ও বিদ্যুতের সংযোগ নিতে। মেইনটিন্যান্স খাত থেকে বাকি নির্মাণ সামগ্রী কিনে নিতে। তাড়াতাড়ি এইজন্য করছিলাম যে, ‘বুচারি’ বানালে যাদের স্বার্থে আঘাত লাগবে তাদের কেউ যাতে উপরওয়ালা কাউকে দিয়ে আমার এ ‘ষড়যন্ত্র’ অংকুরেই নস্যাত না করে দেয়। যেমন আদেশ, তেমন কাজ। প্রচুর আলোবাতাসের ব্যবস্থা রেখে, চারদিকে ফ্লাইপ্রুফ নেটের ঘেরা দিয়ে, প্রায় রাতারাতি টিনের চালওয়ালা ‘বুচারি’ তৈরী হয়ে গেলো। এবার ঠিকাদারকে বলা হলো গরু, খাসি এবং মুরগি, সব জীবীত অবস্থায় কলেজে আনতে হবে। কলেজের মেডিক্যাল অফিসার পরীক্ষা করে দেখে ‘গ্রহণযোগ্য’ বলে সার্টিফিকেট দিলে কলেজের ‘বুচারি’তে জবাই করে গোস্ত সরবরাহ করতে হবে। কলেজ মসজিদের ইমাম সাহেব বিনা পারিশ্রমিকে পশু জবাইর কাজ করে দিবেন। মজার ব্যাপার হলো, জ্যান্ত মুরগি খাচায় ভরে আনলেও, ঠিকাদারকে জ্যান্ত গরু ও খাসি সকাল বেলা একাডেমিক ব্লকের সামনে দিয়ে হাটিয়ে আনতে বলা হলো। ক্যাডেটরা ক্লাসরুমে বসেই নিজের পায়ে হেটে যাওয়া গরু ও খাসির অবয়ব দেখতে পেতো। এবার আর খাবার টেবিলে কোনো গোস্তের চিহ্ন রইলো না। ছেলেরা পরিতৃপ্তির সাথে পরিবেশিত প্রতিটি গোস্তের টুকরা খেয়ে শেষ করতে লাগলো। এই ঘটনার কিছুদিন পর ঢাকায় কোনো কাজে গেলে আর্মি হেডকোর্য়াটার্সে ক্যাডেট কলেজ গভর্নিং বডিজের চেয়ারম্যান জে: এরশাদের সাথে দেখা। তিনি অনেকের সামনে আমাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ওয়েলডান, আশরাফ। ‘বুচারি’ বানিয়ে খুব ভালো কাজ করেছো। আমি বললম, স্যার, আপনি কেমন করে জানলেন ? আমি তো আপনাকে জানাইনি। তিনি মুচকি হেসে বললেন, বেনামী চিঠি থেকে জেনেছি ! তোমরা তো জানোনা, প্রতিদিন প্রিন্সিপালদের বিরুদ্ধে আমার কাছে প্রচুর বেনামী চিঠি আসে। প্রিন্সিপালদের মধ্যে যারা খুব ভালো করছে, এবং যারা খুব খারাপ করছে তাদের বিরুদ্ধে বেশি বেনামী চিঠি আসে। ডোন্ট ওরি, তুমি অবশ্যই ভালো করছো। কীপ ইট আপ।

0 Comments:

Post a Comment

Subscribe to Post Comments [Atom]



<< Home