ক্যাডেট কলেজের টুকরো স্মৃতি: ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজ: পর্ব ২: প্রিন্সিপাল তো নয় যেনো আই জি প্রিজন !
ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজে যোগদান করার পরপরই নজর দিলাম ক্যাডেটদেরকে বাইরের সকল প্রকার অশুভ প্রভাব ও হস্তক্ষেপ থেকে সুরক্ষা প্রদানের দিকে। কারণ, আমার মনে হয়েছে, ভিতরে আমি যতো ভালো কাজই করি না কেনো, বাইরের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে তাকে রক্ষা না করতে পারলে সে ভালো কাজ সফল হবে না। মাসে একটি নির্দিষ্ট দিনে পেরেন্টস ভিজিটিং ডে ছিলো। বিধি অনুযায়ী ঐদিন শুধুমাত্র ক্যাডেটদের পিতামাতা এবং অনুমোদিত স্থানীয় আভিভাবকরা ক্যাডেটদের সাথে দেখা করতে আসতে পারতেন। ক্যাম্পাসের অভ্যন্তরে একটা নির্দিষ্ট স্থানে একটা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য দেখাসাক্ষাতের ব্যবস্থা ছিলো। লক্ষ্য করলাম, ঐদিন কলেজের মেইন গেইট দিয়ে জলের স্রোতের মতো লোকজন ঢুকতো। কে কার সাথে দেখা করলো তার কোনো হিসাব ছিলো না। খবর নিয়ে জানলাম, ক্যাডেটদের পিতামাতা ছাড়াও, আত্মীয় নয় এমন লোকজন আত্মীয় পরিচয় দিয়ে প্রবেশ করতো। যার মধ্যে উগ্র রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী, ধর্মীয় গুরু, এলাকার মাস্তান, সিনিয়র ক্লাসের ক্যাডেটদের গার্লফ্রেন্ডসহ আরো অনেকে ছিলো। এ ছাড়া পেরেন্টস ভিজিটিং ডে নয় এমন দিনেও কিছুকিছু লোক, বিশেষ করে কিছু উচ্চপদস্থ সরকারি অফিসার এবং তাঁদের পত্নীগণ, ভিতরে এসে ক্যাডেটদের সাথে দেখা করতো।
একদিন ক্লাস টুয়েলভের একটি ছেলের বাবা আমাকে ঢাকা থেকে টেলিফোন করলেন। ধরা যাক ছেলেটির নাম বাবর। অত্যন্ত কাতর কন্ঠে আমাকে বাবরের বাবা যা বললেন তার সারাংশ হলো: তিনি একটি সরকারি প্রতিষ্ঠানের মাঝারি পর্যায়ের অফিসার। আগে যশোর শহরে পোস্টেড ছিলেন তখন পেরন্টেস ভিজিটিং ডে’তে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে এসে বাবরের সাথে দেখা করতেন। ঢাকায় থাকার কারণে গত ছ’মাস যাবত তিনি বা পরিবারের অন্য কেউ ঐদিনগুলোতে বাবরকে দেখতে আসতে পারছেন না। এই সুযোগ নিয়ে তাঁদের যশোরের এক প্রাক্তন পড়শী মহিলা বাবরের খালার পরিচয় দিয়ে বাবরকে দেখতে আসছে। আমি সরল মনে জানতে চাইলাম তাতে দোষের কী হলো। জবাবে ভদ্রলোক যা বললেন তাতে আমার দিব্যদৃষ্টি খুলে গেলো ! তথাকথিত খালার একটি ১৫/১৬ বছর বয়সী মেয়ে আছে যে ক্লাস টেনে পড়ে। মহিলা চাচ্ছে বাবর যাতে তার মেয়ের সাথে প্রেম করতে থাকে। বাবর ক্যাডেট কলেজের ছাত্র, পড়াশুনাসহ সবদিক দিয়ে ভালো। জামাই হিসেবে খুব ভালো হবে। তাই এখন থেকে ‘হুক’ করে রাখতে চাচ্ছে। বাবর অনেকটা পটে গেছে বলে বাবরের মা-বাবার ধারণা। কলেজে লম্বা ছুটি হলে বাবর এখন আর সরাসরি ঢাকা চলে যায় না। যশোরে ‘খালা’র বাসায় দু’য়েক দিন বেড়িয়ে পরে ঢাকা যায়। বিষয়টি বাবরের বাবা এবং মা কেউই মেনে নিতে পারছেন না। কাঁদোকাঁদো হয়ে তিনি বললেন, যেভাবেই হোক বাবরের সাথে ঐ ‘খালা’ এবং তার মেয়ের দেখাসাক্ষাত বন্ধ করতেই হবে। কলেজে ভেকেশন শুরু হলে বাবরকে সরাসরি ঢাকাতে আসতে হবে। যশোরে ‘খালা’র বাড়ি যাওয়া চলবে না। আমি মনেমনে ভাবলাম, আল্লাহ জানেন, এমন আর কতো বাবর আছে আমার কলেজে ! আমি বাবরের বাবাকে এই বলে আস্বস্ত করলাম, আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন। অবশ্যই কিছু একটা করবো।
মাসিক হা্উস ইন্সপেকশনের সময় কোনোকোনো ক্যাডেটের কাবার্ড থেকে উগ্র রাজনৈতিক দলের প্রচারমূলক পুস্তিকা, লিফলেট পাওয়া গেলো। শুক্রবার জুমার নামাজে ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দলের সদস্যরা নামাজ পড়ার অছিলায় কলেজ মসজিদে এসে ছেলেদের সাথে রাজনৈতিক আলোচনা করতো। কিছু উগ্র বামপন্থী দলের কর্মীরাও সুযোগ বুঝে কলেজে ঢুকে একই কাজ করছে বলে জানতে পারললাম।
টি-ব্রেকের সময় আমি স্টাফ রুমে গিয়ে ফ্যাকাল্টি মেম্বারদের সাথে একত্রে চা-নাস্তা খেতাম । এটা আমার প্রতিদিনের অভ্যাস ছিলো। অভ্যাসটি শিখেছিলাম আর্মি থেকে। ইউনিট পর্যায়ে আর্মিতে এটির চর্চা খুব জনপ্রিয়। অফিসে বা বাইরে খুব জরুরি কিছু না থাকলে এটা মিস করতাম না। চা-নাস্তা খেতেখেতে হাল্কা পরিবেশে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের অবতারণা করে সকলের মতামত ও সুপারিশ জেনে নিতাম। মতানৈক্য হলে বেশ বিতর্ক জমে উঠতো। টি-ব্রেকের নির্ধারিত সময় শেষ হয়ে গেলে যাঁদের ক্লাস বা কাজ থাকতো তাঁরা উঠে চলে যেতেন। আমি অন্যদের নিয়ে আলাপ করতাম। ফর্মাল স্টাফ মিটিংয়ে অনেকে, বিশেষ করে জুনিয়র সহকর্মীরা, সহজে মুখ খুলতে চান না। কিন্তু ইনফর্মাল চায়ের টেবিলে হাল্কা পরিবেশের কারণে সবাই মনের কথা বলতে উৎসাহিত বোধ করতেন। অনেকটা আড্ডার মতো পরিবেশ হতো, যেখানে আমি বলতাম খুব কম, শুনতাম বেশি। নেপথ্যে থেকে আলোচনার বিষয় ও গতি নিয়ন্ত্রণ করতাম। প্রায় সকল ক্ষেত্রে আলোচনায় গৃহীত সিদ্ধান্ত আমার নিজস্ব সিদ্ধান্ত থেকে ভিন্নতর হতো না। এ ধরনের আলোচনায় আরও একটা সুবিধা ছিলো। আলোচনার মাধ্যমে যে সিদ্ধান্ত বেরিয়ে আসতো তা, প্রিন্সিপালের সিদ্ধান্ত হিসেবে অফিস অর্ডারের মাধ্যমে প্রকাশিত হলেও, উপস্থিত সকলে যৌথ সিদ্ধান্ত হিসেবে মেনে নিয়ে তা আন্তরিকভাবে পালন করতেন। সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে সবাই নিজেকে অংশীদার মনে করতেন। প্রিন্সিপালকে কমান্ডার বা বস হিসেবে না দেখে টীমলিডার হিসেবে দেখতেন। নির্দেশ প্রদান ও পালনের ক্ষেত্রে এই বিশেষ পদ্ধতিটি খুবই কার্যকর হয়েছিলো। ঐতিহ্যগতভাবে বাংলাদেশিরা এন্টি এস্টাবলিশমেন্ট। যার কারণে, শিক্ষিতরা বসের আদেশ মানার চাইতে টীমলিডারের আদেশ মানতে আধিকতর সাচ্ছ্যন্দ বোধ করেন বলে আমি মনে করি।
যাহোক, পেরেন্টস ভিজিটিং ডে’তে সৃষ্ট এসব অরাজকতা দূর করার জন্য টি-রুমে আলোচনার ভিত্তিতে বেশ কিছু সিদ্ধান্ত নেয়া হলো। যা ক্যাডেটদেরকে সাপ্তাহিক সমাবেসে, এবং তাদের পিতামাতা/অভিভাবকদেরকে লিখিতভাবে জানিয়ে দেওয়া হলো। কলেজ গেইটে কড়াকড়ি আরোপ করা হলো। কলেজ চত্বরে ঢোকার সময় এবং বের হবার সময় সকল ভিজিটরক তার নাম, ঠিকানা, প্রবেশের সময় এবং কারণ, এবং বের হবার সময় লিপিবদ্ধ করার নিয়ম চালু করা হলো। শুক্রবার ক্যাডেট ও ক্যাম্পাসে বসবাসকারী ছাড়া অন্যদের কলেজ মসজিদে জুমার নামাজের জন্য আসা বন্ধ করা হলো। ক্যাডেটদের আবাসিক এলাকায় প্রবেশের পথে প্রয়োজনীয় চেকপোস্ট বসানো হলো। মসজিদে কর্মকর্তা-কর্মচারীর কোনো বহিরাগত মেহমান আসতে চাইলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীকে বলা হলো মেহমানকে নিজে সঙ্গে করে আনতে। সকল পিতামাতা ও অনুমোদিত অভিভাবককে কলেজের অফিস থেকে ছবিসহ পরিচয়পত্র প্রদান করা হলো। পেরেন্টস ভিজিটিং ডে’তে পরিচয়পত্র দেখিয়ে প্রবেশ করা বাধ্যতামূলক করা হলো। কোনো পিতামাতা বা অনুমোদিত অবিভাবক পরিচয়পত্র আনতে ভুলে গেলে সংশ্লিষ্ট ক্যাডেটের হাউস মাস্টার/টিউটর গেইটে এসে পরিচয় জেনে নিয়ে তাঁকে ভিতরে আসতে দিতেন।
এতো সব করার পরও বাবরের বাবার সমস্যা পুরোপুরি সমাধান হলো না। বাবরের যশোর যাওয়া বন্ধ করতে হবে। ঝিনাইদহ বাস মালিক সমিতির কর্মকর্তাদেরকে চায়ের দাওয়াত দিয়ে আমার অফিসে ডেকে এনে সহযোগিতা চাইলাম। সিদ্ধান্ত হলো, ভেকেশন শুরুর কয়েকদিন আগে জানালে তাঁরা ঢাকা, খুলনা, কুষ্টিয়া, যশোর, মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গা এসব শহরের জন্য রিজার্ভড বাসের ব্যবস্থা করে দিবেন। এসব বাস গন্তব্য ছাড়া রাস্তায় কোথাও থামবে না। কোনো ক্যাডেট নির্ধারিত গন্তব্য ছাড়া অন্য কোথাও যেতে চাইলে আগেভাগে অভিভাবকের কাছ থেকে লিখিত অনুরোধ আনতে হবে। এরপর থেকে বাবরের পক্ষে আর যশোরে ‘খালা’র বাড়ি যাওয়া আমার জানামতে সম্ভব হয়নি। তবে শেষ পর্যন্ত সেই ‘খালা’র মেয়েটির সাথে বাবরের প্রেম কতদূর এগিয়েছিলো, তা আমি জানতে পারিনি !
ইতোমধ্যে একটি ঘটনা ঘটলো যা আমার জন্য কষ্টদায়ক হলেও আমার কাজ কিছুটা হলেও সহজ করে দিলো। একদিন দুপুর বেলা আমার বড় মামা গ্রামের বাড়ি থেকে কলেজে এলেন আমার পরিবারের সবার সাথে দেখা করতে। ছোটো বেলায় আমার মা মারা যাবার পর থেকে, যেখানেই থাকতাম না কেনো, উনি প্রায়ই এমন আসতেন। বিকেল বেলা মামা ইচ্ছে প্রকাশ করলেন উনার গ্রামের একটি ক্যাডেটকে উনি দেখবেন। ওর বাবাকে উনি কথা দিয়ে এসেছেন। আমি পড়লাম মহা বিপদে। কলেজের আইন ভঙ্গ করে আমার পক্ষে উনার ইচ্ছা পূরণ করা কিছুতেই সম্ভব নয়। অন্যদিকে জীবনে কখনও মামার কথা অমান্য করিনি। তখনই সরাসরি জবাব দিলে, আমি জানি, মামা আমার বাসা ছেড়ে রাগ করে চলে যাবেন। কিছুটা সময় নেবার জন্য বললাম, এই তো এলেন। রেস্ট করেন। দেখি কাল সকালে কী করা যায়। পরদিন সকাল বেলা নাস্তার টেবিলে মামা পুনরায় অনুরোধ জানালেন ছেলেটিকে দেখার জন্য। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ক্যাডেটদের সাথে বহিরাগতদের দেখাসাক্ষাতের নিয়মকানুন সম্পর্কে ছেলেটির বাবা আপনাকে কিছু বলেননি ? তিনি জানালেন, না। আমি তখন অনেক কষ্টে তাকে বুঝিয়ে বললাম, কেনো কলেজের আইন অনুযায়ী তাঁর সাথে ছেলেটিকে দেখা করতে দেওয়া যায় না। তিনি বললেন, প্রিন্সিপাল আনুমতি দিলেও দেখা করা যাবে না ? আমি বললাম, না। খুব জরুরি কারণ ছাড়া প্রিন্সিপালের অনুমতি দেওয়ার এখতিয়ার নেই। আপনার সাথে ঐ ছেলেটির দেখা করার কোনো জরুরি প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করি না। আমি খোঁজ নিয়েছি। ছেলেটি ভালো আছে। বাড়ি ফিরে ওর বাবাকে জানিয়ে দিবেন। যদি ওর বাবা প্রশ্ন করেন কেনো দেখা হলো না, তবে তাঁকে কি জবাব দেবো, মামা জানতে চাইলেন। বলবেন, ভাগ্নে খুব আদর যত্ন ও সম্মান করেছে। তবে প্রিন্সিপাল বেটা খুব নিষ্ঠুর ! কোনোমতেই আপনার ছেলের সাথে দেখা করার অনুমতি দিলো না। আমার একথা শুনে মনে হলো মামা নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। মুখ অত্যন্ত বেজার করে মামা উঠে গেলেন। কোনো রকমে চা-নাস্তা খেয়ে চলে গেলেন। তারপর রাগ করে প্রায় তিনচার মাস আমার বাসায় আসেননি।
ঘটনাটি কেমন করে যেনো সারা কলেজে ছড়িয়ে গেলো। হয়তো প্রিন্সিপালের বাসার স্টাফদের কাছ থেকে জানতে পেরে থাকবে। এখানে একটা কথা বলে রাখি। ক্যাডেট কলেজের প্রিন্সিপালের ব্যক্তিগত জীবনে প্রাইভেসি বলতে কিছু নেই। সারাক্ষণ তাঁকে এবং তাঁর পরিবারের সদস্যদেরকে প্রায় ১৫০ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীর তীক্ষ্ন নজরদারিতে থাকতে হয়। ভালো বা মন্দ উল্লেখযোগ্য কিছু ঘটলে তা সাথেসাথে সবার কানে পৌঁছে যায়। ক্যাডেটরাও জেনে ফেলে। এজন্য প্রিন্সিপালকে, এমনকি তাঁর পরিবারের সদস্যদেরকে, প্রতিটি কাজে এবং কথায় অনগার্ড থাকা খুবই জরুরি।
কিছুকিছু পিতামাতা/অভিভাবক, বিশেষ করে মায়েরা, উপরে উক্ত ব্যবস্থা নেবার কারণে প্রথম দিকে প্রিন্সিপালের উপর খুব রাগ করেছিলেন। তাঁদের নানারকম মন্তব্য, যা মোটেও সুখকর ছিলো না, ঘুরেফিরে আমার কানে আসতে লাগলো। তাঁরা কেউকেউ এমন মন্তব্যও করলেন, প্রিন্সিপাল তো নয় যেনো আই জি প্রিজন এসেছেন। তবে অনেকে ব্যাপারটি প্রশংসার চোখেও দেখেছিলেন। কিছুদিন পরে অবশ্য সবাই নিয়মটি মন থেকে মেনে নিয়েছিলেন।
0 Comments:
Post a Comment
Subscribe to Post Comments [Atom]
<< Home