ক্যাডেট কলেজের টুকরো স্মৃতি: ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজ: পর্ব ৬: ঠিকাদারের চ্যালেঞ্জ
কলেজে যোগদানের সপ্তাহখানিকের মধ্যে লক্ষ্য করলাম, প্রিন্সিপালসহ কিছু কর্মকর্তা এবং কর্মচারি ঠিকাদারের কাছ থেকে ফ্রেশ রেশন, যেমন গোস্ত, মাছ, তরকারি, তাজা ফল ইত্যাদি ক্রয় করতেন। মাসের শেষে ঠিকাদারের বিল পরিশোধ করতেন। আরও লক্ষ্য করলাম, প্রিন্সিপালের বাসায় সরবরাহকৃত মাছ-গোস্তের ওজন চাহিদকৃত পরিমানের চাইতে সবসময় বেশি। তরি-তরকারি, ফল-মূলের গুণগত মান ক্যাডেট মেসে সরবরাহকৃত আইটেমের চেয়ে অনেক ভালো, এবং পরিমানও চাহিদার চাইতে বেশি। কোনো কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারি মাসের পর মাস ঠিকাদারের বিল পরিশোধ না করে বাকি রাখছেন। এ নিয়ে ঠিকাদার কোনো আভিযোগও করছেন না। আমার বুঝতে বাকি রইলো না, প্রিন্সিপাল এবং কর্মকর্তা-কর্মচারিদের বাসায় অন-পেমেন্ট রেশন সাপ্লাইয়ের নামে বড় রকমের দুর্নীতি হচ্ছে। এসব লোকদের পরিমানে বেশি এবং উন্নততর মানের রেশন সাপ্লাই করে ঠিকাদারের যে লোকসান হচ্ছে, তা তিনি ক্যাডেট মেসে ওজনে কম এবং খারাপ রেশন সাপ্লাই করে পুষিয়ে নিচ্ছেন। ব্যাপারটি সম্পূর্ণ অনৈতিক হবার কারণে সাথেসাথে ঠিকাদারের কাছ থেকে প্রিন্সিপালসহ অন্য সকলের রেশন নেয়া নিষিদ্ধ করে দিলাম। ঝিনাইদহ শহরের কাঁচা বাজার কলেজ গেইট থেকে মাত্র সোয়া মাইল দূরে। বাস, রিক্সা বা সাইকেলে করে যাওয়াআসা করা কোনো কঠিন কাজ ছিলো না।
ক্যাডেটদের জন্য নিকটস্থ আর্মি ইউনিট অথবা এসএসডি (স্টেশন সাপ্লাই ডেপো) থেকে সরকার-নির্ধারিত মূল্যে চাল, আটা, চিনি ও ভোজ্য তেল সরবরাহ করা হতো। ফ্রেশ এবং ড্রাই রেশনের বাকি সব আইটেম ঠিকাদারের কাছ থেকে নিতে হতো। সকল আইটেম সাপ্লাই করার জন্য একজন ঠিকাদার ওপেন টেন্ডারের মাধ্যমে বারো মাসের জন্য নিয়োগ পেতেন। রাজনৈতিকভাবে অতি প্রভাবশালী এবং পেশীশক্তিতে অত্যন্ত বলীয়ান ঝিনাইদহ শহরের একই ব্যক্তি প্রতি বছর ছলে-বলে-কৌশলে ঠিকিাদারির একাজটি বাগিয়ে নিতেন। ভয়ে কেউ কোনো প্রতিবাদ করতে সাহস পেতো না। বাইরে থেকে এসে অন্য কোনো ঠিকাদার ভয়ে টেন্ডার জমা দিতে পারতেন না। তাছাড়া, টেন্ডারে কিছুকিছু আইটেম ছিলো যা কখনই কেনা হতো না। যেমন, গুড় এবং নারিকেল। কলেজ অফিস থেকে এসব আইটেমের চাহিদাও দেখানো হতো অনেক বেশি করে। যেমন, গুড়ের বাৎসরিক চাহিদা ছিলো ৩০ মণ, নারিকেলের চাহিদা ছিলো ৫০০০। আমার মনে আছে, গুড়ের দাম কোট করা হয়েছিলো কেজিপ্রতি দুই পয়সা, আর নারিকেল প্রতিটির দাম ছিলো এক পয়সা ! ক্যাডেট মেসে গুড়ের ব্যবহার একেবারেই ছিলো না। সকল প্রয়োজনে চিনি ব্যবহার করা হতো। কখনও কখনও নারিকেলের প্রয়োজন হলে কলেজের নিজস্ব গাছ থেকে নারিকেল পেরে ব্যবহার করা হতো। প্রভাবশালী ঠিকাদারটি এরকম সব আইটেমের অবিশ্বাস্য রকম কম দাম কোট করতেন। অন্যদিকে যেসব আইটেম প্রায় প্রতিদিন লাগতো সেগুলোর দাম অসম্ভব বেশি করে কোট করতেন। যেমন, রুই মাছের কেজি তখন বাজারে ছিলো ৩০ থেকে ৪০ টাকা। টেন্ডারে কোট করা হতো ৭০ থেকে ৮০ টাকা, বা তারও বেশি। একইভাবে মুরগি, গরু এবং খাসির গোস্তসহ অন্যান্য আইটেমের দাম আকাশচুম্বি অবাস্তব রেটে কোট করা হতো। এর মধ্যে কতো বড় অসাধু চতুরতা আছে, তা যাঁরা সাপ্লাইয়ের ব্যবসার সাথে জড়িত তাঁরা সবাই জানেন। তবে যাঁরা ব্যবসা করেন না, তাঁদের জন্য বিষয়টি একটু খোলাসা করে বলছি। টেন্ডারে উল্লিখিত প্রতিটি আইটেমের ইউনিট প্রাইস কোট করে চাহিদাকৃত সকল আইটেমের, আইটেমওয়াইজ, মোট পরিমানের দাম কোট করা হতো। সবশেষে সব আইটেমের সর্বসাকুল্যে যা দাম হতো তা কোট কর হতো। নিত্য প্রয়োজনীয় আইটেমগুলোর দাম আকাশচুম্বি হলেও গুড় এবং নারিকেলের মতো আপ্রয়োজনীয় আইটেমের হাস্যকর কম দামের কারণে সর্বসাকুল্য দাম অনেক কমে আসতো। বাহির থেকে কোনো ঠিকাদার এলে তাঁর পক্ষে এ চালাকি করা সম্ভব হতো না। তাঁরা গুড় এবং নারিকেলসহ সব আইটেমের স্বাভাবিক দাম কোট করতেন। যারফলে তাঁদের কোট করা সর্বসাকুল্য দাম প্রভাবশালী ঠিকাদারের কোট করা দামের চাইতে বেশি হতো। ঝিনাইদহ শহরের সেই একই প্রভাবশালী ঠিকাদার বছরের পর বছর, আইনের কোনো ব্যত্যয় না ঘটিয়ে, এভাবে সাপ্লাইয়ের কাজটি হস্তগত করতেন।
বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করে উভয় পক্ষের জন্য গ্রহণযোগ্য একটি সমাধান বের করার জন্য ঠিকাদারকে অফিসে আসতে অনুরোধ করলাম। অফিসে এলে আমি তাঁকে নিশ্চয়তা দিলাম, যেসব আইটেমের অস্বাভাবিক বেশি দাম ধরা হয়েছে সেগুলো কমিয়ে সহনীয় পর্যায়ে আনা হলে আমি গুড় বা নারিকেল জাতীয় আইটেমের জন্য কোনো ডিমান্ড দেবো না। চাইলে তাঁকে আমি লিখিত নিশ্চয়তা দিতে রাজি আছি। তিনি কোনো সিদ্ধান্ত না দিয়ে পরে জানাবেন বলে চলে গেলেন। পরে লোক মারফত জানালেন, তাঁর পক্ষে এখন কিছু করা সম্ভব নয়। পরবর্তী অর্থ বছরে কোটেশন সাবমিট করার সময় তিনি কথাটা বিবেচনায় রাখবেন। শুনে আমার খুব মন খারাপ হলো, রাগও হলো ঠিকাদারের উপর। নিজের সন্তানের বয়সী বাচ্চা ছেলেদের কল্যাণের কথা বিবেচনা না করে বছরের পর বছর নাজায়েয মুনাফা লুটে খাচ্ছেন। অথচ, ৩০ জুন পর্যন্ত, মাত্র দু’তিন মাসের জন্য কোনো বিবেচনা করতে রাজি নন। ভাবলাম, এই জালিমকে অন্তত: একবার উচিৎ শিক্ষা দিতে হবে। আমি সর্বোচ্চ পরিমান গুড় এবং নারিকেল সাপ্লাই করার জন্য ঠিকাদারকে অর্ডার দিলাম। এবার তাঁর টনক নড়লো। লোক পাঠিয়ে অনেক অনুনয়-বিনয় করলো গুড় এবং নারিকেলের অর্ডার বাতিল করার জন্য। আমার এক জবাব, সময়মত গুড় এবং নারিকেল সরবরাহ করুন। নইলে চুক্তির শর্ত অনুযায়ী আর্নেস্ট মানি ৩০ হাজার টাকা বাজেয়াপ্ত করা হবে। কলেজের কেউকেউ মন্তব্য করলেন, প্রিন্সিপাল সাহেবের কি মাথা খারাপ হয়ে গেলো ? এত গুড় আর নারিকেল কে খাবে ? তাঁদেরকে বললাম, গুড় ডেইরি ফার্মের গাভীদের খাওয়ানো হবে। নারিকেল ক্যাডেট মেসে দেওয়ার পর যা অতিরিক্ত থাকবে তা কলেজের কর্মকর্তা-কর্মচারিদের কাছে কেনাদামে বিক্রি করা হবে। করেছিলামও তাই ! ঠিকাদার আমাকে বিভিন্ন চ্যানেলে হুমকি-ধামকি দিলেন। শেষ পর্যন্ত ‘রক্ত’ (আসলে আলতা !) দিয়ে চিঠি লিখে হত্যা করার হুমকিও দিতে বাকি রাখলেন না। আমার শুভাকাঙ্খীরা আমাকে সতর্ক হয়ে চলাফেরা করার পরামর্শ দিলেন। বিশেষ করে রাতবিরাতে গাড়িতে করে একা শুধু ড্রাইভার নিয়ে ৩০ মাইল দূরে যশোর ক্যান্টনমেন্টে যাতায়াতে নিষেধ করলেন। সেসময়ে ঝিনাইদহ অঞ্চল উগ্র রাজনৈতিক কর্মকান্ডের জন্য পরিচিত ছিলো। প্রায়ই দু’য়েকটা রাজনৈতিক হত্যাকান্ড সংঘটিত হতো। যাহোক, আমি এসবে কর্ণপাত করিনি। আমার বিশ্বাস ছিলো, এবং আজও আছে, হায়াত-মউতের মালিক আল্লাহ। আর, যারা এরকম হুমকি দেয় তারা সাধারণত: কাপুরুষ হয়ে থাকে। যাদের সাহস থাকে তারা হুমকি দেয় না, কাজটাই করে ফেলে।
তখন সম্ভবত: মার্চ মাসের শেষ ভাগ। এপ্রিল মাসে পরবর্তী অর্থ বছরের জন্য নতুন দরপত্র আহ্বানের সময় হবে। সংশ্লিষ্ট সকল ছোটোছোটো সাব-কন্ট্রাক্টরকে আফিসে ডাকলাম। তাঁরা সবাই যা একবাক্যে বললেন তা হলো: সরবরাহকৃত সকল আইটেমের কনসলিডেটেড মূল্য প্রায় ৩০ লক্ষ টাকা। যার জন্য টেন্ডারের সাথে ৩০ হাজার টাকার বেশি আর্নেস্ট মানি জমা দিতে হয়। তাঁরা প্রত্যেকে অতি ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। এতো টাকা আর্নেস্ট মানি দেওয়া তাঁদের কারও একার পক্ষে সম্ভব নয়। শ্রেণী অনুযায়ী আইটেমগুলো ভাগভাগ করে প্রতি ৬ মাসে যদি টেন্ডার ডাকা হয় তবে তাঁরা তাতে অংশ নিতে পারবেন। সেক্ষেত্রে প্রতি শ্রেণীর আইটেমসমূহের জন্য ৫ থেকে ১০ হাজার টাকার মতো আর্নেস্ট মানি দিতে হবে। তবে একাজ করতে গেলে বড় একটা সমস্যা হবে। সেজন্য তাঁরা আমার সাহায্য চাইলেন। প্রভাবশালী বড় ঠিকাদার ক্ষেপে গিয়ে নিজস্ব গুন্ডা দিয়ে, অথবা থানাপুলিশ দিয়ে তাঁদের হেনস্থা করতে চাইবেন। আমি আমার পক্ষ থেকে সকল প্রকার সাহায্য-সহযোগিতার নিশ্চয়তা দিলাম।
কেনো আমি ফ্রেশ এবং ড্রাই রেশনের দরপত্র ভেঙ্গেভেঙ্গে ছোটো করতে চাই তা ব্যাখ্যা করে চেয়ারম্যানের অফিসে চিঠি দিলাম। চেয়ারম্যান অনুমোদন দিয়ে দিলেন। ঝিনাইদহের এসডিও এবং এসডিপিও-কে (তখনও ঝিনাইদহ জেলা হয়নি) ক্ষুদ্র ঠিকাদারদের নিরাপত্তার কথা বলে, তাঁদের সহযোগিতা চাইলাম। তাঁদের দু’জনকেই আমার কাছে অত্যন্ত ভালো অফিসার বলে মনে হয়েছে। দু’জনেই সানন্দে রাজি হলেন সর্বপ্রকার সহযোগিতা প্রদানের জন্য। এতোদিন পর তাঁদের নাম মনে করতে পারছিনা বলে আমি দু:খিত। আসলে, স্থানীয় প্রশাসনিক অফিসারদের সহযোগিতা ছাড়া কোনো প্রতিষ্ঠান, বিশেষ করে মফস্বল অঞ্চলে, পরিচালনা করা খুবই কঠিন। সে যায়গায় তাঁরা যদি অন্যায় হস্তক্ষেপ করেন তাহল কাজটি করা প্রায় অসম্ভব হয়ে যায়।
পরবর্তী জুলাই মাস থেকে ক্যাডেটদের খাওয়াদাওয়া নিয়ে বড় কোনো সমস্যা রইলো না। নবনিযুক্ত ক্ষুদ্র ঠিকাদাররা অত্যন্ত উৎসাহের সাথে ভালো মানের ফ্রেশ এবং ড্রাই রেশন সরবরাহ করতে লাগলেন। বড় একটা ঝামেলা থেকে বাঁচা গেলো !
0 Comments:
Post a Comment
Subscribe to Post Comments [Atom]
<< Home