tag:blogger.com,1999:blog-298317252024-03-13T05:50:16.586-07:00Ashraf’s ColumnThis is a collection of Brigadier General (Retd) Syed ABM Ashrafuzzaman's thoughts posted on various Bangladesh dailies and e-forums on diverse topics.
syed.ashrafuzzaman@gmail.comAshraf's columnhttp://www.blogger.com/profile/16382744974160016625noreply@blogger.comBlogger83125tag:blogger.com,1999:blog-29831725.post-74143106877800306842014-10-24T01:06:00.001-07:002014-10-24T01:06:07.487-07:00ক্যাডেট কলেজের টুকরো স্মৃতি: শেষ পর্ব : ৯ কিছু পরামর্শবিভিন্ন সময়ে আত্মীয়-স্বজন এবং পরিচিত জনেরা আমার কাছে পরামর্শ চেয়ে থাকেন, তাঁর ছেলে বা মেয়েকে ক্যাডেট কলেজে পড়তে পাঠাবেন কিনা। ক্যাডেট কলেজের একাডেমিক সিলেবাস সম্বন্ধে সবাই জানলেও এর কারিকুলাম, অর্থাৎ এর পাঠ্যসূচির দার্শনিক ভিত্তি, সম্পর্কে বেশিরভাগ লোকের স্বচ্ছ ধারণা নেই। এ সম্পর্কে জানার জন্য বাজারে বইপত্র আছ বলে আমার জানা নেই। মানুষ তাই ক্যাডেট কলেজ কোচিং সেন্টার, ক্যাডেট কলেজের পরিচিত প্রাক্তন ছাত্র বা শিক্ষক, অথবা আর্মি অফিসারের কাছ থেকে এ সম্পর্কে জানতে চান। সহজবোধ্য কারণে কোচিং সেন্টার কখনও সঠিক তথ্য সরবরাহ করে না। বাকিদের সাথে যোগাযোগ করা অনেকের পক্ষে সম্ভব হয় না। যাহোক, এ বিষয়ে আমার ব্যক্তিগত বিশ্বাস থেকে বলে নিতে চাই। যদিও অনেকে আমার বক্তব্যকে মানতে চাইবেন না। অনেকে ভুল বুঝবেন।
প্রথম কথা হলো, আমি বিশ্বাস করি, বর্তমানে যেমনটা আছে তাতে, আমি মেয়েদেরকে ক্যাডেট কলেজে পড়তে পাঠানোর বিরোধী। ক্যাডেট কলেজে একটি ছেলে বা মেয়ে সাড়ে এগারো বা বারো বছর বয়স থেকে সাড়ে সতেরো বা আঠারো বছর বয়স পর্যন্ত অবস্থান করে। বয়সসীমা আভিন্ন হলেও এই বয়সের একটি ছেলে ও একটি মেয়ের শারীরিক এবং মানসিক গঠন ও ডিভেলাপমেন্টের মধ্যে আকাশ-পাতাল পার্থক্য বিরাজ করে। পাঠকদের মধ্যে যাঁরা ইতোমধ্যে মা-বাবা হয়েছেন, আশা করি তাঁদেরকে বিষয়টি বুঝিয়ে বলতে হবে না। আমাদের সমাজে এই বয়সের একটি মেয়েকে ভবিষ্যত সংসার জীবনে সার্থক ও সুখী হবার জন্য অনেক ট্রিক্স অব দি ট্রেইড শিখতে হয়। আর এটা শেখার জন্য কোনো পাঠশালা বা পাঠ্যবই নেই। আবহমান কাল থেকে আমাদের মেয়েরা এ কৌশলগুলো নিজনিজ মায়ের কাছ থেকে, এবং পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের কাছ থেকে, রপ্ত করে থাকে। আমাদের সমাজে এখনও একটি মেয়ে, জীবনের অন্যন্য ক্ষেত্রে অসাধারণ কৃতিত্ব অর্জন করলেও, যদি সংসার জীবনে কৃতকার্য না হতে পারে, তাহলে সে জীবনে সুখী হতে পারে না। আমাদের দেশে ক্যাডেট কলেজের কারিকুলাম মূলত: ডিজাইন করা হয়েছিলো শুধুমাত্র নির্দিষ্ট বয়সের ছেলেদের জন্য, মেয়েদের জন্য নয়। ক্যাডেট কলেজের যে পরিবেশ তাতে একটি কিশোরী মেয়ে আর্মি থেকে আসা মেজর হাবিলদার/নায়েকদের কাছ থেকে কী শিখবে তা আমি বুঝতে পারি না। আপনার মেয়েকে ক্যাডেট কলেজে ভর্তি করার আগে কথাগুলো ভেবে দেখবেন।
এবার অশা যাক ছেলেদের কথায়। উপরে যে বয়সসীমা উল্লেখ করা হয়েছে তাতে একটি ছেলে ‘ছেলেমানুষ’ থাকে। তাকে গড়েপিটে একাধিক ‘ম্যানলি’ গুণাবলী শেখানো হয়। তবে মনে রাখার বিষয়, সব ছেলে জন্মগতভাবে ‘ক্যাডেট কলেজ টাইপ’ নয়। আল্লাহ সব ছেলেকে ‘ক্যাডেট কলেজ টাইপ’ করে সৃষ্টি করেন না। সব ছেলে বড় হয়ে জেনারেল হয় না, হবার দরকারও নেই। সমাজের সার্বিক উন্নতির জন্য সকল পেশায় মেধাবী ও সৃজনশীল কর্মীর প্রয়োজন। যে ছেলেটি বড় হয়ে একজন অধ্যাপক সত্যেন বসু, একজন ড: ইউনুস, একজন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন, একজন ড: এফ আর খান, বা একজন কবি নজরুল ইসলাম হবে, সে তো ক্যাডেট কলেজের শৃঙ্খলিত জন্য ‘মিসফিট’ হবে। ক্যাডেট কলেজ শিক্ষা পদ্ধতির সবথেকে বড় দোষ হলো, এখানে ক্রিয়েটিভিটি বা সৃজনশীলতা বিকাশের সুযোগ অতি সীমিত। এখানে ভালো করতে হলে একটি ছেলেকে কনফর্মিস্ট (Conformist) বা নির্বাক আজ্ঞাবহ হয়ে থাকতে হয়। প্রচলিত ধ্যানধারণার বাইরে বা বিরুদ্ধে কিছু ভাবা বা বলার সুযোগ নাই বললেই চলে। এলিমেন্টারি মিলিটারি ট্রেইনিংয়ের অংশ হিসেবে এমনটা করা হয়। এখান থেকে পাশ করা বেশিরভাগ ছেলে, দেখা গেছে, প্রাণের টানের চাইতে কর্তব্যবোধ থেকে তাড়িত হয়ে মানবিক কাজে অংশ গ্রহণ করে। একটি মানব শিশুর মধ্যে মানবিক গুণগুলোর স্ফুরণ, বর্ধণ ও উন্নয়নের জন্য একটা বয়স পর্যন্ত প্যারেন্টাল লাভ এন্ড কেয়ার, অর্থাৎ মা-বাবার আদর-ভালোবাসা ও যত্ন, খুব জরুরি। সে স্বর্গীয় আদর-ভালোবাসা ও যত্ন থেকে কী মূল্যে আপনি আপনার ছেলেকে বঞ্চিত করে পরিবার থেকে দূরে সড়িয়ে দিয়ে ক্যাডেট কলেজে দিবেন, তা ভালো করে ভেবে দেখা উচিৎ। ক্যাডেট কলেজগুলো মূলত: বৃটিশ পাবলিক স্কুলের আদলে স্থাপন করা হয়েছে। কলোনিয়াল যুগে অনেক বৃটিশ নাগরিককে বিভিন্ন কলোনিতে চাকুরি করতে হতো। সেসব কলোনিতে তাদের সন্তানদের জন্য উপযোগী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছিলো না। তাই এসব সন্তানদের জন্য বিলেতে, ক্ষতিকারক দিকগুলো মেনে নিয়ে, আবাসিক পাবলিক স্কুল স্থাপন করা হয়। পরের দিকে ভারতে এরকম প্রতিষ্ঠান স্থাপন করা হয়। বিশেষ করে চা বাগানে, সমূদ্রগামী জাহাজে, বন বিভাগে এবং বিদেশে কর্মরত লোকদের সন্তানদের জন্য এসব পাবলিক স্কুল জনপ্রিয় হতে থাকে। ব্রোকেন ফ্যামিলির, অর্থাৎ যেসব পরিবারে বাবা-মা তালাক বা অন্য কারণে একত্রে বাস করে না তাদের, বাচ্চাদের জন্যও এসব স্কুল জনপ্রিয় হয়। আপনার যদি এমন বাধ্যবাধকতা থাকে, অথবা আপনার ছেলে যদি ‘ক্যাডেট কলেজ টাইপ’ হয় তাহলে তাকে ক্যাডেট কলেজে পাঠাতে পারেন। তা না হলে, ছেলেকে একটি ভালো স্কুলে পাঠান, বাড়িতে ছেলের বেড়ে উঠার উপর নজর রাখুন। দেখবেন, আপনার ছেলে স্বাভাবিকভাবে বেড়ে উঠবে।
পাঠক আমাকে প্রশ্ন করতে পারেন, আপনার নিজের ছেলেমেয়েদের স্কুল পর্যায়ে কোথায় পড়িয়েছেন। আমাদের একটি মেয়ে এবং দু’টি ছেলে। মেয়েকে ক্যাডেট কলেজে দেওয়ার কথা কখনও আমার এবং আমার স্ত্রীর মাথায় আসেনি। বড় ছেলে সহপাঠীদের পাল্লায় পড়ে নিজ উদ্যোগে ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে কোনো একটি ক্যাডেট কলেজে গিয়েছিলো। কিন্তু সে ক্যাডেট কলেজ টাইপ না হওয়াতে দু’বছর না যেতেই তাকে বাড়ি ফিরিয়ে আনতে হয়েছিলো। ছোটো ছেলেও ক্যাডেট কলেজ টাইপ ছিলো না। তাছাড়া ও যখন ক্লাস সেভেনে তখন আমি পরিবারসহ বিদেশে কর্মরত ছিলাম। সুতরাং তাকেও ক্যাডেট কলেজে পাঠানো হয়নি। তবে আল্লাহ ওদের প্রতি, এবং বাবা-মা হিসেবে আমাদের প্রতি, অত্যন্ত সদয় ছিলনে এবং আছেন। কখনও ওদের কারও জন্য প্রাইভেট টিউটর রাখতে হয়নি। কোনো বিষয় বুঝতে না পারলে বন্ধুদের কাছ থেকে, অথবা ক্লাশের পরে শিক্ষকের কাছ থেকে বুঝে নিতো। বাড়িতে প্রাইভেট টিউটর নাই, সেজন্য ক্লাসে বাধ্য হয়ে মনোযোগী থাকতো। একবার ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে অবস্থিত বিখ্যাত একটি স্কুলের একজন শিক্ষক তাঁর কাছে প্রাইভেট নাপড়ার জন্য আমার মেয়েকে ইচ্ছাকৃতভাবে কম নম্বর দিয়েছিলো। মেয়েকে অনেক কষ্ট করে শেষমেষ বুঝাতে পেরেছিলাম যে তোমার বোর্ডের পরীক্ষার খাতা অবশ্যই এই শিক্ষক দেখবেন না। আমার মেয়ে বোর্ডের পরীক্ষায় মাত্র ৬ নম্বরের জন্য মেধা তালিকায় স্থান মিস করেছিলো ! উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করার পর ওদের লেখাপড়ার জন্য আমাকে কোনো অর্থ ব্যয় করতে হয়নি। তিনজনই ১০০% স্কলারশিপ নিয়ে দেশে এবং বিদেশে উচচ শিক্ষা শেষ করে যারযার পেশায় সাফল্যের সাথে নিয়োজিত আছে। সেজন্য আল্লাহর কাছে হাজার শুকরিয়া আদায় করছি। চাকুরি জীবনের প্রথম দিকে শিশু, কিশোর এবং প্রাপ্তবয়স্কদের শিক্ষাদান এবং শিক্ষাগ্রহণের উপর ট্রেইনিং নিতে হয়েছিলো। সেখানে যা কিছু শেখানো হয়েছিলো তা নিজের ছেলেময়েদের উপর প্রয়োগ করে এমন সুফল পাওয়া গেছে বলে আমি মনে করি। এজন্য কখনও কখনও আপনজনদের সমালোচনা সইতে হয়েছে। যেমন, বাচ্চাদের জন্য প্রাইভেট টিউটর না রাখার জন্য, বিশেষ করে মাধ্যমিক এবং উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার পূর্বে, আমাকে অনেকে কৃপণ বলে আখ্যায়িত করেছিলো। তাই বলে আমি নিজে ওদের পড়াইনি। শুধু বলা ছিলো, যদি মনে করো কোনো বিষয় বুঝতে কষ্ট হচ্ছে এবং সে বিষয়ে আমি তোমাকে সাহায্য করতে পারি, তাহলে দিনরাত্রি যে কোনো সময়ে আমার কাছে চলে আসবে। খুব কম সময়ই ওরা আমার কাছে আসতো। ব্যক্তিগত এসব কথা বলার জন্য ক্ষমা চাইছি। কথাগুলো কোনো প্রকার বড়াই করার জন্য বলছি না। বিনয়ের সাথে বলছি। আমার অভিজ্ঞতা থেকে হয়তো আমার মতো অন্য কোনো অভিভাবক উপকৃত হতে পারেন, এই আশায়।Ashraf's columnhttp://www.blogger.com/profile/16382744974160016625noreply@blogger.com0tag:blogger.com,1999:blog-29831725.post-16690750708650674962014-10-24T01:05:00.001-07:002014-10-24T01:05:01.436-07:00ক্যাডেট কলেজের টুকরো স্মৃতি: ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজ পর্ব : ৮
প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের হত্যাকান্ড
১৯৮১ সালের ৩০ মে। ফজরের নামাজ শেষ করে উঠতে না উঠতেই ক্যান্টমেন্ট থেকে টেলিফোন কল পেলাম। অপর প্রান্ত থেকে পরিচিত একজন অফিসার উত্তেজিত কন্ঠে জিজ্ঞাসা করলেন, স্যার, খবর শুনেছেন ? আমি বললাম, কী খবর ? তিনি বললেন, জেনারেল জিয়া হ্যাজ বিন কিল্ড। আমাকে চট্টগ্রাম রেডিওর খবর শোনার পরামর্শ দিয়ে তিনি ঝটপট টেলিফোন রেখে দিলেন। আমি জানতাম, প্রেসিডেন্ট জে: জিয়া তখন চট্টগ্রাম সফর করছিলেন। কিন্তু এমন মর্মান্তিক দু:সংবাদ শোনার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। যেমন ছিলো না বাংলাদেশের কোটিকোটি মানুষ। দ্রুত রেডিও অন করলাম। জে: জিয়ার নিহত হবার সংবাদ প্রচার করা হচ্ছে। আমাদের গেস্টরুমে তখন বরিশাল থেকে বেড়াতে আসা আমার মেঝো ভায়রা জনাব সিরাজুল ইসলাম ছিলেন। পেশাগতভাবে একজন সফল ব্যবসায়ী হলেও ব্যাক্তি জীবনে তিনি ছিলেন অত্যন্ত পরহেজগার, সুফীবাদের অনুসারী। গেস্টরুমে উঁকি দিয়ে দেখলাম দুলাভাই তখনও তাঁর নিয়মিত রুটিন আনুযায়ী ফজরের নামাজের পর অজিফা পড়ছেন। আমার পায়ের আওয়াজ পেয়ে তিনি ঘর থেকে বেরিয়ে এসে জিজ্ঞাসা করলেন, কী হয়েছে ? তিনি খবর শুনে “ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন” পড়ে মন্তব্য করলেন, আফসোস করে লাভ নেই। আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্য করেন। আমরা বান্দারা সব সময় বুঝতে পারিনা। আমি অবাক হয়ে প্রশ্ন করলাম, দুলাভাই, এটা কেমন কথা হলো ? এতোবড় একজন দেশপ্রেমিক নেতাকে হত্যা করা হলো। আর আপনি বলছেন, আল্লাহ ভালো করেছেন। নাস্তার পর এ নিয়ে আপনার সাথে কথা বলবো, বলে তিনি আবার অজিফায় ফিরে গেলেন।
কিছুদিনি আগে একজন গুণী লোকের মুখে শুনেছিলাম, বহি:স্থ কোনো একটি শক্তি চায়না বাংলাদেশের নেতৃত্ব কখনও একজন শক্তিশালী জাতীয়বাদী নেতার হাতে পড়ুক। তাতে বহি:স্থ শক্তিটি বাংলদেশের অর্থনীতি, ডিফেন্স, ফরেন পলিসি ইচ্ছেমতো নিজ স্বার্থে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না। পরবর্তীকালে মি: অশোক রায়না নামের একজন ভারতীয় লেখকের লেখা ‘ ইনসাইড র দি স্টোরি অব ইন্ডিয়া’স সিক্রেট সার্ভিস ’ নামক বইটি পড়ে একথার প্রমাণ পেয়েছিলাম। বঙ্গুবন্ধু হত্যা এবং পরে জে: জিয়া হত্যা, অনেকে মনে করেন, অভিন্ন সূত্রে গাঁথা। আমাদের জাতির জীবনে যাত্রালগ্নে এদু’টি নির্মম হত্যাকান্ড আমাদের জাতীয় অগ্রগতিকে যে কতোটা পিছিয়ে দিয়েছে তা আজ সকল সচেতন দেশবাসী উপলব্ধি করছেন।
জে: জিয়া পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমি, কাকুলে আমার প্রশিক্ষক ছিলেন। তিনি আমাকে ব্যাক্তিগতভাবে শুধু চিনতেনই না, আমাকে তিনি অত্যন্ত স্নেহ করতেন, বিশ্বাস করতেন। তাঁর মতো একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা, একজন মহান দেশপ্রেমিক, একজন নিবেদিতপ্রাণ কর্মবীর এবং, সর্বোপরি, একজন রাষ্ট্রনায়ককে কেনো ঘাতকদের গুলিতে প্রাণ দিতে হবে, কোনোমতেই সে প্রশ্নের জবাব খুঁজে পাচ্ছিলাম না। পরবর্তীকালে তাঁকে হত্যা করার অপরাধে ১৩ জন কর্মরত আর্মি অফিসারকে মৃত্যুদন্ড দেওয়া হয়। অনেককে বিভিন্ন মেয়াদের কারাদন্ড দেওয়া হয়। বেশ কিছু অফিসার চাকুরিচ্যুত হয়। কিন্তু আফসোস, যেসব দেশি ও বিদেশি শক্তি এই নির্মম হত্যাকান্ডের পেছনে ছিলো তাদেরকে চিহ্নিত করার জন্য কোনো তদন্ত আমার জানামতে আজও করা হয়নি। যেমনটি করা হয়নি বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা শেখ মুজিবর রহমানের হত্যাকান্ডের পর। অথচ, উভয় পক্ষের কিছু লোক পরষ্পরের দিকে অভিযোগ ছুড়ে দিয়ে কূটতর্কে ব্যস্ত আছে। জনগণের দৃষ্টি অন্য দিকে ডাইভার্ট করে আসছে। আল্লাহ জানেন, অযোগ্য, অদক্ষ এবং বহুলাংশে অসৎ এসব লোকেরা আর কতোদিন এদু’জন মহান নেতার লাশকে মূলধন করে রাজনীতি করে যাবে।
সে যাহোক, ওসব অপ্রিয় রাজনৈতিক প্রসঙ্গ আমার আজকের বলার বিষয় নয়। জে: জিয়ার হত্যার খবর শোনার পর ভাবতে লাগলাম, আমার কলেজে এ ঘটনার কী প্রভাব পড়বে এবং আমার কী করণীয় হবে। তাড়াতাড়ি নাস্তা সেরে ইউনিফর্ম পড়ে অফিসের উদ্দেশ্যে ঘরের বাইরে আসতেই কলেজের হেড চৌকিদার, একজন অবসরপ্রাপ্ত সৈনিক, সামনে এসে দাঁড়ালো। রিপোর্ট করলো, স্যার, চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্ট থেকে জে: মঞ্জুরের এক ব্রিগেড সৈন্য শুভপুর যাবার পথে আমাদের কলেজের গেইটের সামনে যাত্রাবিরতি করছে। তাদের লোক কলেজের ভিতরে এসে খাবার পানি নিতে চাচ্ছে। আমি তাদের গেইটের সামনে বসিয়ে এই বলে এসেছি যে, প্রিন্সিপাল স্যারের অনুমতি নিয়ে আসছি। স্যার দেরি করা যাবে না। তাড়াতাড়ি সিদ্ধান্ত দিন। নইলে ওরা গেইট ভেঙ্গে ভেতরে ঢুকে পড়বে। ক্যাডেটরা ওদের দেখলে ভয়ে চিৎকার, দৌড়াদৌড়ি শুরু করে দেবে। কী করবো, বা কার সাথে পরামর্শ করবো, তা চিন্তা করারও সময় নেই। মনেমনে আল্লাহকে স্মরণ করতে লাগলাম। ওদের ব্রিগেড কমান্ডার (পরে মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত) ব্যাক্তিগতভাবে আমার পরিচিত ছিলেন। হেড চৌকিদারকে বললাম, তুমি নিজে গিয়ে ওনার সাথে দেখা করে আমার সালাম দিয়ে বলো, ওনার সৈন্যরা যদি কলেজের ভিতর ঢুকে পড়ে, তাহলে এক ভীষণ অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে। ক্যাডেটরা ভয় পেয়ে যত্রতত্র ছোটাছুটি শুরু করবে। কেউ কারও কথা শুনবে না। কলেজের কোনো সীমানা প্রাচীর নেই। অনেক ক্যাডেট প্রাণভয়ে পালিয়ে যেতে পারে। পরে যখন শান্তি অবস্থা ফিরে আসবে, তখন দেখা যাবে কোনো ক্যাডেটকে হয়তো খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। সেই ছেলেটি হয়তো আপনাদের কারও ছেলে বা আত্মীয় হতে পারে। আর যা-ই করেন, এই বাচ্চাদেরকে নিরাপত্তা দেওয়া আমাদের সবার কর্তব্য। আমাদের কলেজের পিকআপে করে ভিতর থেকে গেইট পর্যন্ত আমরা পানি এনে দেবো। সেখান থেকে আপনার সৈন্যরা পানি নিয়ে যাবে। তাছাড়া, পুকুরের চারপাশে যতো নারিকেল গাছ আছে তা থেকে আপনার লোকেরা যতো খুশি ডাব পেড়ে খেয়ে তৃষ্ণা নিবারণ করতে পারে। আল্লাহর অশেষ দয়া, কথায় কাজ হলো। সৈন্যরা কলেজের ভেতরে আর প্রবেশ করলো না।
ইতোমধ্যে ঢাকা রেডিও থেকে প্রচার হচ্ছিলো যে কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট থেকে ব্রিগেডিয়ার ( পরে মেজর জেনারেল, বর্তমানে মরহুম) মাহমুদুল হাসান (অনেকে আদর করে কালাভাই নামে ডাকতো) সরকারের অনুগত সৈন্যবাহিনী নিয়ে বিদ্রোহ দমনের লক্ষ্যে চট্টগ্রাম অভিমুখে রওয়ানা হয়ে গেছেন। কলেজের বেশ কিছু শিক্ষক অত্যন্ত আতংকিত হয়ে আমার আফিসে এসে জড়ো হলেন। তাঁদের মধ্যে বেশ কয়েকজন ছিলেন যাঁরা মুক্তিযুদ্ধের সময় সাগর থেকে ফৌজদারহাটের উপর পাকিস্তানি নৌবাহিনীর গোলা বর্ষণ প্রত্যক্ষ করেছিলেন। সেই বিভৎষতার কথা মনে করে তাঁরা সম্ভাব্য যুদ্ধ শুরু হবার আগেই কলেজ ক্যাম্পাস ত্যাগ করে চলে যেতে চাইলেন। এঁদের মধ্যে অন্তত: একজন চট্টগ্রাম শহরে তাঁর আত্মীয়ের বাসায সপরিবারে আমাকে আশ্রয় দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেন। আর আমি যদি একান্তই কলেজ ত্যাগ না করি তাহলে আমার স্ত্রী ও সন্তানদের সময় থাকতে শহরে পাঠিয়ে দেওয়ার অনুরোধ করলেন। আমার ও আমার পরিবারের প্রতি তাঁদের কনসার্নকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানিয়ে আমি সপরিবারে কলেজ ক্যাম্পাসে অবস্থান করার সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিলাম। আমার বিশ্বাস ছিলো, যদি একান্তই উভয় পক্ষের মধ্যে গোলাগোলি শুরু হয়, কোনো পক্ষই আমার ক্যাডেটদের ক্ষতি হয় এমন কিছু করবে না। উভয় পক্ষের লোকদের ছেলে বা আত্মীয়ের ছেলে, কেউ না কেউ কলেজে আছে। কথাটা তারা মনে রাখবে। পরে শুনেছিলাম, কলেজের অনেক শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারি তাঁদের পরিবারবর্গ ক্যাম্পাসের বাইরে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন।
সকাল প্রায় দশটার দিকে বিদ্রোহের অন্যতম রিংলিডার হিসেবে পরিচিত একজন (পরে মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত) আমাকে টেলিফোন করলেন। তিনি মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। দু’বছরের সিনিয়রিটি পেয়েও তিনি চাকুরিতে আমার জুনিয়র ছিলেন। যাহোক, টেলিফোন হাতে নিয়েই তিনি আমাকে অশ্রাব্য ভাষায় গালাগালি শুরু করলেন। আমার অপরাধ, কেনো আমি কলেজে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত করেছি। কেনো কলেজে ক্লাস বন্ধ রেখেছি। আমি যতটা সম্ভব শান্ত থেকে তাঁকে বুঝাতে চেষ্টা করলাম, দেশের মহামান্য প্রেসিডেন্ট, যেভাবেই হোক, মারা গেছেন। সেজন্য তাঁর বিদেহী আত্মার প্রতি সম্মান দেখিয়ে পতাকা অর্ধনমিত করেছি। কলেজের স্বাভাবিক কাজকর্ম বন্ধ রেখেছি। জোহরের নামাজের পর কলেজ মসজিদে বিশেষ দোয়ার ব্যবস্থা করেছি। এসব শুনে তিনি উন্মাদের মতো চিৎকার করে বললেন, বাস্টার্ড, কার অর্ডারে তুমি এগুলো করছো ? আমি বললাম, এসব করার জন্য কারও অর্ডারের প্রয়োজন হয়না। কোনো দেশের প্রেসিডেন্ট মারা গেলে রাস্ট্রীয় প্রটোকলের অংশ হিসেবে এসব করা হয়ে থাকে, তা প্রেসিডেন্ট যেভাবেই মারা যান না কেনো। জবাবে বললেন, কাম অন বাস্টার্ড, আমি এখনই লোক পাঠাচ্ছি। তোমাকে প্রটোকল শিখিয়ে দেবে। আমি আমার সিদ্ধান্তে অটল রইলাম। আল্লাহ মালিক। যা কপালে আছে তাই হবে। তখন মনে পড়লো মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে শহীদ ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজের তৎকালীন প্রিন্সিপাল লে: কনর্ল এম এম রহমান এ ই সি’র কথা। আমি আমার সন্তানসম ক্যাডেটদের সামনে নিজেকে ছোটো করতে চাইনি। যাহোক, শেষতক হুমকি প্রদানকারীর লোকেরা আর আসার সুযোগ পায়নি। অথবা, পাঠাবার মতো লোক হাতের কাছে পাননি।
রাত্রি প্রায় দেড়টার দিকে চৌকিদারের ডাকাডাকি শুনতে পেলাম। সেই সাথে অতি পরিচিত কন্ঠের আওয়াজ। আশরাফ, দরজা খোলো। ভয় পেয়ো না। আমি ব্রিগেডিয়ার মাহমুদুল হাসান। কুমিল্লা থেকে এসেছি। বেশিক্ষণ বসবো না। এক কাপ চা খেয়ে চলে যাবো। দরজা খুলে ব্রি: মাহমুদকে দেখামাত্র তিনি আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। তাঁর সাথে ব্রিগেড আর্টিলারির সিও লে: কর্নল সামস। তাঁর সাথেও বুক মেলালাম। অতো রাত্রে বাবুর্চি বাসায় থাকার কথা নয়। আমার স্ত্রী নিজ হাতে চা-নাস্তা বানিয়ে পরিবেশন করলেন। ব্রি: মাহমুদ কেমন করে নিজ সৈন্য নিয়ে বিনা বাধায় ভাটিয়ারি পর্যন্ত এসেছেন, সেকথা শুনালেন। বিদ্রোহী ইউনিটগুলোর অফিসার ও সৈন্যরা কেমন করে একের পর এক সাদা ফ্ল্যাগ দেখিয়ে আত্মসমর্পণ করলো সে বিবরণ শুনালেন। ব্রি: মাহমুদের বিবরণ থেকে একটা বিষয় অত্যন্ত পরিষ্কার হয়ে হয়ে গেলো যে, গুটিকয়েক অফিসার এই বিদ্রোহ ও প্রসিডেন্টের হত্যাকান্ডে জড়িত। সাধারণ সৈনিকরা এ ঘটনার সাথে সম্পৃক্ত ছিলো না।
পুরো দেশবাসীর সাথ আমার ক্যাডেটরাও এই মর্মন্তুদ ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব হয়ে গেলো। শিক্ষক ও স্টাফ কেউ মনোযোগ দিয়ে কাজ করতে পারছিলেন না। প্রতিদিন ক্যাডেট ও শিক্ষকদের এসেম্বলি করে তাদের মটিভেট করলাম। যাতে গুজবে কান দিয়ে বিভ্রান্ত না হয় সেজন্য শিক্ষকদের মাধ্যমে সঠিক সংবাদ প্রবাহ জারি রাখার ব্যবস্থা করলাম। ধীরেধীরে আবস্থা শান্ত হয়ে এলো। কলেজে স্বাভাবিক কর্মজীবন ফিরে এলো।
৩০ মে তারিখ সকালে নাস্তার টেবিলে সিরাজ দুলাভাই এভাবে তাঁর মন্তব্যের ব্যাখ্যা দিলেন। আল্লাহ স্বয়ং ইমানদার এবং মানী লোকের মান রক্ষা করেন। এ প্রসঙ্গে তিনি একটি ঘটনা উল্লেখ করলেন। কোনো একজন ওলিআল্লাহ (নামটা তিনি বলেছিলেন, আমি ভুলে গেছি) মসজিদে খুৎবা দেওয়ার সময় ইসলামে বিধবা বিবাহের প্রয়োজনীয়তা, গুরুত্ব এবং উপকারিতা সম্পর্কে যা বলা হয়েছে, সে বিষয়ে উল্লেখ করলেন। খুৎবা শেষ হলে এক ত্যাদড় মার্কা তরুণ হুজুরকে প্রশ্ন করে বসলো, হুজুর ইসলামে বিধবা বিবাহ যদি এতই ভালো হয় তাহলে আমি আপনার মাকে, যিনি একজন বিধবা, বিয়ে করতে চাই। এ বিষয়ে আপনার মন্তব্য জানতে চাই। কয়েক মুহূর্তের বিব্রত অবস্থা কাটিয়ে উঠে হুজুর হাসিমুখে জবাব দিলনে, বিয়ে ব্যাপারটা ইসলামে দু’জন প্রাপ্তবয়স্ক নরনারীর চুক্তির বিষয়। প্রস্তাবিত বিয়েতে তুমি এক পক্ষ। তুমি রাজি আছো। অপর পক্ষে আমার মা। চলো আমার বাড়ি যেয়ে মাকে জিজ্ঞাসা করি। তিনি যদি এ বিয়েতে রাজি থাকেন, তাহলে, আলহামদুলিল্লাহ, এ বিয়ে হবে। এই বলে হুজুর মসজিদ থেকে বের হয়ে বাড়ির দিকে রওয়ানা হলেন। পেছনে অন্য মুসুল্লিরা, সাথে সেই তরুণটি। কিছুটা রাস্তা আসার পর তরুণটি হঠাৎ বুকে হাত দিয়ে বসে পড়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লো। হুজুর স্বগতোক্তি করলেন, হে আল্লাহ কেনো এমনটি করলে ? আমি তো ওকে কোনো অভিশাপ দেইনি। অন্যরা ঘটনার নাটকীয়তায় অবাক হলেও সবাই বুঝতে পারলো, আল্লাহ তাঁর এক প্রিয় বান্দাকে আসন্ন অপমান থেকে বাঁচাবার জন্য এমন অলৌকিক ঘটনা ঘটালেন। সিরাজ দুলাভাই সবশেষে নিজের মতো করে এভাবে বললেন, জে: জিয়া একজন নেক বান্দা ছিলেন। দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি যেভাবে আগাচ্ছে তাতে জে: জিয়া রাজনীতির উপর নিয়ন্ত্রণ দ্রুত হারাচ্ছেন। মনে হয়, আল্লাহ ওনাকে কোনো আসন্ন অপমান বা ব্যর্থতা থেকে বাঁচাবার জন্য এমন করে থাকবেন। এই অকাল মৃত্যুর মধ্য দিয়ে আল্লাহ ওনাকে আরও সম্মান ও মর্যাদা দান করবেন।
আধ্যাত্মিক জগতের উচ্চমার্গের এসব কথা আমার মতো সাধারণ লোকের মাথায় ঢোকার কথা নয়। তবে জে: জিয়ার জানাজায় আগত লোকসংখ্যা আমার সেদিনের মেহমানের কথার সত্যতা প্রমাণ করে। জে: জিয়ার সাথে আমার ব্যাক্তিগত সম্পর্ক সম্বন্ধে আগেই বলেছি। আমার পক্ষে নির্মোহ অবস্থান উঠে তাঁকে মূল্যায়ন করা সম্ভব নয়। যেমন কোনো পুত্র নির্মোহ অবস্থান থেকে নিজ পিতার সমালোচনা করতে পারে না। আশা করি পাঠক আমার এ ব্যর্থতাকে ক্ষমা করবেন।Ashraf's columnhttp://www.blogger.com/profile/16382744974160016625noreply@blogger.com0tag:blogger.com,1999:blog-29831725.post-3841087871684563222014-06-10T05:47:00.003-07:002014-06-10T05:47:45.208-07:00ক্যাডেট কলেজের টুকরো স্মৃতি: ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজ: পর্ব ১১: কিছু উল্লেখযোগ্য ঘটনা(এক)
আর্মিতে অনেক মজার মজার জোক বা চুটকি প্রচলিত আছে। জোকগুলেো সৃষ্টি হয়েছে মূলত: আর্মি জীবনের সুখদু:খের অভিজ্ঞতা থেকে। প্রায় প্রতিটি জোকেরই কিছু-না-কিছু শেখার বিষয় থাকে। এমন একটি বহুল প্রচলিত জোক: One can do a job in three ways. They are the right way, the wrong way, and the army way. The last one is neither right nor wrong but serves the purpose. যার সরল অর্থ করলে দাঁড়ায়, যেকোনো কাজ তিনভাবে করা যেতে পারে। শুদ্ধভাবে, ভুলভাবে এবং আর্মির মতো করে। শেষের প্রক্রিয়াটি শুদ্ধও নয়, ভুলও নয়, তবে কাজ চলে যায় ! সেবার তেমন একটি অভিজ্ঞতা হলো। সকল শ্রেণীর কর্মকর্তা-কর্মচারিদের নিয়ে কলেজ চত্বরে অন্যান্য গাছের চারার সাথে অনেক কাঁঠাল গাছের চারা লাগিয়েছিলাম। ছোটোবেলা থেকে কাঁঠাল গাছের প্রতি আমার প্রচন্ড রকমের দূর্বলতা ছিলো, এখনও আছে। কাঁঠাল, কাঁচা অথবা পাকা, খাদ্য হিসেবে মানুষের জন্য অত্যন্ত পুষ্টিকর। এর ‘বুচরা’ দুগ্ধবতী গাভীর জন্য খুব পুষ্টিকর। ঘরবাড়ি, ফার্নিচার এমনকি কাঠের সিন্দুক বানাবার জন্য মজবুতি, আঁশ এবং টেক্সচারের দিক থেকে সেগুনের পরই এর স্থান। আর কাঁঠালের পাতা তো গরু এবং ছাগল, বিশেষ করে ছাগলের জন্য প্রবাদসম খাদ্য। ঝিনাইদহ অঞ্চলের মাটি ও জলবায়ু কাঁঠাল গাছের জন্য খুবই উপযোগী। কর্মকর্তা-কর্মচারিদের প্রায় সবাই গরু-ছাগল পুষতেন। তাই সবাইকে ‘দরবারে’ কঠোরভাবে সতর্ক করে দিলাম যেনো কারও গরু-ছাগল দ্বারা কাঁঠালের চারার কোনো ক্ষতি না হয়। মালি ও চৌকিদারদের আদেশ দেওয়া হলো কড়া নজর রাখার জন্য। কয়েকদিন না যেতেই হেড মালি দৌড়ে এসে জানালো অমুক সিনিয়র শিক্ষকের ছাগলকে কাঁঠাল চারার পাতা ভক্ষণরতো অবস্থায় আটক করা হয়েছে। পরবর্তী আদেশ চাই। কলেজের দেয়ালের বাইরে স্থানীয় পৌরসভা পরিচালিত খোঁয়াড় আছে। ধৃত ছাগলটি সেখানে জমা দিলে কিছু নগদ টাকা জরিমানা দিয়ে মালিক সেটা ছাড়িয়ে আনতে পারবে। এতো কিছু বলার পরেও ছাগলের (মালিকের নয়) এমন বেয়াদবি সহ্য হলো না। মনেমনে ভবালাম, এখনই সুযোগ ! বিড়াল পহেলা রাতেই মারতে হবে ! এমন এক্সাম্পল সেট করতে হবে যাতে ক্যাম্পাসের সব গরু-ছাগলের মালিক হেদায়েত হয়ে যায়। হুকুম দিলাম, এখনই জবাই করে ছাগলের গোস্ত পুরোটা ক্যাডেট মেসে দিয়ে দাও। চামড়া বাজারে বিক্রি করে টাকাটা ক্যাডেট মেসের পেটি ক্যাশে জমা করে দাও। যেই কথা সেই কাজ। ছাগলের মালিক বিষয়টি জানার আগেই ছাগলটি গোস্ত হয়ে মেসের ফ্রিজে স্থান পেলো। ছাগলের মালিক যখন জানলেন তখন তিনি আর এ নিয়ে কোনো রা করলেন না। তবে ঘটনাটি ওয়াইল্ড ফায়ারের মতো মানুষের মুখেমুখে শুধু ক্যাম্পসে নয়, ঝিনাইদহ শহরে পৌছে গেলো। সপ্তাহ দু’য়েক পরে মেস ম্যানেজারকে ডেকে জব্দকৃত ছাগলের গোস্তের পরিমান এবং কনট্র্যাক্ট রেটে তার দাম, এবং চামড়ার বিক্রয় মূল্য জেনে নিয়ে পুরো টাকাটা ছাগলের মালিককে দিয়ে দিতে বললাম। টাকাটা পাবার পর ছাগলের মালিক ভদ্রলোক একদিন এসে অতি লজ্জিতভাবে আমার সাথে দেখা করে ক্ষমা চাইলেন। ততোদিনে আমার উদ্দেশ্য হাসিল হয়ে গেছে। এর পর যতোদিন ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজে ছিলাম, কারও গরু বা ছাগলে ক্যাম্পাসের কোনো ফুল বা ফল গাছের পাতা খেয়েছে, এমন খবর কানে আসেনি।
(দুই)
১৯৮০ এর দশকের মাঝামাঝি সময়ের কথা। আমি তখন আর্মি হেডকোয়ার্টার্সে কাজ করি। একদিন দুপুর বেলা, তখনও অফিস ছুটি হতে কিছুটা সময় বাকি, আমার স্ত্রী বাসা থেকে টেলিফোন করে জানালেন, ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজ থেকে একজন স্টাফ একটি বিশাল পাকা কাঁঠাল নিয়ে এসেছে। বলছে, প্রিনসইপিাল সাহেব পাঠিয়েছেন। এখন কী করবো ? এখানে উল্লেখ্য যে, আমার পুরো চাকুরি জীবনে নিজের ভাইবোন বা নিকট আত্মীয় ছাড়া অন্য কারও আমার বাসায় কোনো মিষ্টির প্যাকেট, ফলের ঝুড়ি বা অন্য কিছু নিয়ে আসা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ছিলো। না জেনে যদি কেউ এনে ফেলে তবে তা বিনয়ের সাথে প্রত্যাখ্যান করা হতো, আমি বাসায় থাকি বা না থাকি। বাংলাদেশের প্রক্ষিতে এর কারণ ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না। আমার ছেলেমেয়েদের বিয়ের অনুষ্ঠানে বা জন্মদিনে আমি সতর্কতার সাথে সেসব লোকদের আমন্ত্রণ জানাতে বিরত থেকেছি যাদের সাথে আমার অফিসের দূরতম কোনো ব্যাবসায়িক সম্পর্ক ছিলো। কাঁঠাল বহনকারিকে বারান্দায় বসিয়ে রাখতে বলে আমি টেলিফোনে ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজের তৎকালীন প্রিন্সিপাল লে: কর্নেল নূরুন্নবীকে (পরে কর্নেল, বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত। ঢাকার মাইলস্টোন স্কুল ও কলেজের প্রতিষ্ঠাতা।) টেলিফোন করে বিষয়টি জানতে চাইলাম।
প্রিন্সিপাল আমারই কোরের অতি ঘনিষ্ট জুনিয়র কলিগ ছিলো। টেলিফোনে প্রথমেই তাকে প্রচন্ড কিছু বকা (ঝাড়ি) দিলাম। বললাম, তুমি তো ভালো করে জানো আমি আমার বাসায় কারো এসব আমকাঁঠাল আনা একেবারে অনুমেোদন করি না। তারপরও সব জেনেশুনে কেনো আমার বাসায় কাঁঠাল পাঠিয়েছো ? পাঠাবার আগে কেনো আমার অনুমতি নেওনি ? আমার পক্ষ থেকে বকাঝকা শেষ হলে নবী বললো, স্যার, আপনার সব কথা মেনে নিলাম। এবার দয়া করে আমার কথা একটু শুনুন। আপনি প্রিন্সিপাল থাকার সময় যে কাঁঠালের চারা লাগিয়ে গিয়েছিলেন সেগুলোতে এবার প্রথম ফল ধরেছে। কলেজের চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারিদেরকে তাদের পরিশ্রমের স্বীকৃতি হিসেবে প্রথম ফলনের সব কাঁঠাল নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নিতে বললাম। তারা সবাই এক বাক্যে বললো, এসব কাঁঠাল গাছ প্রাক্তন প্রিন্সিপাল আশরাফ স্যার নিজ উদ্যোগে আমাদের উৎসাহ ও প্রেরণা দিয়ে লাগিয়েছিলেন। এর মধ্যে আনেক গাছ তিনি নিজ হাতে লাগিয়েছিলেন। এসব গাছের কাঁঠাল তাঁকে না দিয়ে আমারা খেতে পারবো না। উনি এখন ঢাকায় আছেন। ওনার জন্য অন্তত: একটি কাঁঠাল হলেও পাঠিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হোক। নবী আরও বললো, এটা কর্মচারিদের আন্তরিক আনুরোধ ছিলো, যা ফেলে দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব ছিলো না। আপনার প্রাক্তন কর্মচারিদের আপনার প্রতি সম্মান ও ভালোবাসার প্রতীক হিসেবে কাঁঠালটি আপনাকে পাঠিয়েছে। এতে আমার কোনো ভূমিকা নেই। এখন রাখা না রাখা আপনার ইচ্ছে। রাখতে না চাইলে বহনকারির হাতে ফেরত পাঠিয়ে দিন। আমি কর্মচারিদের সেভাবে বলে দেবো। আর পূর্বানুমতির কথা যদি বলেন, তাহলে বলবো, কাজটি আমি জেনেশুনে করেছি। অনুমতি চাইলে আপনি কখনও তা দিতেন না। এরপর আমার পক্ষে কাঁঠালটি ফিরিয়ে দেওয়া আর সম্ভব হলো না। ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজের কর্মচারিদের প্রতি কৃতজ্ঞতায় আমার মন ভরে গেলো। নবীকে বললাম, কাঁঠাল রেখে দিলাম। ওদেরকে আমার কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ জানিয়ে দিও। আমার ও আমার পরিবারের সদস্যদের জন্য দোয়া করতে বলো। অফিস থেকে বাসায় এসে কাঁঠাল বহনকারিকে নিয়ে একসাথে লাঞ্চ করে একই কথা বলে তাকে বিদায় জানালাম। জীবনে অনেক কাঁঠাল খেয়েছি। কন্তু সেদিনের মতো তৃপ্তি নিয়ে কোনো কাঁঠাল খেয়েছি বলে মনে পড়ে না।
(তিন)
তখনকার ক্যাডেট কলেজের ক্যাডেটদের জন্য নির্ধারিত দন্ডবিধিতে অপরাধকে দুই শ্রেণীতে ভাগ করা ছিলো। এক, মেজর অফেন্স অর্থাৎ বড় অপরাধ। দুই, মাইনর অফেন্স অর্থাৎ ছোটো অপরাধ। কোনো ক্যাডেট বড় কোনো অপরাধ করলে তাকে কলেজ থেকে অবশ্যই ‘উইথড্র’ বা বহিস্কার করার হুকুম ছিলো। ধূমপান বড় অপরাধ বলে গণ্য হতো। একাদশ শ্রেণীর একটি ছেলে ধূমপান করে ধরা পড়লো। দন্ডবিধি অনুযায়ী তাকে কলেজ থেকে ‘উইথড্র’ করার আদেশ দিলাম। ছেলেটির বাবা নিকটস্থ কোনো এক জেলা বারের এডভোকেট ছিলেন। তিনি এসে ভাইস প্রিন্সিপাল মি: রবকে এসে ধরলেন। যখন দেখলেন কোনো যুক্তিতে কাজ হচ্ছে না তখন তিনি এক মজার যুক্তি দেখালেন। বললেন, আজকাল পৃথিবীর সবাই সিগারেট খায়। আমার ছেলে না হয় একটু খেয়েছে। তাতে এমন কী হয়েছে ? তাই বলে আপনারা তাকে কলেজ থেকে বের করে দেবেন ! এটা অন্যায়। মি: রব জবাবে যা বলেছিলেন তা আজও আমার মনে আছে। তিনি বলেছিলেন, পৃথিবীর সবাই বিয়ে করে। যান, আপনার ছেলেকেও এখনই বিয়ে দিয়ে দিন !
(৪)
বেয়াদবি করার জন্য হাউস মাস্টার একটি ছেলেকে বকা দিলেন। ছেলেটি ক্ষেপে গিয়ে হাউস মাস্টারকে খুব অভদ্র ভাষায় পাল্টা গালি দিলো। ছেলেটির আপন চাচা আর্মির সিনিয়র অফিসার ছিলেন। সে ভেবেছিলো তাকে কোনো কঠোর সাজা দেওয়া যাবে না। ছেলেটিকে পত্রপাঠ ‘উইথড্র’ বা বহিস্কার করে বাড়ি পাঠিয়ে দিলাম। ছেলেটির চাচা, যিনি আমার সিনিয়র এবং পরিচিত ছিলেন, আমাকে টেলিফোনে বহুবার অনুরোধ করলেন ‘উইথড্রয়াল’ বাতিল করার জন্য। তাঁকে আমি বুঝালাম, ক্যাডেট কলেজ বিধি অনুযায়ী একবার কোনো ক্যাডেটকে কলেজ থেকে বহিস্কার করা হলে তাকে ফিরিয়ে আনার কোনো বিধান নেই। ছেলেটির বাবা যিনি যশোর জেলা বারের উকিল ছিলেন জেলা জজের আদালতে আমার বিরুদ্ধে মামলা করে দিলেন। প্রথমে আমি মামলার খবর জানতাম না। একদিন অন্য আর একজন যশোরের গার্ডিয়ান, যিনি নিজে উকিল ছিলেন, আমার অফিসে এসে মামলার খবর জানিয়ে বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চাইলেন। সব শোনার পর তিনি খুব দু:খ প্রকাশ করে মামালার জন্য কোনো চিন্তা না করতে বললেন। মামলার দিন আমার আদালতে হাজির হবার প্রয়োজন নেই। আমার পক্ষ নিয়ে তিনি বিনা পারিশ্রমিকে মামলায় লড়বেন বলে আশ্বস্ত করলেন। পরে শুনেছিলাম জজ সাহেব মামালা কোনো শুনানি না করে এই বলে খারিজ করে দেন যে, কোনো শিক্ষক যদি তাঁর ছাত্রকে বেয়াদবির জন্য শাস্তি দিয়ে থাকেন তাহলে যথার্থ কাজটিই করেছেন। এজন্য শিক্ষকদেরকে যদি আমরা বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে শুরু করি তাহলে দেশটি শিক্ষিত বয়াদবে ভরে যাবে। সমাজে শিক্ষিত ভদ্রলোক আর পাওয়া যাবে না।
(৫)
দুর্ঘটনায় স্থানীয় সরকার পক্ষীয় এম পি সাহেবের ভাগ্নে আহত হয়েছে। তাকে যশোর সদর হাপাতালে নিয়ে যেতে হবে। ভাইস প্রিন্সিপাল মি: রব তাঁর পরিচিত হওয়ায় এম পি সাহেব টেলিফোন করে কলেজের এম্বুলেন্স দ্রুত পাঠাতে বললেন। মি: রব জানালেন, কলেজের এম্বুলেন্স শুধুমাত্র অসুস্থ ক্যাডেটদের পরিবহনের জন্য। বিধি অনুযায়ী অন্যদের প্রয়োজনে এটা ব্যবহার করা নিষিদ্ধ। তারপরও এম পি সাহেব আমাকে টেলিফোন করলেন। আমিও একই জবাব দিলাম। এম পি সাহেব ভীষণ ক্ষেপে গিয়ে আমাকে অভদ্র ভাষায় গালি দিয়ে বললেন, আমাকে তিনি দেখে নিবেন। মহামান্য প্রেসিডেন্টের কাছে আমার বিরুদ্ধে নালিশ করবেন। আমি তাঁকে ঠান্ডা মাথায় স্মরণ করিয়ে দিলাম, মহামান্য প্রসিডেন্ট আমাকে কাকুল মিলিটারি একাডেমি থেকে চিনেন। উনিই আমাকে প্রিন্সিপাল হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন। আমাদের দুর্ভাগ্য শুধুমাত্র রাজনীতি করার জন্য তাঁর মতো একজন ভালো মানুষকে আপনার মতো একজন বাজে লোকের সাথে রাজনৈতিক সম্পর্ক রাখতে হচ্ছে। যাহোক, বিষয়টির এখানে সমাপ্তি ঘটে। মহামান্য প্রেসিডেন্টের অফিস থেকে কেউ কোনো দিন এ নিয়ে আমাকে কোনো প্রশ্ন করেনি।
(৬)
আমার বড় মামার ছোটো ছেলে ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজে ভর্তি হবার জন্য লিখিত পরীক্ষা দিলো। তখনকার রেওয়াজ অনুযায়ী ৫০ জন প্রার্থীকে চূড়ান্তভাবে সিলেক্ট করার জন্য লিখিত পরীক্ষার ফলের ভিত্তিতে কমবেশি ১৫০ জন প্রার্থীকে মৌখিক পরীক্ষা এবং মেডিক্যাল টেস্টের জন্য ডাকা হতো। দেখা গেলো আমার মামাতো ভাইটি মাত্র তিন নম্বর কম হবার কারণে মৌখিক পরীক্ষার জন্য কোয়ালিফাই করছে না। এখানে বলা যেতে পারে, তখনকার দিনে আমাদের কোনো কম্প্যুটার ছিলো না। দাদার আমলের টাইপরাইটার ছিলো সকল দাপ্তরিক কাজের জন্য একমাত্র ভরষা। ভর্তি পরীক্ষার টেবুলেশন করা, মেধা তালিকা প্রস্তুত করা, ইত্যাদি সকল কাজ নিরাপত্তা বজায় রেখে নিজ দায়িত্বে প্রিন্সিপালকে করতে হতো। সাধারণত: এ কাজে কেরানিদের সম্পৃক্ত করা হতো না। প্রিন্সিপাল নিজে অতি বিশ্বস্ত এক-দুজন শিক্ষককে সাথে নিয়ে কাজটি করতেন। সেবার আমার মামাতো ভাই ভর্তি পরীক্ষা দিয়েছিলো, এ কথা আমি ছাড়া আর কারও জানা ছিলো না। আমি ইচ্ছে করলে লিখিত পরীক্ষার মেধা তালিকায় তিন নম্বর নিচে নেমে আমার ভাইকে মৌখিখ পরীক্ষার জন্য ডাকতে পারতাম। সেটা করলে মৌখিক পরীক্ষার জন্য ১৫০ জনের বদলে ১৫৭/১৫৮ জন কোয়ালিফাই করতো। কখনও কখনও, বিশেষ যোগ্যতাসম্পন্ন প্রার্থীকে (যেমন ভালো খেলোয়াড়, অভিনেতা ইত্যাদি) সুযোগ দেওয়ার জন্য, এমন করা যে হতো না, তা নয়। প্রক্রিয়াগত দিক থেকে কাজটা করা তেমন অনিয়ম বা অন্যায় হতো না। কারও চোখেও পড়তো না। পরে মৌখিক পরীক্ষায় অনেক বেশি নম্বর প্রদান করে ভাইকে চূড়ান্তভাবে সিলেক্ট করা যেতো। কিন্তু আমার বিবেক সায় দিলো না। সবাইকে না হয় ফাঁকি দিলাম, আল্লাহকে তো ফাঁকি দেওয়া যাবে না ! যাহোক, কাজটি করিনি। এ নিয়ে কারও সাথে কথাও বলিনি। আমার কোনো অনুশোচনাও ছিলো না।
রেজাল্ট বের হবার পর বড় মামা যখন দেখলেন তাঁর ছেলে পাশ করেনি, তখন তিনি মনে খুব আঘাত পেয়েছিলনে। গ্রামের লোকেরা ইতোমধ্যে মামাকে কংগ্রাচ্যুলেট করতে শুরু করেছিলো। আপন ভাগ্নে ক্যাডেট কলেজের প্রিন্সিপাল। তাঁর ছেলেকে আটকায় কে ? এ ঘটনার পর মামা আমার উপর অভিমান করে প্রায় এক বছর আমার বাসায় আসেননি। পরবর্তী কালে আমার সেই মামাতো ভাইটি ঢাকা কলেজ থেকে অত্যন্ত কৃতিত্বের সাথে এইচ এস সি পাশ করে আর্মিতে কমিশন লাভ করে। বর্তমানে সে একজন কর্মরত সিনিয়র অফিসার।Ashraf's columnhttp://www.blogger.com/profile/16382744974160016625noreply@blogger.com0tag:blogger.com,1999:blog-29831725.post-66477497017385597892014-06-02T17:05:00.004-07:002014-06-02T17:05:53.697-07:00ক্যাডেট কলেজের টুকরো স্মৃতি: ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজ: পর্ব ৮: দুষ্টামির পক্ষে ওকালতি !ক্যাডেট কলেজের টুকরো স্মৃতি: ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজ: পর্ব ৮
দুষ্টামির পক্ষে ওকালতি !
আমাকে যাঁরা ব্যক্তিগতভাবে চেনেন তাঁরা হয়তো এই লেখার শিরোনাম দেখে বলবেন, বুঝেছি, নিজে দাদা-নানা হয়েছো তো, তাই ছোটোদের হয়ে ওকালতি করতে এসেছো ! কথাটা পুরো না হলেও অনেকটা সত্যি। বিষয়টি গভীরে গিয়ে বুঝার জন্য আমাকে কিছুটা বুড়ো হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছে বৈ কি! কিছুটা নিজের নাতিনাতনিদের দেখে, কিছুটা মাস্টারি জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে এবং বাকিটা পড়াশুনা করে যা জেনেছি, আজকে তা-ই পাঠকদের সাথে শেয়ার করতে চাই।
ছোটোদের যে ক’টি সহজাত প্রবৃত্তি আছে তার মধ্যে দুষ্টামি অন্যতম। মোটামুটি পাঁচ বছর বয়স থেকে শিশুদের বুদ্ধিবৃত্তির বিকাশ ঘটে। এজন্য শিক্ষা মনোবিজ্ঞানীরা পাঁচ বছর বয়স হবার আগে বাচ্চাদের আনুষ্ঠানিক শিক্ষাদান অনুমোদন করেন না। পাঁচ বছর বয়স থেকে শিশুরা অল্পঅল্প ভালোমন্দ, কী করলে কী হতে পারে এসব বুঝতে শেখে। আর তখন থেকে দুষ্টামি করা শুরু হয়। দুষ্টামি করার নানা উদ্দেশ্য হতে পারে। নির্দোষ আনন্দ বা তামাসা করার জন্য হতে পারে। কোনো কঠিন কাজ বা চালাকি করে নিজের বাহাদুরি দেখাবার জন্য হতে পারে। কখনও বড়দের উপর রাগ প্রকাশ করার জন্য, বা প্রতিশোধ নেবার জন্য হতে পারে। মায়ের উপর রাগ করে সব আচার খেয়ে ফেলে বয়াম খালি করে ফেলা আমাদের ছোটোবেলায় খুব কমন দুষ্টামি ছিলো। উদ্দেশ্য যা-ই হোক, দুষ্টামি করতে হলে বুদ্ধি লাগে। দুষ্টামি করতে হলে লক্ষ্য নির্ধারণ করতে হয়। প্ল্যান করতে হয়। প্ল্যান কার্যকর করার একাধিক পন্থা থেকে সবচাইতে কার্যকরটি বেছে নিতে হয়। এসব কিছু করার জন্য চিন্তাধারার মধ্যে সংগতি (coherence) ও ধারাবাহিকতা (continuity) রাখতে হয়। দুষ্টামির পরিণতি দেখার জন্য বা উপভোগ করার জন্য অবশ্যই কাউকে না কাউকে টার্গেট বা লক্ষ্য স্থীর করা হয়। বোকারা দুষ্টামি করতে পারে না। করলেও তা দুষ্টামি না হয়ে বোকামি হয়। ছোটোদের মধ্যে যার যতো বেশি বুদ্ধি তার দুষ্টামি ততো তীক্ষ্ন ও ফলপ্রসূ হয়। বড়দের উচিত হবে, দুষ্টামি যাতে নিরাপত্তা ও ভদ্রতার সীমার মধ্যে থাকে সে সম্পর্কে ছোটোদের সচেতন করা। এজন্য মারধর বা বকাঝকা না করে বন্ধুর মতো প্রয়োজনীয় পরামর্শ ও উৎসাহ দেওয়া। একটা কথা মনে রাখা জরুরি, দুষ্টামি বখাটে হবার লক্ষণ নয়, বুদ্ধিমত্তার লক্ষণ। ইস্, আমাদের ছোটো বেলায় মাবাবারা যদি বিষয়টা জানতেন! তাহলে অনেক মারপিট থেকে রক্ষা পেতাম ! ছোটোবেলায় লেখাপড়ার জন্য মারপিট খেতে হয়নি। যা খেয়েছি তার সবটাই ছিলো দুষ্টামি করার জন্য।
এখন কথা হলো, ছোটোরা কতো বয়সে বড় হয় ? এ প্রশ্নের কোনো সুনির্দিষ্ট উত্তর নেই। স্থান, কাল, সমাজ ভেদে ছোটোদের মধ্যে বুদ্ধি বিকাশের তারতম্য ঘটে। বাংলাদেশের বারো বছর বয়সী একটি ছেলে একটি নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে সাধারনভাবে যে প্রতিক্রিয়া দেখাবে, ইউরোপ, আমিরিকা বা আফ্রিকার একই বয়সী একটি ছেলে অভিন্ন পরিস্থিতিতে সে প্রতিক্রিয়া দেখাবে না। আমাদের সমাজে বর্তমানে ছোটোদের বয়স কমবেশি ১৫/১৬ বছর হয়ে গেলে তারা দুষ্টামির বয়স পার করে ফেলে বলে মনে করা হয়।
এবার আসা যাক দুষ্টামির সীমানা কতদূর গিয়ে শেষ হয়ে সেটা বদমাশির পর্যায়ে চলে যায়। দুষ্টামির উদ্দেশ্য যদি হয় কাউকে শারীরিক বা মানসিকভাবে কষ্ট দেওয়া বা ক্ষতিগ্রস্ত করা তাহলে সেটা আর দুষ্টামি থাকে না, বদমাশি হয়ে যায়। বদমাশিকে কখনও হাল্কাভাবে নেবার উপায় নেই। কেউ বদমাশি করলে তাকে সেজন্য কমবেশি সাজা পেতে হবে। সে সাজা সামান্য ভর্ৎসনা থেকে শুরু হতে পারে। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর থেকে আমাদের উঠতি বয়সের ছেলেরা অনেকে একটি বিশেষ ধরনের বদমাশি কাজ করে আসছে। আর তা হলো মেয়েদের নানাভাবে উত্যক্ত করা। এমনকি রাস্তাঘাটে প্রকাশ্যে মেয়েদের কাছে জোর করে প্রেম নিবেদন করা, তাদের গায়ে হাত দেওয়া, মেরে জখম করা, ডিজিটাল টেকনোলজির মাধ্যমে ইন্টারনেটে আপত্তিকর ছবি প্রকাশ করা ইত্যাদি। আমাদের সময়ের দেখেছি, উঠতি বয়সের ছেলেরা কেউকেউ খেলাধুলা, লেখালেখি, গানবাদ্য, নাটক-থিয়েটার, বিতর্ক-আবৃত্তি প্রতিযোগিতা, এসব বিভিন্ন কর্মকান্ডসহ নানা সৃজনশীল কর্মে অংশ গ্রহণ করে এবং তাতে উৎকর্ষ অর্জন করে সমবয়সী মেয়েদের মন জয় করার চেষ্টা করতো। তাতে কপাল ভালো হলে কোনো কোনো মেয়ে পটে যেতো, প্রেমে পড়ে যেতো। কোনো একজন মেয়ে প্রেমে না পড়তে চাইলে, তার পিছে ঘুরে সময় নষ্ট না করে, ছেলেটি অন্য মেয়ের কাছে প্রেম নিবেদন করতো। কিন্তু প্রেমের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করার কারণে একটি মেয়ের সর্বনাশ করা, জীবননাশ হোক এমন বদমাশি করা তো দূরের কথা, কাউকে এমন ভাবতেও দেখিনি। একটি ছেলে যদি নিজের ব্যক্তিগত সাফল্য এবং অর্জন দিয়ে কোনো মেয়ের মন জয় করার যোগ্যতা লাভ করে তাহলে তাকে কোনো মেয়ের মন পাবার জন্য মেয়েদের স্কুল-কলেজের গেইটে তীর্থর কাকের মতো দাঁড়িয়ে থাকতে হতো না। অথবা, মোটর সাইকেলে চড়ে মেয়েদের রিক্সার পেছনে ঘুরঘুর করতে হতো না, রিক্সার ফাক দিয়ে বেড়িয়ে আসা মেয়েদের ওড়না ধরে টানাটানি করতে হতো না। এসব কারণে আমরা বড়রা শুধু ছেলেদের মন্দ বলি, গালাগালি করি। কিন্তু বয়সের কারণে জাগ্রত তাদের প্রেমের বাসনা চরিতার্থ করার কোনো সুস্থ শালীন আউটলেটের বা পথের সন্ধান দিতে পারছি না। যাঁরা রাষ্ট্র ও সমাজ পরিচালনার দায়িত্বে আছেন, আশা করি, বিষয়টি ভেবে দেখবেন। স্কুল-কলেজগুলিকে শুধুমাত্র জিপিএ ফাইভ পাবার কারখানা না বানিয়ে সেখানে যাতে সকল প্রকার কো-কারিকুলার এক্টিভিটির চর্চা করা হয় তার ব্যবস্থা করলে এসব বদমাশি বহুলাংশে কমে যাবে। তারুণ্যের অমিত শক্তি ও সম্ভাবনাকে শুধু লেখাপড়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে তাকে চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ার সুযোগ করে দিতে হবে।
ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজে আমার থাকাকালীন সময়ে সংঘটিত ছেলেদের একটি দুষ্টামির ঘটনা বলে এবারের লেখা শেষ করতে চাচ্ছি। ক্যাডেট মেসের সামনে একটি ছোট্ট সবুজ লন ছিলো। ক্যাডেটদের মনোরঞ্জনের জন্য তাতে বিভিন্ন রংয়ের কিছু গার্ডেন লাইট লাগিয়েছিলাম। একদিন সকাল বেলা হঠাৎ রিপোর্ট পেলাম কে বা কারা সবগুলো লাইট ভেংগে ফেলেছে। বুঝতে অসুবিধা হলো না, ছেলেরা প্রশাসনের কারো কোনো কথায় বা কাজে রুষ্ট হয়ে এমনটি করেছে। ছেলেরা ভাবলো, প্রিন্সিপাল সাহেব নিশ্চয়ই রেগেমেগে ভয়ংকর কিছু একটা করবেন। পক্ষান্তরে আমি কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালাম না। ভাবখানা এমন দেখালাম যে কিছুই হয়নি। খবর পেলাম, একাদশ শ্রেণীর ক্যাডেটরা মেসের ভারপ্রাপ্ত অফিসারকে অনুরোধ করেছিলো মেনুর বাইরে কিছু খাবার আইটেম দেওয়ার জন্য, যা তিনি যথার্থ কারণে দিতে অস্বীকার করেন। যাহোক, পরবর্তী সাপ্তাহিক সমাবেশে আমি বিষয়টি উল্লেখ করে ক্যাডেটদের উদ্দেশ্যে বললাম, আমি তোমাদের মনোরঞ্জনের জন্য মেসের লনে গার্ডন লাইট লাগিয়েছিলাম। তোমাদের কেউকেউ সেটা পসন্দ করোনি। তাই ভেংগে ফেলেছো। কষ্ট করে ভাংগার দরকার ছিলো না। আমাকে বললে আমিই খুলে ফেলতাম। আর যদি তোমাদের মধ্যে কারো আত্মীয়ের ঝিনাইদহ শহরে ইলেকট্রিক সরঞ্জামের দোকান থেকে থাকে, এবং তার পৃষ্ঠপোষকতা করার জন্য কেউ লাইটগুলো ভেংগে থাকো, তাহলে জেনে রাখো, আমি নতুন করে আর এসব লাইট লাগাবো না। তাছাড়া নতুন লাইট লাগাবার জন্য যে টাকা খরচ হবে সে টাকা নতুন করে সরকার কলেজকে দেবে না। বাজেটে যা টাকা দেওয়া হয়েছে সেখান থেকে এ অতিরিক্ত খরচ মেটাতে হবে। তাতে তোমাদের অন্যান্য প্রয়োজন মেটাবার জন্য যেমন খাবার, জামাকাপড়, বইপত্র, খেলার সামগ্রী ইত্যাদি ক্রয়ের জন্য যে টাকা বরাদ্দ আছে সেটাতে টান পড়বে। কোনোরকম চমক ছাড়া সেদিনের সমাবেশ শেষ হলো।
তিনচার দিন পরের কথা। একাদশ শ্রেণীর পক্হ থেকে পাঁচছ’জন ক্যাডেট এলো আমার অফিসে দেখা করতে। তারা বললো, স্যার, গার্ডেন লাইটগুলো আমরা ভেংগেছি। মেসের ভারপ্রাপ্ত আফিসারকে আমরা একটা অনুরোধ করেছিলাম। তিনি তা রাখেননি। আমরা খুব ক্ষুদ্ধ হয়ে লাইটগুলো ভংগেছি। কাজটি করা আমাদের উচিত হয়নি। আমরা দু:খিত। এবারের মতো আমাদের মাফ করে দিন। দয়া করে লাইগুলো লাগিয়ে দিন। ভবিষ্যতে আর এমন হবে না। আমি ছেলেদের চোখেমুখে আন্তরিক অনুতাপের ছায়া দেখলাম। হেসে দিয়ে বললাম, বিষয়টি বুঝতে পারার জন্য ধন্যবাদ। মন্দ কাজ করার পর নিজ থেকে অনুতপ্ত হওয়ার পর আর বলার কিছু থাকে না। এবার ক্লাসে যাও। আগামীকালের মধ্যে লাইটগুলো যাতে লেগে যায় সে ব্যবস্থা করা হবে।
এ ঘটনার পর কোনো ক্যাডেট সচেতনভাবে কলেজের কোনো সম্পত্তি বিনষ্ট করেছে বলে শুনিনি।Ashraf's columnhttp://www.blogger.com/profile/16382744974160016625noreply@blogger.com0tag:blogger.com,1999:blog-29831725.post-63699327970627121392014-06-02T16:56:00.000-07:002014-06-02T16:56:37.239-07:00ক্যাডেট কলেজের টুকরো স্মৃতি: ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজ: পর্ব ১০: ক্যাডেটের কান্নারবীন্দ্রনাথের ‘ছুটি’ নামক ছোটো গল্পটি যাঁরা পড়ছেন তাঁদের গল্পেটির প্রধান চরিত্র ফটিকের কথা নিশ্চয়ই মনে আছে। ক্যাডেট কলেজে ছেলেরা যখন প্রথম এসে ভর্তি হয় তখন তাদের বয়স, স্বভাব এবং অনুভূতি ফটিকের মতোই থাকে। এই বয়সের বাচ্চারা ভীষণ স্নেহের কাংগাল হয়। মাবাবা, ভাইবোন থেকে দূরে চলে গেলে অল্প দিনের মধ্যেই তাদের জন্য কাতর হয়ে পড়ে। ক্যাডেট কলেজে রাত্রি সারে দশটায় (শীতকালে দশটায়) লাইটস আউট হয়। অর্থাৎ হাউসের সিকিউরিটি লাইট ছাড়া বাকি সকল বাতি নিভিয়ে ফেলতে হয়। ডিউটি মাস্টাররা একটা রাউন্ড দিয়ে যারযার ঘরে ফিরে যান। নাইটগার্ডরা পাহারায় থাকে। প্রায় প্রতি রাত্রে এগারোটার দিকে আমি পায়ে হেঁটে রাউন্ড দিতে বের হতাম। সংগে কাউকে রাখতাম না। ঝিনাইদহে রাতের বেলা সাঁপের খুব উপদ্রব ছিলো। সাঁপের আক্রমণ থেকে বাঁচার জন্য হাতে একটি টর্চ এবং ছোটো লাঠি রাখতাম। কারও ঘুমের যাতে ব্যাঘাত না হয় সেজন্য পায়ে নরম রাবার সোলের জুতা থাকতো। ক্যাডেটদের ডর্মিটরির ভেতর দিয়ে হেটে যাবার সময় লেপের তল থেকে প্রায়ই জুনিয়র ক্যাডেটদের, বিশেষ করে নবাগতদের, ফুঁপিয়েফুঁপিয়ে কান্নার শব্দ শুনতে পেতাম। তখন আমার মনটা খুব খারাপ হয়ে যেতো। মনে পড়ে যেতো, আমি নিজেও বাইশ বছর বয়সে সুদূর কাকুলের মিলিটারি একাডেমিতে গিয়ে প্রথম প্রথম লাইটস আউটের পর বিছানায় শুয়ে বাড়ির কথা মনে করে কত না কেঁদেছি। কান্ন্ররত ছেলেটির হাউস মাস্টারকে পরদিন সকালে অনুরোধ করতাম ছেলেটির বিশেষ যত্ন নিতে। অবশ্য ছেলেটি যাতে জানতে না পারে আমি তার কান্না শুনেছি।
ব্যাক্তিগতভাবে আমার আরও একটি কাজ করতে ভালো লাগতো। তা হলো, কলেজ হাসপাতালে ভর্তি ক্যাডেটদের দেখতে যাওয়া। সব সময় প্রায় দশবারোজন অসুস্থ ক্যাডেট হাসপাতালে ভর্তি থাকতো। আমার মনে পড়তো, ছোটো বেলায় অসুস্থ হলে আমার মা কতো কাতর হতেন। আমার মায়ের ফ্রিজ ছিলো না। আমার পসন্দ হতো না বলে একটার পর একটা কতো কী ফ্রেশ রান্না করে আমাকে খেতে দিতেন। আদর করে গায়েমাথায় কতো হাত বুলিয়ে দিতেন। যেমনটি সব বাংগালি মা আবহমান কাল ধরে করে আসছেন। অথচ অসুস্থ ক্যাডেটরা শুয়েশুয়ে হাসপাতলের ছাদ দেখছে। কেউবা বই পড়ে সময় কাটাচ্ছে। মেস থেকে রান্না করা যে খাবার আসে তা-ই খাচ্ছে, ইচ্ছা হোক বা না হোক। বিষয়টি নিয়ে আমার স্ত্রীর সাথে আলাপ করলাম।
প্রসঙ্গত: বলা যেতে পারে ক্যাডেট কলেজে যখন আসি তখন আমার স্ত্রী রুমী ক্যাডেট কলেজের পরিবেশ-পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে নিজের লাইফস্টাইল সম্পূর্ণ বদলে ফেলে। যতো সৌখিন কাপড় আর গয়নাপাতি ছিলো, যা কলেজে পড়া ঠিক হবে, না তা সব সুটকেসে বন্ধ করে রেখে দেয়। তার যুক্তি, ছেলেরা প্রিন্সিপালের স্ত্রীকে মায়ের মতো দেখতে চাইবে, সিনমার নায়িকাদের মতো নিশ্চয়ই নয়। ছাত্রীজীবনে নিজের কলেজের প্রিন্সিপাল আপাদের কথা মনে করে তার মনে এমন চিন্তা এসেছে। সে যে এতো সহজে নিজেকে একজন সিনিয়র আর্মি অফিসারের স্ত্রীর অবস্থান থেকে একজন সাদামাটা বাংগালি মায়ের অবস্থানে নিয়ে আসবে, তা ভাবতে পারিনি। বিষয়টি কলেজের সকল কর্মকর্তা-কর্মচারি, বিশেষ করে ক্যাডেটদের, মনোযোগ আকর্ষণ করেছিলো। কলেজের সকল চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারিদের বলা হলো, প্রিন্সিপালের স্ত্রীকে “ম্যাডাম” বা “বেগম সাহেবা” বলে সম্বোধন করা যাবে না। “আম্মা” বলে ডাকতে হবে। শিক্ষাটি রুমী, যার বাবা বৃটিশ আমল থেকে একজন প্রথম শ্রেণীর গেজেটেড অফিসার ছিলেন, তার মার কাছ থেকে পেয়েছিলো।
প্রথম যেদিন বিকেল বেলা রুমীকে নিয়ে কলেজ হাসপাতালে গেলাম সেদিন সে রোগীদের জন্য নিজহাতে বানিয়ে কিছু কেইক-বিস্কুট সংগে নিয়ে গিয়েছিলো। হাসপাতালের ছেলেরা সেগুলো পেয়ে এতো খুশি হয়েছিলো যে তা দেখার মতো ছিলো। এর পর থেকে প্রায় প্রতিদিন হাসপাতালে ভর্তি ছেলেদের দেখতে যেতো। তাদের সাথে তাদের বাড়ির গল্প করতো। কেউ মাথা ব্যাথা করছে বললে তার মাথায় সস্নেহে হাত বুলিয়ে দিতো, বিশেষ করে ছোটো বাচ্চাদের। কার কী খেতে মন চাইছে জেনে নিয়ে বাসায় ফিরে সে অনুযায়ী বাজার করিয়ে পরের দিন রান্না করে নিয়ে যেতো। কেউ ট্যাংরা মাছের তরকারি, কেউ কেচকি মাছের চর্চরি, কেউবা শুটকির ভর্তা, এমন সব খেতে চাইতো যা ক্যাডেট মেসে রান্না হয় না। এরপর, কোনো ক্যাডেট অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হলে তার বন্ধুরা ঠাট্টা করে বলতো, যা যা কয়েকদিন আরাম করে প্রিন্সিপাল স্যারের বাসার রান্না খেয়ে আয় ! কখনও কখনও, প্রয়জোন মনে হলে, কোনো বাচ্চার অসুখ নিয়ে রুমী মেডিকেল অফিসারের সাথেও আলাপ করতো। অল্প দিনের মধ্যে ক্যাডেটরা রুমীকে নিজ পরিবারের একজন সদস্য বলে মনে করতে লাগলো। ব্যাপারটি আমার কাছেও ইন্টারেস্টিং মনে হয়েছে ! একজন মা চিরদিনই মা, তা তিনি যেখানই থাকুন না কেনো।Ashraf's columnhttp://www.blogger.com/profile/16382744974160016625noreply@blogger.com0tag:blogger.com,1999:blog-29831725.post-84101067935197471382014-06-02T16:51:00.001-07:002014-06-02T16:51:10.977-07:00ক্যাডেট কলেজের টুকরো স্মৃতি: ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজ: পর্ব ৯
ভালো ছেলের সহসা মন্দ হয়ে যাওয়া
ধরা যাক ছেলেটির নাম রফিক, ক্যাডেট রফিক (সংগত কারণে এটি তার আসল নাম নয়)। পড়াশুনায় অত্যন্ত মেধাবী। মাধ্যমিক পরীক্ষায় সম্মিলিত মেধা তালিকায় প্রথম দশজনের মধ্যে ছিলো। কলেজ হকি, ক্রিকেট এবং বাস্কেটবল টীমের অপরিহার্য খেলোয়াড়। ইংরেজি এবং বাংলা বক্তৃতা ও আবৃত্তিতে অসাধারন পারফর্মার। একজন দক্ষ ও কার্যকর ফর্ম (ক্লাস) লীডার। এক কথায়, আউটস্ট্যান্ডিং ক্যাডেট। মনেমনে ঠিক করেছিলাম একাদশ শ্রেণীতে উঠলে রফিককে এসিস্ট্যান্ট হাউস প্রিফেক্ট বানাবো। দ্বাদশ শ্রেণীতে উঠলে কলেজ প্রিফেক্ট হবার সকল সম্ভাবনা ছিলো।
হঠাৎ করে রফিকের যেনো কী হয়ে গেলো। মাধ্যমিক পরীক্ষা শেষে নিয়মানুযায়ী তিন প্রায় মাসের জন্য লম্বা ছুটিতে বাড়িতে গিয়েছিলো। রেজাল্ট বের হবার পর কলেজে ফিরে আসার পর সবাই বিস্ময়ের সাথে লক্ষ্য করলো রফিক আর আগের রফিক নেই। লেখাপড়া, খেলাধুলাসহ কোনো কাজে রফিকের আগের মতো উৎসাহ এবং মনোযোগ কোনোটাই নেই। বন্ধুদের কাছ থেকে নিজেকে দূরে সড়িয়ে রাখছে। জুতার ফিতা বাঁধতে, জামার বোতাম লাগাতে ভুলে যাচ্ছে। শিক্ষকদের উপদেশ, বকাঝকা এমনকি এক্সট্রা ড্রিল কিছুতেই কাজ হচ্ছে না।
ক্যাডেট কলেজে একটা বাজে নিয়ম আছে, যা আমার কখনও পসন্দ হয়নি। মাধ্যমিক পরীক্ষা শেষ হতেই ছেলেদেরকে ছুটি দিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয়। ফল বের হলে প্রায় তিন মাস পর কলেজে ফিরিয়ে আনা হয়। দীর্ঘ তিন মাস বাড়িতে থেকে বেশিরভাগ ছেলে কোনো কাজকর্ম না করে, সংগদোষে দুষ্টু হয়ে, মাবাবার অতিরিক্ত প্রশ্রয়ে অলস সময় কাটিয়ে মাথাটাকে শয়তানের কারখানা বানিয়ে নিয়ে আসে। ক্যাডেট কলেজ এবং বাড়ির পরিবেশের মধ্যে এতটাই তফাৎ যে, কলেজে ফিরে এসে কলেজের দৈনন্দিন জীবনের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে এদের বেশ কষ্ট হয়। এসব ছেলেকে পুনরায় লাইনে ফিরিয়ে আনতে শিক্ষকদের অনেক পরিশ্রম করতে হয়। কেউকেউ লাইনে আসতে ব্যর্থ হবার কারণে কলেজ থেকে বহিস্কৃত পর্যন্ত হয়ে যায়। যেসব অভিন্ন বড় বদভ্যাস এসময়ে অনেক ছেলের মধ্যে লক্ষ্য করা যায় সেগুলো হলো, ছোটোদের মারধর করা, কথায়কথায় অশ্লীল বাক্য উচ্চারণ করা, ধূমপানে আসক্ত হওয়া, লম্বা চুল রাখতে চেষ্টা করা, জামাকাপড় আগোছালো করে পরিধান করা, সুযোগ পেলেই পেরন্টেস ভিজিটিং ডে’তে আগত মেয়েদের বিরক্ত করা ইত্যাদি। দু’একজন ড্রাগেও আসক্ত হয়ে পড়ে। ব্যাপারগুলো অবশ্যই দু:খজনক। পঞ্চাশজন ক্যাডেটের তিন মাসের ভরণপোষণের খরচ বাঁচাবার লক্ষ্যে কাজটি করা হয়ে থাকে। কিন্তু এতে যে ক্ষতি হয় তা তো কখনও টাকা দিয়ে পূরণ করা যায় না। কর্তৃপক্ষ এক্ষেত্রে ছুটিটা কমিয়ে একমাস করে বাকি দুই মাস ছেলেদের কলেজে রাখলে অনেক দিক থেকে ভালো হতো।
যাহোক, রফিকের বিষয়টি আমার নজরে এলো। ওর হাউস মাষ্টার অনেক চেষ্টা করেও রফিকের এমন দূ:খজনক পরিবর্তনের কারণ উদ্ধার করতে পারলেন না। সে মন খুলে কারও সাথে নিজের অশান্তির কথা বলতে চাইলো না। আমার মনে হলো, ছুটির সময় বাড়িতে এমন কিছু ঘটেছে যার জন্য আজকে সে এমন অস্বাভাবিক আচরণ করছে। অবশেষে আমি রফিকের বাবার শরণাপন্ন হলাম। রফিকের বাবা যশোর শহরের একজন গন্যমান্য ধনী ব্যাবসায়ী। ধর্মভীরু, ভদ্র ও বিনয়ী বলে সুখ্যাতি আছে। তিনি খবর পেয়ে সাথেসাথে আমার অফিসে এসে দেখা করলেন। তাঁর কাছ থেকে যা শুনলাম তাতে আমার সন্দেহ সত্য প্রমাণিত হলো।
রফিকের যখন মাত্র পাঁচ বছর বয়স তখন ওর মা ওকে এবং ওর বড় একজন বোনকে রেখে মারা যান। তারপর রফিকের বাবা দুই সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে দ্বিতীয়বার আর বিয়ে করেননি। মাহারা ছেলে ও মেয়েকে বুকে আগলে ধরে সকল প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে লড়াই করে এতোদিন সংসার আগলে রেখেছিলেন। রফিক বড় হয়ে ক্যাডেট কলেজে ভর্তি হয়েছে। মেয়ে ধীরেধীরে বড় হয়ে লেখাপড়ার সাথেসাথে বাবার সংসারের হাল ধরে রেখেছে। মেয়ে বড় হয়ে উঠলে তার বিয়ে দেওয়ার বিষয়টি সামনে চলে এলো। কিন্তু মেয়ের এক কথা, আমি বিয়ে করে শ্বশুর বাড়ি চলে গেলে আমার বাবার কী হবে ? তাঁকে কে দেখবে ? সংসারের কী হবে ? বাবা অনেক বুঝালেন। কাজ হলো না। অবশেষে মেয়ে অনেক পীড়াপিড়ির পর এক শর্তে বিয়ে করতে রাজী হলো। তার বিয়ের আগে বাবাকে বিয়ে করে ঘরে নতুন মা আনতে হবে। তার হাতে সংসারের ভার বুঝিয়ে দিয়ে তবেই মেয়ে বিয়ে করতে রাজী আছে। মেয়ে নিজেই দেখেশুনে একজন বয়স্ক নি:সন্তান বিধবা মহিলার সাথে বাবার বিয়ে দিয়ে নতুন মা ঘরে আনলো। ঘটনাটি যখন ঘটে তখন রফিক কলেজে। সামনে ওর এসএসসি পরীক্ষা। ডিসটার্ব হবে বলে রফিককে কিছু জানানো হলো না। মেয়ে বললো, রফিক পরীক্ষা শেষে বাড়ি আসলে ওকে সব বুঝিয়ে বলার দায়িত্ব আমার। বাবা, তুমি এ নিয়ে ভেবো না। পরীক্ষা শেষে রফিক বাড়ি এসে নতুন মাকে দেখে হতবাক হয়ে গেলো, প্রচন্ড মানসিক আঘাত পেলো। ওর জীবনের সব হিসাব কোথায় যেনো এলোমেলো হয়ে গেলো। বড় বোন, যে নাকি মায়ের মতো আদরস্নেহ দিয়ে রফিককে বড় করেছে, অনেক বুঝালো। কিন্তু রফিক নতুন মায়ের আগমন কিছুতেই মেনে নিতে পারলো না। বাবাকে মনে হলো অনেক দূরের কেউ। তখন থেকে শুরু হয় রফিকের এলোমেলো পথচলা। বলতে বলতে রফিকের বাবার দু’চোখের পাতা আর্দ্র হয়ে গেলো। আমার দিকে তাকিয়ে করুণ কন্ঠে প্রশ্ন করলেন, আমি কি ভুল করলাম ? আমি শান্ত হবার জন্য অনুরোধ জানিয়ে বললাম, না, আপনি ভুল করেননি, ঠিকই করেছেন। আমি ওর সাথে কথা বলবো। আশা করি আমি রফিককে বুঝাতে পারবো।
পরের দিন গেইমস পিরিয়ডে রফিককে আমার অফিসে ডেকে এনে বসালাম। ওর বাবার কাছ থেকে যা শুনেছি তা বললাম। তাকে নানাভাবে বুঝিয়ে বললাম যে তার বাবা দ্বিতীয়বার বিয়ে করে কোনো ভুল কাজ করেননি। বিষয়টি বুঝার বয়স এখনও তার হয়নি। আরও একটু বয়স হলে সে নিজেই বুঝবে, এছাড়া বাবার কিছু করার ছিলো না। তাছাড়া, ব্যাক্তি হিসেবে বিয়ে করা বা না করা তাঁর মৌলিক অধিকার। তাঁকে বাধা দেবার কোনো নৈতিক অধিকার তার, বা অন্য কারও, নেই। আমি আরও বললাম, তোমার বাবা তোমাদের দুই ভাইবোনকে পাগলের মতো ভালোবাসেন। তারপরও এসব কারণে তুমি অমনোযোগী হতে পারো না। তোমার ভবিষ্যত জীবন ধ্বংস করতে পারো না। বাবাকে কষ্ট দিতে পারো না। এখন থেকে কলেজের কাজকর্মে আগের মতো উৎসাহের সাথে অংশ নাও। অবশ্যই আল্লাহ তোমার সহায় থাকবেন। ইনশাল্লাহ সব ঠিক হয়ে যাবে।
ধীরে ধীরে রফিক কলেজ জীবনের সাথে আবার তাল মিলিয়ে চলতে শুরু করলো। প্রায় বিশ বছর পর রফিকের সাথে ঢাকা সিএমএইচে স্টাফ সার্জনের ওয়েটিং রুমে দেখা। বাংলাদেশ এয়ারফোর্সের ইউনিফর্ম পড়া। সে তখন উইং কমান্ডার রফিক, জিডিপি। বাংলাদেশ এয়ার ফোর্সের একজন গর্বিত টেস্ট পাইলট।Ashraf's columnhttp://www.blogger.com/profile/16382744974160016625noreply@blogger.com0tag:blogger.com,1999:blog-29831725.post-38960380613041526272014-05-24T22:10:00.003-07:002014-05-24T22:10:51.586-07:00ক্যাডেট কলেজের টুকরো স্মৃতি: ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজ: পর্ব ৭If you fail to keep the boys busy, they will keep you busy !
উপরের কথাটি যে কোনো আবাসিক স্কুল, তা ছেলেদের বা মেয়েদের যাদের জন্য হোক না কেনো, সবার জন্য একটি পরীক্ষীত পুরাতন সত্য কথা। এ জন্য ক্যাডেট কলেজে দৈনিক কর্মসূচিতে নিয়মিত লেখাপড়া ও খেলাধুলা ছাড়া আরও অনেক রকমের কাজকর্ম ক্যাডেটদের জন্য নির্ধারন করা হয়ে থাকে। বিশেষ করে উইকএন্ডে এবং সরকারি ছুটির দিনে ক্যাডেটদের ব্যাস্ত রাখার জন্য নানা প্রকার ফিল্ড এক্টিভিটি যেমন আউটডোর খেলাধুলা, ক্রসকান্ট্রি দৌড়, হাইকিং, এডভেঞ্চার ট্রিপ, পিকনিক, আর্মি, নেভী এবং এয়ারফোর্সের ইউনিট ভিজিট, নিকটবতর্তী ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ স্থান ও যাদুঘর ভিজিট; স্টেইজ একটিভিটি যেমন কারেন্ট এফেয়ার্স ডিসপ্লে, বক্তৃতা-আবৃত্তি-বিতর্ক প্রতিযোগিতা, নাটক মঞ্চায়ন, সঙ্গীতানুষ্ঠান ইত্যাদির ব্যবস্থা করা হয়। ক্যডেট কলেজের শিক্ষকদের অবস্থা অনেকটা আমাদের দেশের মায়েদের মতো। যতোক্ষণ সন্তান বাড়িতে আছে ততোক্ষণ মায়ের কোনো সাপ্তাহিক, বাৎসরিক বা সরকারি ছুটি নেই। হরতাল-ধর্মঘট নেই। চিন্তার কোনো শেষ নেই। সময়মতো তাঁকে সন্তানের খাবারের আয়োজন করতে হয়, অন্যান্য দেখভাল করতে হয়। বরং ছুটির দিনগুলোতে ক্যাডেট কলেজের শিক্ষকরা তুলনামূলকভাবে বেশি ব্যাস্ত থাকেন। আমি এমন ঘটনা বহুবার প্রত্যক্ষ করেছি যেখানে একজন হাউস মাস্টার বা হাউস টিউটর বাসায় নিজের সন্তানকে অসুস্থ ফেলে রেখে কলেজে এসে অসুস্থ ক্যাডেটের দেখাশুনা করছেন। যুক্তি একটাই। বাসায় রখে আসা নিজ সন্তানকে দেখার জন্য তার মা রয়েছেন। অসুস্থ ক্যাডেটকে তিনি ছাড়া তো আর কেউ দেখার নেই।
এসব কারণে পাকিস্তান আমলে প্রতিষ্ঠার সময় থেকে ক্যাডেট কলেজের শিক্ষকদের জন্য বিশেষ বেতন স্কেল ছিলো। যা সরকারি কলেজের শিক্ষকদের চাইতে বেশি ছিলো। তাছাড়া অতিরিক্ত ভাতাসহ কিছু সুযোগসুবিধা দেওয়া হতো। তা না হলে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করে আসা মেধাবী চৌকশ তরুনদের ক্যাডেট কলেজে শিক্ষকতার পেশায় আকর্ষণ করা সম্ভব ছিলো না। এখানে উল্লেখ্য যে, ক্যাডেট কলেজের শিক্ষকরা অতীতে কখনও প্রাইভেট পড়ানো বা কোচিং সেন্টার চালানোর সময়, সুযোগ অথবা অনুমতি পেতেন না। বর্তমানেও পান না। ১৯৭১ সনে দেশ স্বাধীন হবার পর দুর্ভাগ্যবশত: তৎকালীন শাসকরা, আরও অনেক সূক্ষ বিষয়ের মতো, এই বিষয়টিও অনুধাবন করতে ব্যর্থ হন। কিছু হিংসুটে মতলববাজ লোক তাঁদেরকে বুঝালেন, যেহেতু সরকারি কলেজ এবং ক্যাডেট কলেজ উভয়ের ফ্যাকাল্টির সর্বনিম্ন পদের নাম লেকচারার, সুতরাং উভয়ের বেতনের স্কেল অভিন্ন হতে হবে। নইলে সরকারি কলেজের শিক্ষকরা নারাজ হবেন। যেমন বলা হতো, সড়ক ও জনপথ বিভাগের জংগলের মধ্যে অবস্থিত রেস্ট হাউসে কর্মরত বাবুর্চি এবং বঙ্গভবনে কর্মরত মহামান্য প্রেসিডেন্টের বাবুর্চি, দু’জনই বাবুর্চি। সুতরাং দুই বাবুর্চির বেতন স্কেল অভিন্ন হতে হবে ! আরও বুঝানো হলো, যেহেতু ক্যাডেট কলেজে প্রধানত: স্কুল পর্যায়ে শিক্ষাদান করা হয়, সেহেতু সেখানে সরকারি কলেজের পে-স্কেল প্রদান করা যুক্তিযুক্ত নয়। শাসকগণ একথা বিবেচনায় নিলেন না, কেনো প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে ক্যাডেট কলেজকে বিশেষ প্রতিষ্ঠান হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছিলো। কাজটি করা হয়েছলো জাতীয় স্বার্থে। ফলশ্রুতি হিসেবে, মেধাবী এবং চৌকশ তরুনরা বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়ে ক্যাডেট কলেজে শিক্ষকতা করতে আসতেন। স্বাধীনতার পর ক্যাডেট কলেজের শিক্ষকদের বেতনভাতা ডাউনগ্রেইড করা হলে পরিণতিতে যা হবার তাই হলো। অনেক দক্ষ শিক্ষক ক্যাডেট কলেজ ছেড়ে চলে গেলেন। মধ্যপ্রাচ্য এবং আফ্রিকার কিছু দেশ এসব শিক্ষকদের ভালো বেতন-ভাতা দিয়ে লুফে নিলো। তারপরও কিছু অভিজ্ঞ শিক্ষক রয়ে গিয়েছিলেন যাঁরা ১৯৮০এর দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত কাজ করে চাকুরি থেকে স্বাভাবিক অবসর নেন। তার পরের কথা না বলাই ভালো হবে।
যাঁদের শক্তিশালী হাতে বিধাতা রাষ্ট্র পরিচালনার ভার দেন তাঁরা যদি দয়া করে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা সম্পর্কে একটা কথা মনে রাখেন তাহলে দেশ ও জাতির উপকার হবে। নইলে যা হয় তা তো চোখের সামনে দেখছি। কথাটা হলো, যে কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মেরুদন্ড হলো তার শিক্ষকমন্ডলী। ইংরেজিতে যাকে বলা হয় ফ্যাকাল্টি। মাথাভারি ম্যানেজিং কমিটি, বড় বিল্ডিং, সুন্দর বাগান সব কিছু প্রাণহীন হয়ে যায় যদি শিক্ষকরা কাজের না হন। কোনো অফিসে দশজন কেরানি বা অফিসারের মধ্যে এক বা দু’জন কমজোর বা অযোগ্য হলে কাজ চালিয়ে নেয়া যায়। কিন্তু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে একটি ক্লাসরুমে মাত্র একজন শিক্ষক পাঠদান করেন। কোনো কারণে তিনি ব্যর্থ হলে সেই ক্লাসের সকল শিক্ষার্থীর একটা পিরিয়ড অযথা নষ্ট হয়ে যায়। এমন করে একজন ব্যর্থ শিক্ষক বছরের পর বছর শতশত ছাত্রের শতশত ঘন্টা নষ্ট করেন। আর এজন্য সে শিক্ষককে দায়ী করা যায় না। তিনি নিজেকে নিজে নিয়োগ দনে না। যাঁরা রাস্ট্র বা কমিউনিটির পক্ষ থেকে এসব শিক্ষক সিলেকশন এবং নিয়োগ দান করে থাকেন তাঁরাই এ ব্যর্থতার জন্য পুরোপুরি দায়ী। শতশত শিক্ষার্থীর শিক্ষা জীবন ক্ষতিগ্রস্ত করার জন্য অবশ্যই তাঁদেরকে, ভোটারদের কাছে না হোক, বিধাতার কাছে জবাবদিহি করতে হবে বলে আমি বিশ্বাস করি।
যাহোক, এবার আগের কথায় ফিরে আসি। আমি লক্ষ্য করলাম, ক্যাডেটরা সব সময় কেনো জানি কাজেকর্মে উৎসাহ ধরে রাখতে পারছে না। সব কিছু চলছে যেনো মেশিনের মতো। নির্ধারিত কাজ কলেজের নিয়মানুযায়ী করতে হবে, তাই করে যাচ্ছে। তাতে নেই কোনো প্রাণের ছোঁয়া। আমার ভাগ্য ভালো, তখন পর্যন্ত পাকিস্তান আমলে নিয়োগ পাওয়া সিনিয়র শিক্ষক মি: করিম, মি: আশরাফ আলী এবং মি: মন্ডলের মতো দক্ষ ও অভিজ্ঞ ব্যক্তিরা হাউস মাস্টারের দায়িত্ব পালন করছিলেন। ভাইস প্রিন্সিপাল মি: এফ এম আব্দুর রব একজন অতি দক্ষ এবং সক্রিয় পেশাদার শিক্ষক ছিলেন। চমৎকার সহকর্মী এবং বন্ধু ছিলেন। আর্মি থেকে ডেপুটেশনে আসা এডজুটেন্ট মেজর মঈন ছিলেন ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজের প্রাক্তন ক্যাডেট। অত্যন্ত ডেডিকেটেড এবং পেশাদার আর্মি অফিসার। প্রিন্সিপাল হিসেবে আমি কী প্রত্যাশা করি তা কখনও বিস্তারিতভাবে বলতে হতো না। ইশারাই যথেষ্ট ছিলো। ক্যাডেট মেসের ভারপ্রাপ্ত অফিসার ছিলেন আর্টস এন্ড ক্রাফ্টসের শিক্ষক মি: কামাল মাহমুদ। অত্যন্ত পরিশ্রমী, সৎ ও নিরহংকার মানুষ। আর্মি মেডিকেল কোর থেকে ডেপুটেশনে আসা মেজর (পরে লে: কর্নেল, বর্তমানে মরহুম) কফিলউদ্দিন আহমদ (বিখ্যাত অভিনেতা তৌকীর আহমদের পিতা) ছিলেন মেডিকেল অফিসার। অল্প দিনের মধ্যে এঁদের সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় ক্যাডেটদের কর্মচাঞ্চল্য নতুন উচ্চতায় পৌছতে পেরেছিলো। ক্যাডেটদের মধ্যে শৃংখলা ভংগের ঘটনা উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেলো। লেখাপড়া, খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডসহ সকল ক্ষেত্রে ক্যাডেটরা জাতীয় পর্যায়ে উৎকর্ষের স্বাক্ষর রাখতে লাগলো। প্রশাসনের শৈথিল্য বা ব্যর্থতার কারণে কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা যদি শৃংখলা ভংগ করে, এবং সেজন্য তাদেরকে শাস্তি দেওয়া হয়, তাহলে সেটা খুব পরিতাপের বিষয়। ব্যাপারটা অনেকটা এরকম: কাউকে আপনি একদিকে কাতুকুতু দিলেন, অন্যদিকে তাকে হাসতে বারণ করে বললেন, খবরদার ! হাসবে না, হাসলে সাজা দেবো ! কিন্তু সে হেসে দিলো, আপনি তাকে সেজন্য সাজা দিলেন। এমন অযোগ্য প্রশাসক, তা যে কোনো প্রতিষ্ঠানের হোক না কেনো, কখনও কল্যাণ বয়ে আনতে পারে না। কোনো জাতির ভবিষ্যতকে অন্ধকারে ঠেলে দিতে হলে তার সহজতম উপায় হলো সে জাতির শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে অযোগ্য প্রধান এবং অযোগ্য শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া।Ashraf's columnhttp://www.blogger.com/profile/16382744974160016625noreply@blogger.com0tag:blogger.com,1999:blog-29831725.post-3238719994853762762014-03-30T20:45:00.002-07:002014-03-30T20:45:50.680-07:00ক্যাডেট কলেজের টুকরো স্মৃতি: ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজ: পর্ব ৬: ঠিকাদারের চ্যালেঞ্জ
কলেজে যোগদানের সপ্তাহখানিকের মধ্যে লক্ষ্য করলাম, প্রিন্সিপালসহ কিছু কর্মকর্তা এবং কর্মচারি ঠিকাদারের কাছ থেকে ফ্রেশ রেশন, যেমন গোস্ত, মাছ, তরকারি, তাজা ফল ইত্যাদি ক্রয় করতেন। মাসের শেষে ঠিকাদারের বিল পরিশোধ করতেন। আরও লক্ষ্য করলাম, প্রিন্সিপালের বাসায় সরবরাহকৃত মাছ-গোস্তের ওজন চাহিদকৃত পরিমানের চাইতে সবসময় বেশি। তরি-তরকারি, ফল-মূলের গুণগত মান ক্যাডেট মেসে সরবরাহকৃত আইটেমের চেয়ে অনেক ভালো, এবং পরিমানও চাহিদার চাইতে বেশি। কোনো কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারি মাসের পর মাস ঠিকাদারের বিল পরিশোধ না করে বাকি রাখছেন। এ নিয়ে ঠিকাদার কোনো আভিযোগও করছেন না। আমার বুঝতে বাকি রইলো না, প্রিন্সিপাল এবং কর্মকর্তা-কর্মচারিদের বাসায় অন-পেমেন্ট রেশন সাপ্লাইয়ের নামে বড় রকমের দুর্নীতি হচ্ছে। এসব লোকদের পরিমানে বেশি এবং উন্নততর মানের রেশন সাপ্লাই করে ঠিকাদারের যে লোকসান হচ্ছে, তা তিনি ক্যাডেট মেসে ওজনে কম এবং খারাপ রেশন সাপ্লাই করে পুষিয়ে নিচ্ছেন। ব্যাপারটি সম্পূর্ণ অনৈতিক হবার কারণে সাথেসাথে ঠিকাদারের কাছ থেকে প্রিন্সিপালসহ অন্য সকলের রেশন নেয়া নিষিদ্ধ করে দিলাম। ঝিনাইদহ শহরের কাঁচা বাজার কলেজ গেইট থেকে মাত্র সোয়া মাইল দূরে। বাস, রিক্সা বা সাইকেলে করে যাওয়াআসা করা কোনো কঠিন কাজ ছিলো না।
ক্যাডেটদের জন্য নিকটস্থ আর্মি ইউনিট অথবা এসএসডি (স্টেশন সাপ্লাই ডেপো) থেকে সরকার-নির্ধারিত মূল্যে চাল, আটা, চিনি ও ভোজ্য তেল সরবরাহ করা হতো। ফ্রেশ এবং ড্রাই রেশনের বাকি সব আইটেম ঠিকাদারের কাছ থেকে নিতে হতো। সকল আইটেম সাপ্লাই করার জন্য একজন ঠিকাদার ওপেন টেন্ডারের মাধ্যমে বারো মাসের জন্য নিয়োগ পেতেন। রাজনৈতিকভাবে অতি প্রভাবশালী এবং পেশীশক্তিতে অত্যন্ত বলীয়ান ঝিনাইদহ শহরের একই ব্যক্তি প্রতি বছর ছলে-বলে-কৌশলে ঠিকিাদারির একাজটি বাগিয়ে নিতেন। ভয়ে কেউ কোনো প্রতিবাদ করতে সাহস পেতো না। বাইরে থেকে এসে অন্য কোনো ঠিকাদার ভয়ে টেন্ডার জমা দিতে পারতেন না। তাছাড়া, টেন্ডারে কিছুকিছু আইটেম ছিলো যা কখনই কেনা হতো না। যেমন, গুড় এবং নারিকেল। কলেজ অফিস থেকে এসব আইটেমের চাহিদাও দেখানো হতো অনেক বেশি করে। যেমন, গুড়ের বাৎসরিক চাহিদা ছিলো ৩০ মণ, নারিকেলের চাহিদা ছিলো ৫০০০। আমার মনে আছে, গুড়ের দাম কোট করা হয়েছিলো কেজিপ্রতি দুই পয়সা, আর নারিকেল প্রতিটির দাম ছিলো এক পয়সা ! ক্যাডেট মেসে গুড়ের ব্যবহার একেবারেই ছিলো না। সকল প্রয়োজনে চিনি ব্যবহার করা হতো। কখনও কখনও নারিকেলের প্রয়োজন হলে কলেজের নিজস্ব গাছ থেকে নারিকেল পেরে ব্যবহার করা হতো। প্রভাবশালী ঠিকাদারটি এরকম সব আইটেমের অবিশ্বাস্য রকম কম দাম কোট করতেন। অন্যদিকে যেসব আইটেম প্রায় প্রতিদিন লাগতো সেগুলোর দাম অসম্ভব বেশি করে কোট করতেন। যেমন, রুই মাছের কেজি তখন বাজারে ছিলো ৩০ থেকে ৪০ টাকা। টেন্ডারে কোট করা হতো ৭০ থেকে ৮০ টাকা, বা তারও বেশি। একইভাবে মুরগি, গরু এবং খাসির গোস্তসহ অন্যান্য আইটেমের দাম আকাশচুম্বি অবাস্তব রেটে কোট করা হতো। এর মধ্যে কতো বড় অসাধু চতুরতা আছে, তা যাঁরা সাপ্লাইয়ের ব্যবসার সাথে জড়িত তাঁরা সবাই জানেন। তবে যাঁরা ব্যবসা করেন না, তাঁদের জন্য বিষয়টি একটু খোলাসা করে বলছি। টেন্ডারে উল্লিখিত প্রতিটি আইটেমের ইউনিট প্রাইস কোট করে চাহিদাকৃত সকল আইটেমের, আইটেমওয়াইজ, মোট পরিমানের দাম কোট করা হতো। সবশেষে সব আইটেমের সর্বসাকুল্যে যা দাম হতো তা কোট কর হতো। নিত্য প্রয়োজনীয় আইটেমগুলোর দাম আকাশচুম্বি হলেও গুড় এবং নারিকেলের মতো আপ্রয়োজনীয় আইটেমের হাস্যকর কম দামের কারণে সর্বসাকুল্য দাম অনেক কমে আসতো। বাহির থেকে কোনো ঠিকাদার এলে তাঁর পক্ষে এ চালাকি করা সম্ভব হতো না। তাঁরা গুড় এবং নারিকেলসহ সব আইটেমের স্বাভাবিক দাম কোট করতেন। যারফলে তাঁদের কোট করা সর্বসাকুল্য দাম প্রভাবশালী ঠিকাদারের কোট করা দামের চাইতে বেশি হতো। ঝিনাইদহ শহরের সেই একই প্রভাবশালী ঠিকাদার বছরের পর বছর, আইনের কোনো ব্যত্যয় না ঘটিয়ে, এভাবে সাপ্লাইয়ের কাজটি হস্তগত করতেন।
বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করে উভয় পক্ষের জন্য গ্রহণযোগ্য একটি সমাধান বের করার জন্য ঠিকাদারকে অফিসে আসতে অনুরোধ করলাম। অফিসে এলে আমি তাঁকে নিশ্চয়তা দিলাম, যেসব আইটেমের অস্বাভাবিক বেশি দাম ধরা হয়েছে সেগুলো কমিয়ে সহনীয় পর্যায়ে আনা হলে আমি গুড় বা নারিকেল জাতীয় আইটেমের জন্য কোনো ডিমান্ড দেবো না। চাইলে তাঁকে আমি লিখিত নিশ্চয়তা দিতে রাজি আছি। তিনি কোনো সিদ্ধান্ত না দিয়ে পরে জানাবেন বলে চলে গেলেন। পরে লোক মারফত জানালেন, তাঁর পক্ষে এখন কিছু করা সম্ভব নয়। পরবর্তী অর্থ বছরে কোটেশন সাবমিট করার সময় তিনি কথাটা বিবেচনায় রাখবেন। শুনে আমার খুব মন খারাপ হলো, রাগও হলো ঠিকাদারের উপর। নিজের সন্তানের বয়সী বাচ্চা ছেলেদের কল্যাণের কথা বিবেচনা না করে বছরের পর বছর নাজায়েয মুনাফা লুটে খাচ্ছেন। অথচ, ৩০ জুন পর্যন্ত, মাত্র দু’তিন মাসের জন্য কোনো বিবেচনা করতে রাজি নন। ভাবলাম, এই জালিমকে অন্তত: একবার উচিৎ শিক্ষা দিতে হবে। আমি সর্বোচ্চ পরিমান গুড় এবং নারিকেল সাপ্লাই করার জন্য ঠিকাদারকে অর্ডার দিলাম। এবার তাঁর টনক নড়লো। লোক পাঠিয়ে অনেক অনুনয়-বিনয় করলো গুড় এবং নারিকেলের অর্ডার বাতিল করার জন্য। আমার এক জবাব, সময়মত গুড় এবং নারিকেল সরবরাহ করুন। নইলে চুক্তির শর্ত অনুযায়ী আর্নেস্ট মানি ৩০ হাজার টাকা বাজেয়াপ্ত করা হবে। কলেজের কেউকেউ মন্তব্য করলেন, প্রিন্সিপাল সাহেবের কি মাথা খারাপ হয়ে গেলো ? এত গুড় আর নারিকেল কে খাবে ? তাঁদেরকে বললাম, গুড় ডেইরি ফার্মের গাভীদের খাওয়ানো হবে। নারিকেল ক্যাডেট মেসে দেওয়ার পর যা অতিরিক্ত থাকবে তা কলেজের কর্মকর্তা-কর্মচারিদের কাছে কেনাদামে বিক্রি করা হবে। করেছিলামও তাই ! ঠিকাদার আমাকে বিভিন্ন চ্যানেলে হুমকি-ধামকি দিলেন। শেষ পর্যন্ত ‘রক্ত’ (আসলে আলতা !) দিয়ে চিঠি লিখে হত্যা করার হুমকিও দিতে বাকি রাখলেন না। আমার শুভাকাঙ্খীরা আমাকে সতর্ক হয়ে চলাফেরা করার পরামর্শ দিলেন। বিশেষ করে রাতবিরাতে গাড়িতে করে একা শুধু ড্রাইভার নিয়ে ৩০ মাইল দূরে যশোর ক্যান্টনমেন্টে যাতায়াতে নিষেধ করলেন। সেসময়ে ঝিনাইদহ অঞ্চল উগ্র রাজনৈতিক কর্মকান্ডের জন্য পরিচিত ছিলো। প্রায়ই দু’য়েকটা রাজনৈতিক হত্যাকান্ড সংঘটিত হতো। যাহোক, আমি এসবে কর্ণপাত করিনি। আমার বিশ্বাস ছিলো, এবং আজও আছে, হায়াত-মউতের মালিক আল্লাহ। আর, যারা এরকম হুমকি দেয় তারা সাধারণত: কাপুরুষ হয়ে থাকে। যাদের সাহস থাকে তারা হুমকি দেয় না, কাজটাই করে ফেলে।
তখন সম্ভবত: মার্চ মাসের শেষ ভাগ। এপ্রিল মাসে পরবর্তী অর্থ বছরের জন্য নতুন দরপত্র আহ্বানের সময় হবে। সংশ্লিষ্ট সকল ছোটোছোটো সাব-কন্ট্রাক্টরকে আফিসে ডাকলাম। তাঁরা সবাই যা একবাক্যে বললেন তা হলো: সরবরাহকৃত সকল আইটেমের কনসলিডেটেড মূল্য প্রায় ৩০ লক্ষ টাকা। যার জন্য টেন্ডারের সাথে ৩০ হাজার টাকার বেশি আর্নেস্ট মানি জমা দিতে হয়। তাঁরা প্রত্যেকে অতি ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। এতো টাকা আর্নেস্ট মানি দেওয়া তাঁদের কারও একার পক্ষে সম্ভব নয়। শ্রেণী অনুযায়ী আইটেমগুলো ভাগভাগ করে প্রতি ৬ মাসে যদি টেন্ডার ডাকা হয় তবে তাঁরা তাতে অংশ নিতে পারবেন। সেক্ষেত্রে প্রতি শ্রেণীর আইটেমসমূহের জন্য ৫ থেকে ১০ হাজার টাকার মতো আর্নেস্ট মানি দিতে হবে। তবে একাজ করতে গেলে বড় একটা সমস্যা হবে। সেজন্য তাঁরা আমার সাহায্য চাইলেন। প্রভাবশালী বড় ঠিকাদার ক্ষেপে গিয়ে নিজস্ব গুন্ডা দিয়ে, অথবা থানাপুলিশ দিয়ে তাঁদের হেনস্থা করতে চাইবেন। আমি আমার পক্ষ থেকে সকল প্রকার সাহায্য-সহযোগিতার নিশ্চয়তা দিলাম।
কেনো আমি ফ্রেশ এবং ড্রাই রেশনের দরপত্র ভেঙ্গেভেঙ্গে ছোটো করতে চাই তা ব্যাখ্যা করে চেয়ারম্যানের অফিসে চিঠি দিলাম। চেয়ারম্যান অনুমোদন দিয়ে দিলেন। ঝিনাইদহের এসডিও এবং এসডিপিও-কে (তখনও ঝিনাইদহ জেলা হয়নি) ক্ষুদ্র ঠিকাদারদের নিরাপত্তার কথা বলে, তাঁদের সহযোগিতা চাইলাম। তাঁদের দু’জনকেই আমার কাছে অত্যন্ত ভালো অফিসার বলে মনে হয়েছে। দু’জনেই সানন্দে রাজি হলেন সর্বপ্রকার সহযোগিতা প্রদানের জন্য। এতোদিন পর তাঁদের নাম মনে করতে পারছিনা বলে আমি দু:খিত। আসলে, স্থানীয় প্রশাসনিক অফিসারদের সহযোগিতা ছাড়া কোনো প্রতিষ্ঠান, বিশেষ করে মফস্বল অঞ্চলে, পরিচালনা করা খুবই কঠিন। সে যায়গায় তাঁরা যদি অন্যায় হস্তক্ষেপ করেন তাহল কাজটি করা প্রায় অসম্ভব হয়ে যায়।
পরবর্তী জুলাই মাস থেকে ক্যাডেটদের খাওয়াদাওয়া নিয়ে বড় কোনো সমস্যা রইলো না। নবনিযুক্ত ক্ষুদ্র ঠিকাদাররা অত্যন্ত উৎসাহের সাথে ভালো মানের ফ্রেশ এবং ড্রাই রেশন সরবরাহ করতে লাগলেন। বড় একটা ঝামেলা থেকে বাঁচা গেলো !Ashraf's columnhttp://www.blogger.com/profile/16382744974160016625noreply@blogger.com0tag:blogger.com,1999:blog-29831725.post-20548685136831088852014-03-25T11:17:00.003-07:002014-03-25T11:17:59.430-07:00ক্যাডেট কলেজের টুকরো স্মৃতি: ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজ: পর্ব ৫: ক্যাডেট কলেজে অশান্তি এড়াতে হলেআপনা র ঘরে যদি তিনটি ছেলেকে দিনের চব্বিশ ঘন্টা মাসের পর মাস আটকে রাখা হয় তাহলে কেমন অরাজক পরিস্থিতি হতে পারে, আশা করি, তা বুঝিয়ে বলতে হবে না। কমবেশি তিন’শ ছেলেকে (বা মেয়েকে), যাদের বয়স ১২ থেকে ১৮ বছর, যদি কঠিন শৃঙ্খলার মধ্যে আটকে রাখা হয় এবং সেখানে যদি শান্তিশৃঙ্খলা বজায় না থাকে তাহলে পরিস্থিতি কোন পর্যন্ত যেতে পারে, তা কল্পনাও করা যায় না। অথচ, ক্যাডেট কলেজগুলো অনেক দিন ধরে এই আপাত: অসম্ভব কাজটিই সার্থকতার সাথে করে সবার প্রশংসা কুড়াচ্ছে। যদি কেউ প্রশ্ন করেন, এর কোনো গোপন রহস্য আছে কি না। যদি থাকে তাহলে সেটা কী ? এ প্রশ্নের জবাব হলো: কোনো রহস্য নেই। যে চারটি বিষয়ে মনোযোগ দিলে পরিস্থিতি আপনার নিয়ন্ত্রণে থাকবে তা হলো: (১) ছেলেদেরকে সময়মতো ভালো খাবার পরিবেশন করুন। (২) রুটিনমতো কাজকর্মে ব্যস্ত রাখুন। (৩) পর্যাপ্ত বিনোদনের ব্যবস্থা রাখুন। (৪) রাতে নিরবচ্ছিন্ন ঘুমেরে যাতে ব্যাঘাত না হয়, তা নিশ্চিত করুন। দেখবেন, বড় কোনো অশান্তি হবে না। ছোটোখাটো কিছু সমস্যা হতেই পারে। প্রশাসন যদি সজাগ থেকে সময়মতো সঠিক ব্যবস্থা নেয় তাহলে এসব ছোটো সমস্যা কোনো বড় অসুবিধা করে না। কেউ হয়তো প্রশ্ন করতে পারেন, তাহলে পড়ালেখা কোথায় গেলো ? ক্যাডেট কলেজের কোনো ক্যাডেটকে পড়ালেখা করার জন্য বলতে হয় না। একাজটি ওরা নিজ থেকেই খুব সিরিয়াসলি করে থাকে। এমনকি অনেকে লাইটস আউটের (রাতে আবশ্যিকভাবে বাতি নেভাবার সময়) পর ডিউটি মাস্টারের নজর এড়িয়ে চুপিচুপি পড়শুনা করে থাকে, বিশেষ করে পরীক্ষার আগে। শিক্ষকগণ শুধু নির্দেশণা দিয়ে সাহায্য করেন। কেউ কোনো বিষয়ে অতি দূর্বল হলে তাকে ক্লাসের বাইরে অতিরিক্ত সময়ে টিউটরিং করে থাকেন। স্পুনফিডিংয়ের কোনো প্রয়োজন হয় না। যখন ক্যাডেটরা ভেকেশনে বাড়ি যেতো তখন যাবার আগে হাউস মাস্টাররা ছেলেদের ব্যাগ-সুটকেইস রীতিমতো তল্লাশি করে সকল পাঠ্যবই হাউসে রেখে দিতেন। কোনো হোম ওয়ার্ক দেওয়া হতো না। ছেলেদের বলা হতো: বাড়ি গিয়ে আনন্দ করো, ঘুরে বেড়াও, খেলাধুলা করো, সিলেবাসের বাইরের বইপত্র পড়ো, মা-বাবার ঘরের কাজে সাহায্য করো ইত্যাদি। আড়াই-তিন মাস একনাগারে কলেজে থাকলে এক ধরনের একঘেয়েমি এসে যায়। তা থেকে মুক্তি পাবার জন্যই এমন পরামর্শ দেওয়া হতো।
আজকাল শুনছি, ভেকেশনে যাবার সময় ক্যাডেটদের পাঠ্যবই সঙ্গে নিতে অনেকটা বাধ্য করা হয়। প্রচুর হোম ওয়ার্ক দেওয়া হয়। বাড়িতে থাকতে কোন কোন বিষয়ে প্রাইভেট টিউটরের কাছে পড়তে হবে সে সম্পর্কে অভিভাবককে চিঠি দিয়ে জানানো হয়। যে দর্শন ও নীতির উপর ভিত্তি করে শুধুমাত্র জাতীয় ভিত্তিতে মেধাবীদের জন্য ক্যাডেট কলেজ শুরুতে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিলো, এসব কাজ তার পরিপন্থি। যেসব ছেলেমেয়েদের জন্য এমন করা প্রয়োজন তারা ক্যাডেট কলেজে ভর্তি হবার জন্য উপযুক্ত নয়, অন্তত: মেধার দিক থেকে। শোনা যায়, আজকাল ভর্তির জন্য নির্বাচন প্রক্রিয়ায় আপোষ করা হচ্ছে। কথাটা সত্য হলে এটা কঠোরভাবে বন্ধ করতে হবে। আর যদি ভর্তির জন্য নির্বাচন প্রক্রিয়ায় কোনো ত্রুটি থাকে, বিশেষজ্ঞদের দিয়ে নির্বাচন প্রক্রিয়াকে সংষ্কার করতে হবে। তা নাহলে ক্যাডেট কলেজের সুনাম, ঐতিহ্য ও কার্যকারিতা ধরে রাখা যাবে না ক্যাডেট কলেজের জন্য জনগণের ট্যাক্স থেকে যে বিপুল পরিমান অর্থ ব্যয় করা হয়, তার যৌক্তিকতা ধরে রাখা যাবে না।
এবার আসা যাক ক্যাডেট কলেজে ক্যাডেটদের খাবার ব্যবস্থা প্রসঙ্গে। সকালের পিটি/প্যারেডের পর ব্রেকফাস্ট, সকাল দশটার দিকে মিল্ক ব্রেকে দুধ আর বিস্কুট, দুপুর একটার দিকে লাঞ্চ, বিকেলে গেইমস পিরিয়ডের পর চা-টিফিন, সর্বশেষ রাতে ডিনার। ক্যাডেট কলেজে মাথাপ্রতি একজন ক্যাডেটকে কোন বেলায় কোন খাবার কতটুকু দিতে হবে তা পুষ্টিবিজ্ঞানী নির্ধারণ করে দেন। যেমন, বলা হয় না, এক বেলায় একজন ক্যাডেটকে এতো টাকার মুরগির গোস্ত দিতে হবে। বলা হয়, এতো গ্রাম মুরগির গোস্ত দিতে হবে, দাম যতোই হোক না কেনো। যার ফলে বাজারে খাদ্যদ্রব্যের দাম বাড়লে ক্যাডেট কলেজের বাজেটও আবশ্যিকভাবে বাড়াতে হয়। যে কোনো রান্না করা খাবার খেতে ভালো লাগবে কি না তা বহুলাংশে নিভর্র করে রান্নার উপকরণের গুণগত মান, রান্নার প্রক্রিয়া এবং পরিবেশের মানের উপর। এসব দেখার জন্য ডিউটি মাস্টার এবং ডিউটি এনসিওকে তাঁদের পর্যবেক্ষণে সর্বোচ্চ মনোযোগী হবার জন্য অনুরোধ করলাম। আমি নিজেও সময়ে-অসময়ে ক্যাডেট মেসের কুকহাউস ভিজিট করতে লাগলাম। সুযোগ পেলেই খাবার সময়, আগাম খবর না দিয়ে, মেসে গিয়ে ক্যাডেটদের সাথে বসে খাবার টেস্ট করতে লাগলাম। পরিবেশিত খাবারের মান এবং স্বাদ সম্পর্কে ক্যাডেটদের মতামত নিয়ে খোলাখুলি আলোচনা করতাম। একথা সত্য, ক্যাডেটদের মন্তব্যে বাড়াবাড়ি ছিলো, এ ধরনের কম্যুনিটি কিচেনের রান্না সম্পর্কে সাধারণত: যা হয়ে থাকে। তারপরও অত্যন্ত পরিতাপের সাথে লক্ষ্য করলাম: (১) অধিকাংশ ছেলে টিফিনে পরিবেশিত দুধ না খেয়ে টেবিলের উপর দুধভর্তি কাপ ছেড়ে যাচ্ছে। জিজ্ঞাসা করাতে ছেলেরা জবাব দিলো, স্যার, দুধ খেতে ভালো লাগে না। (২) যে বেলায় গরু, খাসি বা মুরগির গোস্ত থাকতো ছেলেরা সব গোস্ত না খেয়ে প্লেটে ফেলে রেখে যেতো। জিজ্ঞেস করলে ছেলেরা একবাক্যে জবাব দেতো, মরা গরুর (খাসি বা মুরগির) গোস্ত। খাওয়া যায় না। (৩) বাজে রান্নার জন্য সব্জিও অনেকে খেতে পসন্দ করতো না। শুধু ডাল দিয়ে ভাত খেয়ে উঠে যেতো। এসব দেখে ও শুনে মনেমনে কষ্ট পেতাম। সরকার ছেলেদের খাওয়াদাওয়ার জন্য এতো টাকা খরচ করছে। অথচ, ছেলেরা খেতে পারছে না। নিজের ছেলেবেলার কথা মনে হলো। মা যখন গ্লাসে করে গরম দুধ খেতে দিতেন তখন কী মজা করেই না তা খেতাম ! আর গোস্ত ! মা যে বেলায় গোস্ত রান্না করতেন সে বেলায় শুরু থেকেই সব ভাইবোন মিলে আনন্দে লাফাতাম ! খেতে বসার আগেই জিহ্বায় পানি এসে জেতো !
যাহোক, ছেলেদের মেসের খাবারে অরুচির কারণ খুঁজতে বেশি দূর যেতে হলো না। কলেজের নিজস্ব ডেইরি ফার্মে পর্যাপ্ত সংখ্যক গাভী ছিলো। যার বেশির ভাগ ছিলো ‘সিন্ধি’ প্রজাতির। অল্প কিছু ছিলো ‘ফ্রিজিয়ান’। দেশি জাতের কোনো গরু ছিলো না। তা সত্বেও মেসের চাহিদা মেটাবার মতো পর্যাপ্ত দুধ সেখানে উৎপন্ন হতো না। ফলে পুরোটাই বাইরের ঠিকাদারের কাছ থেকে কিনতে হতো। বাংলাদেশের বাস্তবতায় কোনো ঠিকাদারের কাছ থেকে খাঁটি দুধ আশা করা তখনও যেতো না, এখনও যায় না। ছেলেদেরকে খাঁটি দুধ খাওয়াতে হলে যে কোনো মূল্যে কলেজের নিজস্ব ডেইরি ফার্মের উন্নতি করা ছাড়া গত্যন্তর রইলো না। খুলনা থেকে সরকারি পশুপালন বিভাগের উপ-পরিচালক মহোদয়কে পরামর্শের জন্য দাওয়াত দিলাম। ভদ্রলোক খুব খুশিমনে এলেন। সঙ্গে ঝিনাইদহের সাবডিভিশনাল পশুপালন অফিসারকে আনলেন। সরজমিনে ডেইরি ফার্ম দেখলেন। ফার্মে রাখা রেজিস্টার খুলে প্রতিটি গাভীর বয়স, রোগ প্রতিরোধক টিকা দেওয়ার রেকর্ড, সবশেষ কবে ডিওয়ার্মিং (কৃমিমুক্ত) করা হয়েছে, খাবারের মেনু, নিয়মিত ব্যায়ামের রুটিন, এসব তথ্য পরীক্ষা করলেন। সাবডিভিশনাল পশুপালন অফিসারকে বিস্তারিত নির্দেশ প্রদান করে তাঁকে ফার্মের দায়িত্ব নিতে বললেন । সাবডিভিশনাল পশুপালন অফিসার বিষয়টিকে ব্যক্তিগত চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিলেন। প্রতি সপ্তাহে দু’তিনবার কলেজে এসে ফার্মের দেখভাল করতে লাগলেন। ফার্মের কর্মীদের পরামর্শ দিতে লাগলেন। কলেজের কৃষি ফার্মে অন্য ফসলের চাষ কমিয়ে দিয়ে সেখানে গাভীর দুধ বাড়ে এমন খাদ্য যথা নেপিয়ার ঘাস, জার্মান ঘাস, ভুট্টা ইত্যাদির চাষ শুরু হলো। ক্যাডেট মেসের ভাতের মাড় অন্য কোথাও না গিয়ে পুরোটা ডেইরি ফার্মে আসতে লাগলো। তিন মাসের মধ্যে, গাভীর সংখ্যা না বাড়িয়ে, দুধের পরিমান এতটা বেড়ে গেলো যে, ক্যাডেট মেসের চাহিদা মিটিয়ে কলেজের কর্মকর্তা-কর্মচারীদেরকে, বিশেষ করে যাদের দুগ্ধপোষ্য শিশু এবং ছোটো বাচ্চা ছিলো তাদেরকে, ভর্তুকিমূল্যে দুধ সরবরাহ করা সম্ভব হলো। ভেকেশনের সময় শহরের মিষ্টির দোকানদাররা সারপ্লাস দুধ সানন্দে কিনে নিয়ে যেতো। শত হলেও খাঁটি দুধ তো ! ক্যাডেটরা বেজায় খুশি হলো। এবার আর টেবিলে খালি দুধের গ্লাস দেখা গেলো না।
ডেইরি ফার্মের কথা অসম্পূর্ণ রয়ে যাবে যদি তার এক সদস্যের কথা না বলা হয়। তার নাম ‘মন্টু’। কলেজের সবাই তাকে এই নামে চিনতো। পরিচিত রাখাল নাম ধরে ডাকলে মন্টু যেখানই থাকতো ছুটে আসতো। সে ছিলো ফার্মের প্রবীনতম ষাঁড়। জাতে ছিলো ‘সিন্ধি’। গায়ের রং টকটকে লাল। দেখতে অত্যন্ত স্বাস্থ্যবান, হ্যান্ডসাম এবং স্মার্ট ! গত তিন বছর যাবত নিকটস্থ ভাটুই বাজারের কোরবানির হাটে নিয়ে বিক্রি করার চেষ্টা করা সত্বেও বিক্রি করা যায়নি। প্রতিবারই সকল বাধা এবং রশি ছিন্ন করে মন্টু হাট থেকে পালিয়ে এক দৌড়ে কলেজে ফিরে এসে ফার্মে ঢুকে নিজ অবস্থানে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতো। যেহেতু আমাদের ফার্মটি ছিলো মূলত: দুধের জন্য, এঁড়ে বাছুর বড় হয়ে গেলে সেটিকে রাখার ব্যবস্থা ছিলো না। সিদ্ধান্ত নিলাম, কষ্ট হলেও, মন্টুকে এবার যে করে হোক বিদায় করতে হবে। এবার কোরবানির সময় কলেজের পিকআপে চড়িয়ে মন্টুকে ঢাকার গাবতলি গরুর হাটে পাঠিয়ে দেওয়া হলো। এবার আর মন্টু হাট থেকে মন্টু ফিরে এলো না। মন্টুকে যখন ঢাকা নেবার জন্য পিকআপে উঠানো হয় ফার্মের রাখালসহ অনেকের চোখে পানি দেখে আমি নিজেও বিচলিত হয়ে পড়েছিলাম বৈকি।
ক্যাডেট মেসে রান্না করা গোস্তের স্বাদ ও মান উন্নয়ন করা অতটা সহজ ছিলো না। কুকহাউস থেকে যাতে কেউ কোনো মশলা, বিশেষ করে অতি দামি গরম মশলা, রান্নার তেল-ঘি চুরি করে বাইরে নিতে না পারে সেজন্য কুকহাউসের স্টাফদের আচমকা শরীর তল্লাসি শুরু করা হলো। প্যান্টের পকেটে ভরে গড়ম মশলা চুরি করে নেবার সময় ধরা পড়ায় দু’একজনকে চাকুরি থেকে বরখাস্ত করা হলো। এদের মধ্যে কেউকেউ স্থানীয় হবার কারণে বাইরের মাস্তানদের সাথে নিয়ে প্রিন্সিপালকে একহাত দেখে নেবার হুমকি দিলো। এতো সবের পরও গোস্তের মান বাড়ানো গেলো না। একেবারে মৃত না হলেও মৃতপ্রায় এবং অতিশয় রুগ্ন পশুর গোস্ত সরবরাহ বন্ধ করা যাচ্ছিলো না। গোস্তের ঠিকাদারকে ডেকে প্রথমে অনুরোধ পরে সতর্ক করলাম। কোনো কাজ হলো না। ঠিকাদারের এক জবাব, তাঁর নিজের কোনো কসাইখানা বা গোস্তের ব্যবসা নাই। কসাইদের কাছ থেকে কিনে তিনি গোস্ত সাপ্লাই দেন। কলেজের মেডিক্যাল অফিসার ছিলেন মেজর (পরে লে: কর্নেল, বর্তমানে মরহুম) কফিলউদ্দিন আহমদ (চলচ্চিত্র পরিচালক তৌকীর আহমদের পিতা)। ঠিকাদার ফ্রেশ রেশন নিয়ে এলে তিনি প্রতিবার গোস্তসহ সব আইটেমের গুণগত মান পরীক্ষা করতে লাগলেন। কোনো কিছুতেই কাজ হচ্ছিলো না। সর্বশেষ উপায় হিসেবে আমাকে নিজ দায়িত্বে একটি অসাধারণ পদক্ষেপ নিতে হলো। বিল্ডিং সুপারভাইজারকে ডেকে বললাম মেসের পাশে একটি ‘বুচারি’ অর্থাৎ কসাইখানা বানাতে হবে। যাতে একটা বা দু’টো গরু একসাথে জবাই করে গোস্ত বানানো যেতে পারে। তার জন্য সম্ভাব্য নির্মাণ ব্যয় কতো হবে তা আইটেমওয়ারি লিখে আমাকে এস্টিমেট দিতে বললাম। এস্টিমেট দেখে চিন্তায় পড়ে গেলাম। প্রিন্সিপালের ফিনান্সিয়াল পাওয়ারের চাইতে অনেক বেশি টাকার প্রয়োজন। যদি অনুমোদন চেয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে উর্ধতন কতৃর্পক্ষকে চিঠি লিখি, আর যদি কোনো কারণে সে অনুরোধ প্রত্যাখ্যাত হয়, তাহলে ‘বুচারি’ আর কখনও বানানো যাবে না। অথচ ‘বুচারি’ না বানিয়ে সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়।
কলেজের সামনে যশোর-কুষ্টিয়া হাইওয়ে। তার পাশে, আল্লাহ জানেন কবে থেকে, প্রচুর অব্যবহৃত উদ্বৃত্ত ইট পড়ে ছিলো। কলেজের পাম্প হাউস বানানোর সময়ে ঠিকাদার কর্তৃক লেবারদের জন্য নির্মিত টিনশেড বহুদিন যাবত পড়ে ছিলো। বিল্ডিং সুপারভাইজারকে আদেশ দিলাম, যতো শীঘ্র সম্ভব হাইওয়ের পাশ থেকে অব্যবহৃত ইট, এবং পাম্প হাউসের পাশ থেকে টিন নিয়ে এসে ‘বুচারি’ বানিয়ে ফেলতে। ক্যাডেট মেস থেকে পানি ও বিদ্যুতের সংযোগ নিতে। মেইনটিন্যান্স খাত থেকে বাকি নির্মাণ সামগ্রী কিনে নিতে। তাড়াতাড়ি এইজন্য করছিলাম যে, ‘বুচারি’ বানালে যাদের স্বার্থে আঘাত লাগবে তাদের কেউ যাতে উপরওয়ালা কাউকে দিয়ে আমার এ ‘ষড়যন্ত্র’ অংকুরেই নস্যাত না করে দেয়। যেমন আদেশ, তেমন কাজ। প্রচুর আলোবাতাসের ব্যবস্থা রেখে, চারদিকে ফ্লাইপ্রুফ নেটের ঘেরা দিয়ে, প্রায় রাতারাতি টিনের চালওয়ালা ‘বুচারি’ তৈরী হয়ে গেলো। এবার ঠিকাদারকে বলা হলো গরু, খাসি এবং মুরগি, সব জীবীত অবস্থায় কলেজে আনতে হবে। কলেজের মেডিক্যাল অফিসার পরীক্ষা করে দেখে ‘গ্রহণযোগ্য’ বলে সার্টিফিকেট দিলে কলেজের ‘বুচারি’তে জবাই করে গোস্ত সরবরাহ করতে হবে। কলেজ মসজিদের ইমাম সাহেব বিনা পারিশ্রমিকে পশু জবাইর কাজ করে দিবেন।
মজার ব্যাপার হলো, জ্যান্ত মুরগি খাচায় ভরে আনলেও, ঠিকাদারকে জ্যান্ত গরু ও খাসি সকাল বেলা একাডেমিক ব্লকের সামনে দিয়ে হাটিয়ে আনতে বলা হলো। ক্যাডেটরা ক্লাসরুমে বসেই নিজের পায়ে হেটে যাওয়া গরু ও খাসির অবয়ব দেখতে পেতো। এবার আর খাবার টেবিলে কোনো গোস্তের চিহ্ন রইলো না। ছেলেরা পরিতৃপ্তির সাথে পরিবেশিত প্রতিটি গোস্তের টুকরা খেয়ে শেষ করতে লাগলো।
এই ঘটনার কিছুদিন পর ঢাকায় কোনো কাজে গেলে আর্মি হেডকোর্য়াটার্সে ক্যাডেট কলেজ গভর্নিং বডিজের চেয়ারম্যান জে: এরশাদের সাথে দেখা। তিনি অনেকের সামনে আমাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ওয়েলডান, আশরাফ। ‘বুচারি’ বানিয়ে খুব ভালো কাজ করেছো। আমি বললম, স্যার, আপনি কেমন করে জানলেন ? আমি তো আপনাকে জানাইনি। তিনি মুচকি হেসে বললেন, বেনামী চিঠি থেকে জেনেছি ! তোমরা তো জানোনা, প্রতিদিন প্রিন্সিপালদের বিরুদ্ধে আমার কাছে প্রচুর বেনামী চিঠি আসে। প্রিন্সিপালদের মধ্যে যারা খুব ভালো করছে, এবং যারা খুব খারাপ করছে তাদের বিরুদ্ধে বেশি বেনামী চিঠি আসে। ডোন্ট ওরি, তুমি অবশ্যই ভালো করছো। কীপ ইট আপ।Ashraf's columnhttp://www.blogger.com/profile/16382744974160016625noreply@blogger.com0tag:blogger.com,1999:blog-29831725.post-54681668198050412992014-03-25T11:17:00.000-07:002014-03-25T11:17:06.044-07:00ক্যাডেট কলেজের টুকরো স্মৃতি: ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজ: পর্ব ৪: সেকুলারিজম নিয়ে বিভ্রান্তিপেরেন্টস ভিজিটিং ডে’তে অফিসে বসে আছি। অভিভাবকরা এক এক করে আসছেন। কেউ আসছেন শুধু শুভেচ্ছা জানাতে। কেউ আসছেন নিজ ছেলের কোনো সমস্যা নিয়ে আলোচনা করতে। কেউ বা আসছেন কলেজ কর্তৃপক্ষের কোনো সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করে তা প্রত্যাহার করার অনুরোধ জানাতে। নানা বয়সের, নানা পেশার, নানা ব্যাকগ্রাউন্ডের লোক আসছেন। প্রত্যেকে আমার সম্মানিত ক্লায়েন্ট। সেভাবেই সবার সাথে কথা বলে আসছিলাম। হঠাৎ করে এক ভদ্রলোক কিছুটা উত্তেজিত অবস্থায় আমার অফিসে এসে বসলেন। মনে হলো, আমার অফিসে আসার আগে উনি কোনো বিষয় নিয়ে কারো সাথে কথা বলছিলেন। উত্তেজনাটা সেখানেই ঘটেছে। বাংলা একাডেমির একজন সিনিয়র অফিসার হিসেবে নিজের পরিচয় দিলেন। আরও জানালেন, বাজারে উনার লেখা এবং অনুবাদ করা অনেক বই আছে। বাংলাদেশের শিল্প, সাহিত্য এবং সংস্কৃতি জগতের একজন সিনিয়র মোড়ল বলেও নিজেকে তুলে ধরলেন। ধরা যাক ভদ্রলোকের নাম মাসুদ সাহেব। কোনো প্রকার ভূমিকা না করে মাসুদ সাহেব বললেন: তাঁর ছেলে ক্লাস নাইনে পড়ে। তাকে জোর করে কলেজ কর্তৃপক্ষ মসজিদে নিয়ে নামাজ পড়তে বাধ্য করছে। উল্লেখ করা যেতে পারে যে, প্রতিদিন মাগরিবের ওয়াক্তে সকল মুসলমান ছেলেদের জন্য সারিবদ্ধ হয়ে মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়া বাধ্যতামূলক। একইভাবে শুক্রবার জুমার নামাজ মসজিদে গিয়ে আদায় করা বাধ্যতামূলক। অন্যান্য ওয়াক্তিয়া নামাজ পড়ার জন্য প্রত্যেক হাউসে প্রেয়াররুম আছে। মাসুদ সাহেব পবিত্র কুর’আনের সুরা বাকারার ২৫৬ নম্বর আয়াতের প্রথম অংশ উদ্ধৃত করে বললেন, ইসলামে ধর্ম নিয়ে জবরদস্তি নেই। যার খুশি সে নামাজ পড়বে। যার খুশি সে পড়বে না। তিনি আরও বললেন, বাংলাদেশ একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। এখানে কাউকে ইচ্ছার বিরুদ্ধে নামাজ পড়ানো যাবে না। ভদ্রলোক একই আয়াতের ঠিক পরের অংশটি বেমালুম চেপে গেলেন, যেমনটি আমাদের দেশের একধরনের সেকুলারিস্ট রাজনৈতিক নেতারা করে থাকেন। এধরনের লোকদের সাথে তর্ক করে লাভ হয় না। আমি আমার অফিস সুপারিনটেনডেন্ট নাজির সাহেবকে বললাম মাসুদ সাহেবের ছেলের পার্সোনাল ফাইল আনতে। ফাইলের একেবারের প্রথম পাতাটি ছিলো দু’বছর আগে পাঠানো তাঁর ছেলের ভর্তির দরখাস্ত। যার নিচের দিকে মাসুদ সাহেবের নিজের দস্তখত। দরখাস্তে প্রার্থীর ধর্ম হিসেবে ‘ইসলাম’ কলম দিয়ে লেখা ছিলো। আমি কথা না বাড়িয়ে দরখাস্তটি মাসুদ সাহেবের দিকে এগিয়ে দিয়ে বরলাম, ‘ইসলাম’ কথাটি কেটে দিন। পরিবর্তে ‘নাস্তিক’ বা ‘নাই’ যা খুশি লিখে নিচে আজকের তারিখসহ ইনিশিয়াল করে দিন। আপনার ছেলেকে আর আমি জোর করে নামাজ পড়তে নেবো না। ভদ্রলোক মনে হলো বজ্রাহত হলেন। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন, তা কি সম্ভব ? আমি বললাম, যদি সম্ভব না হয়, তাহলে দয়া করে এবার যান। আমাকে আমার কাজ করতে দিন। মাসুদ সাহেব আর কথা না বাড়িয়ে উঠে গেলেন। এই ঘটনার পর কোনো পেরেন্টস ডে’তে ওনার সাথে আর দেখা হয়েছে বলে পড়ে না।
১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পর ক্যাডেট কলেজকে লোকচোখে হেয় প্রতিপন্ন করার জন্য কিছু মতলববাজ লোক এক ধরনের প্রপাগান্ডা শুরু করে। তারা বলতে শুরু করে, নতুন সংবিধানে সেকুলারিজম অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। সুতরাং স্কুলের বাচ্চাদের আর ধর্মীয় শিক্ষা দেওয়ার প্রয়োজন নেই। ক্যাডেট কলেজসহ সকল স্কুল থেকে অবিলম্বে ধর্মীয় শিক্ষা উঠিয়ে দেওয়া হোক। সংবিধানে যা-ই লেখা থাক না কেনো, বাস্তব সত্য হচ্ছে, একজন মুসলমান আল্লাহ কর্তৃক নির্দেশিত এবং রাসুল পাক (সা:) কর্তৃক প্রদর্শিত পথে আল্লাহর ইবাদত করেন। নিজে নামাজ-রোজা করেন, সন্তানকে নামাজ-কালিমা শেখান। পিতামাতা বা কারো মৃত্যু হলে তাঁর জন্য জানাযা পড়েন, দোয়া করেন। শতকরা নব্বইভাগ মুসলমানের দেশে এসবই তো স্বাভাবিক। কীভাবে এসব কতর্ব্য পালন করতে হয়, অর্থাৎ দৈনন্দিন জীবনে কীভাবে ইসলাম চর্চা করতে হয় এবং তার অনুশাসন মেনে চলতে হয়, তা একজন মুসলমানের সন্তানকে শিশুকাল থেকে শিক্ষা দেওয়া অতীব জরুরি। কয়েক যুগ আগে নিজ বাড়িতে ধর্মীয় শিক্ষক রেখে, অথবা নিকটস্থ মকতবে পাঠিয়ে মুসলমানের শিশু সন্তানদের এসব শেখানো হতো। আজকাল নানা কারণে পিতামাতার পক্ষে এই দায়িত্ব পালন করা কঠিন হয়ে পড়েছে। তাই সংগত কারণে সেই দায়িত্ব রাষ্ট্র নিজে গ্রহণ করেছে। স্কুল পর্যায়ে তাই ধর্মীয় শিক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। শুধু ইসলাম নয়, অন্য ধর্মালম্বীদের সন্তানদেরও নিজনিজ ধর্ম শিক্ষার ব্যবস্থা স্কুলে রাখা হয়েছে। ক্যাডেট কলেজেও ইসলামসহ সকল ধর্ম শিক্ষা দেওয়া হয়ে থাকে।
নৈতিক শিক্ষাকে সব সময় সাধারণ শিক্ষার অপরিহার্য অঙ্গ হিসেবে ধরা হয়। নৈতিক শিক্ষা ছাড়া শিক্ষা কখনও পূর্ণতা লাভ করে না। শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য একটি মানব শিশুকে আলোকিত মানুষে, পরিপূর্ণ মানুষরূপে গড়ে তোলা। যে মানুষের নৈতিক গুণাবলী নাই তাকে আর যা-ই বলা যায় না কেনো, আলোকিত বা পরিপূর্ণ মানুষ বলা যায় না। পৃথিবীর সকল সমাজে ধর্মীয় শিক্ষাকে, শিক্ষক থেকে ছাত্রের মধ্যে, নৈতিক শিক্ষা স্থানান্তরের সর্বোৎকৃষ্ট কনডুইট (Conduit) বলে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। যেসব লোক স্কুল থেকে ধর্মীয় শিক্ষার মূলোৎপাটন করতে চান তাঁরা নৈতিক শিক্ষা প্রদানের কনডুইটের বিকল্প হিসেবে স্কুল পর্যায়ে কী ব্যবহার করবেন, তা কিন্তু বলেন না।
ধর্মীয় শিক্ষার নৈতিক এবং আধ্যাত্মিক গুরুত্ব ছাড়াও সামাজিক গুরুত্ব অপরিসীম। ধরা যাক, আমাদের দেশে মুসলমান বলে পরিচিত একজন লোক কোনো প্রতিষ্ঠানের নেতৃস্থানীয় পদে আছেন। তিনি হতে পারেন বেসামরিক বা সামরিক সার্ভিসের অফিসার, অথবা কোনো ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের একজন বড়কর্তা। তাঁর প্রতিষ্ঠানের কেউ একজন মারা গেলো। কর্তাব্যাক্তিটি এই বলে জানাযায় যোগ দিলেন না যে, তিনি জানাযার নামায পড়তে জানেন না। তা হলে ঐ প্রতিষ্ঠানের লোকেরা কি তাঁকে মনেপ্রাণে নেতা হিসাবে মেনে নিতে পারবেন ? নিশ্চয়ই না।
মাসুদ সাহেবের কথা শোনার পর থেকে অনেকদিন বিষয়টি নিয়ে ভেবেছি। বন্ধুবান্ধব ও সহকর্মীদের সাথে আলোচনা করেছি। আসলে ইংরেজি সেকুলারিজম শব্দটির অর্থ কি ? ধর্মনিরপেক্ষতা না ধর্মহীনতা ? যদি ধর্মহীনতা হয়, তাহলে অর্থ খুব পরিষ্কার। সেকুলার সমাজে বা রাষ্ট্রে ধর্মের কোনো স্থান নেই। সহজ কথা। এ নিয়ে অতিরিক্ত আলোচনার প্রয়োজন নেই। কিন্তু যদি অর্থ হয় ধর্মনিরপেক্ষতা, তা হলে বিষয়টি অবশ্যই বিভ্রান্তির সৃষ্টি করে। ধরা যাক, আমাকে বলা হলো: ইসলামধর্ম, সনাতনধর্ম, খৃষ্টধর্ম, বৌদ্ধধর্ম, এসবের মধ্য থেকে যেকোনো একটি ধর্ম পসন্দ করে নেও। বলা বাহুল্য, একজন মুসলমান হিসেবে ইসলামই হবে আমার শেষ এবং একমাত্র চয়েস। একইভাবে একজন হিন্দু, খৃষ্টান বা বৌদ্ধ নিজনিজ ধর্মকে বেছে নিবেন। এখানে তো কারো পক্ষে নিরপেক্ষ থাকার সুযোগ নেই। তাহলে কথাটা দাড়ালো, সেকুলারিজমের অর্থ ধর্মনিরপেক্ষতা করা যায় না। আজকাল কেউ কেউ সেকুলারিজমের অর্থ অসাম্প্রদায়িকতা বলে চালাবার চেষ্টা করছেন। আমি মনে করি, সেটাও ঠিক নয়। ধর্ম আর সম্প্রদায় এক কথা নয়। একই ধর্মের মধ্যে একাধিক সম্প্রদায় বিরাজ করে। পশ্চিমা বিশ্বে, এমন কি আমাদের পাশের দেশ ভারতে, সেকুলারিজম বলতে সকল ধর্মের সমান মর্যাদা ও গুরুত্বকে বুঝানো হয়। সঠিক অর্থ প্রকাশ করা জন্য এর বাংলা প্রতিশব্দ হিসেবে ‘ পরধর্মসহিষ্ঞুতা’ বলা যেতে পারে। আশা করি, যাঁরা বাংলাভাষার শব্দ বা ওয়ার্ডের উৎস এবং অর্থ নিয়ে গবেষণা করেন ( Etymologist) তাঁরা যদি একটি যুৎসই প্রতিশব্দ চালু করতে পারেন তাহলে সেকুলারিজমের অর্থ নিয়ে সকল বিভ্রান্তি দূর হবে।
আজকের পর্ব শেষ করার পূর্বে আমাদের দেশের সেকুলারিজমের অন্ধ ভক্তদের উদ্দেশ্যে কয়েকটি কথা নিবেদন করতে চাই। ১৯৭৬ সনের ২২ সেপ্টেম্বর তারিখে আমি, আরও দু’জন সহকর্মীর সাথে, প্রথম চীনদেশে যাই। ১৯৭১ সনে দেশ স্বাধীন হবার আগে ইসলামাবাদে অবস্থিত ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব মডার্ন ল্যাঙ্গুয়েজেজ নামক প্রতিষ্ঠানে সরকারি ব্যবস্থায় দেড় বছর চীনা ভাষা পড়াশুনা করি। যুদ্ধ শুরু হবার কারণে পাকিস্তানিরা আমাদের তিনজন বাংগালিকে ফাইনাল পরীক্ষা দিতে না দিয়ে প্রথমে বিভিন্ন ইউনিটে, পরে বন্দিশিবিরে পাঠিয়ে দেয়। চীন কর্তৃক বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার পরপরই বাংলাদেশ আর্মি আমাদের তিনজনকে চীনা বৃত্তির অধীনে সে দেশে চীনা ভাষার কোর্সটি শেষ করে ডিগ্রি নেবার জন্য পাঠিয়ে দেয়। মূল কোর্স তিন বছরের হলেও পূর্ববর্তী পাঠকাল বিবেচনা করে দশ মাসের একটি সেসনের পর আমাদের তিনজনকে চীনের বিশ্ববিদ্যালয়টি ফাইনাল পরীক্ষায় অংশ নেবার অনুমতি দেয়। আগের থেকে চীনা ভাষায় অনেকটা দক্ষতা থাকার কারণে সেখানে পৌছে, ইন্টারপ্রেটরের মাধ্যমে নয়, আমরা নিজেদের চোখ-কান দিয়ে চীনা সমাজ এবং রাষ্ট্রকে দেখতে পেরছি। সর্বপ্রথম যে বিষয়টা আমাদের মনে গভীর রেখাপাত করলো, তা হলো নিজেরা কট্টর কম্যুনিস্ট হওয়া সত্বেও অন্যের ধর্মের প্রতি তাদের শ্রদ্ধাবোধ। আমাদের ক্যাফেটেরিয়ায় মুসলমান ছাত্রদের জন্য আলাদা ডাইনিং হল ছিলো। যেখানে মুসলমান শেফ দিয়ে রান্না করা একমাত্র হালাল খাবার পরিবেশন করা হতো। তখন এবং পরবর্তীকালে চীনে থাকার সময় চীনের বিভিন্ন অঞ্চলে অনেক শহর এবং গ্রাম ভিজিট করেছি। সবখানে একই রকম অবস্থা দেখেছি। মসজিদসহ সকল ধর্মের উপাসনালয় রাষ্ট্রের টাকায় চালানো হচ্ছে। সরকারি কোষাগারের অর্থ দিয়ে কুর’আন শরীফ ছাপিয়ে মুসলমানদের মধ্যে বিতরণ করা হচ্ছে, মসজিদের ইমামদের বেতন দেওয়া হচ্ছে। এমনকি সরকারি টাকায় প্রতি বছর মুসলমানদের হজ্জ করতে পাঠানো হচ্ছে। ইসলাম সম্বন্ধে পড়াশুনা করার জন্য ইমামদের মিশরের আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠানো হচ্ছে। ছোটোবড় সকল শহরে হালাল গোস্তের দোকান রয়েছে। প্রায় সব রেস্টুরেন্টে হালাল খাবার পরিবেশনের ব্যবস্থা রয়েছে, যা রেস্টুরেন্টের বাইরে সাইনবোর্ডে লেখা রয়েছে। একবার বিশেষ ট্রেনে করে আমাদের কোথাও নিয়ে যাওয়া হচ্ছিলো। পথে খাবারের জন্য একটি স্টেশনে ট্রেন থেমেছিলো। আমরা কিছু মুসলমান যাত্রী খাবার শেষ হলে ওয়াক্তিয়া নামাজের জন্য প্ল্যাটফর্মের উপর দাঁড়ালাম। চীনারা বিন্দুমাত্র বিরক্তি প্রকাশ না করে নামাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করে পরে ট্রেন ছাড়লো। আরেকবার, তখন আমি আমাদের পেইচিং দূতাবাসে চাকুরি করি, রমজান মাসে পেইচিং থেকে অনেক দূরে এক শহরে কাজে গিয়েছি। সেখানে পৌছার পর আমার হোস্টকে জানালাম, আমি রোজা রাখছি, শেষরাতে সেহরির ব্যবস্থা করা যাবে কিনা। হোস্ট, পিএলএ’র একজন কর্নেল, হেসে দিয়ে বললেন, আমি তোমাদের রোজা সম্বন্ধে জানি। আমার ইউনিটে কিছু মুসলিম সোলজার আছে যারা নিয়মিত রোজা রাখে। তুমি এ নিয়ে ভেবো না। ভোর রাতে দরজায় নক্ শুনে জেগে দেখলাম মেসের দু’জন কর্মীকে সাথে নিয়ে চীনা কর্নেল সাহেব ইউনিফর্ম পরিহিত অবস্থায় নিজে সেহরির খাবার হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। এ দৃশ্য দেখে বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে গেলাম। কর্নেল সাহেব অনুমতি নিয়ে ঘরে এসে টেবিলে খাবার সাজিয়ে রেখে চলে গেলেন। যাবার সময় বলে গেলেন, সকাল বেলা প্লেট-পেয়ালা নিয়ে যাবেন। দু’তিন দিন সেখানে ছিলাম। প্রতিদিন সেহরি এবং ইফতারির সময় একইভাবে আমাকে খাবার সার্ভ করা হয়েছিলো। কম্যুনিস্ট দেশের মানুষের অপরের ধর্মের প্রতি সম্মান দেখার পর আমার দেশে মুসলমানের ঘরে জন্ম নেয়া সেকুলারিজমের ফেরিওয়ালাদের কথা শুনে ভাবি, এরা আসলে কী চায় ?Ashraf's columnhttp://www.blogger.com/profile/16382744974160016625noreply@blogger.com0tag:blogger.com,1999:blog-29831725.post-65493535683063266792014-03-25T11:15:00.003-07:002014-03-25T11:15:43.713-07:00ক্যাডেট কলেজের টুকরো স্মৃতি: ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজ: পর্ব ৩: মায়ের মন মানে না মানাসন্তানের প্রতি বাংগালি মায়ের প্রবাদতুল্য বাৎসল্য সম্পর্কে আমরা সবাই অবগত আছি। এজন্য আমরা বাংগালিরা নিজেদেরকে ভাগ্যবান মনে করি। কন্তু কখনও যে এই বাৎসল্য অশান্তির কারণ হতে পারে তেমন অভিজ্ঞতা ক’জনের হয় ? ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজে প্রিন্সিপালের দায়িত্ব পালনকালে আমাকে এমন একটি অশান্তির মোকাবিলা করতে গিয়ে বেশ বেগ পেতে হয়েছিলো। এখানে বলে রাখা ভালো, ছোটোবেলায় নিজের মাকে হারিয়েছিলাম। তাই মায়েদের ব্যাপারে সবসময় খুব ষ্পর্শকাতর ছিলাম, এখনও আছি। আমি যখন দেখি একজন মা তাঁর সন্তানকে কোলে নিয়ে চুমু খাচ্ছেন, সন্তানের মাথায় হাত রেখে দোয়া করছেন, অথবা নিজহাতে সন্তানের মুখে খাবার তুলে দিচ্ছেন, তখন আমার মনে হয় পৃথিবীর একটি সুন্দরতম দৃশ্য আল্লাহ আমাকে দেখাচ্ছেন। আমার কোনো কাজে বা কথায় কোনো মা কষ্ট পান তা আমি কখনও চাই না। তারপরও ক্যাডেটদের বৃহত্তর স্বার্থে আমাকে এমন একটা সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিলো যাতে তাদের মায়েরা আহত বোধ করেছিলেন।
পেরেন্টস ভিজিটিং ডে’তে আগত সকল মা তাঁর ছেলের জন্য একাধিক টিফিন ক্যারিয়ার এবং ব্যাগ ভরে খাবার নিয়ে আসতেন। রান্না করা নানাবিধ খাবার, পিঠাপায়েস থেকে শুরু করে যাবতীয় মৌসুমী ফল, কোমল পানীয় কোনোকিছু বাদ যেতো না। বিশেষ করে নিচের ক্লাসের ছেলেদের মায়েদের মধ্যে প্রবণতাটা লক্ষ্যণীয়ভাবে বেশি ছিলো। মা ছেলেকে নিজের পাশে বসিয়ে ‘ডাকফিডিং’ করতেন। যার ফলে পরদিন সকালে কলেজের হাসপাতালে ডায়রিয়াজনিত কারণে সিক রিপোর্টের সংখ্যা অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যেতো। তবে সবচেয়ে খারাপ পরিণতি ছিলো বিষয়টির ইমশেনাল দিক। যাদের মায়েরা আসতেন সেসব ক্যাডেট সবার সামনে প্রকাশ্যে হাপুসহুপুস করে খেলেও, যাদের মায়েরা আসতে পারতেন না তাদের চোখেমুখে যে বঞ্চনার করুণভাব ফুঠে উঠতো তা আমাকে ব্যাথিত করে তুলতো। এমন অনেক ছেলে ছিলো যাদের মায়েরা দূরত্ব অথবা অসুস্থতার কারণে কখনই আসতে পারতেন না। এদের অবস্থা চিন্তা করে আমার নিজের মনও খারাপ হয়ে যেতো।
একদিন কৌতহল বশত: ছেলেকে খাওয়াচ্ছেন এমন একজন মায়ের পাশে গিয়ে বসে আলাপ শুরু করলাম। দেখলাম তিনি পরম আদরের সাথে আস্ত মুরগির রোস্ট ভেঙ্গে ছেলের মুখে তুলে দিচ্ছেন। জানতে পারলাম, ছেলেটির বাবা খুলনায় স্বল্প বেতনে একটি চাকুরি করেন। তাঁদের আরও তিনটি ছেলেমেয়ে বাড়িতে আছে। জিজ্ঞাসা করলাম, বাসায় সপ্তাহে ক’বার মুরগির রোস্ট রান্না করেন ? জবাবে তিনি জানালেন, সপ্তাহ তো দূরের কথা। মাসেও একবার করেন না। সামর্থ্যে কুলায় না। মেহমান-অতিথি এলে কালেভদ্রে মুরগির রোস্ট রান্না করেন। জিজ্ঞাসা করলাম, আপনি কী জানেন, আপনার এই ছেলে ক্যাডেট কলেজে সপ্তাহে কতবার মুরগির গোস্ত খায় ? মা কিছুক্ষণ নীরবে মাথা নিচু করে থেকে বললেন, কী করবো স্যার। মনটা যে মানে না। প্রত্যেকবার পেরেন্টস ডে’তে আসার সময় টাকা ধার করে মুরগি কিনে রোস্ট বানিয়ে আনি। আমি তাঁর ক্যাডেট ছেলেকে দেখিয়ে বললাম, এই ছেলে সপ্তাহে চার বেলা মুরগির গোস্ত, চার বেলা গরু বা খাসির গোস্ত, চার বেলা বড় মাছ এবং দুই বেলা শাকশব্জি দিয়ে ভাত বা পোলাও খায়। এছাড়া নিয়মিত ডিম, দুধ, ফলমূলসহ অনেক রকম পুষ্টিকর খাবার খেয়ে থাকে। আপনি তো আপনার চারটি সন্তানের সকলরই মা। বাড়িতে আপনার সাথে যে তিনজন থাকে তাদেরকে মাসে একবার মুরগি খাওয়াতে পারেন না। অথচ, যে ছেলে ক্যাডেট কলেজে থেকে সপ্তাহে চারদিন মুরগিসহ আরও অনেক পুষ্টিকর খাবার খাচ্ছে তার জন্য ধার করা টাকা দিয়ে মুরগি রান্না করে আনছেন, আপনারই অন্য বাচ্চাদের বঞ্চিত করে। মা হয়ে সন্তানদের মধ্যে এ ধরনের পক্ষপাতিত্ব করা কি ঠিক কাজ হলো ? আমি মায়ের চোখে পানি দেখলাম। তিনি বললেন, আজই শেষ। ভবিষ্যতে এমন আর হবে না।
আমি মায়ের চোখের পানিতে সমস্যার সমাধান খুঁজে পেলাম। সহকর্মীদের সাথে আলাপ করে পেরেন্টস ভিজিটিং ডে’তে ক্যাডেটদের জন্য সকল প্রকার খাবার এবং পানীয় আনা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ করা হলো। এবার অনেক মা ভীষণ ক্ষেপে গেলেন। তাঁদের বক্তব্য, আমরা নিজেদের টাকা দিয়ে নিজেদের ছেলেদের জন্য খাবার আনি। তাতে প্রিন্সিপাল সাহেবের আপত্তি করার কী আছে ? একদিন চারপাঁচজন মা মিলে একটি ডেলিগেশন নিয়ে আমার অফিসে এলেন। আমার সিদ্ধান্ত বাতিল করার জন্য জোর অনুরোধ জানালেন। আমি আমার পক্ষ থেকে বিষয়টি বুঝিয়ে বললাম। উপরে বর্ণিত মায়ের ছেলেকে মুরগির রোস্ট খাওয়ানের ঘটনা বললাম। সবশেষে বললাম, তবে হ্যাঁ, আমার তিন’শ ছেলের সবার জন্য যদি খাবার আনতে পারেন তা হলে মোস্ট ওয়েলকাম। আমাকে আগে থাকতে জানাবেন। আমি আনন্দের সাথে পরিবেশনের সব ব্যবস্থা করে দেবো। এরপর এমন অনুরোধ নিয়ে কেউ আর অমার কাছে আসেননি।Ashraf's columnhttp://www.blogger.com/profile/16382744974160016625noreply@blogger.com0tag:blogger.com,1999:blog-29831725.post-67566683082250499372014-03-25T11:14:00.002-07:002014-03-25T11:14:47.831-07:00ক্যাডেট কলেজের টুকরো স্মৃতি: ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজ: পর্ব ২: প্রিন্সিপাল তো নয় যেনো আই জি প্রিজন !ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজে যোগদান করার পরপরই নজর দিলাম ক্যাডেটদেরকে বাইরের সকল প্রকার অশুভ প্রভাব ও হস্তক্ষেপ থেকে সুরক্ষা প্রদানের দিকে। কারণ, আমার মনে হয়েছে, ভিতরে আমি যতো ভালো কাজই করি না কেনো, বাইরের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে তাকে রক্ষা না করতে পারলে সে ভালো কাজ সফল হবে না। মাসে একটি নির্দিষ্ট দিনে পেরেন্টস ভিজিটিং ডে ছিলো। বিধি অনুযায়ী ঐদিন শুধুমাত্র ক্যাডেটদের পিতামাতা এবং অনুমোদিত স্থানীয় আভিভাবকরা ক্যাডেটদের সাথে দেখা করতে আসতে পারতেন। ক্যাম্পাসের অভ্যন্তরে একটা নির্দিষ্ট স্থানে একটা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য দেখাসাক্ষাতের ব্যবস্থা ছিলো। লক্ষ্য করলাম, ঐদিন কলেজের মেইন গেইট দিয়ে জলের স্রোতের মতো লোকজন ঢুকতো। কে কার সাথে দেখা করলো তার কোনো হিসাব ছিলো না। খবর নিয়ে জানলাম, ক্যাডেটদের পিতামাতা ছাড়াও, আত্মীয় নয় এমন লোকজন আত্মীয় পরিচয় দিয়ে প্রবেশ করতো। যার মধ্যে উগ্র রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী, ধর্মীয় গুরু, এলাকার মাস্তান, সিনিয়র ক্লাসের ক্যাডেটদের গার্লফ্রেন্ডসহ আরো অনেকে ছিলো। এ ছাড়া পেরেন্টস ভিজিটিং ডে নয় এমন দিনেও কিছুকিছু লোক, বিশেষ করে কিছু উচ্চপদস্থ সরকারি অফিসার এবং তাঁদের পত্নীগণ, ভিতরে এসে ক্যাডেটদের সাথে দেখা করতো।
একদিন ক্লাস টুয়েলভের একটি ছেলের বাবা আমাকে ঢাকা থেকে টেলিফোন করলেন। ধরা যাক ছেলেটির নাম বাবর। অত্যন্ত কাতর কন্ঠে আমাকে বাবরের বাবা যা বললেন তার সারাংশ হলো: তিনি একটি সরকারি প্রতিষ্ঠানের মাঝারি পর্যায়ের অফিসার। আগে যশোর শহরে পোস্টেড ছিলেন তখন পেরন্টেস ভিজিটিং ডে’তে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে এসে বাবরের সাথে দেখা করতেন। ঢাকায় থাকার কারণে গত ছ’মাস যাবত তিনি বা পরিবারের অন্য কেউ ঐদিনগুলোতে বাবরকে দেখতে আসতে পারছেন না। এই সুযোগ নিয়ে তাঁদের যশোরের এক প্রাক্তন পড়শী মহিলা বাবরের খালার পরিচয় দিয়ে বাবরকে দেখতে আসছে। আমি সরল মনে জানতে চাইলাম তাতে দোষের কী হলো। জবাবে ভদ্রলোক যা বললেন তাতে আমার দিব্যদৃষ্টি খুলে গেলো ! তথাকথিত খালার একটি ১৫/১৬ বছর বয়সী মেয়ে আছে যে ক্লাস টেনে পড়ে। মহিলা চাচ্ছে বাবর যাতে তার মেয়ের সাথে প্রেম করতে থাকে। বাবর ক্যাডেট কলেজের ছাত্র, পড়াশুনাসহ সবদিক দিয়ে ভালো। জামাই হিসেবে খুব ভালো হবে। তাই এখন থেকে ‘হুক’ করে রাখতে চাচ্ছে। বাবর অনেকটা পটে গেছে বলে বাবরের মা-বাবার ধারণা। কলেজে লম্বা ছুটি হলে বাবর এখন আর সরাসরি ঢাকা চলে যায় না। যশোরে ‘খালা’র বাসায় দু’য়েক দিন বেড়িয়ে পরে ঢাকা যায়। বিষয়টি বাবরের বাবা এবং মা কেউই মেনে নিতে পারছেন না। কাঁদোকাঁদো হয়ে তিনি বললেন, যেভাবেই হোক বাবরের সাথে ঐ ‘খালা’ এবং তার মেয়ের দেখাসাক্ষাত বন্ধ করতেই হবে। কলেজে ভেকেশন শুরু হলে বাবরকে সরাসরি ঢাকাতে আসতে হবে। যশোরে ‘খালা’র বাড়ি যাওয়া চলবে না। আমি মনেমনে ভাবলাম, আল্লাহ জানেন, এমন আর কতো বাবর আছে আমার কলেজে ! আমি বাবরের বাবাকে এই বলে আস্বস্ত করলাম, আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন। অবশ্যই কিছু একটা করবো।
মাসিক হা্উস ইন্সপেকশনের সময় কোনোকোনো ক্যাডেটের কাবার্ড থেকে উগ্র রাজনৈতিক দলের প্রচারমূলক পুস্তিকা, লিফলেট পাওয়া গেলো। শুক্রবার জুমার নামাজে ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দলের সদস্যরা নামাজ পড়ার অছিলায় কলেজ মসজিদে এসে ছেলেদের সাথে রাজনৈতিক আলোচনা করতো। কিছু উগ্র বামপন্থী দলের কর্মীরাও সুযোগ বুঝে কলেজে ঢুকে একই কাজ করছে বলে জানতে পারললাম।
টি-ব্রেকের সময় আমি স্টাফ রুমে গিয়ে ফ্যাকাল্টি মেম্বারদের সাথে একত্রে চা-নাস্তা খেতাম । এটা আমার প্রতিদিনের অভ্যাস ছিলো। অভ্যাসটি শিখেছিলাম আর্মি থেকে। ইউনিট পর্যায়ে আর্মিতে এটির চর্চা খুব জনপ্রিয়। অফিসে বা বাইরে খুব জরুরি কিছু না থাকলে এটা মিস করতাম না। চা-নাস্তা খেতেখেতে হাল্কা পরিবেশে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের অবতারণা করে সকলের মতামত ও সুপারিশ জেনে নিতাম। মতানৈক্য হলে বেশ বিতর্ক জমে উঠতো। টি-ব্রেকের নির্ধারিত সময় শেষ হয়ে গেলে যাঁদের ক্লাস বা কাজ থাকতো তাঁরা উঠে চলে যেতেন। আমি অন্যদের নিয়ে আলাপ করতাম। ফর্মাল স্টাফ মিটিংয়ে অনেকে, বিশেষ করে জুনিয়র সহকর্মীরা, সহজে মুখ খুলতে চান না। কিন্তু ইনফর্মাল চায়ের টেবিলে হাল্কা পরিবেশের কারণে সবাই মনের কথা বলতে উৎসাহিত বোধ করতেন। অনেকটা আড্ডার মতো পরিবেশ হতো, যেখানে আমি বলতাম খুব কম, শুনতাম বেশি। নেপথ্যে থেকে আলোচনার বিষয় ও গতি নিয়ন্ত্রণ করতাম। প্রায় সকল ক্ষেত্রে আলোচনায় গৃহীত সিদ্ধান্ত আমার নিজস্ব সিদ্ধান্ত থেকে ভিন্নতর হতো না। এ ধরনের আলোচনায় আরও একটা সুবিধা ছিলো। আলোচনার মাধ্যমে যে সিদ্ধান্ত বেরিয়ে আসতো তা, প্রিন্সিপালের সিদ্ধান্ত হিসেবে অফিস অর্ডারের মাধ্যমে প্রকাশিত হলেও, উপস্থিত সকলে যৌথ সিদ্ধান্ত হিসেবে মেনে নিয়ে তা আন্তরিকভাবে পালন করতেন। সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে সবাই নিজেকে অংশীদার মনে করতেন। প্রিন্সিপালকে কমান্ডার বা বস হিসেবে না দেখে টীমলিডার হিসেবে দেখতেন। নির্দেশ প্রদান ও পালনের ক্ষেত্রে এই বিশেষ পদ্ধতিটি খুবই কার্যকর হয়েছিলো। ঐতিহ্যগতভাবে বাংলাদেশিরা এন্টি এস্টাবলিশমেন্ট। যার কারণে, শিক্ষিতরা বসের আদেশ মানার চাইতে টীমলিডারের আদেশ মানতে আধিকতর সাচ্ছ্যন্দ বোধ করেন বলে আমি মনে করি।
যাহোক, পেরেন্টস ভিজিটিং ডে’তে সৃষ্ট এসব অরাজকতা দূর করার জন্য টি-রুমে আলোচনার ভিত্তিতে বেশ কিছু সিদ্ধান্ত নেয়া হলো। যা ক্যাডেটদেরকে সাপ্তাহিক সমাবেসে, এবং তাদের পিতামাতা/অভিভাবকদেরকে লিখিতভাবে জানিয়ে দেওয়া হলো। কলেজ গেইটে কড়াকড়ি আরোপ করা হলো। কলেজ চত্বরে ঢোকার সময় এবং বের হবার সময় সকল ভিজিটরক তার নাম, ঠিকানা, প্রবেশের সময় এবং কারণ, এবং বের হবার সময় লিপিবদ্ধ করার নিয়ম চালু করা হলো। শুক্রবার ক্যাডেট ও ক্যাম্পাসে বসবাসকারী ছাড়া অন্যদের কলেজ মসজিদে জুমার নামাজের জন্য আসা বন্ধ করা হলো। ক্যাডেটদের আবাসিক এলাকায় প্রবেশের পথে প্রয়োজনীয় চেকপোস্ট বসানো হলো। মসজিদে কর্মকর্তা-কর্মচারীর কোনো বহিরাগত মেহমান আসতে চাইলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীকে বলা হলো মেহমানকে নিজে সঙ্গে করে আনতে। সকল পিতামাতা ও অনুমোদিত অভিভাবককে কলেজের অফিস থেকে ছবিসহ পরিচয়পত্র প্রদান করা হলো। পেরেন্টস ভিজিটিং ডে’তে পরিচয়পত্র দেখিয়ে প্রবেশ করা বাধ্যতামূলক করা হলো। কোনো পিতামাতা বা অনুমোদিত অবিভাবক পরিচয়পত্র আনতে ভুলে গেলে সংশ্লিষ্ট ক্যাডেটের হাউস মাস্টার/টিউটর গেইটে এসে পরিচয় জেনে নিয়ে তাঁকে ভিতরে আসতে দিতেন।
এতো সব করার পরও বাবরের বাবার সমস্যা পুরোপুরি সমাধান হলো না। বাবরের যশোর যাওয়া বন্ধ করতে হবে। ঝিনাইদহ বাস মালিক সমিতির কর্মকর্তাদেরকে চায়ের দাওয়াত দিয়ে আমার অফিসে ডেকে এনে সহযোগিতা চাইলাম। সিদ্ধান্ত হলো, ভেকেশন শুরুর কয়েকদিন আগে জানালে তাঁরা ঢাকা, খুলনা, কুষ্টিয়া, যশোর, মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গা এসব শহরের জন্য রিজার্ভড বাসের ব্যবস্থা করে দিবেন। এসব বাস গন্তব্য ছাড়া রাস্তায় কোথাও থামবে না। কোনো ক্যাডেট নির্ধারিত গন্তব্য ছাড়া অন্য কোথাও যেতে চাইলে আগেভাগে অভিভাবকের কাছ থেকে লিখিত অনুরোধ আনতে হবে। এরপর থেকে বাবরের পক্ষে আর যশোরে ‘খালা’র বাড়ি যাওয়া আমার জানামতে সম্ভব হয়নি। তবে শেষ পর্যন্ত সেই ‘খালা’র মেয়েটির সাথে বাবরের প্রেম কতদূর এগিয়েছিলো, তা আমি জানতে পারিনি !
ইতোমধ্যে একটি ঘটনা ঘটলো যা আমার জন্য কষ্টদায়ক হলেও আমার কাজ কিছুটা হলেও সহজ করে দিলো। একদিন দুপুর বেলা আমার বড় মামা গ্রামের বাড়ি থেকে কলেজে এলেন আমার পরিবারের সবার সাথে দেখা করতে। ছোটো বেলায় আমার মা মারা যাবার পর থেকে, যেখানেই থাকতাম না কেনো, উনি প্রায়ই এমন আসতেন। বিকেল বেলা মামা ইচ্ছে প্রকাশ করলেন উনার গ্রামের একটি ক্যাডেটকে উনি দেখবেন। ওর বাবাকে উনি কথা দিয়ে এসেছেন। আমি পড়লাম মহা বিপদে। কলেজের আইন ভঙ্গ করে আমার পক্ষে উনার ইচ্ছা পূরণ করা কিছুতেই সম্ভব নয়। অন্যদিকে জীবনে কখনও মামার কথা অমান্য করিনি। তখনই সরাসরি জবাব দিলে, আমি জানি, মামা আমার বাসা ছেড়ে রাগ করে চলে যাবেন। কিছুটা সময় নেবার জন্য বললাম, এই তো এলেন। রেস্ট করেন। দেখি কাল সকালে কী করা যায়। পরদিন সকাল বেলা নাস্তার টেবিলে মামা পুনরায় অনুরোধ জানালেন ছেলেটিকে দেখার জন্য। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ক্যাডেটদের সাথে বহিরাগতদের দেখাসাক্ষাতের নিয়মকানুন সম্পর্কে ছেলেটির বাবা আপনাকে কিছু বলেননি ? তিনি জানালেন, না। আমি তখন অনেক কষ্টে তাকে বুঝিয়ে বললাম, কেনো কলেজের আইন অনুযায়ী তাঁর সাথে ছেলেটিকে দেখা করতে দেওয়া যায় না। তিনি বললেন, প্রিন্সিপাল আনুমতি দিলেও দেখা করা যাবে না ? আমি বললাম, না। খুব জরুরি কারণ ছাড়া প্রিন্সিপালের অনুমতি দেওয়ার এখতিয়ার নেই। আপনার সাথে ঐ ছেলেটির দেখা করার কোনো জরুরি প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করি না। আমি খোঁজ নিয়েছি। ছেলেটি ভালো আছে। বাড়ি ফিরে ওর বাবাকে জানিয়ে দিবেন। যদি ওর বাবা প্রশ্ন করেন কেনো দেখা হলো না, তবে তাঁকে কি জবাব দেবো, মামা জানতে চাইলেন। বলবেন, ভাগ্নে খুব আদর যত্ন ও সম্মান করেছে। তবে প্রিন্সিপাল বেটা খুব নিষ্ঠুর ! কোনোমতেই আপনার ছেলের সাথে দেখা করার অনুমতি দিলো না। আমার একথা শুনে মনে হলো মামা নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। মুখ অত্যন্ত বেজার করে মামা উঠে গেলেন। কোনো রকমে চা-নাস্তা খেয়ে চলে গেলেন। তারপর রাগ করে প্রায় তিনচার মাস আমার বাসায় আসেননি।
ঘটনাটি কেমন করে যেনো সারা কলেজে ছড়িয়ে গেলো। হয়তো প্রিন্সিপালের বাসার স্টাফদের কাছ থেকে জানতে পেরে থাকবে। এখানে একটা কথা বলে রাখি। ক্যাডেট কলেজের প্রিন্সিপালের ব্যক্তিগত জীবনে প্রাইভেসি বলতে কিছু নেই। সারাক্ষণ তাঁকে এবং তাঁর পরিবারের সদস্যদেরকে প্রায় ১৫০ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীর তীক্ষ্ন নজরদারিতে থাকতে হয়। ভালো বা মন্দ উল্লেখযোগ্য কিছু ঘটলে তা সাথেসাথে সবার কানে পৌঁছে যায়। ক্যাডেটরাও জেনে ফেলে। এজন্য প্রিন্সিপালকে, এমনকি তাঁর পরিবারের সদস্যদেরকে, প্রতিটি কাজে এবং কথায় অনগার্ড থাকা খুবই জরুরি।
কিছুকিছু পিতামাতা/অভিভাবক, বিশেষ করে মায়েরা, উপরে উক্ত ব্যবস্থা নেবার কারণে প্রথম দিকে প্রিন্সিপালের উপর খুব রাগ করেছিলেন। তাঁদের নানারকম মন্তব্য, যা মোটেও সুখকর ছিলো না, ঘুরেফিরে আমার কানে আসতে লাগলো। তাঁরা কেউকেউ এমন মন্তব্যও করলেন, প্রিন্সিপাল তো নয় যেনো আই জি প্রিজন এসেছেন। তবে অনেকে ব্যাপারটি প্রশংসার চোখেও দেখেছিলেন। কিছুদিন পরে অবশ্য সবাই নিয়মটি মন থেকে মেনে নিয়েছিলেন।Ashraf's columnhttp://www.blogger.com/profile/16382744974160016625noreply@blogger.com0tag:blogger.com,1999:blog-29831725.post-47417576195151865672014-03-25T11:13:00.004-07:002014-03-25T11:13:49.604-07:00ক্যাডেট কলেজের টুকরো স্মৃতি: ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজ: পর্ব ১: প্রিন্সিপাল পদে যোগদান১৯৭৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের ৮ তারিখে ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজের প্রিন্সিপাল পদে যোগদান করি। তখন আমার বয়স কতোই বা হবে। সার্টিফিকেট অনুযায়ী বত্রিশ বছর কয়েক মাস। বাস্তবে তেত্রিশ বছর। প্রসঙ্গত: বর্তমান প্রজন্মের তরুণ-তরুণীদের জন্য একটা কথা বলা প্রয়োজন মনে করছি। এখন থেকে ষাট-সত্তর বছর আগে, আমাদের ছোটোবেলায়, এখনকার মতো জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধনের কোনো রেওয়াজ এবং ব্যবস্থা ছিলো না। প্রায় সকলের দু’টো করে জন্মদিন থাকতো। একটা ছিলো আসল জন্মদিন। আর একটা অফিসিয়াল জন্মদিন। ক্লাস নাইনে উঠার পর সকলকে দু’বছর পর মেট্রিকুলেশন পরীক্ষার জন্য শিক্ষা বোর্ডে নাম রেজিস্ট্রি করতে হতো। কাজটি নিজনিজ স্কুলের মাধ্যমে করতে হতো। তখন, মাস্টার্স পাশ করে সরকারি চাকুরিতে ঢোকার সর্বনিম্ন বয়স বিবেচনায় রেখে, স্কুলের হেড স্যার একটা জন্মদিন ঠিক করে লিখে দিতেন। যাতে রিটায়ার করার আগ পর্যন্ত সর্বোচ্চ বেশিদিন চাকুরি করা সম্ভব হয়। আমার বেলায়ও তেমনটি হয়েছিলো। এ নিয়ে একবার জেদ্দা এয়ারপোর্টে বেশ বিব্রত হয়েছিলাম। আমার পাসপোর্ট দেখতেদেখতে ইমিগ্রেশন অফিসার হঠাৎ আমাকে প্রশ্ন করলেন, আচ্ছা বলোতো তোমার দেশের প্রায় সব লোকের জন্মদিন পহেলা জানুয়ারি হয় কেনো ? সৌদি ইমিগ্রেশন অফিরারটি হঠাৎ আমাকে কেনো এমন প্রশ্ন করলেন তা বুঝতে পারলাম না। আমার পাসপোর্টে অবশ্য আমার সরকারি জন্মদিন পহেলা জানুয়ারি ছিলো না। উপরে বর্ণিত আমার জবাব শুনে ভদ্রলোক অবাকই হয়েছিলেন বৈ কি ! যাহোক, আগের কথায় আসি। বলা হয়েছিলো এতো কম বয়সে, অর্থাৎ চল্লিশের চাইতে কম বয়সে,উপমহাদেশে আমার আগে আর কেউ পাবলিক স্কুল বা ক্যাডেট কলেজে প্রিন্সিপাল পদে নিয়োগ পাননি। আজকে ছত্রিশ বছর পর, ২০১৪ সালে, যখন ফিরে তাকাই তখন মনে হয়, আমার মতো এতো অল্প বয়সের একজনকে এমন গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ দেবার পেছনে দু’টি কারণ ছিলো। এক, ১৯৭১ সনের পূর্বে সশস্ত্রবাহিনীর শিক্ষা বিভাগ থেকে পশ্চিম পাকিস্তানি অফিসাররা চাকুরিতে সিনিয়র হবার কারণে প্রিন্সিপাল পদে নিয়োগ পেতেন। তখন পর্যন্ত মাত্র একজন বাংগালি অফিসার এই পদে নিয়োগ পেয়েছিলেন। তাঁর নাম শহীদ লে: কর্নেল এম এম (মোহাম্মদ মঞ্জুরুর) রহমান এইসি (আর্মি এডুকেশন কোর), যিনি কর্নেল রহমান নামে অধিক পরিচিত ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় নিজ কর্মস্থল ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজে কনের্ল রহমান পাকিস্তান আর্মির হাতে নিমর্মভাবে, একজন সত্যিকারের বীরের মত, শহীদ হন। দু:খের বিষয়, আমাদের আর্মি তথা দেশ আজ পর্যন্ত এই বীরের প্রতি যথাযথ সম্মান দেখাতে পারেনি।
দুই, তখন দেশের প্রসিডেন্ট হিসেবে চীফ এক্সিকিউটিভ ছিলেন শহীদ জেনারেল জিয়াউর রহমান, বীর উত্তম। ডিফেন্স মিনিস্ট্রির দায়িত্বও তাঁর হাতে ছিলো। জে: জিয়া পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমিতে সরাসরি ইন্সট্রাক্টর হিসেবে আমাকে পড়িয়েছেন, ট্রেইনিং দিয়েছেন। ১৯৭৩ সালে আর্মি হেডকোর্য়াটার্সে বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমি (বি এম এ) প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে, প্রস্তুতিমূলক কাজগুলো দ্রুত সম্পন্ন করার জন্য, একটি সেল গঠন করা হয়েছিলো। অনেক কাজের মধ্যে যার প্রধান কাজ ছিলো বি এম এ’র জন্য টেবল অব অর্গানাইজেশন এন্ড ইকুইপমেন্ট (টি ও এন্ড ই) প্রনয়ণ করা। এই সেলে প্রথম যে চারজন অফিসারের কাজ করার গৌরব হয়েছিলো তার মধ্যে আমি একজন ছিলাম। জে: জিয়া আর্মির ডেপুটি চীফ অব স্টাফ হিসেবে সেলের কাজ তত্বাবধান করতেন। তখন আর একবার আমার সুযোগ হয়েছিলো জে: জিয়ার প্রত্যক্ষ সাহচর্যে আসার। পরে আরও একবার জে: জিয়ার ব্যক্তিগত তত্বাবধানে কাজ করার সৌভাগ্য আমার হয়েছিলো। ১৯৭৫ সালে মার্শাল ল’ জারি হবার পর রাস্ট্রের সকল গোয়েন্দা সংস্থার কাজকর্ম কেন্দ্রীয়ভাবে নিয়ন্ত্রণ ও সমন্বয় করার জন্য কোঅর্ডিনেশন এন্ড কন্ট্রোল সেল ফর ন্যাশনাল সিকিউরিটি নামে প্রেসিডেন্টের অধীনে একটি শীর্ষ প্রতিষ্ঠান স্থাপন করা হয়। সেখানে আর্মি থেকে প্রাথমিকভাবে যে চারজন অফিসারকে নিয়োগ দেওয়া হয় তার মধ্যে আমাকে রাখা হয়েছিলো। ব্যক্তিগতভাবে জে: জিয়া এই সেলের কাজ তত্বাবধান করতেন। বলতে গেলে এসব কারণে আমি সম্ভবত: ব্যক্তিগতভাবে জে: জিয়ার স্নেহভাজন এবং আস্থাভাজন হয়ে উঠেছিলাম।
১৯৭১ সালে দেশ পাকিস্তানি হানাদার মুক্ত হবার পর দেখা গেলো বাঁচিয়ে রাখতে হলে, অন্যান্য রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের মতো, ক্যাডেট কলেজগুলোরও পুনর্গঠন করা জরুরি। তখনকার ডেপুটি আর্মি চীফ জে: জিয়াকে ক্যাডেট কলেজগুলোর গভর্নিং বডির চেয়ারম্যান নিয়োগ করে তাঁকে এই দায়িত্ব অর্পণ করা হয়। জে: জিয়ার নির্দেশনায় প্রিন্সিপাল নিয়োগের জন্য একটি প্রক্রিয়া নির্ধারণ করা হয়। প্রক্রিয়া অনুযায়ী ক্যাডেট কলেজের প্রিন্সিপাল হবার যোগ্য এমন প্রার্থীদের নাম আর্মি, নেভী, এয়ার ফোর্স ও ক্যাডেট কলেজের সিভিলিয়ান শিক্ষকদের পক্ষ থেকে ডিফেন্স মিনিস্ট্রিতে পাঠানো হয়। সেবার তালিকাতে আমার নামও ছিলো। পরবর্তীকালে নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে জানতে পারি যে, নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ ক্যাডেট কলেজ কাউন্সিলের চেয়ারম্যন আমার ব্যাপারে আপত্তি জানিয়েছিলেন বয়স কম হবার কারণে। কিন্তু জে: জিয়া এই বলে সে আপত্তি নাকোচ করে দিয়েছিলেন, Don’t worry. I know this boy. He will not let you down. যাঁদের জে: জিয়ার সাথে কাজ করার অভিজ্ঞতা আছে তাঁরা জানেন, জে: জিয়ার কথা এবং কাজের স্টাইলই এমন ছিলো।
১৯৬৩ সনে ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৬৪ সন থেকে রেগুলার ক্যাডেট ভর্তি এবং ক্লাস শুরু হয়। তৎকালীন পাকিস্তান আর্মি এডুকেশন কোরের অত্যন্ত দক্ষ, মেধাবী এবং চৌকশ অফিসার লে: কর্নেল এন ডি হাসানকে প্রতিষ্ঠাতা প্রিন্সিপাল হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সদ্য পাশ করা একঝাঁক অত্যন্ত মেধাবী ও ডেডিকেটেড যুবককে অতি যত্ন সহকারে নির্বাচন করে লেকচারার হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। যাঁরা শুধু নিজনিজ একাডেমিক বিষয়ে ভালো জ্ঞান রাখতেন না, নানা প্রকার শিক্ষাসহায়ক (কো-কারিকুলার) বিষয়েও পারদর্শী ছিলেন। প্রত্যেকে বালকদের জন্য অনুকরণীয় ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন। এখানে উল্লেখ্য, তখন ক্যাডেট কলেজের একজন লেকচারের বেসিক পে, সরকারি কলেজ এবং পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন লেকচারের বেসিক পে থেকে বেশি ছিলো। চাকুরির সুযোগ-সুবিধাও উন্নততর ছিলো। মুক্তিযুদ্ধের পর এসব পার্থক্য আর ধরে রাখা সম্ভব হয়নি। কর্নেল হাসানের সুযোগ্য নেতৃত্বে শুরুতেই নবনিযুক্ত ফ্যাকাল্টি মেম্বররা এক অসাধারণ ট্রেন্ড সেট করতে, অর্থাৎ ধারা প্রবর্তন করতে, সমর্থ হন। ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজের ইতিহাসে এঁদের অবদান স্বর্ণাক্ষরে চিরদিন লেখা থাকবে। যে কোনো প্রতিষ্ঠানের, বিশেষ করে তা যদি হয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, প্রতিষ্ঠাতা প্রধান নিয়োগের ক্ষেত্রে নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষকে সর্বোচ্চ যত্নশীল হওয়া প্রয়োজন। তিনি শুরুতে ভালো বা মন্দ যে ট্রেন্ড সেট করবেন প্রতিষ্ঠানটিকে সেটাই অনেকদিন, এমনকি চিরদিন, বহন করতে হয়। কর্নেল হাসানের পর, কর্নেল রহমানসহ চারজন অত্যন্ত দক্ষ প্রিন্সিপাল আমার আগে সুনামের সাথে দায়িত্ব পালন করেন। এসব গুণী ব্যক্তিদের পর আমার মতো একজন অনভিজ্ঞ তরুনের প্রিন্সিপালের দায়িত্ব গ্রহণ সত্যিকার অর্থেই বিরাট চ্যালেঞ্জ ছিলো।
ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজের অন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্টের কথা উল্লেখ করার দাবি রাখে। তা হলো, চতুর্থ শ্রেণীর সর্বকনিষ্ঠ কর্মচারি থেকে শুরু করে প্রথম শ্রেণীর সর্বজ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা পর্যন্ত, সকলে ব্যক্তিগতভাবে এবং সমষ্টিগতভাবে কলেজের প্রতি প্রচন্ডভাবে অনুগত ছিলেন। আমি দেখেছি, প্রিন্সিপালের সকল আদেশ তাঁরা কীভাবে শিরোধার্য মনে করে সর্বোচ্চ আন্তরিকতার সাথে পালন করতেন।
কলেজটি প্রত্যন্ত এলাকায় অবস্থিত হবার কারণে বড় শহরের সামাজিক, রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ক্ষতিকর প্রভাব ও ঝামেলা থেকে মুক্ত ছিলো। বেশিরভাগ ক্যাডেট আসতো গ্রামীণ অঞ্চল অথবা ছোটো মফস্বল শহর থেকে। ক্যাডেটদের এবং তাদের অভিভাবকদের মধ্যে একরকম গ্রামীণ সারল্য লক্ষ্য করে আমি মাঝেমাঝে হতবাক হয়ে যেতাম। যেমন, কোনো কোনো অভিভাবক প্রিন্সিপালের অফিসে ঢোকার সময় জুতা খুলে ঢুকতেন। আমি চেয়ার থেকে উঠে গিয়ে হাত ধরে বারণ করার আগেই কাজটি করে ফেলতেন। ক্যাডেটদের অভিভাবকরা ছিলেন, শিক্ষিত-অশিক্ষিত এবং ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে, অত্যন্ত ভদ্র ও বিনয়ী। অপসন্দ হলেও কলেজ কর্তৃপক্ষের সকল আদেশ-উপদেশ হাসিমুখে পালন করতেন। তাঁরা বিশ্বাস করতেন, কলেজ কর্তৃপক্ষ যা কিছু করছে তা সবই তাঁদের সন্তানের মঙ্গলের জন্য।
যে কারো জন্য ফার্স্ট টাইম প্রিন্সিপাল হিসেবে কাজ করার জন্য ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজ একটি আদর্শ প্রতিষ্ঠন ছিলো। সে জন্য প্রিন্সিপাল হিসেবে ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজে প্রথম নিয়োগ পাবার জন্য আমি নিজেকে অনেক ভাগ্যবান মনে করি। কলেজের সহকর্মীরা আমাকে অনেক ট্রিক্স অব দি ট্রেইড শিখতে সাহায্য করেছেন। যা বই পড়ে শেখা যায় না।
১৯৫০ দশকের শেষভাগে তৎকালীন পাকিস্তানে বৃটিশ পাবলিক স্কুলের আদলে ক্যাডেটট কলেজ স্থাপনের কাজ শুরু হয়। মূল উদ্দেশ্য ছিলো, ১১/১২ বছরের ছেলেদেরকে বোর্ডিং স্কুলের পরিবেশে রেখে ক্লাস সেভেন থেকে ক্লাস টুয়েলভ পর্যন্ত, অর্থাৎ এইচএসসি পযর্ন্ত শিক্ষাদান করা। সেইসাথে কিছু এলিমেন্টারি মিলিটারি ট্রইনিং দেওয়া, এবং নেতৃত্বের জন্য প্রয়োজনীয় মৌলিক কিছু গুণাবলী বিকাশে সহায়তা করা। যাতে পাশ করে ছেলেরা সশস্ত্রবাহিনীতে কমিশন্ড র্যাং কে যোগদানের জন্য উপযুক্ত এবং উৎসাহিত হয়। সেদিক থেকে বিচার করলে বলা যায়, বাংলাদেশের ক্যাডেট কলেজগুলো সর্বাংশে না হলেও অনেকাংশে সফল হয়েছে, এখনও হচ্ছে বলে আমি মনে করি। ক্যাডেট কলেজ থেকে পাশ করে একটি ছেলে (বা বর্তমানে মেয়েও) যদি সশস্ত্রবাহিনীতে যোগদান করতে আগ্রহী না হয় তা হলেও ক্ষতি নেই বলে আমি মনে করি। অন্য যেকোনো পেশাতেই সে যোগদান করুক না কেনো, সেখানে সে ক্যাডেট কলেজে অর্জিত গুণাবলী দ্বারা অন্যদের তুলনায় অধিকতর অবদান রাখবে বলে আমার বিশ্বাস। যদি কেউ তা না পারে তবে সেটা ক্যাডেট কলেজের ব্যর্থতা নয়, তার ব্যক্তিগত ব্যর্থতা। সেজন্য অনেক কারণ থাকতে পারে।
পৃথিবীর অনেক দেশেই স্কুল পর্যায়ের ছেলেমেয়েদের জন্য ক্যাডেট কলেজের মতো রাষ্ট্র পরিচালিত উন্নত মানের স্কুল আছে। যেগুলোকে সেন্টার্স অব এক্সেলেন্স বলা হয়ে থাকে। আমি নিজে চীনদেশে এমন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দেখেছি। অন্যান্য সমাজতান্ত্রিক দেশেও এমন ব্যবস্থা আছে বলে জেনেছি। রাষ্ট্র এবং সমাজ পরিচালনায় নেতৃত্ব প্রদান করা ডাফার বা অকর্মণ্যদের কাজ নয়। এজন্য দরকার মেধাবী, দক্ষ এবং দেশেপ্রমিক কর্মীর। যারা সকল ক্ষেত্রে যোগ্য নেতৃত্ব প্রদান করবে। এসব সেন্টার্স অব এক্সেলেন্সে ছেলেমেয়েদের নেতৃত্বের প্রয়োজনীয় গুনাবলী, ইংরেজিতে যাকে বলা হয় কোয়ালিটিজ অব হেড, হার্ট এন্ড হ্যান্ড, শিক্ষা দেওয়া হয়। বলে রাখা ভালো, এখানে নেতৃত্ব বলতে শুধু রাজনৈতিক নেতৃত্ব বুঝায় না। যেকোনো পেশায় উৎকর্ষ অর্জনের জন্য প্রয়োজন সুযোগ্য নেতৃত্বের। যদি একমাত্র মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে সকলের সন্তানের জন্য এসব প্রতিষ্ঠানের দরজা সমানভাবে উন্মুক্ত রাখা হয়, তাহলে রাষ্ট্রীয় খরচে ক্যাডেট কলেজ পরিচালনাতে কারও আপত্তি থাকার কথা নয়। বাংলাদেশে কিছু লোক আছেন যাঁরা ক্যাডেট কলেজের কঠোর সমালোচনা করে থাকেন। এঁদের বেশিরভাগই বিত্তশালী ও শক্তিশালী, যাঁরা নিজেদের বিত্ত ও শক্তি দিয়ে বাংলাদেশে নিজ ইচ্ছামতো সব কিছু কিনতে পারেন বা করিয়ে নিতে পারেন। সুপারিশ বা অর্থের জোরে নিজ সন্তানের জন্য ভর্তির ব্যবস্থা করতে না পেরে এরা ক্যাডেট কলেজের সমালোচনা করেন। অন্য কিছু লোক আছেন যাঁরা নীতিগত প্রশ্ন তুলে ক্যাডেট কলেজের বিরোধিতা করেন। যাঁদের সমালোচনা, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অজ্ঞতাপ্রসূত। বহু বছর আগে, পাকিস্তান আমলে, একজন জ্ঞানী লোকের মুখে আমাদের একটি সামাজিক ব্যাধি সম্পর্কে একটা দামি কথা শুনেছিলাম। কথাটা বর্তমানে মনে হয় অধিকতর প্রযোজ্য। কথাটা হলো: Too many people talk too much on subjects they know too little.
আমি ১৯৭৮ সনের ফেব্রুয়ারি থেকে ১৯৮০ সনের মে মাসের প্রথম ভাগ পর্যন্ত ঝিনাইদহে দায়িত্ব পালন করি। সময়টা অল্প হলেও এ সময়ে বেশ কিছু ঘটনা ঘটে যা পাঠকের কাছে আকর্ষণীয় হতে পারে। সব ঘটনা তো বলা যাবে না। পরবর্তীত তার মধ্য থেকে কয়েকটি মাত্র উল্লেখ করার ইচ্ছা রাখি।Ashraf's columnhttp://www.blogger.com/profile/16382744974160016625noreply@blogger.com0tag:blogger.com,1999:blog-29831725.post-58552216185033313132013-11-11T11:49:00.003-08:002013-11-11T12:14:05.204-08:00ক্যাডেট কলেজের টুকরো স্মৃতি
</br>
<p>২০০০ সনের জানুয়ারিতে অবসরে যাবার আগ পর্যন্ত তেত্রিশ বছর সেনাবাহিনীতে চাকুরি করেছি। এর মধ্যে প্রায় পাঁচ বছর ক্যাডেট কলেজে কাজ করেছি। চাকুরির একেবারে শুরুতে এক বছর পাকিস্তানের মিলিটারি কলেজ ঝেলামে জুনিয়র একাডেমিক ইন্সট্রাক্টর হিসেবে চাকুরি করেছি। পরে চাকুরির ১১/১২ বছরের মাথায় চার বছর একনাগারে ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজ এবং ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজের প্রিন্সিপালের দায়িত্ব পালন করেছি। এ সময়ে অনেক কিছু দেখেছি, শুনেছি, শিখেছি, অনুভব করেছি, কিছুটা অভিজ্ঞতাও হয়েছে। তার কিছু কিছু অংশ পাঠকদের সাথে শেয়ার করার তাগিদ অনুভব করছি। গল্পচ্ছলে যখন আত্মীয়স্বজন বা বন্ধুবান্ধবদের কাছে এসব দিনের কোনো ঘটনা বলি, তখন কেউ কেউ সেগুলো লিখে প্রকাশ করার জন্য অনুরোধ করেন। তাঁদের যুক্তি: এগুলো বাস্তব জীবনের অভিজ্ঞতা। ভবিষ্যতের আভিভাবক, শিক্ষক, এমনকি ক্যাডেটরা পড়ে উপকৃত হতে পারে।
সামরিক বাহিনীতে চাকুরি করার সময়ে রোজনামচা বা ডাইরি লেখার অভ্যাস বজায় রাখা নিরাপদ নয়, বিশেষ করে আমাদের মতো দেশে। স্বাধীনভাবে চিন্তা করতে পারলেও স্বাধীনভাবে বলা বা লেখা খুব ঝুঁকিপূর্ণ। ১৯৭১ সনের পূর্বে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে চাকুরি করার সময়ে একজন বাংগালি অফিসারের জন্য কাজটি যারপরনাই বিপজ্জনক ছিলো। তাই চাকুরি জীবনের শুরু থেকে ডাইরি লেখার অভ্যাস গড়ে উঠেনি। যা কিছু লিখছি তার সবটাই স্মৃতি থেকে। দিন, তারিখ, সময়ের হেরফের হতে পারে। লোকজনের নাম ভুল হতে পারে। বোধগম্য কারণে কোনোকোনো লোকের সঠিক নাম আড়াল করে ছদ্মনাম ব্যবহার করতে হয়েছে।</p>
<p>আমি ইতিহাস লিখতে বসিনি। আমি লিখছি আমার নিজের জীবনে ঘটে যাওয়া কিছু ঘটনা। সাধারণ বিবেচনায় এগুলো নৈমিত্তিক ঘটনা হলেও আমার কাছে, তখন মনে না হলেও, এখন মনে হয় এর মধ্যে কিছু অসাধারণ ঘটনা ছিলো। যদিও সব ঘটনার নায়ক বা ভিলেন আমি নিজে নই। কখনও কখনও পার্শ্ব চরিত্র হিসেবে ঘটনার স্বাক্ষী ছিলাম। তাই বর্ণনাতে ‘আমি’র আধিক্য থাকাটা স্বাভাবিক হলেও উদ্দেশ্য আত্মপ্রচার নয়। আশা করি পাঠক ক্ষমা করবেন। প্রয়োজনে যাতে সহজে উল্লেখ করা যায় সেজন্য বর্ণিত ঘটনাগুলোকে একটি করে শিরোনাম ও ক্রমিক নম্বর দিয়ে বর্ণনা করা হয়েছে। </p>
মিলিটারি কলেজ ঝেলাম: পর্ব ১
বাংগালির উর্দু শেখা
</br>
<p>১৯৬৭ সনের আগস্ট মাসের ২৭ তারিখে পি এম এ’র (পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমি) ট্রেইনিং শেষ করে পাকিস্তান আর্মির এডুকেশন কোরে সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট হিসেবে পার্মানেন্ট রেগুলার কমিশন লাভ করি। পাসিং আউটের পর ছুটি কাটিয়ে সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি আমার জীবনের প্রথম ইউনিট মিলিটারি কলেজ ঝেলামে যোগদান করি। এখানে মিলিটারি কলেজ ঝেলাম সম্পর্কে কিছু বলাটা আশা করি অপ্রাসংগিক হবে না। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে বৃটিশ গভর্নমেন্টের পক্ষে অনেক ভারতীয় সৈনিক যুদ্ধ করে প্রাণ হারিয়েছিলো। প্রধানত: সেসব নিহত সৈনিকদের ছেলেদেরকে সরকারি খরচে লেখাপড়া শিখিয়ে সৈনিক বানাবার লক্ষ্যে বৃটিশ সরকার ১৯২২ সনে (পাকিস্তানের) ঝেলামে মুসলমানদের জন্য এবং (ভারতের) দেরাদুনে অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের জন্য দু’টি পৃথক আবাসিক স্কুল প্রতিষ্ঠা করে। নাম দেওয়া হয় কিং জর্জ রয়েল মিলিটারি স্কুল। ১৯২৫ সাল থেকে স্কুল দু’টোর কার্যক্রম শুরু হয়। সাধারণ বেসামরিক স্কুলের সিলেবাস অনুযায়ী ক্লাস এইট পর্যন্ত পাঠদানের পাশাপাশি এলিমেন্টারি মিলিটারি ট্রেইনিং দেবার ব্যবস্থা রাখা হয়। অত্যন্ত পারদর্শিতা অর্জনকারীকে কমিশন প্রদানের জন্য নির্বাচন করা হতো। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর ঝেলামের স্কুলটির নাম পাল্টে মিলিটারি কলেজ ঝেলাম রাখা হয়। প্রচলিত বোর্ডিং স্কুলের মত এটিকে একটি ইন্টারমিডিয়েট কলেজে (দ্বাদশ শ্রণী পর্যন্ত) উন্নীত করা হয়। অনেকটা বর্তমানের ক্যাডেট কলেজের মত। পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর ইতিহাসে এই কলেজের প্রাক্তন ছাত্ররা আজ পর্যন্ত অতি গৌরবময় দেশপ্রেম, আত্মত্যাগ ও শৌর্যবীর্যের স্বাক্ষর রেখে আসছে। পাকিস্তানের একাধিক আর্মি চীফ, নেভি চীফ ও এয়ার চীফ এই কলেজের প্রাক্তন ছাত্র। পাকিস্তানের বর্তমান (২০১৩) আর্মি চীফ জেনারেল আশফাক পারভেজ কায়ানী এই কলেজের একজন প্রাক্তন ছাত্র, যাকে ১৯৬৭ সনে ক্লাসরুমে পড়াবার সুযোগ আমার হয়েছিলো।</p>
<p> আমি যখন যোগদান করি তখন মিলিটারি কলেজ ঝেলামে ছাত্র, যাদেরকে সরকারিভাবে ক্যাডেট বলা হতো তাদের, সংখ্যা ছিলো কমবেশি ৩০০। হাউস (হোস্টেল) ছিলো ৪টি। এর মধ্যে শের শাহ নামক একটি হাউসে একেবারে নতুন আসা ক্লাস এইটের ক্যাডেটদের রাখার ব্যবস্থা ছিলো। অন্য তিনটি হাউসে বাকি ক্লাসের ক্যাডেটদের মোটামোটি সমানভাবে ভাগ করে রাখা হতো। অমি যখন ছিলাম তখন এই প্রতিষ্ঠানে বাংগালি আর কোনো অফিসার বা কর্মচারি ছিলো না। ক্যাডেট ছিলো মাত্র চারজন। এর মধ্যে দু’জন আপন ভাই নিচের ক্লাসে পড়তো, যাদের বাবা ছিলেন সিলেটি, মা ইউরোপিয়ান। দু’জনের কেউ বাংলা এক শব্দও বলতে পারতো না। বাকি দু’জন পড়তো ক্লাস টুয়েলভে। ভালো বাংলা বলতে পারতো। ওদের বাবারা পাকিস্তান আর্মিতে অফিসার ছিলেন। সুযোগ পেলে কখনও কখনও লুকিয়ে ওদের সাথে বাংলায় দু’য়েক কথা বলতাম। যথাসময়ে ওরা দু’জন আর্মিতে কমিশন লাভ করেছিলো। বাংলাদেশে এসে অবসরে যাবার আগে একজন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল অন্যজন লেফটেন্যান্ট কর্নেল হতে পেরেছিলো। যাহোক, আমার দায়িত্ব ছিলো ক্লাসরুমে আমার নিজের সাবজেক্ট কেমিস্ট্রি এবং সাধারণ বিজ্ঞান পড়ানো। সেইসাথে শের শাহ হাউসের এসিস্ট্যান্ট হাউস টিউটরের দায়িত্ব পালন করা। এছাড়া ফটোগ্রাফি ক্লাব, মিউজিক ক্লাব এবং ফুটবল আর সাঁতারের ভারপ্রপ্ত অফিসার করা হলো আমাকে। হাইকিং ক্লাবের সাথেও আমাকে যুক্ত করা হলো। মজার কথা হলো, এসবের মধ্যে শুধু ফটোগ্রাফি ও সাঁতার সম্বন্ধে আমার কিছু ধারণা ছিলো। তারপরও মিউজিক আর ফুটবলের দায়িত্ব এড়ানো গেলো না। পাকিস্তানিদের বিশ্বাস ছিলো, তখনকার পূর্ব পাকিস্তানের সকল তরুন জন্মগতভাবে গান আর ফুটবলের বিশেষজ্ঞ হয়ে থাকে ! সকল দায়িত্ব পালনে দেহমন উজাড় করে দিয়ে লেগে গেলাম, যেমনটা সকল সেকেন্ড লেফটেন্যান্টরা করে থাকে।</p>
<p>প্রথমেই হোচট খেতে হলো ভাষা নিয়ে। ক্লাসরুমে পড়ানোসহ ক্যাডেটদের সাথে, এবং অফিসারদের সাথে সকল ফর্মাল কথাবার্তা ইংরেজিতে করতে হয়। অনানুষ্ঠানিক দু’য়েক কথা উর্দুতেও বলা যায়। বাংলা সম্পূর্ণ অচল। বাংলা বলাটা ছিলো গুনায়ে কবিরা। ভুলে দু’য়েক কথা মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেলে আসেপাশের সবাই ‘কেয়া বোলা, কেয়া বোলা তুমনে’ বলে হৈহৈ করে উঠতো। আমার ইংরেজি উচ্চারণ পদ্মাপাড়ের উচ্চাড়ণ। বিশেষ করে ইংরেজি অক্ষর ‘জে’ (এবং জিওমেট্রির ‘জি’) এবং ‘জেড’ এর উচ্চারণ নিয়ে মহাবিপদে পড়েছিলাম। বাংলা ভাষায় তফাৎ না থকলেও উর্দু ভাষায় এ দু’টোর উচ্চারণগত পার্থক্যের কারণে অর্থের পার্থক্য ইংরেজির মতোই প্রবল। পাকিস্তানি এক সহকর্মী যিনি ইংরেজি ভাষার শিক্ষক ছিলেন বুদ্ধি ও অভয় দিয়ে বললেন, ছোট একটি রেডিও কিনে নাও। বেশি করে রেডিওতে বিবিসি শোন। টেইপ রেকর্ডার কিনে নিজের কথা বারবার বাজিয়ে শোন। উচ্চারণে কোথায় ভুল হচ্ছে লক্ষ্য করো। তাহলেই দেখবে ইংরেজি বলাটা রপ্ত হয়ে যাবে। তাছাড়া, তোমার লেখা পড়ে মনে হয়, ইংরেজি ভাষাটা তো তুমি ভালোই জানো। সমস্যা হবে না। কথা ঠিক। অল্প দিনের মধ্যে ওস্তাদের কথামত সমস্যা বহুলাংশে কেটে গেলো।</p>
<p>মহা সমস্যা হলো উর্দু নিয়ে। সৈনিকদের সাথে, বেয়ারা-বাবুর্চির সাথে, বাজারে দোকানদারের সাথে, রাস্তায় টাংগাওয়ালার সাথে উর্দু অথবা পাঞ্জাবি ছাড়া উপায় নাই। পাঞ্জাবি শেখা বাদ দিয়ে উর্দু শেখার উদ্যোগ নিলাম। এর অন্য আরও একটা গুরুত্বপূর্ণ কারণ ছিলো। যেসব তরুণ রেগুলার কমিশন্ড অফিসারের মেট্রিক পর্যায়ে উর্দু ভাষা ছিলো না, তাদের জন্য চাকুরির প্রথম দু’বছরের মধ্যে আর্মি পরিচালিত সমমানের পরীক্ষায় পাশ করা জরুরি ছিলো। যতদিন পাশ না করতো ততদিন চাকুরি স্থায়ী করা হতো না। আর্মির পরীক্ষায় লিখিত এবং মৌখিক আলাদা আলাদা দুই পেপার ছিলো। টেনেটুনে লিখিত পেপারে পাশ করলেও ৯৫% পরীক্ষার্থী, তা সে বাংগালি, পাঞ্জাবি, পাঠান যে জাতিরই হোক না কেনো, মৌখিক পেপারে ফেল করতো ! বলা হতো, পরীক্ষা নেয়ার ফী হিসেবে অনেক বেশি টাকা আয় করার জন্য পরীক্ষকরা এমনটা করতেন। যাহোক, আমি সর্বশক্তি দিয়ে উর্দু বলা, পড়া ও লেখা শেখার চেষ্টা শুরু করে দিলাম। কারণ, মেট্রিকে আমার উর্দু পড়া হয়নি, তার বদলে পড়েছিলাম আরবি। এতে একটা সুবিধা হয়েছিলো। উর্দুর অক্ষরগুলো নতুন করে চিনতে হয়নি। তবে বাধার হিমালয় ছিলো অন্যখানে। বাজারি উর্দু বলা খুবই সহজ। ইংরেজি, হিন্দি মিলিয়ে গ্রামারের পরোয়া না করে জগাখিচুরি কিছু একটা বলে ফেললেই হলো। কেউ মাইন্ড করে না। কিন্তু কেতাবি উর্দু বলা যে কতো কঠিন, তা একমাত্র ভুক্তভোগী জানে। একদিকে বড় কাফ-ছোট কাফ, আইন-গাইন, জ্বীম-জাল-জে-জোয়া, বড় হে-ছোট হে, তে-তোয়া ইত্যাদি বর্ণসমূহের মধ্যে উচ্চারণগত সূক্ষ পার্থক্য আয়ত্ব করার চাইতে পাথর চিবিয়ে খাওয়া সহজ। তার পরেও কথা আছে। উচ্চারণ হয়তবা ঠিক হলো, ব্যাকরণ ? সেটা তো প্রায় কুকুরের লেজ সোজা করার মতো কঠিন। মনে আছে, একবার ক্যাডেটদের নিয়ে বাইরে কোথাও গিয়েছিলাম। ফেরত আসার সময় বাস এলো। আমি ছেলেদের লক্ষ্য করে যেইনা বলেছি, চলো, বাস আগিয়া, অমনি সবাই এতো জোরে অট্টহাসি করে উঠলো যে আমি মহাআহাম্মক বনে গেলাম। আমার আপরাধ, বলা উচিত ছিলো, বাস আগেয়ি। যার কারণ আমি আজও বুঝি না। বাস তো প্রাণী নয় যে এর জেন্ডার খুঁজতে হবে ! কর্তার টেন্স, জেন্ডার, নাম্বার ভেদে বাক্যের ভিতর ক্রিয়াপদের যে রূপান্তর হয়, যাকে ইংরেজিতে কনজুগেশন বলে, তার হদিস রাখা, মানুষ তো দূরের কথা, দেবতার পক্ষেও হয়তো সম্ভব নয় ! এর পর রয়েছে ভোক্যাব্যুলারি অর্থাৎ নতুন নতুন শব্দ শেখার সমস্যা। ঝেলাম বাজারে মাগুর মাছ দেখে খাবার শখ জাগলো। মেসে এসে বাবুর্চিকে বললাম মাগুর মাছ এনে রান্না করতে। বুড়ো পাঞ্জাবি বাবুর্চি লাল খান চোখ কপালে তুলে বললো, সাব, হাম মাগর মাছ নেই খাতে। উয়োহ তো হারাম হায়। বাংগাল মে তোমলোগ খাতেহো ? পরদিন সকালে অফিসে গিয়ে এক পাঞ্জাবি কলিগের কাছ থেকে বুড়োর অবাক হবার কারণ বুঝলাম। উর্দুতে মাগর মাছ মানে কুমির ! সে সময় ঢাকা শিক্ষা বোর্ড মহাত্রাতা হিসেবে আবির্ভূত হয়। তারা বাংগালি আর্মি অফিসারদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা হিসেবে শুধুমাত্র উর্দু ভাষার মেট্রিক পরীক্ষা নেবার ব্যবস্থা রেখেছিলো। কেবলমাত্র লিখিত পরীক্ষা যাতে বেশিরভাগ প্রশ্নের উত্তর বাংলায় লিখে সহজে পাশ করা যেতো। অবশেষে আমি আরও অনেক বংগসন্তানের মতো ঢাকায় এসে সেই পরীক্ষা দিয়ে পাশ করে নিজের মান রক্ষা করি।</p>
-------------</br>
মিলিটারি কলেজ ঝেলাম: পর্ব ২</br>
লেফটেন্যান্ট ফিশ!</br>
<p>আগেই বলেছি, মিলিটারি কলেজে জয়েন করার পরপরই আমাকে ক্লাসরুমে নিজের সাবজেক্ট পড়ানো ছাড়া ফটোগ্রাফি, মিউজিক, ফুটবল ও সুইমিং ক্লাবের অফিসার-ইন-চার্জ (ও আই সি) নিয়োগ দেওয়া হয়। ছাত্রজীবনে ছবি তোলার শখ ছিলো। তখন ছিলো সাদাকালো ছবির জমানা। ফিল্ম ডেভেলপ ও প্রিন্ট করা সম্বন্ধে কিছু ধারণা ছিলো। কলেজ লাইব্রেরিতে ফটোগ্রাফির উপর ভালোভালো বই ছিলো। সেসব পড়ে মোটামুটি কাজ চালিয়ে নিলাম। সাঁতার ভালোই জানতাম। সেকথায় পরে আসছি। মিউজিক ক্লাবে বেশিরভাগ ছেলে ছিলো কলেজ ব্যান্ডের সদস্য। যার জন্য আর্মি থেকে আসা ব্যান্ড ইন্সট্রাক্টর ছিলো। এছাড়া বাহির থেকে একজন সিভিলিয়ান গানের মাস্টার সপ্তাহে একদিন এসে ছেলেদের সা-রে-গা-মা শেখাতেন। এই বৃদ্ধ ভদ্রলোককে আমি কখনও হারমনিয়াম আর ঢোল ছাড়া অন্য কিছু বাজাতে দেখিনি। আর্মি স্কুল অব ফিজিক্যাল ট্রেইনিং এন্ড স্পোর্টস থেকে পাশ করে আসা হাবিলদাররা ফুটবলসহ অন্যান্য গেইম ও সাঁতার শেখাতো। আমার কাজ ছিলো এসবের সমন্বয় ও তত্বাবধান করা।</p>
<p>এবার আসি সাঁতারের কথায়। আমার বয়স যখন সাত কি আট বছর তখন মামা বাড়ি গেলে আমার ছোটো মামা আমাকে একটি বিশেষ সাঁতারের কৌশল শেখান, যা মামা নিজেও খুব ভালো জানতেন। দুই হাত পিঠের পেছনে নিয়ে কব্জি বরাবর একটি ছোটো রশি বা গামছা দিয়ে একসাথে বেঁধে দিতেন। তারপর দুই পা’র গোড়ালি বরাবর একসাথে গামছা দিয়ে বেঁধে আমাকে দু’তিনজন মিলে ঘাড়ে করে নিয়ে পুকুরে ছেড়ে দিতেন। আমি বহাল তবিয়তে ধীরেধীরে সাঁতার দিয়ে দূরত্ব অতিক্রম করতাম। কখনও চিৎসাঁতার, কখনও বুকসাঁতার দিতাম। হাত-পা বাধা অবস্থায় মাঝেমাঝে চিৎ হয়ে বুকের উপর চারখানা থান ইট নিয়ে সাঁতার দিয়ে বন্ধুদের চমৎকৃত করে দিতাম। ইউনিভার্সিটিতে পড়াকালীন সময় পর্যন্ত এই বিশেষ সাঁতাররে চর্চাটা অব্যাহত রেখেছিলাম।</p>
<p>মিলিটারি কলেজে আমার সহকর্মী বেশ ক’জন অবাংগালি অফিসার ছিলেন যাঁরা সাঁতার জানতেন না, পানিকে যমের মতো ভয় করতেন। একদিন কথাচ্ছলে তাঁদেরকে সাহস যোগাবার জন্য বললাম, সাঁতরানো কোনো কঠিন কাজ নয়। আমাকে হাত-পা বেঁধে পানিতে ছেড়ে দিলেও সাঁতরাতে পারি। কথাটা ওরা মোটেও বিশ্বাস করলেন না। বললেন, জানি তোমরা ইস্ট পাকিস্তানিরা পানির দেশের মানুষ। সবাইকে সাঁতার জানতে হয়। তাই বলে অতটা বাহাদুরি করো না। কথাটা আমি পরে ভুলে গেলেও ওরা ভুলেননি। এর ক’দিন পর কিছু ক্যাডেট নিয়ে আমরা মংলা ড্যামে বেড়াতে গেলাম। আমাকে অবাক করে দিয়ে সেই সহকর্মীরা দু’টুকরা রশি বের করে বললো, এবার তোমার কথা রাখো। আমরা তোমার দু’হাত পেছনে বেঁধে দেবো, সেই সাথে দু’পা গোড়ালিতে একসাথে বেঁধে দিয়ে লেকের পানিতে ছেড়ে দেবো। ভয় পেয়ো না, আটজন দক্ষ সাঁতারু হাবিলদার এবং ক্যাডেট তোমাকে ঘিরে রাখবে, তুমি যাতে ডুবে না মরো। তোমাকে মেরে আমরা কোর্টমার্শালে যেতে চাই না। বাংগালি পৌরুষের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছোড়া হয়েছে ! বললাম, কবুল ! তা-ই করো। ভয় নেই, আমি ইনশাল্লাহ মরবো না। তোমরা বিপদে পড়বে না। কথামতো প্রায় চল্লিশ মিনিট সাঁতরালাম, তার মধ্যে কিছুক্ষণ বুকের উপর চারখানা থান ইট নিয়ে। যখন আমাকে পানি থেকে টেনে তোলা হলো, তখন সে কী আনন্দ আর চিৎকার। রাতারাতি হিরো হয়ে গেলাম। বিশেষ করে ক্যাডেটদের কাছে।</p>
<p>ঝেলাম এবং নিকটস্থ খাড়িয়া ক্যান্টনমেন্টে খবরটা বাতাসের বেগে ছড়িয়ে গেলো। এরিয়া কমান্ডার শুনতে পেয়ে ভাবলেন, তাঁর এরিয়াতে বহু অবাংগালি অফিসার আছেন যাঁরা সাঁতার জানেন না। পানিকে যমের মতো ভয় পান। কিছুদিন আগে এক্সারসাইজের সময় প্রায় হাটু পানিতে ডুবে একজন ইনফ্যান্ট্রির ক্যাপ্টেইন মারা যান। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, অসাতারুদের ভয় ভাংগানোর জন্য, পরবর্তী রবিবার (সাপ্তাহিক ছুটির দিন) বিকেলে মিলিটারি কলেজের সুইমিং পুলে লে: আশরাফের সুইমিং প্রদর্শণীর ব্যবস্থা কর হোক। সকল অফিসার সস্ত্রীক আমন্ত্রিত। বাচ্চারা বিশেষভাবে আমন্ত্রিত। নির্ধারিত দিনে সুইমিং পুলে মহাআয়োজন। চর্তুদিকে সামিয়ানা টাংগানো হয়েছে। সকল বয়সের অফিসার, তাঁদের স্ত্রী-পুত্র-কন্যাগণ, কলেজের ক্যাডেটগণ, স্টাফ, সব মিলিয়ে অনেক লোকের সমাগম। কলেজের ব্যান্ড বাদ্য বাজাচ্ছে। কাবাব, স্যান্ডউইচ, সামুসাসহ নানা ধরনের মুখরোচক স্ন্যাকস। সাথে চা, কফি, সোডা। সেই সাথে চলছে মাইকের ঘোষণা। নির্ধারিত সময়ে চারজন তাগড়া হাবিলদার, যেমন করে লাশ কাঁধে করে বহন করে তেমন করে, আমাকে কাঁধে বয়ে নিয়ে আসলো। আমার পরনে শুধু একটি জাংগিয়া, যাকে ভদ্র ভাষায় বলে সুইমিং কস্টিউম। মনে হচ্ছিলো আমি যেনো সার্কাসের কোনো জন্তু ! আমাকে দেখামাত্র উপস্থিত সবাই, বিশেষ করে মহিলা ও বাচ্চারা উত্তেজনায়, আনন্দে এবং আতংকে চিৎকার হাততালি দিতেদিতে দাঁড়িয়ে গেলো। আমি নিজেও হাবিলদারদের কাঁধে শুয়ে কেমন যেনো শিহরণ অনুভব করছিলাম। হাবিলদাররা ধীরেধীরে স্লো মার্চ করে পুলরে পারে এসে আমাকে ঝুপ করে পানিতে ফেলে দিলো। অন্য সময় সাথেসাথে পানি থেকে মাথা বের করে নি:শ্বাস নেই, সাঁতার করি। এবার একটু সাসপেন্স করার জন্য বেশ কিছুক্ষণ পানির নিচে মাথা ডুবিয়ে রাখলাম। পরে শুনেছি, যতক্ষণ আমি ডুব মেরে ছিলাম ততক্ষণ উপস্থিত দশর্করা সবাই ভয়ে, আতংকে নির্বাক হয়েছলো। তারপর যখন মাথা বের করলাম তখন কী গগনবিদারী চিৎকার। সাবাস, আশরাফ। সাবাস, বাংগালি। কেউ একজন বলে উঠলেন, ইয়ে তো ইনসান নেহি হায়, মছলি হায়। ব্যাস, সেদিন থেকে আমার নিকনেইম হয়ে গেলো লেফটেন্যান্ট ফিশ ! ওভারনাইট হিরো হয়ে গেলাম। শনিবার সন্ধ্যায় অফিসার্স ক্লাবে গেলে শুনতে পেতাম আমাকে দেখিয়ে লোকজন বলাবলি করছে, দেয়ার গো’জ লে: ফিশ।</p>
---------------
মিলিটারি কলেজ ঝেলাম: পর্ব ৩</br>
শাসন করা তারই সাজে ---</br>
<p>“ফায়ার ! ফায়ার ! আগ লাগি হ্যায় ! সব বাহার আ-যাও!” পড়াশুনা করে, রেকর্ডপ্লেয়ারে গান শুনে সবে ঘুমিয়েছি। রাত্রি দু’টা-তিনটা হবে। চারদিক থেকে আসা হঠাৎ এমন তীব্র চিৎকারে ঘুম ভেংগে গেলো। অফিসার মেসে নিজের রুমে একা ছিলাম। ( কখনও একরুমে দু’জন সিংগল ফিসারকেও থাকতে হতো।) ধরফরিয়ে উঠে কাপড় পাল্টে দরজা খুলে বাইরে এলাম। পূব-পশ্চিমে টানা কলেজের মেইন রোড ধরে অনেক লোক, যার মধ্যে কোনো ক্যাডেট ছিলো না, পশ্চিম দিকে ছুটছে। সবার মুখে এক চিৎকার, আগ লাগি হ্যায়। পশ্চিম দিকে তাকিয়ে দেখলাম আকাশে আগুনের সুউচ্চ লেলিহান শিখা। ওদিকে ক্যাডেটদের আবাস হিসেবে বাবর হাউস এবং গজনবি হাউস নামে দু’টি হাউস রয়েছে। বলা তো যায় না ! স্লিপার পায়েই ছুটলাম পশ্চিম দিকে। পথে কলেজের কম্যানড্যান্ট কর্নেল মর্তুজাকে (লে: কর্নেল মর্তুজা হোসেন, এ ই সি) খুড়িয়েখুড়িয়ে একই দিকে যাচ্ছেন। পড়নে স্লিপিং স্যুট (বৃটিশ এটিকেট অনুযায়ী স্লিপিং স্যুট পড়ে বেডরুমের বাউরে আসা মহা গুনাহের কাজ !)। দেখামাত্র আমি ফৌজি তরিকায় ‘উইশ’ করলাম, অর্থাৎ “স্লামালেকুম, স্যার” বলে চিৎকার করে উঠলাম। তিনি আতংকিত কন্ঠে বললেন, “ভাই, কওন হো তোম ? ম্যায় জলদি মে আয়নাক (চশমা) ভুল গেয়া। তোম মুঝে যারা সাথ লে চলো।” ইতোমধ্যে কেউ একজন দৌড়ে এসে যা বললো তার সারাংশ হলো: কলেজের পশ্চিম প্রান্তে সীমানা প্রাচীর ঘেঁসে যে গো-খামার রয়েছে সেখানকার খরের গাদায় কে বা কারা আগুন লাগিয়েছে। কম্যানড্যান্টকে নিয়ে আস্তে আস্তে সেখানে গিয়ে দেখলাম আগুন ততক্ষণে নিভে গেছে। কিছু লোক ভীড় করে আছে। গেইটের বাইরে ফায়ার ব্রিগেডের গাড়ি এসে গেছে। অন্য সময় লাইটস আউটের পর সব হাউসে দু’য়েকজন ক্যাডেটকে টয়লেটে যাওয়াআসা করতে দেখা গেলেও সেদিন রাতে একজন ক্যাডেটকেও রুমের বাইরে দেখা গেলো না। হাউসগুলো মনে হচ্ছিলো জনমানবহীন ভূতের বাড়ির মতো।</p>
<p>ক্যাডেট কলেজের মতো মিলিটারি কলেজেও সপ্তাহে একদিন ক্লাস শুরুর আগে এসেম্বলি বা সমাবেশ হতো। তাতে সকল ক্যাডেট ও শিক্ষককে উপস্থিত থাকতে হতো। অগ্নিকান্ডের পরের দিন নরমাল এসেম্বলি ছিলো না, বিশেষ এসেম্বলি ডাকা হলো। সবার মুখ গম্ভীর। চতুর্দিকে থমথমে ভাব। কী জানি, কম্যানড্যান্ট তাঁর বক্তৃতায় অপরাধীদের জন্য কী কঠোর শাস্তি ঘোষণা করেন। যথারীতি কুর’আন থেকে আবৃত্তির পর কম্যানড্যান্ট মঞ্চে উঠলেন। ধীর-স্থিরভাবে চারদিকে একবার চোখ ফিরিয়ে নিলেন। চেহারা বা কন্ঠে রাগ বা উত্তেজনার লেশমাত্র নেই। তারপর বললেন: My dear boys, I understand last night some of you wanted to cut a joke with me. I do appreciate your sense of humor. It is only the intelligent people who can cut good jokes. But, my boys, I have a request to make. Before you cut a joke you should also consider the age of the person concerned. For an old man like me a joke like the one you had last night might be too dangerous to bear with. Next time when you cut such a joke, please keep my age in mind. Thank you. College Captain, carry on, please.এসেম্বলি শেষ। ক্যাডেটরা ক্লাসে চলে গেলো। আমরা ইয়ং আফিসাররা খুব হতাশ হলাম। ক্যাডেট কলেজে সাধারণত ক্লাস ইলেভেনের ছেলেরা, যারা প্রায়শ ইয়ং ইন্সট্রাক্টরদের কর্তৃত্ত মানতে চায় না, বড় ধরনের কান্ড ঘটিয়ে থাকে। এরা কোনো কারণে বড় শাস্তি পেলে ইয়ং ইন্সট্রাক্টররা মনেমনে পুলকিত হয়। যাহোক, আমরাও হতাশ হয়ে যারযার কাজে ফিরে গেলাম। </p>
<p>কম্যানড্যান্ট কর্নেল মর্তুজা ব্যক্তি জীবনে চিরকুমার ছিলেন। প্রথম যৌবনে প্রেমে ব্যর্থ হবার পরিণতি। ছেলেমেয়ে একদম পসন্দ করতেন না বলে রটনা ছিলো। যা সঠিক ছিলো না। যাহোক, সপ্তাহখানেক পরের কথা। ক্লাস ইলেভেনের চারপাঁচজন ক্যাডেট নিয়মানুযায়ী এডজুট্যান্টের অফিসে গিয়ে কম্যানড্যান্টের সাক্ষাৎকার চাইলো। এডজুট্যান্ট কারণ জানতে চাইলেন। ছেলেরা বললো, আপনাকে কারণ বলা যাবে না। যা বলার সরাসরি কম্যানড্যান্টকে বলবো। কম্যানড্যান্ট ছেলেদেরকে তাঁর অফিসে আসার অনুমতি দিলেন। সাথে এডজুট্যান্টকে থাকতে বললেন। বলা তো যায় না, পরিস্থিতি কোন দিকে গড়ায়। ছেলেগুলো কম্যানড্যান্টের অফিসের দরজায় গিয়ে ‘উইশ’ করে হুড়মুড় করে, কেউ চেয়ারের তল দিয়ে, কেউ টেবিলের তল দিয়ে কম্যানড্যান্টের পায়ের উপর হুমরি খেয়ে পড়লো। সবাই উচ্চস্বরে কাঁদতেকাঁদতে বললো: স্যার, উই ডিড ইট। উই পুট দি হে স্ট্যাক অন ফায়ার। প্লিজ ফরগিভ আস। উই আর রিয়ালি ভেরি সরি ফর দি ট্রাবল উই গেইভ ইউ। উই শ্যাল নেভার ডু ইট এগেইন। প্লিজ ফরগিভ আস দিস টাইম। কম্যানড্যান্ট চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে সবাইকে বুকে জড়িয়ে ধরে নিজেও কাঁদতে লাগলেন। হাপুস নয়নে সবার সে কি কান্না ! কিছুক্ষণ কান্নাকাটির পর কম্যানড্যান্ট কিছুটা স্থির হয়ে বললেন: বয়েজ, ইউ আর মাই চিল্ড্রেন। আই ফরগেইভ ইউ দি ডে আই এড্রেসড ইউ। আই এম হ্যাপি টু সি দ্যাট ইউ আর রিপেন্ট্যান্ট। দ্যাট’স লাইক গুড বয়েজ। আই এম প্রাউড অব ইউ। কাম অন মাই সান্স, নাউ স্মাইল ! ছেলেরা তাঁর পা ছুঁয়ে সালাম করে চোখে পানি, ঠোটে হাসি নিয়ে বেরিয়ে আসলো। তারপর কর্নেল মর্তুজা যতদিন ছিলেন ততদিন মিলিটারি কলেজে ছেলেরা তেমন কোনো বড় ঘটনা ঘটিয়েছে বলে শোনা যায়নি।</p>
</br>
সেদিনের সে ঘটনা আমার জীবনে গভীর রেখাপাত করেছিলো। সারা জীবনের জন্য আমাকে যেনো চোখে আংগুল দিয়ে শেখালো: “শাসন করা তারই সাজে সোহাগ করে যে গো।”
-------------</br>
মিলিটারি কলেজ ঝেলাম: পর্ব ৪ </br>
আমার গুরু কর্নেল মর্তুজা </br>
<p>আগেই বলেছি, মিলিটারি কলেজে জয়েন করার সাথেসাথে আমাকে প্রশাসনিক কাজের জন্য শের শাহ হাউসে এসিট্যান্ট হাউস টিউটর নিয়োগ করা হলো। শের শাহ হাউসের হাউস মাস্টার ছিলেন মি: ফজলুল হক হায়দ্রি। সিনিয়র সিভিলিয়ান ইন্সট্রাক্টরদের মধ্যে অন্যতম একজন। বাচ্চ্দের জন্য চমৎকার একজন ইংরেজির শিক্ষক ছিলেন। সমবয়সী হবার কারণে কম্যানড্যান্ট কর্নেল মর্তুজার ব্যক্তিগত বন্ধু ছিলেন। প্রশাসনিক অনেক সিদ্ধান্ত নিতে কম্যানড্যান্টের উপর প্রভাব বিস্তার করতেন। পরে বুঝতে পেরেছিলাম হায়দ্রী সাহেবের একান্ত আগ্রহে আমাকে ওনার অধীনে শের শাহ হাউসে এসিট্যান্ট হাউস টিউটর নিয়োগ করা হয়েছিলো। এর আগে আর কোনো আর্মি অফিসারকে ওনার আন্ডারে নিয়োগ করা সম্ভব হয়নি। কারণ, হায়দ্রী সাহেবের অফিসিয়াল স্ট্যাটাস ছিলো ক্লাস টু গেজেটেড অফিসার। একজন আর্মি অফিসারকে ক্লাস ওয়ান গেজেটেড অফিসার হবার কারণে হায়দ্রী সাহেবের অধীনে নিয়োগ করা সম্পূর্ণ বেআইনি। হায়দ্রী সাহেব আমার জুনিয়রিটির সুযোগ নিয়েছেন। অল্প দিনের মধ্যে বিষয়টি বুঝতে পারলাম। একজন বন্ধু ভাবাপন্ন সিনিয়র পাঞ্জাবি কলিগের সাথে বিষয়টি নিয়ে কথা বললাম। তিনি বললেন, কাজটি অবশ্যই বেআইনি হয়েছে। তোমার প্রতি অবিচার করা হয়েছে। আমি তাঁকে প্রশ্ন করলাম, কেনো তাঁরা কম্যানড্যান্টকে একাজ থেকে বিরত থাকতে বললেন না। জবাবে তিনি যা বললেন তা আমার সারা জীবনের জন্য শিক্ষা হয়ে আছে। তনি বলেছিলেন, প্রথমত: কাজটি করার আগে কম্যানড্যান্ট কোনো আর্মি অফিসারের পরামর্শ চাননি। দ্বিতীয়ত: আর্মিতে আগ বাড়িয়ে কেউ কারও জন্য কথা বলে না। যার কথা তাকেই বলতে হয়। আমরা ভাবলাম, তুমি যদি ব্যাপারটা মেনে নেও তাহলে আমরা বলার কে ? আর, তুমি যদি না মানো তাহলে প্রচলিত আইনই তোমাকে বলে দিবে তোমার কী করতে হবে।</p>
<p>ক’দিন ভেবেচিন্তে অবশেষে একদিন হায়দ্রী সাহেবকে বিনয়ের সাথে বললাম যে, আমার পক্ষে আর তাঁর হাউসে কাজ করা সম্ভব নয়। তিনি যেনো বিকল্প ব্যবস্থা করেন। বিষয়টি ব্যাখ্যা করে আরও বললাম, বয়স্ক লোক হিসেবে আপনাকে আমি সব সময় সম্মান করি। এটি একটি নীতির প্রশ্ন। দয়া করে ব্যক্তিগতভাবে নিবেন না। হায়দ্রী সাহেব কোনো জবাব না দিয়ে আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন।</p>
<p>পরদিন টী-ব্রেকের সময় স্টাফ রুমে সকল আর্মি এবং সিভিলিয়ান অফিসারের সামনে হায়দ্রী সাহেব আমাকে উদ্দেশ্য করে চিৎকার করে বলে উঠলেন, লে: আশরাফ, গতকাল থেকে কেনো আপনি হাউসে ডিউটি থেকে অনুপস্থিত থাকছেন ? এটা খুব অন্যায় কাজ। আপনার বুঝা উচিৎ। আমি বুঝলাম, হায়দ্রী সাহেব এতো লোকের সামনে আমাকে উল্টাপাল্টা কিছু বলার জন্য প্ররোচিত করছেন। রাগের মাথায় মুখ ফসকে অন্যায় কিছু যদি বলে ফেলি তাহলে আমার কোর্ট মার্শাল করতে সাক্ষীর অভাব হবে না। আমি ধীরস্থিরভাবে জবাব দিলাম, আমার যা বলার তা গতকাল আপনাকে বলেছি। আমার আর কিছু বলার নেই। তুমি কম্যানড্যান্টের আদেশ অমান্য করছো, হায়দ্রী সাহেব এবার গর্জে উলেন। আমি বললাম, বিষয়টি তা’হলে আপনি কম্যানড্যান্টকে বলুন। তিনি যা করার করবেন।</p>
<p>এর পরদিন, যা ভেবেছিলাম, কম্যানড্যান্ট আমাকে তাঁর অফিসে ডেকে পাঠালেন। অফিসে ঢুকে স্যাল্যুট করতে না করতেই শুরু হলো বজ্রের গর্জন। ইংরেজি, উর্দু মিলিয়ে আর্মিতে যত গালি ও মন্দ কথা আছে তা প্রবল বেগে আমার উপর বর্ষিত হতে লাগলো। যার বেশিরভাগ ছাপার অযোগ্য। ‘শান’ পজিশনে দাঁড়িয়ে থেকে তাতে অবগাহন করা ছাড়া আমার তখন কিছু করার ছিলো না। তিনি বললেন: তুমি লে: আশরাফ ‘টিট অব এ সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট’ হয়ে আমার আদেশ অমান্য করার ‘অডাসিটি’ কোথায় পেলে ? প্রথম সুযোগেই বিড়াল মারার জন্য আমি খুব আস্তে করে বললাম: স্যার, আপনার আদেশটি এমপিএমএল (ম্যানুয়াল অব পাকিস্তান মিলিটারি ল’) অনুযায়ী বৈধ ছিলো না। তাই মানা সম্ভব নয়। একজন ক্লাস ওয়ান অফিসার হয়ে আমার পক্ষে একজন ক্লাস টু অফিসারের অধীনে কাজ করা সম্ভব নয়। কাজ হলো না। বিড়াল তো মরলোই না, বরং তিনি আরও রেগে গিয়ে বললেন: হতে পারে মি: হায়দ্রী একজন ক্লাস টু অফিসার। কিন্তু আমি আমার ওথরিটি তাঁকে ডেলিগেইট করেছি। তুমি তার হুকুম মানতে বাধ্য। আমি কোনো প্রকার আবেগ না দেখিয়ে বললাম: আপনি আপনার ওথরিটি একজন হাবিলদারের কাছে ডেলিগেইট করতে পারেন। তাইবলে একজন হাবিলদারের কম্যান্ড আমি মানতে পারি না। পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমি আমাকে এমন শিক্ষা দেয়নি। বরং আমাকে বলেছে, কমিশনের প্রতীক হিসেবে তোমার কাঁধে যে ‘পিপ’ দেওয়া হয়েছে, সেটা দেশের মহামান্য প্রসিডেন্ট দিয়েছেন। এটা দেশ ও জাতির গৌরব ও সার্বভৌমত্বের প্রতীক। প্রাণ দিয়ে হলেও এর সম্মান রক্ষা করা তোমার পবিত্র কর্তব্য। এ পর্যন্ত শুনে কম্যানড্যান্ট আরও ক্ষেপে গেলেন। যেনো আগুনে ঘি পড়লো। চিৎকার করে বললেন: ইউ ডাকা ইউনিভার্সিটি চ্যাপস, ইউ ওনলি নো হাউ টু আরগু। বছরের পর বছর তোমার মতো রটেন মাল বের করে ঢাকা ইউনিভার্সিটি দেশের সর্বনাশ করছে। তোমরা শুধু শিখেছো কিভাবে গন্ডগোল পাকাতে হয়। আমি বিনয়ের সাথে বললাম: প্লিজ ক্রিটিসাইজ মি ইফ আই এম রং। বাট, স্যার, প্লিজ ডু নট ক্রিটিসাইজ মাই ইউনিভার্সিটি। ইট ইজ বিক’জ অব ডাকা ইউনিভার্সিটি হোয়াট আই এম টু’ডে। ইট টট মি হাউ টু কীপ মাই হেড হাই এগেইনস্ট অল অডস। ইট ওয়াজ বিক’জ অব ডাকা ইউনিভার্সিটি আই ওয়াজ ফাউন্ড ফিট ফর কমিশন বাই দি আইএসএসবি। আমার প্রাণপ্রিয় ইউনিভার্সিটির সমালোচনা সহ্য করতে না পেরে বেশ কিছুটা ইমোশনাল হয়ে পড়েছিলাম। সব শেষে তিনি গর্জে উঠলেন: ইউ ব্লাডি চ্যাপ, ইউ ডোন্ট নো হোয়াট ইজ অর্মি। আই উইল কিক ইউ আউট অব দি আর্মি। আর্মি ডাজ নট নীড এন ইনডিসিপ্লিড রো’গ লাইক ইউ। নাউ গেট আউট। স্মার্ট একটা স্যাল্যুট দিয়ে বেরিয়ে এলাম।</p>
<p>সেদিন সারাদিন কোনো কাজে মন বসলো না। অবশেষে একাএকাই সিদ্ধান্ত নিলাম, আর্মিতে আর চাকুরি করবো না। মান-ইজ্জত বিসর্জন দিয়ে চাকুরি করার কোনো মানে হয় না। যা হয় হবে, চাকুরি থেকে ইস্তফা দেবো। তখনকার দিনে কম্প্যুটার ছিলো না। ব্যক্তিগত টাইপরাইটারও ছিলো না। সারারাত জেগে আর্মি চীফকে এড্রেস করে, যথাযোগ্য কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে পাঠানোর জন্য, নিজ হাতে রেজিগনেশন লেটার লিখলাম। দরখাস্তে পুরো ঘটনা সংক্ষেপে বর্ণনা করলাম। সবশেষে লিখলাম: আমি ঠিক বুঝতে পারছি না কোনটা আর্মির আসল শিক্ষা। একজন আর্মি অফিসারের মর্যাদা সম্পর্কে পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমি যা আমাকে শিখিয়েছে, নাকি আমার বর্তমান কম্যানড্যান্ট যা শেখাতে চাচ্ছেন। যদি কম্যানড্যান্ট যা শেখাতে চাচ্ছেন তা-ই কারেক্ট হয়, তবে আমি এই আর্মিতে আর চাকুরি করতে চাই না। আমার এই চিঠিকেই পদত্যাগপত্র বলে বিবেচনা করতে সবিনয় অনুরোধ জানাচ্ছি। </p>
<p>আর্মি বিধি অনুযায়ী এধরনের চিঠিকে ‘রিড্রেস অব গ্রীভেন্স’ (দুর্দশার প্রতিকার) চেয়ে চিঠি বলা হয়। কম্যান্ড চ্যানেলের প্রতিজন কম্যান্ডারের হাত হয়ে সর্বশেষে চিঠিটিকে অবশ্যই আর্মি চীফের হাতে পৌছাতে হবে। প্রত্যেক কম্যান্ডারের জন্য নির্ধারিত সময়সীমা বেধে দেওয়া আছে। যদি কোনো কম্যান্ডার নির্ধারিত সময়ের চাইতে বেশি সময় ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় দরখাস্তটি ফেলে রাখেন, তবে আবেদনকারী সরাসরি পরবর্তী সিনিয়র কম্যান্ডারের কাছে তার চিঠি পাঠাতে পারবেন। তবে হ্যাঁ, যদি মাঝ পথে কোনো কম্যান্ডার প্রার্থিত প্রতিকার করে দিতে পারেন, এবং আবেদনকারী অফিসার যদি তাতে সন্তুষ্ট হন, চিঠিটি পরবর্তী সিনিয়র কম্যান্ডারের কাছে আর পাঠনো হয় না। বিষয়টি ওখানেই শেষ হযে যায়।
মিলিটারি কলেজ ঝেলামে আমার কম্যান্ড চ্যানেলে প্রথম অফিসার ছিলনে চীফ ইন্সট্রাক্টর মেজর বি এ (বশীর আহমদ) মালিক, এইসি। পরদিন সকাল বেলা তাঁর অফিসে গিয়ে আমার চিঠিটি তাঁর হাতে দিলাম। মুখ দেখে মনে হলো তিনি এমন কিছু আন্দাজ করেছিলেন। আমার জন্য কফির অর্ডার দিয়ে তিনি চিঠিটি মনেমনে পড়তে লাগলেন। পড়া শেষ করে ছোট্ট করে মন্তব্য করলেন, ওয়েল ড্রাফটেড। রেখে যাও। দেখি কী করতে পারি। </p>
<p>দু’তিন দিন পরের কথা। ঊর্দ্ধতন কম্যান্ডারের কাছে আমার দরখাস্তখানা পাঠাবার সময়সীমা তখনও পার হয়নি। একদিন সকাল দশটার দিকে ডাক এলো কম্যানড্যান্টের কাছ থেকে। যেতেযেতে ভাবলাম, যা হবার হবে। নীতির প্রশ্নে আপোষ করবো না। কম্যানড্যান্টের অফিসে পা দিয়ে স্যাল্যুট করতে না করতেই তিনি আন্তরিক কন্ঠে আহ্বান জানালেন, হাঁ ভাই আশরাফ, আ যাও। টেইক এ সীট। হাউ আর ইউ ? ঘরওয়ালে (বাড়ির সবাই) কেয়সে হ্যায় ? কেয়া পিউগে, চায় ইয়া কফি ? একজন সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট স্বঅভাবিক অবস্থায় তাঁর কমান্ডিং অফিসারের কাছ থেকে স্বপ্নেও এমন আচরণ আশা করতে পারে না। আমার বুঝতে বাকী রইলো না, দেয়ার হ্যাজ বীন এ চেইঞ্জ অব হার্ট ! বসতেবসতে বললাম, থ্যাংক ইউ স্যার। এজ ইউ প্লীজ। কম্যানড্যান্ট অর্ডার্লিকে চা আনতে বললেন। তারপর তিনি বললেন: আশরাফ, আই এম সরি। দি আদার ডে আই ওয়াজ হার্শ উইথ ইউ। ইট কুড বি এভয়ডেড। আই শুড হ্যাভ টেকেন ইওর পয়েন্ট। এনি ওয়ে, লেট’স ফরগেট এন্ড ফরগিভ। ফ্রম টু’ডে আই হ্যাভ পুট ইউ ইন টিপু হাউস। দি হাউস মাস্টার ইজ এ সিনিয়র আর্মি অফিসার। এ নাইস ম্যান। ইউ উইল নট হ্যাভ এনি প্রবলেম ইউথ হিম। আমার চা তখনও শেষ হয়নি। থ্যাংক ইউ, থ্যাংক ইউ ভেরি মাচ স্যার বলে দাঁড়িয়ে স্যাল্যুট করে অত্যন্ত খুশিমনে কম্যানড্যান্টের অফিস থেকে বেরিয়ে এলাম। আল্লাহকে শুকরিয়া জানালাম।</p>
<p>এরপর থেকে কর্নেল মর্তুজা যেনো আমার ব্যক্তিগত বন্ধু হয়ে গেলেন। আমাকে নিজের গাড়িতে বসিয়ে প্রায় উইকএন্ডে ক্লাবে নিয়ে যেতেন। ভালো ছবি হলে ঝেলাম বা রাওয়ালপিন্ডি শহরে সিনেমা দেখাতে নিয়ে যেতেন। গাড়ি চালাতেচালাতে কলেজের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করতেন। প্রায় দিন, রাত্রি বার’টার পর আমার রুমের দরজায় টোকা দিয়ে আমাকে বিছানা থেকে উঠিয়ে বলতেন, আশরাফ, চলো যারা চক্কর লাগাতে হে। বাকী সব লোগ (অন্য অফিসাররা) তো বিবি-বাচ্চা লে কে সোগিয়া হ্যায়। এক তরফ (জুনিয়রদের মধ্যে) তোম হো ব্যাচেলর, দু’সরি তরফ (সিনিয়রদের মধ্যে) ম্যায় হুঁ বাচেলর। ঘর মে কোই কাম নেহি হ্যায়। চলো চক্কর লাগাতে হে। আমাকে সাথে নিয়ে হাউসগুলোতে, কলেজ হাসপাতালে রাউন্ড দিতেন। দেখতেন, ছেলেরা ঠিকমত ঘুমাচ্ছে কিনা। কারও গা থেকে কম্বল পড়ে গেলে একজন মায়ের মতো তা ঠিক করে দিতেন, যেনো ঘুমন্ত ছেলেটি জেগে না উঠে। বাথরুমগুলো পরিষ্কার আছে কিনা, পানির কল সব কাজ করছে কিনা, ইত্যাদি। দু’জনের পায়ে থাকতো রাবার সোলের জুতা, যাতে বাচ্চাদের ঘুমের ব্যাঘাত না হয়। গো-খামারের গরুগলো কেমন আছে তা-ও তিনি দেখতে ভুলতেন না। বলতেন, এটি খুব গুরুত্বপূর্ণ কাজ। গরুগুলো ঠিক না থাকলে ছেলেদেরকে খাঁটি দুধ কেমন করে দেবো ? সারা দিন কাজকর্ম, খেলাধুলা করে আমি খুব ক্লান্ত থাকতাম। রাত জেগে কম্যানড্যান্টের সাথে এভাবে ঘুরতে আমার কষ্ট হতো। ছেলেদের প্রতি কতটা মায়া থাকলে একজন প্রিন্সিপাল এতটা নিবেদিতপ্রাণ হতে পারেন, সত্য বলতে কি, তখন বুঝতে পারিনি। হয়তো বয়স কম হবার কারণে। পরবর্তীকালে যখন আমি নিজে ক্যাডেট কলেজের প্রিন্সিপাল হয়েছিলাম তখন পর্যন্ত আমাকে অপেক্ষা করতে হয়েছিলো একথা বুঝতে যে, কেনো কর্নেল মর্তুজা এমন করতেন। বিষয়টি কাউকে বোধ হয় বুঝিয়ে বলা যায় না, ফুলের ঘ্রাণের মতো উপলব্ধি করতে হয়। সত্যিকার অর্থেই কর্নেল মর্তুজাকে আমি গুরু মানি।</p> Ashraf's columnhttp://www.blogger.com/profile/16382744974160016625noreply@blogger.com0tag:blogger.com,1999:blog-29831725.post-41244942471898405352013-08-13T16:47:00.002-07:002013-08-13T16:47:09.179-07:00Corruption and womenBangladesh is already well known as a corrupt country. It’s because most of its powerful and influential men and women, within and outside the government, practice corruption as a way of life. Sometimes we find names of such allegedly corrupt persons published by the media, though most of the time these people manage the corrupt owners of the media and go unnoticed. What is surprising is that we seldom find names of the women among the corrupt people. Very recently we found the name of only one woman who is allegedly corrupt. She is Mrs. Jasmine, wife of Hallmark boss Mr. Tanvir. Does that mean that the women in our society are all “dhoa tulshipata” (innocent)? Certainly not. I am sure, an intimate study of the corrupt men, will prove that, if not more, at least 95% of them indulge in corrupt practices at the behest of their wives and, in some case, their mothers. In our society we find most of the working and non working women, especially the well to dos, want to live their life as luxuriously as possible. We see them in a rat race for more money and more power. They take a kind of perverted pleasure in living beyond means. They suffer from a mental disease called exhibitionism and are fond of showing off their expensive houses, cars, dresses, ornaments etc. If these women could be motivated to live within their means, if the society could openly question and condemn such exhibitionism, I believe, their men folk would not have run after unearned and ‘haram’ (forbidden by religion) income to meet their wives’ insatiable greed. But the question is: How to motivate these highly ambitious and exceedingly greedy women and bring them to the path of modest living within the means?
I have two humble suggestions. Firstly, women organizations of our country can initiate movements to make the women aware of the far reaching ill effects of corruption on their families and on the society as a whole. They can tell the women that every married woman must prevail upon her husband or son to refrain him from acquiring wealth by illegal means by taking bribe or indulging in dishonest business. She must tell her husband or son that she is happy with his honest income; even if it causes her financial hardship. She can also tell her husband that it will never be good for their children if they are brought up with ‘haram’ money. Moreover, when these children will grow up and learn that their father was a corrupt man they will have no regard for the father. Can we expect to see our senior female social workers starting a movement in this line, or in a better line, by addressing our women, especially the ones who are still students and not married, through media, meetings, seminars and symposia?
Secondly, the wife of a corrupt man should be made a co-accused as an abettor in a corruption case. She may be acquitted by the court if she can prove that she tried her best to refrain her husband from making money by corrupt means. But the husband must be punished if found guilty. If necessary the existing relevant laws may be amended to involve the wife of a corrupt man in such cases.
Before I conclude I must make it clear that I do not write this piece to absolve the corrupt men of their crimes. Under all circumstances they must be punished as per law. They must be condemned by the society every time and everywhere. We don’t any more want to see such persons selected or elected as the chairmen of the local masjid committees or the school committees, not speak of members of the parliament. Let us have the active support of our mothers and sisters to combat corruption.
Ashraf's columnhttp://www.blogger.com/profile/16382744974160016625noreply@blogger.com0tag:blogger.com,1999:blog-29831725.post-66961139012078871852013-08-07T15:05:00.001-07:002013-08-07T15:05:13.732-07:00ঘুসখোরদের জন্য
আমাদের সমাজে বর্তমানে ঘুস একটি মহাসংক্রামক ব্যাধি হিসেবে ছড়িয়ে পড়েছে। সরকারি-বেসরকারি যেকোনো অফিস বা প্রতিষ্ঠানে ঘুস ছাড়া কোনো কাজ হয় না। দাতা কিংবা গ্রহীতা কেউ আর আজকাল ঘুস দেওয়া-নেয়াকে অবৈধ বা অনৈতিক কাজ মনে করেন না। যদিও কাজটি যে কোনো বিবেচনায় যে অবৈধ এবং অনৈতিক তা সকলের জানা আছে। আমার নিজের জীবন থেকে ঘুস সম্পর্কিত দু’টি অভিজ্ঞতার কথা নিচে বর্ণনা করছি। যাঁরা নিশ্চিন্ত মনে এখনও ঘুস খেয়ে চলছেন, বা যাঁরা ভবিষ্যতে ঘুস খাবার পরিকল্পনা করছেন তাঁরা কথাগুলো ভেবে দেখতে পারেন।
১৯৮১ সালের ঘটনা। আমি ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজের অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করছি। কোনো একটা ভ্যাকেশনের পর ক্যাডেটরা সবে কলেজে ফিরে এসেছে। এমন সময় একজন হাউস মাস্টার, যিনি একটি হাউস বা ছাত্রাবাসের প্রায় এক’শ জন ক্যাডেটের সার্বক্ষণিক দেখভালের দায়িত্বে নিয়োযিত থাকেন, এসে এমন এক খবর দিলেন যা আমাকে ভীষণ চিন্তায় ফেলে দিলো। তিনি বললেন, তাঁর হাউসের ক্লাস এইটের একজন ক্যাডেট, যার বয়স ১৪ বা ১৫ বছর হবে, বাড়ি থেকে ফিরে এসে এই বলে ঘোষণা দিয়েছে যে, পরবর্তী ভ্যাকেশনে সে আর কখনও বাড়ি যাবে না। জোর করে বাড়ি পাঠালে সে বাড়ি থেকে পালিয়ে যাবে, নয়তো আত্মহত্যা করবে। তার থাকার জন্য কলেজে অথবা কলেজের পক্ষ থেকে অন্য কোথাও থাকার ব্যবস্থা করা হোক। লম্বা ছুটিতে সব ক্যাডেট বাড়ি যাবার জন্য উদগ্রীব থাকে। অথচ সে জিদ ধরেছে বাড়ি যাবে না। কেনো যাবে না, সে প্রশ্নের উত্তরও হাউস মাস্টার বহু চেষ্টা করে বের করতে পারছেন না। হাউস মাস্টারের ধারণা, বাড়িতে এমন কিছু বিব্রতকর বা লজ্জাজনক ঘটনা ঘটেছে যার জন্য সে আর বাড়িতে যেতে চায় না। ঘটনাটি সে কারও কাছে প্রকাশও করতে চায় না। সহযবোধ্য কারণে ছেলেটির আসল নাম প্রকাশ করছি না। ধরা যাক, তার নাম কামাল।
সাধারণত জটিল কোনো সামাজিক সমস্যা থেকে কামালের মত বয়সী ছেলেরা ( এবং মেয়েরা) এমন অস্বাভাবিক আচরণ করে থাকে। যার উপর আস্থা আছে কোনো মুরুব্বি সঠিকভাবে হস্তক্ষেপ করতে ব্যর্থ হলে এমন আচরণের পরিণতি মারাত্মক হতে পারে। কথাটা আমার জানা ছিলো। শোনার পর দিনই বিকেলে গেইমস পিরিয়ডে কামালকে আমার অফিসে ডেকে আনি। অফিসে আর কেউ না, শুধু কামাল আর আমি। একথা-সেকথা বলার পর পরিবেশ কিছুটা হাল্কা হলে তার বাড়ি না যাইতে চাইবার প্রসঙ্গটি উঠালাম। বিষয়টি খোলাখোলিভাবে বলার জন্য অনুরোধ করলাম। সম্পূর্ণ গোপনীয়তার নিশ্চয়তা দিলাম। তাকে আরও বললাম, বিষয়টি কারও সাথে সেয়ার না করে একাএকা মনের মধ্যে চেপে রাখলে তার মানসিক স্বাস্থ্যের ক্ষতি হবে। পড়াশুনার ক্ষতি হবে। রেজাল্ট খারাপ হবে। আমি তার একজন বন্ধু হিসেবে, একজন হিতাকাঙ্খী হিসেবে তাকে পরামর্শ দিতে চাই। তার সমস্যা সমাধানে সাহায্য করতে চাই। অবশেষে কামাল মুখ খুললো। সে বললো, তার বাবা একজন সরকারি অফিসার। এমন একটি প্রচন্ড বদনাম আছে। তার বিশ্বাস, তার বাবাও ঘুস খান। এবং প্রচুর পরিমানে ঘুস খান। ঠিকাদাররা বাসায় এসে তার বাবা বা মা’র হাতে ঘুসের টাকা ও অন্যান্য সামগ্রী দিয়ে যান। ব্যাপারটা সে ছুটিতে বাসায় থাকার সময় লক্ষ্য করেছে। তার মা প্রতি মাসে প্রায় বিশ হাজার টাকা সংসারের জন্য খরচ করেন, প্রতি মাসে দামিদামি শাড়ি কেনেন। অথচ তার বাবার মাসিক বেতন সব মিলিয়ে ছ-সাত হাজার টাকার বেশি নয়। দাদা-নানারাও নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের লোক। সেখান থেকেও কোনো টাকাপয়সা পাবার কথা নয়। এক পর্যায়ে সে বলে ফেললো, আই হেইট মাই ফাদার। আমি ছুটিতে আর বাড়ি যাবো না। বাবার ঘুসের টাকায় কেনা ভাত আর খেতে চাই না। বাড়ি গেলে আমাকে হারাম খেতে হবে। সমস্যা জটিল, সন্দেহ নাই। কোনো মসজিদে অথবা মজলিসে ঘুসখোরদের সম্পর্কে নিন্দনীয় কথা শুনে, অথবা বইতে পড়ে সে আর নিজেকে স্থির রাখতে পারেনি। তার বাবাকে, সেইসাথে মাকেও, ঘৃণা করতে শুরু করে। তাঁদের কাছে আর সে যেতে চাইছে না। পরের দিন আবার একই সময়ে আমার অফিসে আসতে বলে সেদিনের মত কামালকে তার হাউসে ফিরে যেতে বললাম।
পরের দিন গেইমস পিরিয়ডে কামালকে আবার আমার অফিসে ডেকে এনে নিভৃতে আলাপ শুরু করি। প্রথমেই তাকে আশ্বস্ত করলাম এই বলে, বিষয়টি নিয়ে আমি নিজে অনেক চন্তা করেছি। ধর্ম, আইন এবং নৈতিকতা সম্পর্কে যাঁদের অনেক জ্ঞান আছে এমন কয়েকজন পন্ডিত ব্যক্তির সাথে আলাপ করেছি। তাঁদের সবার একমত, তোমার বাবা ঘুষ খেয়ে, এবং তোমার মা সে ঘুষের টাকা উড়িয়ে অবশ্যই গুনাহ এবং অন্যায় দু’টোই করছেন। তবে সেজন্য তোমার বা তাঁদের অন্য কোনো সন্তানের কোনো গুনাহ বা অন্যায় হবে না। তোমাকে যথাসাধ্য ভালোভাবে লালনপালন করা তাঁদের পবিত্র দায়িত্ব ও কর্তব্য। একাজের জন্য তাঁরা সত্ না অসত্ উপায়ে অর্থ উপার্জন করলেন, তার জন্য সন্তান হিসেবে তোমার কাছে কোনো কৈফিয়ত চাওয়া হবে না। তাই, ভ্যাকেশনে বাড়ি গিয়ে বাড়ির ভাত খেতে, বাবা-মার দেওয়া কাপড় পরতে তোমরি আপত্তির কোনো কারণ নেই। বরং বাবার ঘুষ খাওয়া এবং মায়ের অর্থ অপচয় করা যে তুমি পসন্দ করো না তা বিনয়ের সাথে কোনো প্রকার বেয়াদবি না করে বাবা-মাকে বলতে পারো। যদি তাঁরা তোমার কথা শোনেন, তবে ভালো। আর যদি না সোনেন, তাহলে এ নিয়ে বাবা-মার সাথে কোনো সংঘাতে যাবে না। তাহলে তাঁরা হয়তো তোমার ক্যাডেট কলেজে পড়াই বন্ধ করে দেবেন। কাজের কাজ কিছু হবে না। মাঝখান থেকে তোমার মত সত্ এবং ঈমানদার একজন মানুষের ভবিষ্যত সেবা থেকে আমাদের দেশ বঞ্চিত হবে। তারচেয়ে বরং ভালোভাবে লেখাপড়া শেষ করে যে পেশাতই যোগ দাও না কেনো, সকল প্রকার দুর্নীতি ও লোভ-লালসা থেকে নিজেকে রক্ষা কোরো। অধ:স্তনদেরকেও ওপথে হাটতে দিও না। নিজের বাবা-মার জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করো, আল্লাহ যেনো তাঁদের হেদায়েত করেন। মৃত্যু হলে যেনো অল্লাহ তাঁদের, তোমার অর্জিত নেকির বদলে, গুনাহ মাফ করে দেন। যতক্ষণ কথা বলছিলাম, আমি কামালের মুখের দিকে তাকিয়ে তার ভাবান্তর লক্ষ্য করছিলাম। মনে হলো, আমার কথায় কাজ হচ্ছিলো। যাবার সময় দু’চোখের কোনায় অশ্রুর রেখা দেখেছিলাম। বুঝতে পারিনি, সে অশ্রু আনন্দের না বেদনার। ক’দিন পর ভ্যাকেশন শুরু হলে কামাল আর কোনো কথা না বলে বাড়ি চলে যায়। তারপর বহুদিন হয়ে গেছে। কামাল কোথায় কী করছে জানি না। আমার বিশ্বাস, সে ঘুষ খায় না, সে ভালো আছে। যদি বেঁচে থাকি, আল্লাহ চাইলে, বাংলাদেশে অথবা দেশের বাইরে কোথাও, দেখা হলে দৌড়ে এসে পা ছুঁয়ে বলবে, স্যার, আমাকে চিনলেন না, আমি কামাল। আমি আপনার কথা রেখেছি। আমি ভলো আছি, সত্ আছি। যেমন করে অনেকদিন আগে কলকাতা ডেপুটি হাই কমিশনের সামনে দৌড়ে এসে আমায় কদমবুচি করে মইনুল (আসল নাম নয়) বলেছিলো, স্যার, আমাকে চিনলেন না ! আমি আপনার ক্যাডেট মইনুল, যাকে আপনি অপরাধ করার জন্য ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজ থেকে বের করে দিয়েছিলন। ক্যাডেট কলেজ থেকে বের করে দিয়ে আপনি আমার ভীষণ উপকার করেছিলেন। না হলে আমার মধ্যে যে দোষ ঢুকেছিলো তা থেকে বেরিয়ে আসতে পারতাম না। ক্যাডেট কলেজ থেকে বের হয়ে এসে পৃথিবীকে নতুন করে চিনলাম। নতুন করে চৈতন্য হলো। থাক সে কাহিনী আজ। আর এক দিন বলা যবে।
এবার আসা যাক দ্বিতীয় ঘটনায়। ঘটনাটি ঘটেছিলো ১৯৮০ সালের প্রথম দিকে, যখন আমি সবে ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজে অধ্যক্ষ পদে যোগ দিয়েছি। আমাদের বড় ছেলে রুমনের বয়স তখন মাত্র দশ হয়েছে। ক্লাশ ফোরে পড়ে। হঠাত্ সে একদিন তার মার কাছে বায়না ধরলো, ছোট মাছের তরকারি, শাকপাতা ভাজি, ভর্তা, ডাল, এসব দিয়ে তার ভাত খেতে আর ভালো লাগছে না। তাকে এখন থেকে প্রতি বেলায় গরু-মুরগি-খাসি বা বড় মাছের ঝোল দিয়ে খাবার দিতে হবে। তা নাহলে সে ভাত খাবে না। বিষয়টি আমার স্ত্রী আমাকে জানালেন। তাঁকে এনিয়ে ছেলেরে সাথে কথা বলতে বারণ করলাম। যা বলার আমি নিজেই বলবো। খবর নিয়ে জানা গেলো, ষড়যন্ত্রের মূল হোতা বাসার বুড়ো সরকারি বাবুর্চি আকবর মিয়া। ছোট মাছের তরকারি, শাকপাতা ভাজি, ভর্তা, ডাল, এসব রান্না করতে তার ভালো লাগছে না। তাছাড়া এসব পাকাতে সময় বেশি লাগে। কাজ শেষে তার নিজের বাসায় ফিরতে দেরি হয়। অন্যদিকে আমি পদ্মাপাড়ের ছেলে। ছোটবেলায় মা যা রান্না করে খাইয়েছেন সেসব খেতে এখনও ভালো লাগে। তাছাড়া সরকার যা বেতন দেয় তা দিয়ে সপ্তাহে দু’একদিন হয়তো বড় মাছ বা গোস্ত দিয়ে ভাত খেতে পারি, প্রতিদিন তো নয়। মনে মনে ঠিক করলাম, ছেলেকে বুঝাতে হবে। যে ভাষায় বললে সে ভালোভাবে বুঝবে সে ভাষাতে বলতে হবে। মিলিটারি কায়দায় ‘নো’ বললে কাংখিত ফল পাওয়া যাবে না। বরং ছেলেটি মনে আঘাত পাবে।
পরের রবিবার, তখন রবিবার সাপ্তাহিক ছুটি হতো, নাস্তার টেবিলে রুমনের সাথে কথাটা উঠালাম। ওর আম্মাও সামনে ছিলেন। সহজ ভাষায় ছোটছোট প্রশ্নোত্তরের সাহায্যে ওকে বিষয়টি এভাবে বুঝাবার চেষ্টা করলাম:
শুনলাম, ছোট মাছের তরকারি, শাকপাতা ভাজি, ভর্তা, ডাল, এসব খেতে তোমার আজকাল ভালো লাগছে না। তোমার আম্মাকে বলেছো প্রতিদিন গোস্ত বা বড় মাছের তরকারি দিতে।
জ্বী।
তুমি জানো, গোস্ত, মাছ, শব্জি এসব কোথা থেকে, কেমন করে আমাদের খাবার টেবিলে আসে ?
শুক্কুর ভাই (বেয়ারার) বাজার থেকে টাকা দিয়ে কিনে আনে।
শুক্কুরকে কে বাজার করার টাকা দেয় ?
আম্মা টাকা দেন।
আম্মা কোথায় টাকা পান ?
কেনো, তুমি টাকা দেও, তোমার বেতন থেকে।
আমি কি বেহিসাবি অনেক টাকা বেতন পাই ? নাকি, নির্দিষ্ট পরিমানে কিছু টাকা পাই ? তোমার কী মনে হয় ?
নির্দিষ্ট পরিমানে টাকা পাও।
তুমি কি জানো, সে টাকা কিসেকিসে খরচ হয় ?
না, জানিনা।
আমাদের সবার খাওয়াদাওয়া, জামাকাপড়, তোমার বই-খাতা-পেন্সিল, ছোট চাচা-ফুফুদের পড়াশুনা, চিকিত্সা ইত্যাদি অনেক কাজে খরচ হয়। প্রতিদিন বেশিবেশি গোস্ত-মাছ ও দামিদামি খাবার খেতে হলে অতিরিক্ত টাকা লাগবে। সে টাকাটা কোথায় পাবো ? কম খরচ করে অন্য খাত থেকে টাকা বাঁচিয়ে এনে খাওয়াদাওয়ার জন্য ব্যয় করা যায়। তুমি বলো, কোন খাতে কম খরচ করা যায়।
অনেক্ষণ চুপ থেকে বললো, আমি জানি না। মনে হলো, জমি এবার তৈরি হয়েছে। আমাকে এখনই ওর মনে সততার বীজ বুনতে হবে।
আমি বললাম, হ্যাঁ, একটা উপায় আছে। আমি যদি চুরি করি তা’হলে অনেক টাকা উপার্জন করতে পারবো। (ঘুষ কথাটার অর্থ ও তাত্পর্য তখন ওর জানার কথা নয়। তাই ঘুষের বদলে চুরি বলেছিলাম।) তখন আর আমাদের কোনো অভাব থাকবে না। যা খুশি তাই আমরা খেতে পারবো। কিন্তু, মনে করো, তুমি একদিন ফৌজদারহাট বাজারে গেলে। তোমাকে ওখানকার কেউ চিনে না। এমন সময় তুমি শুনতে পেলে, কেউ একজন বলছে, ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজের প্রিন্সিপ্যাল কর্নেল আশরাফ একটা মস্ত চোর। সে মানুষের টাকা চুরি করে। তখন তোমার কেমন লাগবে শুনতে ?
সাথেসাথে রুমন চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে গেলো। চিতকার করে যা বলেছিলো, তা আজও আমার পরিষ্কার মনে আছে। সে বলেছিলো, না আব্বা না, তুমি কখনও চুরি করবে না। আম্মা যা টেবিলে দিবেন, তাই খাবো। এরপর রুমন এবং ওর ছোট দু’ভাইবোনকে কোনো দিন এটা খাবো না, ওটা খাবো না বলে বায়না ধরতে শুনিনি। হোটেল-রেস্টুরেন্টে খেতে গেলে খাবার নিয়ে বায়না ধরেনি। ওদের মা যা খাবারের অর্ডার দিয়েছেন তাই সানন্দে খেয়েছে।
তিনচার বছর পরের ঘটনা। রুমন সম্ভবত তখন ঢাকার আদমজী ক্যন্টনমেন্ট পাবলিক স্কুলে ক্লাশ সেভেনে পড়ে। একদিন ওর মা লক্ষ্য করলেন যে সে পা খুড়িয়েখুড়িয়ে হাটছে। ভাবলেন, হয়তো স্কুলে খেলতে সময় পড়ে গিয়ে পায়ে আঘাত পেয়েছে। দেখার জন্য কাছে ডাকলেন। রুমন বললো, না, তমেন কিছু নয়। দু’তিন পর ওর মা জোর করে কাছে বসিয়ে যা দেখলেন তাতে যেকোনো মায়ের মন ব্যথায় ভরে উঠার কথা। জুতা ছোট হয়ে গেছে। দৌড়াদৌড়ি করতে গিয়ে গোড়ালিতে ফোষ্কা পড়ে ঘা হয়ে গেছে। মা প্রশ্ন করলেন, জুতা পায়ে লাগছে না, একথা কেনো এতোদিন বলিস নি ? ছেলের জবাব, এখন তো মাসের মাঝামাঝি। আব্বার হাতে যদি টাকা না থাকে। তাই অব্বাকে বিব্রত করতে চাইনি। আর তো মাত্র ক’টা দিন, আগামী মাসের প্রথম দিনেই বলতাম। অফিস থেকে ফিরে এসে স্ত্রীর কাছ থেকে ঘটনাটি শোনার পর চোখে পানি এসে গিয়েছিলো। ছেলেকে ডেকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলাম, তোমার অব্বার অনেক টাকা নেই, একথা সত্য। তাই বলে মাসের মাঝামাঝি সময়ে তোমার জন্য একজোড়া জুতা কিনতে পারবো না, একথা সত্য নয়। ভবিষ্যতে এমন আর করবে না। জামাজুতা ছোট হয়ে গেলে অবশ্যই আম্মাকে বা আব্বাকে বলবে। সেদিনই তাকে নিয়ে বাজারে গিয়ে নতুন জুতা কিনে দেই। আল্লাহর কাছে হাজার শুকরিয়া। পাঠককে অত্যন্ত বিনয়ের সাথে জনাচ্ছি, সেই ছেলে আল্লাহর মেহেরবানিতে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করার পর শতকরা একশ’ ভাগ বৃত্তি সহকারে বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পেশাগত ডিগ্রি নিয়ে সতভাবে জীবন যাপন করছে।
যারা ঘুষ খাচ্ছেন, ব্যবসা-বানিজ্যের নামে চুরি করছেন, মানুষকে বা সরকারকে ঠকিয়ে নানাভাবে পয়সা কামাচ্ছেন, অথবা যারা এসব করবেন বলে চিন্তাভাবনা করছেন, তাঁরা যদি বিষয়টা একবার ভেবে দেখেন। তাঁদের ছেলেময়েরা বড় হয়ে নিজেদের বাবা-মা সম্পর্কে কী ধারণা পোষণ করবে। নিজের সন্তানের কাছে কৃত কর্মের জন্য পাপী বা অপরাধী বলে বিবেচিত হবার চাইতে বাবা-মার জন্য অধিক দু’র্ভাগ্যজনক দুনিয়াতে আর কিছু আছে কি ? দশ বা বারো বছর বয়স হলেই ছেলেমেয়েরা বুঝতে পারে বাবা (এবং মা) হালাল রুজি কামাই করছেন, না হারাম রুজি কামাই করছেন। যদিও ভয় অথবা লজ্জায় তারা সেটা নিয়ে কথা বলে না। যদি কেউ মনে করেন, ওরা তো ছোট, ওরা কিছুই বোঝে না। তা’হলে তিনি অবশ্যই বোকার স্বর্গে বাস করছেন।
Ashraf's columnhttp://www.blogger.com/profile/16382744974160016625noreply@blogger.com1tag:blogger.com,1999:blog-29831725.post-5558135098907403022013-07-05T11:03:00.004-07:002013-07-05T11:06:15.254-07:00বংশ পরিচয়১৯৬৮ সালের শেষ দিকের ঘটনা। আমি তখন পাকিস্তানের কোয়েটা ক্যান্টনমেন্টে একটি ব্রিগেড হেডকোয়ার্টারে জুনিয়র ক্যাপ্টেন হিসেবে কমর্রত ছিলাম। আজকাল যেমন হয়, তখনও পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমিতে লং কোর্সের ক্যাডেট নির্বাচনের জন্য সবার আগে বিভিন্ন স্টেশনে প্রিলিমিনারি ইন্টারভিউ হতো। প্রতিটি ইন্টারভিউ কমিটির প্রেসিডেন্ট হতেন একজন ব্রিগেডিয়ার। সদস্য থাকতেন দু’জন লে: কর্নেল। একজন সিনিয়র মেজর সদস্য সচিবের দায়িত্ব পালন করতেন। সেবার এমন একটি কমিটির সদস্য সচিব হিসেবে আমাকে নিয়োগ দেয়া হলো। শীতকালীন কালেক্টিভ ট্রেইনিংয়ের জন্য স্টেশনের প্রায় সব অফিসার ক্যান্টনমেন্টের বাইরে ছিলেন। তাই আমার মত একজন জুনিয়র অফিসারের উপর এমন গুরুদায়িত্ব দেয়া হয়েছিলো বলে আমাকে জানানো হয়েছিলো। জীবনে এই প্রথম এমন গুরুত্বপূর্ণ কাজ করার সুযোগ এলো। স্বভাবতই মনের মধ্যে কিছুটা উত্তেজনা কাজ করছিলো।
ইন্টারভিউ শুরু হবার দু’তিন দিন আগে আমার নামে জেনারেল হেডকোর্য়াটার্স, রাওয়ালপিন্ডি থেকে একটি ব্যক্তিগত গোপনীয় সরকারি চিঠি এলো। খামটি খোলার পর দেখা গেলো তার ভেতর একখানা ছোট্ট চিঠি। তার সাথে সিলগালা করা মোটা একটি খাম। চিঠিতে বলা হয়েছে, সিলগালা করা খামটি ইন্টারভিউ শুরু হবার পূর্বমুহূর্তে খুলতে হবে, তার আগে কিছুতেই নয়। সিলগালা করা খামটির ভেতরে প্রদত্ত নির্দেশাবলী ইন্টারভিউ কমিটির প্রেসিডেন্ট ও সদস্যদের পাঠ করে শুনিয়ে, চিঠর উপর তাঁদের দস্তখত নিয়ে, সাথে সাথে প্রদত্ত সেলফ এড্রেসড খামে ভরে প্রেরককে ফেরত পাঠাতে হবে।
জেনারেল হেডকোর্য়াটার্সের সেই অতি গোপনীয় চিঠির মূলকথা আমার আজকের লেখার বিষয়বস্তু। ইন্টারভিউর জন্য মোট নম্বর ছিলো ১০০। পাশের নম্বর ৪০। ইন্টারভিউতে আগত প্রার্থীদের কীভাবে প্রশ্ন করতে হবে, কী কী প্রশ্ন করা যাবে, কী কী প্রশ্ন করা যাবে না ইত্যাদির উপর বিশদ নির্দেশনা ছিলো সেই চিঠিতে। সবশেষে, এবং সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা হিসেবে বলা হয়েছিলো, “কমিনা” বংশের কোনো প্রার্থীকে যেনো কোনোভাবেই নির্বাচন না করা হয়। “কমিনা” বংশের ব্যাখ্যায় বলা ছিলো: ধোপা, নাপিত, কসাই, ঢুলি, বেলদার, পাটনি ইত্যাদি তথাকথিত নিচু বংশকে “কমিনা” বংশ বলে বিবেচনা করতে হবে। পক্ষান্তরে প্রার্থীর পরিবারের আপন কোনো সদস্য (বাবা, দাদা, চাচা, মামা, ভাই) যদি বর্তমানে সশস্ত্রবাহিনীতে অফিসার পদে কর্মরত থাকেন, অথবা অতীতে ছিলেন, তাহলে এমন প্রতি সদস্যের জন্য অতিরিক্ত ১০ নম্বর করে প্রদান করতে হবে, তবে একজন প্রার্থীকে এবাবদ ৩০ নম্বরের বেশি দেয়া যাবে না। বয়স তখন নিতান্তই কম ছিলো, পঁচিশেরও নিচে। নির্দেশনাটি মনে মনে পাঠ করে ভীষণ হোচট খেলাম। ভাবলাম, ইসলামিক রিপাবলিকের এ কোন ইসলামী ন্যায় বিচার এবং গণতন্ত্রের রূপ দেখছি ! চিঠিতে অবশ্য স্বীকার করা হয়েছিলো, এই নির্দেশনাটি ইসলামী ন্যায় বিচার এবং গণতন্ত্রের মর্মবাণী উভয়ের সাথে সাংঘর্ষিক।
তারপরও বহু বছরের বাস্তব অভিজ্ঞতার আলোকে সেনাবাহিনীকে বাধ্য হয়ে এমন সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। অনেক বিস্তারিত ব্যাখ্যা ও উদাহরণ দেওয়া হয়েছে। সংক্ষেপ যা বলা হয়েছে তা হলো: সশস্ত্র যুদ্ধের ময়দান এমন একটি স্থান যেখানে যুদ্ধরত অবস্থায় সকল কমান্ডারকে পৃথিবীর নিষ্ঠুরতম কঠোরতা ও বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হয়। এখানে তত্বের কচকচানি, রাগ-বিরাগ বা ভাবাবেগের কোনো যায়গা নেই। অভিজ্ঞতা থেকে দেখা গেছে, আমাদের উপমহাদেশের “কমিনা” বংশের ছেলেমেয়েরা শৈশব ও বাল্যকালে এক ধরনের বিশেষ আর্থসমাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিবেশে বড় হয়ে উঠে। নেতৃত্ব প্রদানের জন্য যেসব মানবিক ও মানসিক (পার্সোনালিটি এন্ড ক্যারাক্টার ট্রেইটস) গুণাবলীর অবশ্য প্রয়োজন, তা সাধারনত: তাদের মধ্যে প্রস্ফুটিত হতে দেখা যায় না। তাদের কেতাবি বিদ্যা যতোই হোক না কেনো। যে ব্যক্তির মধ্যে এসব বিশেষ গুণাবলীর অভাব আছে সে স্বাভাবিক কারণে সশস্ত্রবাহিনীতে, কমান্ডার হলেও, লীডার হতে পারে না। ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে। এদের মধ্যে অনেকে আবার বড় হয়ে এসব দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে পারে। কিন্তু সশস্ত্রবাহিনীতে অফিসার নির্বাচনের সময় এ বিষয়ে চান্স নেয়ার কোনো সুযোগ নেই। আরও একটি কারণ উল্লেখ করা হয়েছে। নিজেদের আর্থসমাজিক ও সাংস্কৃতিক ব্যাকগ্রাউন্ডের কারণে এতদাঞ্চলের সাধারন সৈনিকরা “কমিনা” বংশ থেকে আগত কোনো অফিসারকে মন থেকে নিজেদের লীডার হিসেবে মেনে নিতে চায় না। এমন লীডারের হুকুমে স্বেচ্ছায় প্রাণ দিতে রাজি হতে চায় না।
প্রথম দিনের ইন্টারভিউ শেষ করে রাতে অফিসার্স মেসে ফেরার পরও মাথার মধ্যে বিষয়টি ঘুরপাক খাচ্ছিল। এমন সময় আমার আব্বার বলা একটা কথা মনে পড়লো। একটি উদার ও প্রগতিশীল মনের মানুষ ছিলেন তিনি। আর্মিতে জয়েন করার আগে যখন ঢাকা ইউনিভার্সিটির ছাত্র ছিলাম তখন ছুটিতে আব্বার কাছে গেলে এমন অনেক বিষয় নিয়ে আমার সাথে আলাপ করতেন যা তখনকার দিনে পিতা-পুত্রের মাঝে অনুচ্চার্য বিষয় ছিলো। তাঁর আমাকে নিয়ে চিন্তা ছিলো, ছেলেদের স্কুল এবং ছেলেদের কলেজ থেকে পাশ করা ছেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের কো-এডুকেশনে গিয়ে কোনো মন্দ বংশের মেয়ের প্রেমেট্রেমে জড়িয় না পড়ি। তাই তিনি আমাকে কাছে ডেকে বললেন: বাবা, তুই এখন বড় হয়েছিস। এই বয়সে বিয়ে-শাদী বা প্রেম করার জন্য কোনো ময়ে পসন্দ হওয়াটা অস্বাভাবিক নয়। মনে তেমন কোনো ভাবনা উদয় হলে একটা কথা অবশ্যই মনে রাখবি। মেয়েটি যেনো আজেবাজে ফ্যামিলির না হয়। আজেবাজে ফ্যামিলি বলতে তিনি দরিদ্র পরিবারকে বুঝাননি। বুঝিয়েছিলেন সাংস্কৃতিকভাবে নিম্নমানের, নিম্নরুচির পরিবারকে। তাঁর কথার পক্ষে অনেক যুক্তি ও উদাহরণ দিয়েছিলেন। আমি তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ইস্ট পাকিস্তান স্টুডেন্টস ইউনিয়নের একজন সক্রিয় কর্মী। চেতনায় উদার এবং বামপন্হী। আব্বার কথাগুলু মনে হচ্ছিল প্রচন্ড প্রতিক্রিয়াশীল। তবে প্রতিবাদ করে বলার অনেক কিছু থাকলেও কিছু বলতে সাহস হয়নি। অনেক কাল পর আমার নিজের ছেলেমেয়ের যখন বিয়ে দেওয়ার সময় হলো তখন আব্বার কথার তাত্পর্য পুরোটা বুঝতে পেরেছিলাম।
২৮ বছর পর ১৯৯০ দশকের মাঝামাঝি সময়ে, বাংলাদেশ ইন্টার সার্ভিসেস সিলেকশন বোর্ডের (আইএসএসবি) প্রেসিডন্ট হিসেবে সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনীর একাডেমিগুলোর জন্য ক্যাডেট সিলেকশনের চূড়ান্ত দায়িত্ব আমার ঘাড়ে এসে পড়ে। ১৯৬৮ সালে পাকিস্তানের জেনারেল হেডকোর্য়াটার্সের পাঠানো সেই অতি গোপনীয় চিঠির কথা মনে পড়লো। খুঁজে দেখলাম, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সরকারের পক্ষ থেকে আমাদের আইএসএসবি-কে তেমন কোনো নির্দেশনা দিয়ে চিঠি কখনও দেওয়া হয়নি। কারণ সহজবোধ্য। নীতিগতভাবে সরকার সঠিক কাজটিই করেছেন, তাতে সন্দেহ নেই।
কিন্তু কয়েক সপ্তাহ যেতেই সন্দেহ দেখা দিলো। কোনো এক ইউনিটের এক মেজর, ধরা যাক তার নাম তানিম (সঙ্গত কারণে আসল নাম-ঠিকানা গোপন রাখা হলো), এমন কান্ড ঘটিয়ে ফেললেন যাতে সবাই স্তম্ভিত হয়ে গেলো। গভীর রাত্রে, ছোট দু’টি বাচ্চা যখন ঘুমিয়ে ছিলো, নিজের বাসার জিনিষপত্র ছড়িয়ে-ছিটিয়ে লন্ডভন্ড করে, লোহার রড দিয়ে পিটিয়ে নিজের স্ত্রীকে হত্যা করলেন মেজর তানিম। হৈ-চৈ করে পাড়ার সবাইকে ডেকে এনে বললেন তাঁর বাসায় ডাকাতি হয়েছে। ডাকাত তার স্ত্রীকে মেরে ফেলে ঘরের সব মূল্যবান জিনিষপত্র নিয়ে গেছে। যথাযথ তদন্তের পর এসব তথ্য বেড়িয়ে আসে। স্ত্রীটি ছিলেন অত্যন্ত ধনী পিতামাতার একমাত্র সন্তান। পিতামাতার মৃত্যুর পর তিনি স্বাভাবিকভাবেই তাঁদের সকল সম্পত্তির মালিকানা লাভ করেন। শ্বশুর বাড়ির সম্পত্তি আত্মসাত করার জন্য মেজর তানিম এমন জঘণ্য অপরাধ করেছিলেন। বিচারে দীর্ঘ দিনের কারদন্ড হয়েছিলো। সম্ভবত শিশু সন্তান দু’টির কথা বিবেচনা করে বিচারক প্রাণদন্ড দেননি।
বিষয়টি নিয়ে আর্মি হেডকোর্য়াটার্সে প্রচন্ড আলোড়ন সৃস্টি হলো। চিঠি দিয়ে আমার কাছে জানতে চাওয়া হলো, কেমন করে এমন জঘণ্য ক্রিমিনালকে আইএসএসবি কোয়ালিফাই করেছিলো। ১২/১৪ বছর আগের ফাইলপত্র খুঁজে যা পাওয়া গেলো তা সংক্ষেপে এরকম: মেজর তানিমের জন্ম হয়েছিলো বাংলাদেশে দুর্নীতি ও দুষ্কর্মের জন্য অতি বিখ্যাত একটি ডিপার্টমেন্টের সর্বনিম্ন পর্যায়ের এক কর্মচারির ঘরে। দুর্নীতি ও দুষ্কর্মের পরিবেশে সেখানেই তাঁর বেড়ে উঠা। সদ্য উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে যখন তিনি আইএসএসবি-তে এসেছিলেন তখন তাঁর ক্রিমিনাল মেন্টালিটি টেস্টিং অফিসারদের কাছে ঠিকই ধরা পড়েছিলো। তখন বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমিতে ক্যাডেটদের এতটা অভাব ছিলো যে একডেমি, তথা আর্মি, চালানো কঠিন হয়ে পড়েছিলো। তাই অনেকটা আপোস করে উক্ত মেজরকে, তার রিপোর্টে দুর্বল দিকগুলো উল্লেখ করে, একাডেমিতে পাঠানো হয়েছিলো। আশা করা হয়েছিলো, একাডেমিতে দীর্ঘ ট্রেইনিংয়ের সময়ে তিনি তাঁর দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে পারবেন। না পারলে, কমিশন না দিয়ে একাডেমি থেকে বহিস্কার করা হবে। কে জানে, বিধাতা তখন হয়তো মানুষের দুরাশা দেখে মুচকি হেসেছিলেন।
ক’দিন আগে, ২০১৩ সনের জুন মাসের মাঝামাঝি সময়ে, বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ অধিবেশনে কয়েকজন মাননীয় সংসদ সদস্য যে কদর্যতম অশ্লীল ভাষায় একে অপরকে গালাগাল করলেন, তা সুদূর আমেরিকার স্যান হোসেতে বসে ঢাকার টেলিভিশনের বদৌলতে আমার দেখা এবং শোনার বদকিসমত হয়েছে। শুনতে শুনতে মনে পড়ে গেলো ১৯৬৮ সালে পাওয়া পাকিস্তানী জেনারেল হেডকোর্য়ার্টাস থেকে পাওয়া চিঠির কথা। কপি হাতে থাকলে সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক দল দু’টির সর্বোচ্চ নেতা-নেত্রীদের কাছে পাঠিয়ে দেওয়া যেতো। আরও মনে পড়ে গেলো আমার মরহুম আব্বার কথা।
আমার সাত বছর বয়সী নাতনি, যার জন্ম ও বেড়ে উঠা আমেরিকাতে, আমার পাশে বসে ঢাকার টিভি দেখে। সেখান থেকে অতি উত্সাহ নিয়ে বাংলাভাষা শেখার চেস্টা করে। খুব ভালো বাংলা বলতে পারে। অপিরিচিত কোনো শব্দ বা বাক্য শুনলেই সে আমাকে সাথে সাথে প্রশ্ন করে, “দাদা, এই কথাটার অর্থ কী ?” সেদিন খবর শোনার সময় মাননীয় সংসদ সদস্যদের কুত্সিততম কথাবার্তা শুনে সে আমাকে একই প্রশ্ন করলো। সহৃদয় পাঠক, আপনিই বলুন এই কচি শিশুটিকে আমি কী জবাব দেবো ? বাধ্য হয়ে মিথ্যা কিছু বলে তাকে শান্ত করেছিলাম। একজন সংসদ সদস্য, তা তিনি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ যেভাবেই নির্বাচিত হয়ে এসে থাকুন না কেনো, তিনি তো আমাদের, আ’ম জনতার, লীডার। আর সেজন্যই আমরা “মাননীয়” বলে সম্বোধন করি। না করলে বেয়াদবি হয়। একজন সংসদ সদস্য নিজে নিজে সংসদে আসেননি। তাঁকে তো তাঁর দলের সর্বোচ্চ নেতা বা নেত্রী মনোনয়ন দিয়ে সংসদে এনেছেন। ইংরেজিতে একটা বহুল প্রচলিত কথা আছে যার বাংলা করলে এমন হয়: একজন মানুষের সঙ্গী-সাথীদের কথা-বার্তা, স্বভাব-চরিত্র, অভ্যাস-রুচি দেখে মানুষটির নিজের কথা-বার্তা, স্বভাব-চরিত্র, অভ্যাস-রুচি সম্পর্কে ধারণা করা যায়। এসব কুত্সিত কথা বলা “মাননীয়দের” যেসব বড় নেতা-নেত্রীরা আদর করে সংসদে ঠাঁই দিয়েছেন, আমরা তাঁদেরকেই বা কতটা প্রাপ্য সম্মান দিতে পারি ? কথাটা ভাবার সময় কি এখনও হয়নি ?
Ashraf's columnhttp://www.blogger.com/profile/16382744974160016625noreply@blogger.com1tag:blogger.com,1999:blog-29831725.post-17812742540574195572012-08-12T16:19:00.002-07:002012-08-12T16:31:10.073-07:00বন্ধ হোক গায়ের জোরে গুরুগিরি১। বহু বছর আগে, আধাশতাব্দিরও বেশি হবে, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের লেখায় একটা কথা পড়েছিলাম। কোনোকোনোগুরুজনের আচরণে মাঝেমধ্যে কথাটা যে মনে হয়নি, তা নয়। কিন্তু বাংলাদেশেরশিক্ষাঙ্গণের, বিশেষ করে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালসমূহের বতর্মান হালহকিকত দেখে কথাটাভীষণভাবে মনে পড়ছে। উচ্চ শিক্ষার এসব প্রতিষ্ঠানগুলোতে দু’তিন দশক ধরে যেনৈরাজ্যকর অবস্থা বিরাজ করছে তাতে যে কোনো বিবেকবান ব্যব্ক্তি দেশের ভবিষ্যতচিন্তা করে বিচলিত বোধ করবেন। বহুদিন আগে পড়েছি বলে কবিগুরুর কথাটা স্মৃতি থেকেহুবহু উদ্ধৃত করতে পারছি না। পারিবারিক কারণে দেশ থেকে অনেক দূরে যুক্তরাস্ট্রেবাস করতে হচ্ছে। হাতের কাছে বাংলা রেফারেন্স বই নেই। তাই পাঠকের কাছে ক্ষমা চেয়েনিয়ে ঘুণেধরা স্মৃতিশক্তিকে ভরসা করছি। কবিগুরু যা বলেছিলেন তার মর্মকথা হলো,গায়ের জোরে আর সব হওয়া গেলেও গুরু হওয়া যায়না। আমার বিশ্বাস, বাংলাদেশের মানুষ,বিশেষ করে যাঁদের ছেলেমেয়ে স্কুল, কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করে, গত দু’তিনদশক ধরে কথাটা হাড়েহাড়ে টের পাচ্ছেন। প্রাইমারি স্কুলের শিশু থেকে বিশ্ববিদ্যালয়েরতরুণ পর্যন্ত সকল বয়সের শিক্ষার্থীদের উপর এমন সব লোকদের গুরু হিসেবে চাপিয়ে দেওয়াহচ্ছে যাঁদের বেশির ভাগেরই, শিক্ষাগত যোগ্যতা থাকলেও, গায়ের জোর ছাড়া শিক্ষক হবারমত আর কোনো যোগ্যতা নেই। এখানে গায়ের জোর বলতে শারীরিক শক্তিকে বোঝানো হচ্ছেনা। (যদিওএমন উদাহরণ বিরল নয় যেখানে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের কোনোকোনো শিক্ষকশিশুকিশোর ছাত্রছাত্রীকে শারীরিক শক্তি প্রয়োগ করে রক্তাক্ত করছেন, এমনকি হাসপাতালেপাঠাচ্ছেন।) কোনোকোনো অধ্যক্ষ এবং উপাচার্য সারাক্ষণ বাড়িতে এবং অফিসে পুলিশিপ্রহারায় আবৃত থেকে নিজ প্রতিষ্ঠানের স্বার্থবিরোধী কর্মকান্ড চালাচ্ছেন। এমনকিকেউকেউ নিজ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষককে অমর্যাদাকারী, ছাত্রের হত্যাকারী কিংবা ছাত্রীরনির্যাতনকারীদের পৃষ্ঠপোষকতা করছেন। প্রতিবাদী ছাত্র ও শিক্ষকদের উপর নির্যাতনচালাচ্ছেন, কখনও অতি লজ্জাজনকভাবে পুলিশের সাহায্য নিয়ে। ছাত্রদেরকে শাসন ওপরিচালনা করার জন্য প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব কিছু বিধিবদ্ধ আইনকানুন এবংবিধিবিধান অবশ্যই থাকা দরকার, এবং তা আছেও। প্রতিষ্ঠানের মহাগুরু, যাকে আমরাপ্রধান শিক্ষক, অধ্যক্ষ অথবা উপাচার্য বলে থাকি, তিনিসহ সকল গুরু বা শিক্ষকপ্রয়োজনবোধে এসব আইনকানুন এবং বিধিবিধান, যাকে অন্যভাবে গায়ের জোর বলা যায়, প্রয়োগকরতে পারেন। কিন্তু সমস্যা হলো, একজন শিক্ষক চাইলেও একজন থানার দারোগার মত শুধুমাত্রআইনকানুনের ডান্ডা দেখিয়ে, গায়ের জোরে, ছাত্রদেরকে সুশিক্ষিতরূপে আলোকিত করে গড়েতুলতে পারেন না। একাজ নিষ্ঠা, সততা এবং দক্ষতার সাথে করতে হলে একজন মহাগুরু অথবাগুরুকে, আনুষ্ঠানিক ডিগ্রি ছাড়া, আরও কিছু অত্যাবশ্যকীয় মানবিক ও মানসিক গুণাবলীসম্পন্নহওয়া অপরিহার্য। আমার বিশ্বাস, কবিগুরু তাঁর কথায় সে দিকেই ইঙ্গিত করেছেন।
<br /><br />২। বর্তমানে আমাদেরপাবলিক বিশাববিদ্যালয়গুলোতে ভয়াবহ অনিয়ম, দাঙ্গা, সন্ত্রাস, অগ্নিসংযোগ ওছাত্রীনির্যাতনসহ যেসব দুষ্কর্ম চলছে তা এককথায় নজিরবিহীন। ইতোপূর্বে জাহাঙ্গীরনগরবিশ্ববিদ্যালয়ও অশান্ত, অরাজক হয়ে উঠেছিলো। সরকার অযথা দীর্ঘ কালক্ষেপণের পর,শিক্ষার্থীদের লেখপড়ার প্রভূত ক্ষতি সাধনের পর পুরানো উপাচার্যকে বিদায় করে একজননতুন উপাচার্য নিয়োগ করেছেন। মনে হয় না, তাতেও সমস্যার সমাধান হবে। কিছুদিন যাবত বুয়েটেরভিসি এবং প্রোভিসির প্রশাসনিক যোগ্যতা এবং সততা প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ায় সাধারন শিক্ষক এবংছাত্ররা তাঁদের পদত্যাগ দাবি করে ধর্মঘট করছেন। রাজশাহি বিশ্ববিদ্যালয়ে চাঁদারটাকা ভাগাভাগি নিয়ে একই ছাত্র সংগঠনের দুই অংশের মধ্যে সংঙ্ঘর্ষে একজন ছাত্র নামধারীচাঁদাবাজ নিহত হয়েছে। ২২ বছর যাবত ডাকসুর ইলেকশন না হওয়াতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরসাধারণ ছাত্রসমাজ অস্থির হয়ে উঠছে। সিলেটের ঐতিহ্যবাহী এমসি কলেজে একদল দাঙ্গাবাজছাত্র একটি ছাত্রাবাস আগুন লাগিয়ে ভস্মীভূত করেছে। সাম্প্রতিক কালের ইতিহাসসাক্ষ্য দেয়, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে হত্যাকান্ড সংঘটিত হয়, কিন্তু তার কোনোবিচার হয় না। অন্য কারণ থাকলেও, এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মহাগুরুদের অযোগ্যতা,অদক্ষতা এবং অনেক ক্ষেত্রে অসততা এমন পরিস্থিতির জন্য বহুলাংশে দায়ি। অথচ তাঁদেরকেউই নিজ অক্ষমতা স্বীকার করে আত্মমর্যাদা নিয়ে স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেন না। পরিস্থিতিরচরম অবনতি হবার পর সরকার কর্তৃক অপসারিত না হওয়া পর্যন্ত বেহায়ার মত পদ আকড়েথাকেন। তাঁরা ভুলে যান যে, তাঁরা সরকার কর্তৃক নিয়োজিত আর দশজন কর্মকর্তার মত নন।ডিসি, এসপি বা দারোগার মত সরকারি কর্মকর্তারা আত্মমর্যাদার তোয়াক্কা না করেও চাকরিকরেন, বা করতে হয়। কিন্তু একজন শিক্ষকেরপক্ষে আত্মমর্যাদা বিসর্জন দিয়ে নিজ দায়িত্ব পালন করা কখনও সম্ভব নয়।আত্মমর্যাদাহীন কোনো ব্যক্তি আর যা-ই হোন না কেন, তাঁর পক্ষে গুরু হওয়া সম্ভব নয়।তিনি কখনও শিক্ষার্থীদের মাঝে উন্নত মানুষ হবার জন্য প্রয়োজনীয় আলোক ছড়াতে পারেননা। একজন মহাগুরুর কী কী গুণ থাকলে তাঁকে যোগ্য, দক্ষ, সৎ এবং আত্মমর্যাদাসম্পন্নবলা যাবে সে সম্বন্ধে পরে আলোচনা করছি। তার আগে নবীণ পাঠকদের সাথে আমার নিজেরবিশ্ববিদ্যালয় জীবনের দু’টি অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে চাই।
<br /><br />৩। ১৯৬২ সনেরফেব্রুয়ারি মাস। ঢাকা কলেজ থেকে সবে আইএসসি পরীক্ষা দিয়েছি। তখনও রেজাল্ট আউটহয়নি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তুমুল আয়ুববিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলছে। পরীক্ষার পরপড়াশুনা বা ক্লাশ নেই। তাই প্রতিদিন সকাল বেলা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে এসেমিটিং-মিছিলে যোগ দিতাম। তখনও আমি কোনো ছাত্র সংগঠনের সদস্য হইনি। নিজের বিবেকেরতাড়নায় বাসা থেকে ফাঁকি দিয়ে এসে মিটিং-মিছিলে যোগ দিতাম। একদিন, সঠিক তারিখ মনে নেই,সকাল দশটা-এগারটার দিকে কার্জন হল এলাকার উত্তরপূর্ব দিকের মেইন গেটের ভিতরেদাঁড়িয়ে আমরা বেশ কিছু ছাত্র বিক্ষোভ করছিলাম। সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ। হঠাৎসামনের বড় রাস্তা ধরে উত্তর (হাই কোর্টের) দিক থেকে একটি ইপিআর-এর জিপগাড়ি দ্রুতদক্ষিণ দিকে যাবার সময় চালকের পাশে বসে থাকা পাকিস্তানি অফিসারটি তাঁর পিস্তল দিয়েবিক্ষোভরত ছাত্রদের দিকে এক রাউন্ড গুলি করে বসলো। আমারই পাশে দাড়ানো একজনবিক্ষোভরত ছাত্রের উরুতে গুলিটি লাগার ফলে সে রক্তাক্ত হয়ে মাটিতে পড়ে গেলো।তিন-চার জন ছাত্র মিলে দ্রুত আহত ছাত্রটিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়েগেলো। তুমুল উত্তেজনাকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হলো। কয়েক মিনিটের মধ্যে উপাচার্য ড.মাহমুদ হোসেন (ভারতের প্রয়াত রাষ্ট্রপতি ড. জাকির হোসেনের ভাই) পরিস্থিতি সামালদেওয়ার জন্য অকুস্থলে হাজির হলেন। জীবনে এই প্রথম একজন উপাচার্যকে সামনাসামনিদেখলাম। এতদিন দূর থেকে শুধু তাঁর নিজ বিষয় ইতিহাসের উপর অগাধ পান্ডিত্য, প্রশাসনিকদক্ষতা, সততা, সবোর্পরি ছাত্রদের প্রতি অপার ভালোবাসা ইত্যাদি মানবিক ও মানসিকগুণাবলীর কথা শুনে এসেছি। আজকে সামনাসামনি হয়ে আর সবার মত আমারও মাথা এমনিতেশ্রদ্ধায় নত হয়ে এলো। তিনি কার্জন হল ভবনের উত্তরমুখি প্রধান ফটকের সামনের বারান্দায়এসে দাঁড়ালেন। পেছনে অন্যান্য অধ্যাপকবৃন্দ। তাঁর চোখ বেয়ে অঝরে পানি ঝরছিলো। মনেহলো, একজন স্নেহময় পিতা তাঁর রক্তাক্ত পুত্রের জন্য কাঁদছেন। অথচ তিনি বাঙ্গালিসমাজের কেউ ছিলেন না। উর্দুভাষী এই পন্ডিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়োজিতহবার পূর্বে করাচি বিস্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করছিলেন। মনে হলো, একজন দেবদূতের সামনেদাঁড়িয়ে আছি। ডান হাত সামান্য উচু করেসবাইকে শান্ত হতে ইশারা করলেন। মুহূর্তে পিনপতন নিস্তব্ধতা। ছাত্রদের উদ্দেশ্য করেতিনি যা বললেন তার মর্মার্থ হলো, তাঁর একজন প্রিয় ছাত্র আহত হওয়াতে তিনি অত্যন্ত ব্যথিতএবং ক্ষুদ্ধ। ছাত্ররা বিশ্ববিদ্যালয়ের সীমানার মধ্যে থেকে শান্তিপূর্ণভাবে বিক্ষোভকরছিলো। সরকারি বাহিনীর কোনো প্রয়োজন ছিলো না তাদের প্রতি গুলি করার। তিনি বিষয়টিনিয়ে জরুরিভিত্তিতে মাননীয় চ্যান্সেলরের (কুখ্যাত গভর্নর মোনেম খানের) সাথে আলাপকরবেন। সন্তোষজনক জবাব না পেলে তিনি পদত্যাগ করবেন। একই বছর আমি বিশ্ববিদ্যালয়েভর্তি হবার কিছুদিন পর শুনলাম ড. মাহমুদ হোসেন পদত্যাগ করে চলে গেছেন। মোনেম খানেরমত নোংরা রাজনীতিবিদের সাথে ড. মাহমুদের মত আত্মমর্যাদাসম্পন্ন ভদ্রলোকের মানিয়েচলা সম্ভব ছিলো না।
<br /><br />৪। এর পরের ঘটনা ১৯৬৫সনের সেপ্টেম্বর মাসের। ততদিনে ময়মনসিংহের ড. ওসমান গনি ড. মাহমুদ হোসেনের পরউপাচার্য হয়ে এসেছেন। ড. ওসমান গনিকে গুটিকয়েক এনএসএফ-পন্থী ছাত্র ও মুসলিমলীগপন্থী শিক্ষক ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের কেউই মনেপ্রাণে গ্রহণ করতে পারেননি। আমিওপারিনি। হঠাৎ সেপ্টেম্বর মাসের ৬ তারিখ সকালে আমি যে হলে থাকতাম সে হলে একদুর্ঘটনা ঘটে। আমি ওয়েষ্ট হাউসে তিন তলার যে রুমে থাকি তার পাশের গোসলখানার লেট্রিনেরমধ্যে একজন আগন্তুক অতিথি ব্লেড দিয়ে নিজের গলার একপাশ ও শরীরের অন্যান্য কিছুঅঙ্গ কেটে আত্মহত্যা করে। ঠিক একই সময়ে আমি এবং আরও দু’জন ছাত্র পাশের গোসলখানায়শাওয়ার নিচ্ছিলাম। একজন ছাত্র শেভ করছিলো। স্বাভাবিকভাবেই হৈচৈ ও চাঞ্চল্য হলো।পুলিশ এলো, কেইস হলো। এসব কেইসে আজকের অনেক পুলিশের মত তখনকার পুলিশও আমরা যারাঘটনার সময় গোসলখানায় ছিলাম তাদেরকে আসামি বানিয়ে হত্যা মামলা ঠুকে দিলো। শুরু হলোপুলিশি হয়রানি। কথাটা প্রভোস্টের মাধ্যমে উপাচার্য ড. ওসমান গনির কানে গেলো। উপাচার্যনিজ উদ্যোগে ঢাকার তৎকালীন বাঙ্গালি পুলিশ সুপারের সাথে বিষয়টি নিয়ে আলাপ করেন। আরক’দিন বাদেই আমাদের অনার্স ফাইনাল পরীক্ষা। থানার দারোগারা যেন আমাদের হয়রানি নাকরে সেদিকে নজর রাখার জন্য তিনি পুলিশ সুপারকে অনুরোধ করেন। একদিন সন্ধ্যাবেলাপুলিশ সুপার সিভিল কাপড়ে আমাদের হলে এসে আমাদের সাথে দেখা করলেন। উপাচার্য তাঁকেকি বলেছেন, তা জানালেন। দারোগারা কোনো হ্যারাস করবে না বলে নিশ্চয়তা দিলেন।নিশ্চিন্তভাবে পরীক্ষার পড়া চালিয়ে যাবার জন্য বড় ভাইয়ের মত উপদেশ দিয়ে চলে গেলেন।এরপর মামলার কি হয়েছিলো জানি না, তবে দারোগারা আর আমাদের ধারেকাছে আসেনি। রাজনৈতিকবিবেচেনায় ড. ওসমান গনিকে ভিসি হিসেবে মেনে নিতে না পারলেও আভিভাবক হিসেবে তাঁরঅবদান কখনও অস্বীকার করা যাবে না।
<br /><br />৫। পৃথিবীর সকলপ্রাণীর সন্তান জন্ম নেবার পর খাদ্য ও নিরাপত্তা পেলে নিজেনিজে বেড়ে উঠে বাবামারমত প্রাণীতে পরিণত হয়। একমাত্র মানুষের সন্তান এর ব্যতিক্রম। সে জন্ম নিয়ে একাএকাবড় হয়ে ‘মানুষ’ হতে পারে না। তাকে মানুষ হতে হলে খাদ্য ও নিরাপত্তা ছাড়া আরও কিছুরপ্রয়োজন। জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে এই আরও কিছুর কিছুটা সে পায় তার বাবামার কাছথেকে, অনেকটা পায় শিক্ষক বা গুরুর কাছ থেকে, আর কিছুটা পায় সমাজ ও পরিবেশ থেকে।প্রাচীণ গ্রীক দার্শনিক এরিস্টটল বলেছেন: “Those who educate children well are more to be honored thanthey who produce them; for these only gave them life, those the art of livingwell.” (যাঁরা মানবসন্তানকে সুশিক্ষা প্রদান করেন তাঁদেরকে সন্তানের জন্মদাতাদের চাইতে বেশি সন্মানকরতে হবে। কেননা, জন্মদাতরা সন্তানকে কেবল জীবন দান করেন, শিক্ষকরা দান করেন উন্নতজীবন যাপনের কৌশল।) এজন্যই আদিকাল থেকে আজপর্যন্ত পৃথিবীর সব সমাজে গুরুর কাজটি এত কঠিন, গুরুত্বপূর্ণ এবং মর্যাদাসম্পন্ন। একজনছাত্র, তা সে প্রাথমিক অথবা বিশ্ববিদ্যালয় যে পর্যায়ের হোক না কেন, নিজের গুরুনিজে নির্বাচন করে না। পিতামাতা, সমাজপতি এবং রাষ্ট্র তার জন্য কাজটি করে দেয়। আমাদেরদেশে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যে বিশৃঙ্খল অবস্থা বিরাজ করছে তার সবগুলোরউপাচার্যকে চূড়ান্ত পর্যায়ে সরকার নিয়োগ দিয়ে থাকেন। পিতামাতা, অভিভাবক ও সমাজেরপক্ষ থেকে সরকার এ রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালন করেন। দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, আমাদেরনির্বাচিত সরকার প্রধানরা, অন্য প্রায় সব রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে যেমন,পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রধান নির্বাচনের ক্ষেত্রেও তেমন নিজ দলীয় প্রভাব থেকেনিজেকে মুক্ত রাখতে পারছেন না। দেশের স্বার্থের উপর নিজের দলের স্বার্থকে স্থানদিচ্ছেন। নিজ দলের সমর্থক যোগ্য, দক্ষ এবং আত্মমর্যাদাসম্পন্ন বিশ্ববিদ্যালয়েরসিনিয়র অধ্যাপক, যাঁরা সফল উপাচার্য হতে পারতেন, থাকতেও অযোগ্যদের একের পর একউপাচার্য নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। এর একটাই কারণ হতে পারে। আর তা হলো, প্রত্যেক সরকারপ্রধানই (যিনি নিজ দলেরও প্রধান বটেন) চান একমাত্র দলবাজ, তল্পিবাহক, মোসাহেব জাতীয়অধ্যাপকরা উপাচার্য নিযুক্ত হন। যাতে করে তাঁরা উপাচার্যদের মাধ্যমে পাবলিকবিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র রাজনীতি এবং শিক্ষক রাজনীতি নিজ দলের নিয়ন্ত্রণে রাখতেপারেন।
<br /><br />৬। সকল সিনিয়র অধ্যাপকউপাচার্য হবার জন্য উপযুক্ত নন। তবে সকল উপাচার্যকে অবশ্যই মেধাবী অধ্যাপক, গবেষকএবং পন্ডিত হতে হয়। কথাটার একটু ব্যাখ্যা দেওয়া প্রয়োজন, নইলে ভুল বোঝাবুঝি হতেপারে। একটি বিশ্ববিদ্যালয় অন্য যেকোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে আলাদা ভূমিকা পালনকরে। অন্য সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কাজ প্রধানত: জ্ঞান বিতরণ করা, শিক্ষার্থীকেআলোকিত করা। অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ প্রথমত: গবেষণার মাধ্যমে জ্ঞান সৃষ্টিকরা, সভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। দ্বিতীয়ত: শিক্ষার্থীকে জ্ঞান বিতরণের মাধ্যমে শিক্ষিতকরা, এবং আলোকিত করে গড়ে তোলা। এসব কাজে একজন অধ্যাপক চমৎকার নৈপুণ্য অর্জন করতেপারেন। তারপরও তিনি উপাচার্য হবার জন্য উপযুক্ত না-ও হতেপারেন। একজন উপাচার্যকেসফল অধ্যাপক হবার পাশাপাশি একজন দক্ষ প্রশাসক হতে হয়। তাঁর পক্ষে একদিকেবিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা কার্যে একাডেমিক নেতৃত্ব প্রদান করে জ্ঞান সৃষ্টিতে ভূমিকাপালন করা জরুরি। তিনি যদি তা না পারেন, বা না করেন, তাহলে তাঁর অধীনস্ত শিক্ষকরাএবং ছাত্ররা তাঁর নেতৃত্ব মন থেকে মেনে নিবেন না। অন্যদিকে তাঁকে বিশ্ববিদ্যালয়েরসার্বিক প্রশাসনকর্ম তদারকি করার জন্য একজন দক্ষ প্রশাসক হতে হয়। না হলে,বিশৃঙ্খলা এবং অব্যবস্থা বিশ্ববিদ্যালয়ের অগ্রযাত্রার দ্বার রুদ্ধ করে দেয়। একজনউপাচার্যকে তাই পান্ডিত্য এবং প্রশাসন উভয় ক্ষেত্রেই দক্ষ হওয়া প্রয়োজন। এযুগেএকজন সফল প্রশাসককে একজন সফল নেতা হতে হয়। সফল নেতা হবার জন্য কী কী গুণ থাকাপ্রয়োজন তা ম্যানেজমেন্টের যেকোনো পাঠ্য বইয়ে পাওয়া যাবে। দক্ষতা, যোগ্যতা ওঅভিজ্ঞতার পাশাপাশি জ্ঞান-বুদ্ধি, বিবেক-বিবেচনা, সততা-সত্যশীলতা,মহানুভবতা-উদারতা এসব গুণের অন্যতম।
<br /><br />৭। আজকাল সরকার বা দলপ্রধানরা মনে করেন, যেসব শিক্ষক তাঁর দলের প্রতি অনুগত থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকরাজনীতিতে সফলতা দেখিয়ে শিক্ষক সমিতির সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক ইত্যাদি পদেনির্বাচিত হন তাঁরা তাঁদের নেতৃত্বের গুণে সফল উপাচার্য হবেন। বিশ্ববিদ্যালয়েশিক্ষক রাজনীতি করে নেতা হতে গেলে যে কতটা দলবাজী,ধোকাবাজী ও মোসাহেবী করতে হয়, তাতাঁরা বিবেচনায় রাখেন না। তাই আমরা দেখতে পচ্ছি, সকল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে একরেপর এক আত্মমর্যাদাহীন দলবাজ, মোসাহেব শিক্ষক উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পাচ্ছেন।ফলশ্রুতিতে অনেক অধ্যাপক পেশাগত কাজে মনোনিবেশ না করে উপাচার্য হবার আশায় শিক্ষকরাজনীতিতে মত্ত হয়ে থাকছেন। যাঁদের বিরুদ্ধে পাঠদান এবং গবেষণাকর্মে ফাঁকি দেওয়া,থিসিস নকল করা, ছাত্রদের পরীক্ষার রেজাল্ট হেরফের করা, ছাত্রী নির্যাতন করাইত্যাদি অভিযোগ শোনা যায়, তাঁদের বেশিরভাগই এমন দলবাজ শিক্ষক। এদের মধ্য থেকে যারাউপাচার্য হন তাঁরা নিজ দলের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের, যাঁরা এসব অপরাধ করেন তাঁদের,কোনো বিচার তো করেনই না, বরং দেখা যায় প্রশ্রয় দিচ্ছেন। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেদিনদিন বিশৃঙ্খলা, নৈরাজ্য ও অপরাধ বেড়ে চলছে।
<br /><br />৮। একটা সময় ছিলো যখনকিছুকিছু গুরুত্বপূর্ণ সরকারি পদে, যেমন হাইকোর্টের বিচারপতি, রাষ্ট্রদূত,উপাচার্য ইত্যাদি পদে, নতুন নিয়োগ পাওয়ালোকদের সংক্ষিপ্ত জীবনবৃত্তান্ত সরকারি উদ্যোগে পত্রিকায় ছাপা হতো। আজকাল তেমনটাআর চোখে পড়ে না। হয়তো আজকাল যাঁরা এসব পদে নিয়োগ পাচ্ছেন তাঁদের পক্ষে রাজনৈতিকবিবেচনা ছাড়া আর কিছুই কাজ করে না। তাঁদের না আছে তেমন যোগ্যতা, গৌরব বা সৌরভ যাজানতে পেরে জনগণ তুষ্টি লাভ করতে পারে। অন্যদের বেলায় না হোক, অন্তত: উচ্চ আদালতেরবিচারপতি ও উপাচার্যদের জীবনবৃত্তান্ত এখনও পত্রিকায় প্রকাশ হওয়া উচিত বলে আমি মনেকরি। বিচারপ্রার্থী ও শিক্ষার্থীদের বিশ্বাস ও আস্থা বাড়াবার জন্য এটার প্রয়োজনকখনও ফুরিয়ে যাবে না।
<br /><br />৯। আমাদের সমাজেআবহমানকাল ধরে সিনিয়র শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের কাছে পিতামাতার মত পূজনীয়। পিতামাতাতাঁর সন্তানকে কোন আইনের বলে শাসন করবেন তা কোনো আইনের বইতে লেখা নেই। এ নিয়েপার্লামেন্টেও আইন পাশ হয় না। তাই বলে কোনো পিতামাতা প্রয়োজনে সন্তানকে শাসন করাথেকে বিরত থাকেন না। কোনো সুসন্তানও সে শাসনের অবাধ্য হয় না এই বলে যে, কোন আইনেলেখা আছে যে তোমরা আমায় শাসন করবে? একইভাবে শিক্ষকরা আমাদের যুগযুগ ধরে আদরেরসাথেসাথে প্রয়োজনে শাসন করে আসছেন। শিক্ষক দু’ভাবে এ শাসন করতে পারেন। পিতামাতারজন্য আইনের বই না থাকলেও, শিক্ষকের জন্য রাষ্ট্র আইনের বই বানিয়ে দিয়েছে। তিনিইচ্ছে করলে আইনের বই দেখিয়ে, গায়ের জোরে, শিক্ষার্থীকে শাসন করতে পারেন। অথবা,তিনি পিতামাতার মত আইন না দেখিয়ে শাসন করতে পারেন। এজন্য পিতামাতা যে কর্তৃত্ববলেসন্তান শাসন করেন শিক্ষককে সে কর্তৃত্ব অর্জন করতে হয়। এ কর্তৃত্ব হচ্ছে পিতামাতারমরাল অথারিটি। অনেকে বলেন ডিভাইন অথারিটি। যা প্রবাহিত হয় পিতামাতার নৈতিক অবব্থান থেকে। একজন শিক্ষক যদি নিজ মানবিকগুণের বলে সে অবস্থানে পৌছতে পারেন, তাহলে শিক্ষার্থী শাসন করার জন্য তাঁকে আইনেরবইয়ের পাতা ঘাটতে হয় না, যেমনটি আজকাল হচ্ছে। আমার সৌভাগ্য, প্রাথমিক বিদ্যালয়থেকে বিশ্ববিদ্যালয জীবনে নৈতিক কর্তৃত্ববান অনেক শিক্ষক আমি পেয়েছি, যাঁরা আমাকেপিতামাতার মত আদর দিয়ে শাসন করেছেন। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, আজও তেমন শিক্ষক আমাদেরবিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আছেন। তবে তাঁরা আত্মমর্যাদা বিসর্জণ দিয়ে দলবাজী করেন না, পদও পদবীর লোভে রাজনৈতিক নেতাদের মোসাহেবী করেন না। কোনো সরকার প্রধান যদি, দলবাজীরউর্ধে উঠে, দলের উপর দেশের স্বার্থকে স্থান দিয়ে, যথাযথ সম্মানের সাথে তাঁদেরকেবিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হবার জন্য আহ্বান করেন তাহলে, সবাই না হলেও, দেশেরস্বার্থের কথা বিবেচনা করে অনেকেই এগিয়ে আসবেন। একমাত্র এভাবেই আমাদেরবিশ্ববিদ্যালয়গুলো বর্তমান অচলাবস্থা থেকে মুক্তি পেতে পারে। বর্তমান ও ভবিষ্যতেরসকল সরকার প্রধানদের কাছে বিনীত প্রার্থনা, যথেষ্ট হয়েছে, আর না। যাঁর কাজ তাঁকে করতেদিন। উপযুক্ত ব্যক্তিদেরকে উপাচার্য নিয়োগ দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে রক্ষা করুন।জনগণের নির্বাচিত সরকার প্রধান হিসেবে কেবল আপনারাই পারেন দেশটাকে পচন থেকে, ধ্বংশথেকে রক্ষা করতে।
(লেখক ঝিনাইদহ ক্যাডেটকলেজ এবং ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষ)Ashraf's columnhttp://www.blogger.com/profile/16382744974160016625noreply@blogger.com1tag:blogger.com,1999:blog-29831725.post-54601694858248961122011-06-13T00:00:00.000-07:002011-06-13T00:07:23.927-07:00সৈনিকের কৈফিয়ত১। ১৯৮৩ সনের কথা। জে: এরশাদের মার্শাল ল’র জমানা। আমি তখন ঢাকায় আর্মি হেডকোর্য়াটার্সে কাজ করি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র হিসেবে প্রাণের টানে প্রায়ই বিশ্ববিদ্যালয় পাড়ায় বেড়াতে যেতাম। উদ্দেশ্য, আমার শ্রদ্ধেয় স্যারদের সালাম জানানো আর পুরানো বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেওয়া। তাঁদের মধ্যে অনেকে আর্মি, মার্শাল ল’, সিভিল-মিলিটারি সম্পর্ক, দেশের রাজনৈতিক অবস্থা, এসব নিয়ে আমাকে প্রশ্ন করতেন। আমার মাধ্যমে সম্ভবত সৈনিকদের মনোভাব জানার চেষ্টা করতেন। একদিন আমার অত্যন্ত শ্রদ্ধেয় স্যার কেমেস্ট্রি ডিপার্টমেন্টের প্রফেসর আব্দুল জব্বার মিয়ার সাথে দেখা হলো। ক’দিন আগে আর্মির সৈনিকরা (এই লেখায় অফিসার এবং সিপাহিদের এক কথায় সৈনিক বলে উল্লেখ করা হয়েছে।) অরাজক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ঢুকে ছাত্র ও শিক্ষকদের বেধড়ক মারপিট করেন। দেখা মাত্রই স্যার মুখ কালো করে অত্যন্ত মর্মাহতভাবে আমাকে বললেন, “ তোমাকে, এবং অন্যান্য পরিচিত যারা আর্মিতে কাজ করে তাদেরকে, যখন সিভিল ড্রেসে ডিউটির বাইরে সামাজিক পরিবেশে দেখি, তখন তোমরা সবাই কথায় ও কাজে এত ভদ্র ও বিনয়ী। অথচ সেই তোমরাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ঢুকে কেমন করে এমন নারকীয় তান্ডব ঘটালে ? কেমন করে ছাত্রদেরকে, যারা তোমাদের ছোট ভাইয়ের মত তাদেরকে, এমন নিমর্মভাবে পেটালে ? কেমন করে সম্মানিত শিক্ষকদের গায়ে হাত তুলতে পারলে ? ১৯৭১ সনের আগে পাকিস্তান আর্মির সৈনিকরা এমন করতো। তখন বুঝতাম, ওরা বর্বর ভিনদেশি শাসক, এমনটা করতেই পারে। কিন্তু আমি কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছিনা, কেমন করে তোমরা, আমাদের নিজেদের ছেলেরা, এসব করতে পারো ?”<br /><br />২। সেদিন আমার প্রিয় জব্বার স্যারকে তাঁর প্রশ্নের জবাব খোলাখুলি দিতে পারিনি। কিছু কৈফিয়ত অবশ্য দিয়েছিলাম। বলেছিলাম, “ স্যার, ব্যক্তিজীবনে আমরা সৈনিকরা প্রত্যেকে একেকজন মানুষ। কারও ছেলে, কারও বাবা, কারও ভাই বা কারও স্বামী। ইউনিফর্ম পরে কর্তব্য করতে আসলে এসব কথা মনে রাখা যায় না। তখন যেকোনো মূল্যে, জীবন দিয়ে হলেও, কমান্ডারের হুকুম আমাকে পালন করতে হয়। যথাযোগ্য কর্তৃপক্ষ না ডাকলে আর্মি নিজ থেকে কখনও দাঙ্গা দমনের কাজে নিজকে নিয়োগ করতে পারে না। অন্য সকল সরকারি বাহিনী যখন ব্যর্থ হয় শুধু তখনই উন্মত্ত জনতা নিয়ন্ত্রণ করার জন্য ‘ ইন এইড অব সিভিল পাওয়ার ’ সরকারের আর্মি ডাকার আইনি আধিকার আছে। তাই এ কাজসহ অন্য যেকোনো কাজে আর্মির পক্ষে ব্যর্থতা মেনে নেয়া সম্ভব নয়। আর্মি ব্যর্থ হলে সরকারের হাতে শক্তি প্রয়োগের আর কোনো হাতিয়ার অবশিষ্ট থাকে না। একথা মনে রেখেই সৈনিকরা অর্পিত কর্তব্য পালন করেন। এর মধ্যে রাজনৈতিক বা অন্য কোনো ভাবনা কাজ করে না। সৈনিকের হাতে লাঠি বা ব্যাটন রাখার প্রাধিকার নেই, রেওয়াজও নেই। উন্মত্ত এবং মারমুখী জনতা নিয়ন্ত্রণ করার জন্য তাঁকে বাধ্য হয়ে হাতের রাইফেল ব্যবহার করতে হয়। তা সে পেটানোর জন্য হোক, বা গুলি করার জন্য হোক। কোথায় কখন পুলিশি কাজ করার জন্য আর্মি ডাকা হবে সে বিচারের ভার আর্মির উপর বর্তায় না। তাই, কখনও কখনও আর্মির কাজে বাড়াবাড়ি পরিলক্ষিত হতে পারে। তাছাড়া আর্মি কোনো রাজনৈতিক সংগঠন বা ক্লাব নয় যেখানে ভোটাভোটি করে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। আর্মিতে কমান্ডারের কথাই শেষ কথা। রাষ্ট্রর স্বার্থে এবং পেশাগত প্রয়োজনে সৈনিকের এমন হতে হয়।” জানি, স্যার আমার কৈফিয়তে সন্তুষ্ট হতে পারেননি। স্যার হয়ত বুঝতে পেরেছিলেন, আর্মির একজন কর্মরত অফিসার হিসেবে আমার পক্ষে মন খুলে জবাব দেওয়া সম্ভব ছিলো না। (একজন কর্মরত আর্মি অফিসারের পক্ষে আজও তা সম্ভব নয়।) তাই তিনি সেদিন এ নিয়ে আর কথা বাড়াননি। চাকুরি জীবনে, এবং তারপরে, সিভিলিয়ান বন্ধুবান্ধব ও আত্মীয়স্বজনরা আমাকে ঘুরিয়েফিরিয়ে বহুবার জব্বার স্যারের মত, সিভিল-মিলিটারি সম্পর্ক নিয়ে, অনেক গুরত্বপূর্ণ প্রশ্ন করেছেন। এখনও করে থাকেন। এসব প্রশ্ন আজও মাঝেমাঝে আমাকে তাড়া করে। <br /><br />৩। লক্ষ্য করা গেছে, আমাদের সমাজের বেশ কিছু দায়িত্বশীল ব্যক্তি আর্মি এবং এর সদস্যদের বিরুদ্ধে প্রায়শ: অত্যন্ত দায়িত্বজ্ঞানহীনভাবে মন্তব্য করে থাকেন। এসব মন্তব্য অনেক সময় জ্ঞান ও যুক্তি তো দূরের কথা সভ্যতা-ভব্যতা এমনকি সুরুচির সীমানা অতিক্রম করে যায়। যেমন, বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন নামকরা সিনিয়র অধ্যাপককে জানি যিনি তাঁর লেখায় আর্মির সদস্যদের কখনও সৈনিক বা অফিসার বলে উল্লেখ করেন না। অত্যন্ত তুচ্ছভাবে তাঁদেরকে তিনি “বুটওয়ালা”, “বন্দুকওয়ালা”, “উর্দিওয়ালা” ইত্যাদি বলে উল্লেখ করেন। (এখন অবশ্য তাঁর পসন্দের দল সরকারে আছে বলে এসব বলা আপাতত বন্ধ রেখেছেন।) ১৯৮৩ সালে কোনো এক বিকেলে আমার এক ভাবীর (বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসরের স্ত্রী) বাসায় গেলে তিনি রাগান্বিতভাবে এই বলে আমাকে চার্জ করলেন, “ ভাই, আপনারা (সৈনিকরা) কেমন লোক ? আর্মির সেপাইরা সেদিন মিছিল থেকে ছাত্রদের ধরে নিয়ে ব্লেড দিয়ে হাত-পা কেটে তাতে লবন লাগিয়ে দিয়েছে! কেমন করে আপনারা এত নিষ্ঠুর হতে পারেন ?” শান্তভাবে ভাবীকে জিজ্ঞাসা করলাম, “ আপনি নিজ চোখে দেখেছেন ?” তিনি বললেন, “ না, অন্য একজন বলেছেন।” আবার জিজ্ঞাসা করলাম, “তিনি কি নিজ চোখে দেখেছেন ?” ভাবী জবাব দিলেন, তা তিনি জানেন না। যাহোক, ভাবীকে বললাম, “কোনো সৈনিকের পক্ষে এ ধরনের কাজ ইচ্ছে করলেও করা সম্ভব নয়। কারণ, কাজটা শুধু বেআইনি নয়, অমানবিকও বটে। এমন কাজ করতে গেলে তাঁর কমান্ডার এবেং সঙ্গী সৈনিকরা অবশ্যই বাধা দিবেন। তর্কের খাতিরে যদি ধরে নেয়া যায়, কোনো একজন সৈনিক পাগল বা অমানুষ। তাই বলে সব সৈনিক তা নয়। তাছাড়া এমন কাজের জন্য সৈনিকটিকে ব্যারাক থেকে আসার সময় ব্লেড এবং লবন সাথে করে আনতে হবে !” পরিশেষে ভাবীকে বিষয়টি বোঝাতে পেরেছিলাম। তারপরও বাংলাদেশে এমন লোক দেখেছি যাঁরা এসব উদ্ভট গল্পে বিশ্বাস করে থাকেন।<br /><br />৪। দেশে যখন মার্শাল ল’ জারি থাকে, অথবা তথাকতিত গণতান্ত্রিক বেসামরিক সরকার আর্মির উপর নির্ভর করে দেশ শাসন করে, যখন আর্মিকে শোষণ ও নিপীড়ণের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হতে দেখে, তখন স্বাবাভাবিকভাবে মানুষ আর্মির উপর ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে। সৈনিকদের সর্ম্পকে অনেক ঢালাও বিরূপ মন্তব্য করে থাকে যা বহুলাংশে সঠিক ও তথ্যনির্ভর নয়। জে: এরশাদের মার্শাল ল’র জমানায় আমার নিজ কানে এমন অনেক মন্ত্ব্ব্বব্য শুনতে হয়েছে। আর্মি সর্ম্পকে বহুল প্রচলিত একটি ভুল ধারণা হলো, আর্মির অফিসার ও সৈনিকরা অশিক্ষিত বা অল্প শিক্ষিত। হয়তো একশ’ বা দু’শ’ বছর আগে, যখন সমাজের প্রায় সবাই অশিক্ষিত ছিলো, এমনটা বলার সুযোগ ছিলো। কিন্তু আজকের পরিন্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন। স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশ আর্মির সকল কোরে (শাখায়) সিপাহি পদে ভর্তির সর্বনিম্ন শিক্ষাগত যোগ্যতা এসএসসি অথবা এইচএসসি পাশ। অনেকে তার চাইতে বেশি শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে সিপাহি পদে ভর্তি হন। এদের মধ্যে যেসব সিপাহি এএমসি (আর্মি মেডিক্যাল কোর), এডিসি (আর্মি ডেন্টাল কোর), (সিভিল) ইন্জিনিয়ার্স কোর, ইএমই (ইলেকট্রিক্যাল এবং মেকানিক্যাল ইন্জিনিয়ার্স কোর) এবং অন্যান্য টেকনিক্যাল কোরে ভর্তি হন তাঁদেরকে তিন-চার বছর মেয়াদি পেশাগত ট্রেইনিং কোর্স সম্পন্ন করতে হয়। এসব কোর্স বাইরের প্যারামেডিক্যাল কোর্স, ডিপ্লোমা ইন্জিনিয়ারিং কোর্স, সার্ভেয়ার কোর্স ইত্যাদির সমতুল্য বলে সরকারিভাবে স্বীকৃত। এখানে বলে নেয়া ভালো, আধুনিক আর্মিতে সত্যিকার অর্থে ননটেকনিক্যাল কোর বলে কিছু নেই। বর্তমান যুগে তথাকথিত ননটেকনিক্যাল ইনফ্যানাট্রি কোরের একজন সিপাহিকেও গাইডেড মিসাইল, এক্সপ্লোসিভস, বাতাসের গতিবেগ দেখে অস্ত্রের নিশানা সংশোধণ ইত্যাদি অনেক বিষয়ে তাত্বিক ও প্রায়োগিক জ্ঞান লাভ করতে হয়।<br /><br />৫। এএমসি, এডিসি, ইন্জিনিয়ার্স, ইএমই’সহ সকল টেকনিক্যাল কোরে অফিসার পদে যোগদানের পূর্বযোগ্যতা সংশ্লিষ্ট বিষয়ে গ্রাজুয়েশন ডিগ্রি। অথবা, যোগদানের পর, কোনো কোনো কোরে, নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে গ্রাজুয়েশন ডিগ্রি অর্জন। আর্মি এডুকেশন কোরে (এইসি) কমিশন লাভের জন্য দরখাস্ত করতে হলে প্রার্থীকে কমপক্ষে অনার্সসহ দ্বিতীয় শ্রেণীর মাস্টার্স ডিগ্রি থাকতে হয়। অপরদিকে ননটেকনিক্যাল কোরের অফিসারগণকে বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমি যোগদানের পূর্বশর্ত হিসেবে কমপক্ষে দ্বিতীয় বিভাগে এইচএসসি পাশ হতে হয়। আইএসএসবি (ইন্টার সার্ভিসেস সিলেকশন বোর্ড) নামক প্রতিষ্ঠান থেকে নেতৃত্বের যোগ্যতা সংক্রান্ত কঠিন পরীক্ষায় অবশ্যই কৃতকার্য হতে হয়। মিলিটারি একাডেমিতে দীর্ঘ দু’বছরের ট্রেইনিং শেষে কমিশন লাভের সাথেসাথে আবশ্যিকভাবে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আর্টস বা সাইন্সে গ্রাজুয়েশন ডিগ্রি অর্জন করতে হয়। অনেকে হয়ত জানেন না, বেসামরিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্রাজুয়েশন ডিগ্রি লাভের জন্য একজন প্রার্থীকে ন্যুনতম যে কয়টি বিষয় পড়তে হয় বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমি থেকে গ্রাজুয়েশন ডিগ্রি লাভের জন্য, তার চাইতে কম সময়ে, সব মিলিয়ে তার চাইতে অনেক বেশি মিলিটারি এবং একাডেমিক বিষয়ে পরীক্ষা দিয়ে পাশ করতে হয়। আজকাল ডিফেন্স সার্ভিসেস কমান্ড এন্ড স্টাফ কলেজ এবং ন্যাশনাল ডিফেন্স কলেজ থেকে বাংলাদেশ আর্মির বহু সংখ্যক অফিসার পেশাগত ঊচ্চতর ডিগ্রি ছাড়াও বিভিন্ন একাডেমিক বিষয়ে দেশি ও বিদেশি ইউনিভার্সিটি থেকে মাস্টার্স ও পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করছেন। বেসামরিক জীবনে একজন ডাক্তার, ইন্জিনিয়ার বা একাউন্ট্যান্ট যেমনভাবে বেসিক একাডেমিক যোগ্যতা এইচএসসি পাশ করে নিজস্ব পেশাগত বিষয়ে গ্রাজুয়েশন ডিগ্রি অর্জন করেন, ঠিক একইভাবে একজন কমিশনপ্রাপ্ত আর্মি অফিসার এইচএসসি পাশ করে সমরবিদ্যাসহ অন্যান্য বিষয়ে গ্রাজুয়েশন ডিগ্রি অর্জন করেন। এর পর, আশা করি, যাঁরা সৈনিকদের অশিক্ষিত বলে অবজ্ঞা করেন তাঁরা নিজেদের ভুল বুঝতে পারবেন।<br /><br />৬। তিন-চার দশক, বা তারও আগে, যাঁরা জনগণকে নেতৃত্ব দিতেন তাঁরা আর্মি বা অন্য কোনো পেশাকে অবজ্ঞা করতেন না, অন্তত প্রকাশ্যে নয়। অনেক বছর যাবত আমাদের আর্মির সদস্যরা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে শান্তি রক্ষার কাজে নিয়োজিত আছেন। সেসব দেশে তাঁরা অত্যন্ত সুনামের সাথে কর্তব্য পালন করে আন্তর্জাতিক মহলে অজস্র প্রশংসা কুড়িয়ে আসছেন। কিন্তু, অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, নিজ দেশে তাঁরা সমালোচিত হয়ে আসছেন। যাঁরা রাজনীতি করেন তাঁদের মধ্যে অনেককে আর্মি অফিসারদেরকে, বা পুরেো আর্মিকে লক্ষ্য করে প্রকাশ্যে অবজ্ঞাসূচক মন্তব্য করতে শোনা যায়। এসব রাজনীতিবীদদের পৃষ্ঠপোষক একশ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ী, সুশীল সমাজের সদস্য বলে পরিচিতে এঁদের কিছু অন্ধ স্তাবক এবং লেজুড় হিসেবে পরিচিত কিছু ছাত্রনেতা একাজে রাজনীতিবীদদের চাইতেও এককাঠি এগিয়ে থাকেন।<br /><br />৭। দেশে একাধিকবার মার্শাল ল’ জারি হবার কারণে একশ্রেণীর রাজনীতিবীদ হয়তো আর্মির উপর সহযবোধ্য কারণে বেজায় ক্ষেপে থাকতে পারেন। ক্ষ্যাপার আরও একটা কারণ হতে পারে ঈর্ষা। আজকালকার অধিকাংশ রাজনীতিবীদদের শিক্ষা ও মেধাগত যোগ্যতা, দক্ষতা, সততা, নেতৃত্বের গুণাবলী এবং ছাত্র জীবনে বেআইনি কাজকর্মের রেকর্ড ইত্যাদি বিবেচনা করলে তাঁদের বেশিরভাগই বাংলাদেশ আর্মির একজন নবীণ বা প্রবীণ চৌকশ অফিসারের মুখোমুখি দাঁড়াবার মত নৈতিক যোগ্যতা ও আধিকার রাখেন কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। অথচ এঁদের মধ্য থেকেই সংসদ সদস্য এবং মন্ত্রী নির্বাচন করা হয়। অত্যন্ত পরিতাপের সাথে লক্ষ্য করা যাচ্ছে, দলে অনেক শিক্ষিত, মেধাবী, দক্ষ, সত্ এবং সম্মানিত নেতা-কর্মী থাকা সত্বেও আজকাল বড় বড় রাজনৈতিক দলের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে তাঁদের নির্বাচনে নমিনেশন দেওয়া হয় না। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে নমিনেশন দেওয়া হয় অসাধু ব্যবসায়ী এবং চিহ্নিত ও দুর্নীতিপরায়ণ সন্ত্রাসীদের। রাজনৈতিক দলের সর্বোচ্চ পর্যায়ের নেতা-নেত্রীরা কেনো এমন করেন, তা বলার প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না। <br /><br />৮। যেকোনো দেশের আর্মি সে দেশের নিজস্ব উজ্জ্বল তরুণ নাগরিক দ্বারা সংগঠিত, নিজস্ব অর্থসম্পদ দ্বারা পরিচালিত এবং দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের অতন্দ্র প্রহরী। সম্পূর্ণ রাজনীতিমুক্ত একটি প্রতিষ্ঠান। যেকোনো সংগঠনের মত এর মধ্যও দুষ্ট লোক থাকতে পারে, সাবির্কভাবে সংগঠনের দুর্বলতাও থাকতে পারে। গালাগাল করে, বা বদনাম রটিয়ে এসবের সমাধান হয় না। নেতৃত্বে পরিবর্তন এনে, আইনে যথাযথ সংষ্কার এনে এবং প্রয়োজনবোধে দুষ্ট সদস্যকে সংশোধণ বা বহিষ্কার করে, অবস্থার উন্নতি করা অবশ্যই সম্ভব। যেসব ব্যক্তি কারনে-অকারণে, কথায়-কথায় জাতীয় সেনাবাহীনিকে অন্যায়ভাবে দোষারোপ করে থাকেন তাঁরা দেশের কী উপকার করছেন, জানিনা। তবে, দেশের বহি:শত্রু, যারা আমাদের দেশকে সামরিকভাবে দুর্বল দেখতে চায়, তাদের তাঁরা পরম সেবা করে আসছেন, একথা সহজে অনুমান করা যায়। দেশের ভিতর থেকে জেনেশুনে এ জঘণ্য কাজটি যাঁরা করে আসছেন তাঁরা আর যাই হোন দেশের হিতাকাংখী নন। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যেতে পারে, দুর্নীতির (এবং শৃঙ্খলা ভঙ্গের) কারণে আর্মিতে মাঝারি পর্যায়ের অফিসার ও সৈনিকদের শাস্তি প্রদান নিয়মিত ঘটনা। কিন্ত বাংলাদেশ আর্মিতে সিনিয়র অফিসারদের এসব কারণে শাস্তি দেওয়ার নজির নাই বললেই চলে। যেমন করে তাঁদের সিভিলিয়ান কাউন্টারপার্টরা দুর্নীতির অপরাধ থেকে সদা দায়মুক্ত থাকেন। এর কারণ একটাই। দুর্নীতিপরায়ণ রাজনীতিবীদরা সিনিয়র পদে নিজেদের দুর্নীতির কাজে সহায়ক হিসেবে এসব দুর্নীতিপরায়ণ সামরিক ও বেসামরিক অফিসারদের নিয়োগ দিয়ে থাকেন। <br /><br />৯। আমার বারবার মনে হয়েছে, আর্মি সম্পর্কে মানুষের ভুল ধারণা দূর করতে, এবং আর্মির বিরুদ্ধে প্রচারণার জবাব দেওয়ার জন্য উপরি উক্ত গুরত্বপূর্ণ প্রশ্নেসমূহের জবাব দেওয়া প্রয়োজন। আর্মিতে ৩২ বছর চাকুরি করার পর ১১ বছর আগে অবসর নিয়েছি। মনে হচ্ছে, জীবনের পরন্ত বেলায় এসে এখন নিরাসক্ত মনে ঠান্ডা মাথায় এসব প্রশ্নের উত্তর নির্মোহভাবে দেওয়া আমার জন্য সহজ হবে। একজন কর্মরত সৈনিকের পক্ষে এসব প্রশ্নের জবাব দেওয়া সম্ভব নয়। আর্মি অ্যাক্ট তাঁকে সে অনুমতি দেয় না। তাঁর পক্ষ থেকে জনগণকে সকল প্রশ্নের জবাব দেওয়ার একমাত্র এখতিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রনালয়ের অধীন আইএসপিআর (আন্ত:বাহীনি গণসংযোগ পরিদপ্তর) নামক একটি সরকারি অফিসের। প্রতিরক্ষামন্ত্রী স্বয়ং অফিসটি সরাসরি নিয়ন্ত্রণ করেন। গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় এমনটি হওয়া ন্বাভাবিক এবং কাম্য। কিন্তু সমস্যা হয় যখন শাসন ব্যবস্থা সত্যিকারের গণতান্ত্রিক না হয়ে অন্য কিছু হয়। দেশে যখন সামরিক শাসন থাকে, অথবা গণতন্ত্রের আবরণে স্বৈরতান্ত্রিক শাসন ব্যবন্থা কায়েম থাকে তখন প্রতিরক্ষামন্ত্রী (উল্লেখ্য, বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক সরকারের প্রধানমন্ত্রীরা গত দু’দশক ধরে একের পর একে প্রতিরক্ষা মন্ত্রনালয়টি নিজের হাতে রেখে আসছেন।) আর্মির, তথা রাস্ট্রের, স্বার্থ ও সুনামের চাইতে নিজের রাজনৈতিক ফায়দাকে বেশি প্রাধান্য দিয়ে থাকেন। এধরনের শাসকগোষ্ঠি আর্মিকে সবসময় অত্যাচার, শোষণ ও নিপীড়ণের হাতিয়ার হিসেবে যথেচ্ছ অপব্যবহার করে সবশেষে সব দোষ আর্মির ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে থাকেন। আর্মিকে জনগণের বিপক্ষে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে নিজেদের হীন রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিল করতে এরা কুন্ঠা বোধ করেন না। আইএসপিআরকে আর্মির অনুকূলে ব্যবহার না করে নিজেদের উদ্দেশ্য হাসিলে ব্যবহার করেন। বৃটিশ শাসকরা এবং পরে পাকিন্তানিরা সহজবোধ্য কারণে তাই করেছে। কিন্তু প্রশ্ন উঠে, যখন দেখি ইংরেজ ঔপনিবেশিক শাসকরা বৃটিশ ইন্ডিয়ান আর্মিকে অন্যয়ভাবে দাবিয়ে রাখার জন্য যে আইন প্রনয়ণ করেছিলো (ওদের নিজের দেশের আর্মির জন্য স্বাধীন দেশের উপযোগী আইন সব সময়ই ছিলো, এবং আজও আছে) সেই একই আইন ১৯৭১ সনের ৪০ বছর পর আজও প্রয়োগ করা হচ্ছে বাংলাদেশ আর্মি পরিচালনার জন্য। এ প্রশ্নের উত্তর খুব সহজ। স্বাধীন বাংলাদেশের শাসকশ্রেণী সামরিক, বেসামরিক স্বৈরাচারী অথবা গণতান্ত্রিক যে নামেই দেশ শাসন করুন না কেন, তাঁরা সবাই স্বৈরতান্ত্রিক শাসনে বিশ্বাস করেন। সে কারণে তাঁরা আজ পর্যন্ত বৃটিশ ইন্ডিয়ান আর্মির আইনের শুধু শিরোনাম পাল্টে আসছেন। ভিতরের ধারা-উপধারা সংশোধণ করছেন না। একটি স্বাধীন গণতান্ত্রিক দেশের আর্মির জন্য নতুন করে উপযোগী আইন ইচ্ছাকৃতভাবে প্রনয়ণ করছেন না। আজও যদি আর্মির একজন সৈনিককে অন্যায়ভাবে বা ভুল করে সামরিক আদালতে শাস্তি, এমনকি মৃত্যুদন্ড, দেওয়া হয় তিনি তার বিরুদ্ধে দেশের সব্বোর্চ্চ আদালতে কোনো আপিল করতে পারেন না।<br /><br />১০। আমি যেসব বেসামরিক ব্যক্তির সাথে এসব বিষয় নিয়ে আলাপ করেছি তাঁরা প্রায় সবাই একটি বিষয়ে ভুল করেন বলে আমার মনে হয়েছে। তাঁরা ভুলে যান, পৃথিবীতে আর্মি হচ্ছে একমাত্র রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান যেখানে কিভাবে দ্রুত এবং অধিক হারে মানুষ (নামক শত্রু সৈন্য) হত্যা করা যায় তার কৌশল আইনানুগভাবে শেখানো হয়। উপরওয়ালার আদেশ জীবন দিয়ে হলেও পালন করবো, প্রতিটি সৈনিককে এইমর্মে শপথ গ্রহণ করতে হয়। রাষ্ট্রের আর কোনো বিভাগের কর্মচারিকে, প্রয়োজন নেই বলে, এমন ট্রেইনিং নিতে হয় না, এমন শপথ নিতে হয় না। ধরা যাক, দেশের কোথাও শত্রু সৈন্য দ্বারা আক্রান্ত হলো। সেখানকার বেসামরিক নাগরিক, সরকারি কর্মচারি, ডিসি-এসপি সবাই প্রাণ বাঁচাতে ঐ এলাকা ছেড়ে স্বেচ্ছায় চলে যেতে পারেন, কেউ বাধা দেবে না। কিন্তু আর্মির একজন কর্তব্যরত সৈনিক উপরওয়ালার হুকুম ছাড়া এক পা পিছিয়ে আসতে পারেন না। যদি আসেন, কোর্টমার্শালে তার মৃত্যুদন্ড পর্যন্ত হতে পারে। শত্রুর গুলি খেয়ে মরণ অবধারিত জেনেও তাঁকে তাঁর পজিশনে অটল থাকতে হয়। অন্যান্য পেশার সাথে সৈনিকের পেশার মূল পার্থক্য এখানেই। সৈনিকের পেশাগত প্রয়োজনে শুরু থেকে এই পার্থক্যের সৃষ্টি, যা আজ অব্দি পৃথিবীর সব দেশের সব আর্মিতে বিরাজ করছে। আর্মি অথবা এর কর্মরত সদস্যদের নিয়ে বাংলাদেশে যাঁরা চিন্তাভাবনা করেন, মন্তব্য করেন তাঁরা অনুগ্রহ করে আর্মির এই বৈশিষ্ট্যটি মনে রাখলে অনেক ভুল বুঝাবোঝি থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে।<br /><br />১১। এখানে প্রাসঙ্গিকভাবে প্রশ্ন উঠে, উপরওয়ালার সকল আদেশ কি মানতে হবে ? না। আইন বলে, শুধুমাত্র ল’ফুল অর্থাত্ আইনি আদেশ মানা বাধ্যতামূলক, আনল’ফুল বা বেআইনি আদেশ নয়। তত্ত্বগতভাবে কথাটা ভালোই শোনায়। কিন্তু ইতিহাস বলে, বান্তবে এমনটা অনেক সময় হয় না। সৈনিক তো দূরের কথা, উচ্চ আদালতের বিচারকরা পর্যন্ত স্বেচ্ছায় অথবা পরিস্থিতির চাপে নিজেদের নেয়া শপথ ভঙ্গ করে বেআইনি আদেশ পালন করেছেন, এমন নজির আমাদের দেশে বিরল নয়। বেআইনিভাবে আগত শাসককে তাঁরা শুধু শপথ বাক্য পাঠ করান না, তাঁর সকল আদেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করেন। এমন ঘটনা যখন ঘটে তখন একবারে চুপ থাকলেও পরবর্তিকালে সুবিধামত সময়ে একশ্রণীর বুদ্ধিজীবী শপথ ভঙ্গকারিদের বিরুদ্ধে উচ্চকন্ঠে কঠোর সমালোচনা করেন। একবার ভেবেও দেখেন না, ঘটনা ঘটার সময় চুপ করে থেকে তাঁরা নিজেরা নৈতিক অপরাধ করেছিলেন কিনা। <br /><br />১২। সাধারণ সৈনিকরা কোনো দেশে মার্শাল ল’ জারি করেন না। একটি দেশে প্রধানত তিনটি কারণে জেনারেলগণ মার্শাল ল’ জারি করে থাকেন। এক, ক্ষমতাসীন সিভিলিয়ান সরকারের সাময়িক দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে সুযোগসন্ধানী ও উচ্চাভিলাষী জেনারেলগণ মার্শাল ল’ জারি করেন । দুই, যখন সিভিলিয়ান সরকারের একপক্ষীয় চরম ব্যর্থতার কারণে রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, অভ্যন্তরীণ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, প্রশাসন এবং অর্থনীতি ধ্বংসের মুখোমুখি হওয়া সত্বেও ক্ষমতাসীন সরকার বিকল্প রাজনৈতিক শক্তির কাছে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ক্ষমতা হস্তান্তরে অস্বীকার করেন, তখন জেনারেলগণ দেশ, রাষ্ট্র ও জনগণের স্বার্থে মার্শাল ল’ জারি করেন। তিন, যখন শুধুমাত্র নিজেদের ক্ষুদ্র ব্যক্তিগত এবং দলীয় স্বার্থে ক্ষমতাসীন এবং বিরোধী পক্ষের রাজনৈতিক দলসমূহ এমনভাবে পরষ্পর দাঙ্গাহাঙ্গামায় লিপ্ত হয় যে রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, অভ্যন্তরীণ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, প্রশাসন এবং অর্থনীতি ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে এসে দাঁড়ায় তখন জেনারেলগণ দেশ, রাষ্ট্র ও জনগণের স্বার্থে মার্শাল ল’ জারি করেন। যখন দ্বিতীয় বা তৃতীয় কারনে মার্শাল ল’ জারি করা হয় তখন তার পেছনে সহজবোধ্যে কারণে দৃশ্যমানভাবে সর্বস্তরের জনগণের এবং সৈনিকদের অকুন্ঠ সমর্থন থাকে। <br /><br />১৩। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করা যেতে পারে, বাংলাদেশে আর্মি চীফরা দেশের সরকার প্রধান কর্তৃক নিয়োজিত হয়ে থাকেন। একাজটি সম্পূর্ণভাবে সরকার প্রধানের ব্যক্তিগত এখতিয়ার। দেখা গেছে, আমাদের দেশে পেশাগত দক্ষতা ও যোগ্যতার চাইতে নিয়োজিত জেনারেলের ব্যক্তিগত আনুগত্য, বাড়ি কোন জেলায়, কার আত্মীয় ইত্যাদিকে সবার উপরে স্থান দেওয়া হয়ে থাকে। বাংলাদেশে এমন নজিরও আছে যেখানে অবসরে যাওয়া একজন মেজর জেনারেলকে অবসর অবস্থা থেকে আর্মিতে ফিরিয়ে এনে প্রমোশন দিয়ে আর্মি চীফ বানানো হয়েছিলো। কারণ, তিনি ছিলেন তৎকালীন গণতান্ত্রিক সরকার প্রধানের নিকটাত্মীয়। পেশাগত দক্ষতা, যোগ্যতা এবং সত্যানুরাগিতার বিচারে যখন যে জেনারেলের আর্মি চীফ হওয়া উচিত ছিলো, অনেক ক্ষেত্রে, তাঁকে চীফ করা হয়নি। জানিনা, একটা কথা আমাদের দেশের সিনিয়র রাজনীতিবীদরা আজও কেনো বুঝতে পারছেন না যে, রাজনৈতিক বিবেচনায় আর্মি চীফ নিয়োগ দিয়ে আর্মিকে পলিটিসাইজ করার চেষ্টা করা কতো বড় ভ্রান্ত ধারণা, কতো বড় দেশবিরোধী কাজ। পেশাগতভাবে দক্ষ, রাজনৈতিক আনুগত্য মুক্ত, সত্ এবং দেশপ্রেমিক একজন আর্মি চীফ যতটা আনুগত্য নিয়ে একটি নির্বাচিত সরকার ও তার প্রধানকে রক্ষা করবে, একজন অদক্ষ ও রাজনৈতিকভাবে অনুগত আর্মি চীফের পক্ষে তা করা সম্ভব নয়। কারণ, যখন ক্রান্তিকাল উপস্থিত হয়, তখন সাধারণ সৈনিকরা কোনো অদক্ষ ও রাজনৈতিকভাবে অনুগত আর্মি চীফের কমান্ড মানতে চান না। সাম্প্রতিকালে মিশর এবং তিউনিসিয়া এর জ্বলন্ত নজির। <br /><br />১৪। ১৯৯০ সনের পর থেকে চালু হওয়া নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকারগুলো আর্মিকে নিয়ে একটি সর্বনাশা আত্মঘাতী খেলায় মেতে আছেন। যখন কোনো বড় একটি রাজনৈতিক দল নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতায় আসীন হয়, তখন পূর্ববর্তী (বর্তমানে বিরোধী দলের) সরকারের আমলে যেসব আর্মি অফিসার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর পদে (যেমন প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত স্টাফ অফিসার, বিভিন্ন সিকিউরিটি ইউনিট এবং গোয়েন্দা সংগঠনের প্রধানসহ তাঁদের ঘনিষ্ঠ সহকর্মী) নিয়োজিত ছিলেন তাঁদের সবাইকে অপ্রকাশিত প্রশাসনিক কারণে অকালীন অবসর দিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দেন। অপ্রকাশিত কারণটি হলো, যেহেতু এসব অফিসার আগের সরকারের আমলে (বর্তমান) বিরোধী দলীয় রাজনৈতিক নেতাদের আস্থাভাজন ছিলেন, সুতরাং বর্তমান সরকারের রাজনৈতিক নেতাদের পক্ষে এসব অফিসারকে বিশ্বাস করা আদৌ নিরাপদ নয়। ১৯৯০ সনে স্বৈরাচারী সরকারের পতনের পর প্রথম নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকার ক্ষমতায় এসে প্রায় ৬০ জন পেশাগতভাবে দক্ষ ও অভিজ্ঞ আর্মি অফিসারকে এভাবে অবসর দিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দেন। ফলে, একদিকে যেমন সংশ্লিষ্ট আফিসারগণ ব্যক্তিগতভাবে নির্যাতিত হলেন, অপর দিকে জাতি বঞ্চিত হলো বহু অর্থ-সম্পদ ব্যয়ে গড়ে তোলা ৬০ জন পেশাদার অফিসারের সেবা থেকে। কিছুদিন হলো এই খেলাতে নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে। নির্বাচিত নতুন গণতান্ত্রিক সরকার ক্ষমতায় এসে আগের সরকারের আমলে অবসরে পাঠানো এমন অফিসারদেরকে অবসরের তারিখ (বা তার আগ) থেকে প্রমোশন দিয়ে উচ্চতর অবসর ভাতা মন্জুর করছেন। প্রতিবার সরকার বদলের সময় যদি আর্মিকে এভাবে কমবেশি অফিসার হারাতে হয় তাহলে একটা সময় অচিরে আসবে যখন মেধাবী প্রার্থীরা আর্মিতে আর যোগ দেবে না। অন্যদিকে আর্মি মারাত্মকভাবে পলিটিসাইজড হয়ে যাবে। যা কারো কাম্য হতে পারে না। আর্মি অফিসাররা প্রজাতন্ত্রের কর্মচারি হিসেবে একমাত্র রাষ্ট্র ও সংবিধানের প্রতি অনুগত থাকতে বাধ্য। একজন অফিসারকে সরকার যে পদেই নিয়োগ দিক না কেনো সে পদে তিনি কর্তব্য পালনে বাধ্য। এধরনের কোনো নিয়োগকে রাজনৈতিক নিয়োগ হিসেবে দেখা আইন এবং নৈতিকতাবিরোধী। আর্মি অফিসারদের কাছ থেকে রাজনৈতিক বা দলগত আনুগত্য কামনা করা যেমন অপরাধ, একজন অফিসারের পক্ষে তেমন আনুগত্য পোষণ এবং প্রকাশ করাও অপরাধ। আমাদের বর্তমান প্রজন্মের রাজনীতিবীদরা এবং আর্মি অফিসাররা দেশের সর্বোচ্চ স্বার্থের কথা বিবেচনা করে একথা মনে রাখলে নিজেদের জন্য এবং দেশের জন্য মঙ্গল হবে। <br /><br />১৫। সম্প্রতিকালে বাংলাদেশের মাননীয় সর্র্বোচ্চ আদালত ১৯৭২ সালের মূল সংবিধান পুন:স্থাপন করার জন্য আদেশ প্রদান করতে গিয়ে বিভিন্ন সময়ে সামরিক শাসকগণ কর্তৃক নির্বাহী আদেশবলে প্রবর্তিত এবং মার্শাল ল’র অধীনে নির্বাচিত জাতীয় সংসদ কর্তৃক অনুমোদিত সংবিধানের সকল সংশোধণ (দু’য়েকটি বাদে) এবং আইন রহিত করেছেন। মার্শাল ল’ জারিকারী সকলকে বিচারের আওতায় আনার জন্য প্রশাসন ও সংসদকে পরামর্শ দিয়েছেন। মাননীয় সর্র্বোচ্চ আদালত মার্শাল ল’র চাইতে কম জনগুরুত্বপূর্ণ অনেক বিষয়ে স্বত:প্রণোদিত হয়ে (সুয়ো মটো) হস্তক্ষেপ করে অপরাধীদের বিচার করে দন্ড দিয়ে সাধারণ মানুষের প্রশংসা কুড়াচ্ছেন। কিন্তু যেসব জেনারেল বা রাজনৈতিক ব্যাক্তি মার্শাল ল’ জারি করে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে গুরুতর অপরাধ সংঘটিত করেছেন তাঁদেরকে বিচারের আওতায় আনার জন্য মাননীয় সর্র্বোচ্চ আদালত কেন সুয়ো মটো ব্যবস্থা এযাবত নেননি তা বোধগম্য নয়। যেসব জেনারেল বা ব্যক্তি মার্শাল ল’ জারি করেছেন তাঁদের অবশ্যই বিচার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করা উচিত। তবে যদি উপরিউক্ত ১২ অনুচ্ছেদে বর্ণিত দ্বিতীয় বা তৃতীয় কারনে মার্শাল ল’ জারি করা হয়ে থাকে তাহলে সংশ্লিষ্ট জেনারেলদের বিচার করা নৈতিক দিক থেকে কতটা সমর্থনযোগ্য, সে প্রশ্ন উঠতেই পারে। আমরা জানি, আইন এবং নৈতিকতার মানদন্ড সবসময় অভিন্ন হয় না। আইনের চোখে দন্ডনীয় কাজ কখনও কখনও নৈতিকতার বিচারে শুদ্ধ ও প্রশংসনীয় হয়। যেসব মার্শাল ল’ জারির পেছনে জনগণের স্বত:স্ফুর্ত সমর্থন থাকে সেসব মার্শাল ল’ জারিকারীদের বিচার করতে হলে সমর্থনকারী জনগণেরও তো বিচার করা উচিত। সে বিচার কোন আদালতে হবে ? যেসব রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীর অবিমৃষ্যকারিতার কারণে রাষ্ট্রের প্রশাসনযন্ত্র ভেঙ্গে পড়েছিলো, মার্শাল ল’ জারি করা অপরিহার্য হয়ে পড়েছিলো সেসব রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীর বিচার করা সম্পর্কে মাননীয় আদালত কেন চুপ থাকলেন, তা বোঝা গেলো না। যেসব রাজনৈতিক নেতা-নেত্রী মার্শাল ল’কে (অথবা আধা-মার্শাল ল’কে) আসতে প্রকাশ্যে নিমন্ত্রণ জানালেন, পরবর্তীকালে মার্শাল ল’র অধীনে নির্বাচিত সংসদের সদস্য হয়ে যাঁরা সামরিক শাসকগণ কর্তৃক নির্বাহী আদেশবলে প্রবর্তিত সকল ফরমান এবং সংবিধানের সকল সংশোধণ এবং আইন অনুমোদন করলেন তাঁদের সর্ম্পকে মাননীয় আদালতের নীরবতা বোধগম্য নয়। যে জেনারেল মার্শাল ল’ জারি করেছেন তিনি অপরাধ করে থাকলে সেই জেনারেলকে একাজে যাঁরা প্ররোচণা দিয়েছেন, সক্রিয় সমর্থন যুগিয়েছেন তাঁরা সবাই, তা তাঁরা রাজনীতিবীদ হোন বা অন্য কেউ হোন, কমবেশি দোষী। <br /><br />১৬। আলোচনার খাতিরে ধরা যাক, একজন আর্মি কমান্ডার কোনো এক মধ্যরাতে তাঁর অধীনস্তদের কোথাও অভিযান চালাতে আদেশ করলেন, যার ফলে দেশের আইনানুগ সরকারের পতন ঘটবে। বলা বাহুল্য, নৈতিকতার বিচারে যাই হোক না কেনো, আদেশটি অবশ্যই আনল’ফুল বা বেআইনি। আদেশ মান্য করে সরকারের পতন ঘটালে ব্যক্তিগতভাবে আদেশ পালনকারীর কোনো ঝামেলা পোহাবার ভয় নেই। কিন্তু মনে করুন, কেউ একজন আনল’ফুল আদেশটি অমান্য করলো। একই সাথে অন্যরা আদেশটি পালন করলো এবং সরকারের পতন হলো। তখন আদেশ অমান্যকারী সৈনিককে কোর্টমার্শালে বিচার করে শাস্তি দেওয়া হবে খুবই সাধারণ ব্যাপার। তখন তাঁকে সাহায্য করার জন্য কোনো আইন, কোনো আদালত, কোনো ব্যারিস্টার, কোনো সুশীল সমাজ এগিয়ে আসেন না। তবে হ্যাঁ, যদি কেউ বিপ্লবী মনের অধিকারী হন তাহলে তিনি আনল’ফুল আদেশটি অমান্য করার ঝুঁকি নিতে পারেন। সে ক্ষেত্রে বিপ্লবী সৈনিকটি যদি একজন জেনারেল বা সিনিয়র অফিসার হন তাহলে আর্মির মধ্যে পারষ্পরিক হানাহানি এমনকি দেশে গৃহযুদ্ধ শুরু হতে পারে। ১৯৯৬ সনে বাংলাদেশ আর্মি, আল্লাহর অশেষ রহমতে, অল্পের জন্য তেমন একটি গৃহযুদ্ধ থেকে বেঁচে যায়। সে যাহোক, বাস্তব সত্য হলো, যাঁরা আর্মিতে যোগ দেন তাঁরা সবাই মূলত: ব্যক্তিগতভাবে কনফর্মিস্ট (বিনা বাক্যে উপরওয়ালার আদেশ মান্যকারী) হয়ে থাকেন, অথবা আর্মির কঠোর ট্রেইনিং তাঁদেরকে কনফর্মিস্ট বানিয়ে ছাড়ে। তাঁরা সচারচর রেভ্যুলিউশনারি বা বিপ্লবী হন না। যদিও দলগতভাবে রেভ্যুলিউশনারি হয়ে সৈনিকরা ল’ফুল আদেশ অগ্রাহ্য করে বিপ্লব সংঘটিত করেছেন, নিজ দেশ স্বাধীন করেছেন, এমন নজির ইতিহাসে অনেক আছে। আমাদের দেশেও আছে। তৎকালীন পাকিস্তান আর্মির বাঙ্গালি সৈনিকরা ১৯৭১ সনে একত্রে বিদ্রোহ করে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের সূচনা করেছিলেন। পরবর্তিতে ১৯৯০ সনের শেষভাগে বাংলাদেশ আর্মির র্যাং ক এন্ড ফাইল ঐক্যবদ্ধভাবে সর্বাধিনায়ক প্রেসিডেন্ট জে: এরশাদের আইনানুগ, কিন্তু অনৈতিক, আদেশ অগ্রাহ্য করে জনগণের কাতারে সামিল হয়ে দেশকে স্বৈরশাসন থেকে মুক্ত করেছিলো।<br /><br />১৭। এবার দেখা যাক মার্শাল ল’ জারি ও প্রয়োগে সৈনিক কী ভূমিকা পালন করেন। দেশে যখন পূর্ণ গণতান্ত্রিক পরিবেশ বজায় থাকে, সুস্থ গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ক্ষমতার হাতবদল হয়, রাজনৈতিক দল ও নেতাদের মধ্যে কাঙ্খিত সৌহার্দ বিরাজ করে, সর্বোপরি দেশে যদি সুশাসন থাকে, সমাজে শান্তি ও প্রগতি থাকে তখন কোনো জেনারেলের পক্ষে মার্শাল ল’ জারি করা সম্ভব নয়। কিন্তু যখন গণতন্ত্রের সকল নিয়ম-নীতি পদদলিত হয়, পরষ্পর বিরোধী রাজনৈতিক দল ও নেতাদের মধ্যে সমঝোতার ও সহযোগিতার মনোভাব থাকে না, তাঁরা পরষ্পর হানাহানি ও হত্যায় উন্মত্ত থাকেন, কুশাসন, ঘুষ, দুর্নীতি, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি ও জুলুমে দেশের মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে উঠে, বিরাজমান শাসকগোষ্ঠির দিক থেকে জনগণ মুখ ফিরিয়ে নেয়, তখন জনগণ অত্যন্ত মরিয়া হয়ে আশা করেন কোথাও না কোথাও থেকে একজন ত্রাণকর্তা এসে তাদের রক্ষা করবেন। এমন সময়ে একজন জেনারেল দেশপ্রেম দ্বারা তাড়িত হয়ে মার্শাল ল’ জারি করে থাকেন। তিনি অঙ্গীকার করেন, দেশকে বিশৃঙ্খলা ও অরাজাকতা থেকে রক্ষা করে শান্তি পুন:প্রতিষ্ঠা করবেন, এবং যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নির্বাচন অনুষ্ঠান করে নির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা অর্পণ করে আর্মিকে ব্যারাকে ফিরিয়ে নিয়ে যাবেন। তবে মার্শাল ল’র শুরুতে এমন জেনারেল, বা তাঁর সঙ্গীসাথী অন্য জেনারেলদের, আসল নিয়ত বুঝা যায় না। ছ’মাস, এক বছর পার হলে আসল নিয়ত ধীরে ধীরে প্রকাশ পেতে থাকে। তখন ঘটনা অন্য দিকে মোড় নিতে পারে। সেকথা পরে বলছি।<br /><br />১৮। যেকোনো কারণে দেশে যখন কুশাসন, দুর্নীতি, অবিচার ও জুলুম সহ্যের সীমা অতিক্রম করে, অতিষ্ঠ দেশের মানুষের পিঠ যখন দেয়ালে ঠেকে যায় তখন স্বাভাবিকভাবে আর্মির মধ্যেও তার বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। নিজ বাড়ির দেয়াল যত উঁচু হোক না কেনো, গ্রামে আগুন লাগলে বাড়ির ভিতরে আগুন না আসলেও উত্তাপ আসে। ক্যান্টনমেন্টকে বাকি দেশ থেকে আলাদা করে দেখার সুযোগ তথ্য প্রযুক্তির এ যুগে আর নেই। একজন সাধারণ সৈনিক ছুটিতে গ্রামের বাড়িতে গিয়ে যদি দেখতে পান: তাঁর বাড়ির পাশের কৃষক পরিবার অর্থাভাবে দু’বেলা খেতে পারছে না, বাবা জমির ফসলের ন্যায্য মূল্য পাচ্ছেন না, চাচার জমি সরকারি দলের স্থানীয় কোনো গুন্ডা জবরদখল করে আছে, পাশের বাড়ির স্কুল পড়ুয়া মেয়েটি সরকারি দলের স্থানীয় কোনো গুন্ডার অত্যাচারের ভয়ে স্কুলে যেতে পারছে না এবং এসব অপরাধীর বিরুদ্ধে থানা বা ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে বিচার চেয়ে লাভ হয় না, তখন তাঁর মনেও, আর দশজন নাগরিকের মত, শাসকের বিরুদ্ধে ঘৃণার আগুন জ্বলে উঠে। দেখা গেছে, সহ্য করতে না পেরে, কোনো সৈনিক যদি এমন অভিযোগ নিয়ে থানার ওসি বা ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে গিয়ে নিজ পরিচয় দিয়ে প্রতিকার চান, অনেক সময় প্রতিকার তো পানই না, বরং কখনও কখনও অপমানিত হয়ে ফিরতে হয়। শান্তির সময়ে একটি অপারেশনাল ইউনিটের প্রায় ২০% সৈনিক ছুটিতে ইউনিটের বাইরে অবস্থান করেন। ছুটি শেষে তাঁরা ইউনিটে ফিরে এসে সহকর্মী সৈনিকদের কাছে বাইরের জগতের দেখে আসা নিজের শোচনীয় অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেন। এভাবে সারা দেশের জনগণের সাথে আর্মি ইউনিটেও অসন্তোষ ধুমায়িত হতে থাকে।<br /><br />১৯। আর্মিতে মেজর থেকে নিচের দিকে সিপাহি পর্যন্ত সকল র্যাং কে পদোন্নতি হয় জ্যেষ্ঠতা, যোগ্যতা ও মেধা বিচার করে। এখানে রাজনীতি বা অন্য কোনো কিছুর প্রভাব থাকে না। লেফটেন্যান্ট কর্নেল পদে পদোন্নতির ক্ষেত্রেও অনুরূপ মানদন্ড। তবে কতৃপক্ষ ইচ্ছে করলে এক্ষেত্রেও রাজনৈতিক বিবেচনা প্রয়োগ করতে পারেন, যদিও তেমনটা করা হবে সম্পূর্ণ অনৈতিক। কর্নেল থেকে জেনারেল পদে পদোন্নতির ক্ষেত্রে আমাদের মত দেশে, অন্য যা কিছুই বলা হোক না কেন, বাস্তবে প্রার্থীর রাজনৈতিক ও ব্যক্তিগত আনুগত্যকে সর্বোচ্চ বিবেচনায় নেয়া হয়। কৌতুক করে বলা হয়, রাজনৈতিক সরকারের সদিচ্ছাই এখানে সর্বোচ্চ বিবেচ্য বিষয়। অথচ, সংবিধান অনুযায়ী আর্মির সকল সদস্যকে দেশ, রাস্ট্র ও সংবিধানের প্রতি অনুগত থাকার শপথ নিতে হয়, কোনো রাজনৈতিক বা অরাজনৈতিক ব্যক্তি বা দলের প্রতি নয়।<br /><br />২০। আগেই বলা হয়েছে, দেশে যখন শাসক ব্যক্তি, গোষ্ঠি বা দলের কুশাসন, দুর্নীতি, অবিচার, জুলুম এবং দেশের স্বার্থবিরোধী কাজকর্ম সহ্যের সীমা অতিক্রম করে, দেশের মানুষ যখন অতিষ্ঠ হয়ে উঠে, তখন স্বাভাবিকভাবে আর্মির মধ্যে তার প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। প্রধানত এই প্রতিক্রিয়া প্রকাশ্যে পরিলক্ষিত হয় মেজর এবং তার নিচের র্যাং কের সদস্যদের মধ্যে। ইউনিটগুলোতে দেখা দেয় একধরনের অস্থিরতা। আর্মির প্রতিটি ইউনিট খুব কঠিন বুনটে গ্রথিত সামাজিক সংগঠন। পারষ্পরিক সহমর্মিতা, ঐক্য ও সহযোগিতা যার ভিত্তি। ছুটি থেকে ফিরে আসা সৈনিকের কাছ থেকে গ্রামের সাধারণ মানুষের দু:খ-দুর্দশার কথা শুনে অন্যরাও বিচলিত বোধ করেন। দেশ যখন দু:শাসনের কবলে নিপতিত হয় তখন তার খবর দেশি-বিদেশি খবরের কাগজ, রেডিও, ইন্টারনেট এবং টেলিভিশনের মাধ্যমেও সৈনিকরা বিস্তারিতভাবে জানতে পারেন। নিম্নপদস্থ অফিসার এবং সাধারণ সৈনিকদের মধ্যে এক ধরনের অস্থিরতা ও চাপ সৃষ্টি হয়। একটা পর্যায় পর্যন্ত তাঁরা এই অস্থিরতা ও চাপ সহ্য করতে পারলেও, শেষ অব্দি, যখন কেউ আর্মির ভিতর বা বাইরে থেকে সরকার উৎখাতের আহ্বান জানায় তখন তারা চেইন অব কমান্ড ভেঙ্গে বেড়িয়ে আসার জন্য অস্থির হয়ে উঠেন। এমন সময়ে লে: কর্নেল থেকে জেনারেল র্যাং কের অফিসারদের পক্ষে নিস্ক্রীয় হয়ে থাকা আর সম্ভব হয়ে উঠে না। শাসকের প্রতি ব্যক্তিগত আনুগত্য তুচ্ছ করে নিজের অধীনস্ত সৈনিকদের সাথে যোগ দিয়ে সরকার উৎখাতের প্রক্রিয়ায় অংশ নেন। জনগণের এবং অধীনস্ত সৈনিকদের ইচ্ছার প্রতি সম্মান জানাতে তাঁরা এটা করে থাকেন। চূড়ান্ত ফলশ্রুতিতে দেশে নতুন বেসামরিক সরকার আসে, অথবা মার্শাল ল’ জারি হয়। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, ১৯৯০ সনের শেষভাগে প্রেসিডেন্ট জে: এরশাদের পতনের সময় তাঁরই নিয়োজিত বিশ্বস্ত আর্মি চীফ তাঁকে (জে: এরশাদকে) রক্ষা করতে এগিয়ে আসতে পারেননি। একইভাবে, ২০০৬ সালে প্রসিডেন্ট প্রফেসর ইয়াযউদ্দিনের আদেশ অমান্য করে তৎকালীন আর্মি চীফ সরকার পরিবর্তন করেছিলেন, যদিও একই রাজনৈতিক নেত্রী প্রেসিডেন্ট ও আর্মি চীফ উভয়ের নেতা ও নিয়োগকর্তা ছিলেন। এখানে আরও একটি বিষয় গুরুত্বের সাথে উল্লেখের দাবি রাখে। যখন কোনো জেনারেল এভাবে মার্শাল ল’ জারি করেন তখন তাঁকে দেশের অভ্যন্তরীণ এক বা একাধিক সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দল পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষভাবে স্বাগত জানায়, সমর্থন করে। বাংলাদেশে ১৯৭৫ ও ১৯৮২ সনে যখন মার্শাল ল’ জারি হয়, এবং ২০০৬ সনে যখন আধা-মার্শাল ল’ জারি হয়, প্রতিবারেই কোনো না কোনো বিরোধী রাজনৈতিক দল বা ব্যাক্তি বিরাজমান শাসকের বিরুদ্ধে জেনারেলদের প্রকাশ্যে স্বাগত জানিয়ে সমর্থন করেছিলেন।<br /><br />২১। এখন দেখা যাক, মার্শাল ল’ জারি হবার পর আর্মির অভ্যন্তরে কী ঘটে। বাংলাদেশে যাঁদের বয়স আমার মত সত্তরের কাছাকাছি তাঁদেরকে এ বিষয়ে নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। তাঁরা ১৯৫৮ সন থেকে ১৯৯০ পর্যন্ত জারিকৃত সকল মার্শাল ল’র, এবং ২০০৬ সনে চালুকৃত আধা-মার্শাল ল’র সব ঘটনা নিজ চোখে দেখেছেন। তবে নতুন প্রজন্মের নাগরিকদের জানার জন্য এ বিষয়ে বলার প্রয়োজন আছে বলে মনে করি। সেনাবাহিনী প্রধান নিজেকে চিফ মার্শাল ল’ এডমিনিস্ট্রেটর (সিএমএলএ) নিয়োগ করে মার্শাল ল’ জারি করেন। একইসাথে নৌবাহিনী প্রধান এবং বিমানবাহিনী প্রধানদ্বয়কে ডেপুটি চিফ মার্শাল ল’ এডমিনিস্ট্রেটর (ডিসিএমএলএ) নিয়োগ করা হয়ে থাকে। ফরমেশন কমান্ডারদের (সাধারণত জেনারেল র্যাং কের অফিসার) জোনাল মার্শাল ল’ এডমিনিস্ট্রেটর (জেডএমএলএ) নিয়োগ করা হয়। তার নিচে বিগেডিয়ার জেনারেল র্যাং কের অফিসারদেরকে সাব জোনাল মার্শাল ল’ এডমিনিস্ট্রেটর (এসজেডএমএলএ) নিয়োগ করা হয়। মাঠ পর্যায়ে ইউনিট কমান্ডারদের (লে: কর্নেল) ডিস্ট্রিক্ট মার্শাল ল’ এডমিনিস্ট্রেটর (ডিএমএলএ) নিয়োগ করা হয়। ডিএমএলএ’রা তৃণমূল পর্যায়ে জেলার ডেপুটি কমিশনারসহ আর সব সিভিল অফিসারদের কাজ তদারক করে থাকেন, আদেশ-নির্দেশ দিয়ে থাকেন। কেন্দ্রে সিএমএলএ, ডিসিএমএলএ এবং সিনিয়র জেনারেলগণ বিভিন্ন মন্ত্রনালয়ের দায়িত্ব নিয়ে সরকার পরিচালনা করেন। মার্শাল ল’ জারি হবার সাথেসাথে পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী অপারেশনাল ইউনিটগুলো ক্যান্টনমেন্ট থেকে দ্রুত বেরিয়ে এসে সকল জেলাসদরসহ দেশের আনাচেকোনাচে কমিউনিটি সেন্টার, ক্লাবঘর, স্টেডিয়াম ইত্যাদি স্থানে অবস্থান গ্রহণ করে। <br /><br />২২। মার্শাল ল’ কর্তৃপক্ষ সর্বপ্রথম যে কাজটি করে থাকে তা হলো দ্রুত দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা। কুখ্যাত সন্ত্রাসী, অপরাধী, গুন্ডাবদমাশ, দুর্নীতিবাজ রাজনীতিবীদ, এবং তাদের দোসর মুনাফাখোর ও মজুতদার ব্যবসায়ীদের আটক করে জেলে পুরা হয়। তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত ও মামলা শুরু হয়। সাধারণ আইন অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে তরিৎ ব্যবস্থা নেয়া হয়। স্পেশাল ও সামারি মিলিটারি কোর্ট গঠণ করে এসব অপরাধীদের দ্রুত বিচার করে শাস্তি প্রদান করা হয়। মাঠ পর্যায়ে জুনিয়র অফিসাররা সন্ত্রাসী, অপরাধী ও দুর্নীতিবাজ ও গুন্ডাবদমাশ বলে পরিচিত লোকদের শায়েস্তা করার জন্য আর্মি ক্যাম্পে ধরে এনে শারীরিক সাজা দিয়ে থাকেন। কাজটা বেআইনি হলেও জনগণ খুব পসন্দ করে এসব ধরিবাজ লোকদের পিটুনি খাওয়া। যেসব সিনিয়র দুর্নীতিবাজ রাজনীতিবীদ, সরকারি আমলা এবং ধনী ব্যবসায়ী এতদিন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ও টাকার জোরে নিজেদেরকে সবসময় আইনের ঊর্ধে মনে করে এসেছেন, তাঁরা যখন শাস্তি পেয়ে জেলে যেতে থাকেন তখন সাধারণ মানুষ সন্তুষ্টি প্রকাশ করে থাকেন। মিটিং-মিসিল ও ধর্মঘটসহ সবরকম রাজনৈতিক কর্মকান্ড নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। আফিস-আদালত, কলকারখানা এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে নিয়মিত কাজ হতে থাকে। পুরো সংবিধান, অথবা সংবিধানের মানবাধিকার সংক্রান্ত ধারাগুলো, সাময়িকভাবে রহিত করা হয়। দেশে শান্তির পরিবেশ প্রতিষ্ঠিত হয়। আদালতগুলো অবশ্য কোনো হস্তক্ষেপ ছাড়া নিজ নিজ কাজ চালিয়ে যায়। তবে বেশি দিন এমন অবস্থা থাকে না। <br /><br />২৩। জারি হবার ছ’মাস থেকে এক বছরের মধ্য মার্শাল ল’তে পচনের লক্ষণ দেখা দেয়। সাধারণভাবে আর্মিতে মধ্যম ও নিম্ন পর্যায়ের অফিসারদের দুর্নীতি করার সুযোগ একবোরে নেই বললেই চলে। তবে প্রকিউরমেন্ট, পারচেইজ এবং কনস্ট্রাকশনের সাথে যাঁরা জড়িত, বিশেষ করে সিনিয়র অফিসাররা, ইচ্ছে করলে ব্যাপক আর্থিক দুর্নীতি করতে পারেন। কেউ কেউ করেও থাকেন। এসব অফিসাররা মার্শাল ল’ এলে চুটিয়ে আর্থিকসহ অন্যান্য দুর্নীতি করেন, এমন নজির দুর্লভ নয়। মার্শাল ল’ জারি হবার সাথেসাথে সিভিল আমলারা, বিশেষ করে সিনিয়ররা, একেবারে ঘাপটি মেরে যান। তাঁরা ভালো করেই জানেন, দেশ চালানো আর্মির কাজ নয়। প্রত্যেক মন্ত্রনালয় এবং ডিপার্টমেন্টের নিজস্ব কিছু জটিল এবং ষ্পর্শকাতর কাজ আছে যা প্রশিক্ষণ ও অভিজ্ঞতা ছাড়া করা যায় না। আর্মির অফিসারদের সেটা জানা নেই। স্বাভাবিকভাবেই মার্শাল ল’র দায়িয়ত্বপ্রাপ্ত অফিসাররা একটা সময়ে বুদ্ধিপরামর্শ ও সিদ্ধান্তের জন্য অভিজ্ঞ আমলাদের শরণাপন্ন হন। দুর্নীতিপরায়ণ আমলারা মনেমনে হাসেন আর এই সুযোগের জন্য দিন গুণেন। সুযোগ এসে গেলে দ্বিগুণ-তিনগুণ দুর্নীতি করেন। আগে ফাইল আটকে রেখে যেখানে মক্কেলদের কাছ থেকে, ধরা যাক, এক লক্ষ টাকা ঘুষ নিতেন, মার্শাল ল’র পর সেখানে তিন লক্ষ টাকা দাবি করেন। বলেন, দেশে এখন মার্শাল ল’ চলছে তাই রিস্ক অনেক বেড়ে গেছে, টাকা বেশি দিতে হবে। দেখা গেছে পুলিশ বিভাগের নিম্নস্তরের একশ্রণীর কর্মকর্তা-কর্মচারি মার্শাল ল’র নাম করে স্বাভাবিকের চাইতে অনেক বেশি ঘুষ নিয়ে থাকেন। কারণ, অভিযুক্তদের বিচার মার্শাল ল’ কোর্টে হলেও তদন্ত করা, চার্জশিট দেওয়া ইত্যাদি কাজগুলো বরাবরের মত থানা-পুলিশই করে থাকে। এসব ক্ষেত্রে একশ্রণীর উকিল-এডভোকেট সাহেবরাও কম যান না। মার্শাল ল’ কোর্টের নাম বলে, এমনকি মার্শাল ল’ কোর্টের বিচারককে ঘুষ দিতে হবে বলে, মক্কেলদের কাছ থেকে অবিশ্বাস্য রকমের বেশি টাকা নিয়ে থাকেন। এভাবে মার্শাল ল’র মধ্যেই দুর্নীতি, শোষণ, অত্যাচার এবং সেইসাথে কুশাসন বাড়তে থাকে। সাধারণ মানুষ আবার অতিষ্ঠ হয়ে উঠতে থাকে। তখন তারা মার্শাল ল’ থেকে মুক্তির পথ খুঁজতে শুরু করে। পুরানো রাজনীতিবীদরা আবার ধীরে ধীরে ময়দানে নেমে আসর গরম করতে শুরু করেন।<br /><br />২৪। অন্য সবার মত মার্শাল ল’ জারিকারী জেনারেলগণ একথা ভালোভাবে জানেন যে ক্ষমতা কারো জন্য চিরস্থায়ী নয়। ভবিষ্যতে নিজেদের জীবন, ধন ও মানের নিরপত্তার কথা তাঁদের ভাবিয়ে তুলে। ক্ষমতা গ্রহণের পরপরই তাঁরা ক্ষমতা থেকে বেড়িয়ে যাবার নিরাপদ নির্গমণ পথ, বা সেইফ এক্সিট, খুঁজতে থাকেন। এই লক্ষ্যে তাঁরা হয় পেছনে থেকে নতুন রাজনৈতিক দল গঠণ করেন, অথবা পুরনো রাজনৈতিক দলের সাথে আঁতাত গড়ে তোলেন। নতুন নতুন নামে তল্পিবাহক যুবকশ্রেণী ও পেশাজীবীদের সংগঠণ গড়ে তোলেন। একাজে সরকারি অর্থ ও প্রশাসনকে যথেচ্ছ ব্যবহার করার নজির আছে। <br /><br />২৫। মার্শাল ল’ জারিকারী জেনারেলগণ যদি দুর্নীতিপরায়ন ও ক্ষমতালোভী হন তাহলে নিজেদের ক্ষমতার প্রতি আর্মির ভিতর থেকে যাতে কোনো হুমকি সৃষ্টি না হয় সেজন্য তাঁরা উল্লেখযোগ্য কিছু পদক্ষেপ নিয়ে থাকেন। প্রথমেই সৎ, দেশপ্রেমিক ও রাজনীতিতে উৎসাহ নেই এমন জেনারেলদের আর্মির ভিতরের সকল স্পর্শকাতর পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। দেশের ভিতরে সিভিল পদে, যেমন কপোর্রেশনের চেয়ারম্যানের পদে, নিয়োগ দেওয়া হয়। দেশের বাইরে রাস্ট্রদূত হিসেবে পাঠানো হয়। তাঁদের যায়গায় এমন সব অপেক্ষাকৃত জুনিয়র, অদক্ষ এবং অনেক ক্ষেত্রে লোভী ও অসৎ অফিসারদের প্রমোশন ও নিয়োগ দেওয়া হয় যাঁরা নিজেরাও কখনো ভাবেননি যে তাঁরা একদিন জেনারেল হতে পারবেন। এঁদের মধ্যে অনেককে মার্শাল ল’র সময়ে আর্থিক দুর্নীতি করার সুযোগও দেওয়া হয়। এর সবই করা হয় আর্মিকে সৎ ও সুযোগ্য নের্তত্ব থেকে বঞ্চিত করে ফাইটিং মেশিন হিসেবে তার কর্মক্ষমতা হৃাস করার জন্য। অন্যদিকে সাধারণ সৈনিকদের পেশাগত প্রশিক্ষণ থেকে দূরে সরিয়ে রাখার জন্য নানা চতুর পদক্ষেপ নেয়া হয়। যেমন, ১৯৮২ সনে মার্শাল ল’ জারির পর বাংলাদেশ আর্মিতে সৈনিকদের জন্য আন্ত:ফরমেশন আজান ও ক্বেরাত প্রতিযোগিতা এবং সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা নামক দু’টি প্রতিযোগিতা চালু করা হয়। যা এখনও চালু আছে বলে পত্রিকার পাতায় দেখে থাকি। পৃথিবীতে পঞ্চাশের বেশি মুসলিমপ্রধান রাস্ট্র আছে। তার কোনোটিতে সৈনিকদের জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে আজান ও ক্বেরাত প্রতিযোগিতা অনুষাঠিত হয় কিনা আমার জানা নেই। পৃথিবীর কোনো আর্মিতে সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতার নামে প্রশিক্ষণের অমূল্য সময় ও অর্থ ব্যয় করা হয় বলে আমার জানা নেই। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, যখন যুদ্ধ থাকে না, অর্থাৎ শান্তির সময়ে, সৈনিকদের একমাত্র কাজ যুদ্ধের জন্য অধিকতর প্রস্তুত থাকার জন্য নিরন্তর পেশাগত প্রশিক্ষণ চালিয়ে যাওয়া। একমাত্র ব্যতিক্রম হয় প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময়। যখন উপদ্রুত এলাকায় ত্রাণ ও পুনর্বাসন কাজের জন্য আর্মিকে নিয়োগ করা হয়। সাধারণ সৈনিকদের মার্শাল ল’ ডিউটির নামে, কখনো কখনো নেশন বিল্ডিং ওয়ার্ক বা জতিগঠণমূলক কাজের নামে, ট্রাফিক কন্ট্রোলের মত বিভিন্ন বেসামরিক ফালতু প্রশাসনিক কাজে ব্যস্ত রাখা হয়। <br /><br />২৬। ১৯৯১ সনের কথা। আমি তখন পেইচিংয়ে বাংলাদেশ দূতাবাসে কাজ করি। দেশ থকে একজন অতি তুখোড় এবং নামকরা নাট্য ব্যাক্তিত্ব পেইচিং বেড়াতে এলেন। কোনো এক ডিনার পার্টিতে তাঁর সাথে আলাপ হলো। আলাপের এক পর্যায়ে তিনি মন্তব্য করে বসলেন, বাংলাদেশে আর্মির কোনো প্রয়োজন নেই। যে সম্ভাব্য শত্রুর বিরুদ্ধে এত অর্থসম্পদ ব্যয় করে বাংলাদেশ আর্মি পোষা হচ্ছে তা এত বড় ও শক্তিশালী যে যুদ্ধক্ষেত্রে বাংলাদেশে আর্মি তার বিরুদ্ধে ছ’ঘন্টা দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে কিনা সন্দেহ। তাছাড়া, বাংলাদেশ আর্মি দু’দুজন রাষ্ট্রপতিকে হত্যা করেছে। বারবার মার্শাল জারি করে দেশে গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রা স্তব্ধ করেছে। আর্মি উঠিয়ে দেওয়া দেশের জন্য ভালো হবে। তিনি আরও জানালেন, বাংলাদেশের সুশীল সমাজের অনেক সদস্য এব্যাপারে তাঁর সাথে একমত পোষণ করেন। সুশীল সমাজের সদস্য হিসেবে তিনি একজন প্রখ্যাত অর্থনীতিবীদের নাম উল্লেখ করলেন। জবাবে অত্যন্ত বিনয়ের সাথে বলেছিলাম, শত্রু বড় কি ছোট, শক্তিশালী কি দুর্বল, এসব কথা বিবেচনা করে কখনও কোনো সৈনিক যুদ্ধে যান না। তিনি যুদ্ধে গমন করেন মাতৃভূমির স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য প্রাণ উৎসর্গ করতে। সৈনিকের মনে যদি এই প্রত্যয় থাকে যে তিনি যুদ্ধে শহীদ হলে তাঁর পুত্র হাতে রাইফেল তুলে নেবে, পুত্র শহীদ হলে তার পৌত্র হাতে রাইফেল তুলে নেবে, যেমন করছে যুগ যুগ ধরে ফিলিস্তিনিরা, তাহলে শত্রুর আকার ও শক্তির ভয় দেখিয়ে তাঁকে পদানত করে রাখা যায় না। বরং এমন তেজস্বী জাতির বিরুদ্ধে কোনো আগ্রাসী শত্রু আক্রমণ করতে সাহস পায় না। এমন প্রত্যয়ী ও তেজস্বী জাতি অগ্নিপিন্ড বা ফায়ার বলের মত। শত্রু তাকে গিলে খেতে পারলেও হজম করতে পারে না। শত্রুর নাড়িভুড়ি পুড়িয়ে সে বেড়িয়ে এসে নিজের স্বাধীন সত্ত্বায় দ্রুত প্রত্যাবর্তন করে। জাতীয় শৌর্য, প্রত্যয় ও তেজস্বীতা বহাল রাখার জন্য স্বাধীনতা ও সার্বভৌমতাবের প্রতীক জাতীয় সেনাবাহিনীর প্রয়োজন কখনই অস্বীকার করা যায় না। দখলদার শত্রুর বিরুদ্ধে দীর্ঘস্থায়ী জনযুদ্ধের নিউক্লিয়াস হিসেবে কাজ করার জন্যও একটি সুপ্রশিক্ষিত আর্মির প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করা যায় না। আর্মি থাকা বা না থাকা একটি অত্যন্ত জটিল বিষয়। এর সাথে শুধু নিজ দেশ নয়, আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক ভূ-রাজনীতি, রাজনীতি, সমরনীতি, সামরিক ইতিহাস, অর্থনীতি, সমাজবিজ্ঞান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, নৃবিজ্ঞান, ঐতিহ্য ইত্যাদি অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় জড়িত। যদি একান্তই আর্মি রাখা বা না-রাখার প্রশ্ন কখনও সরকারের গভীর বিবেচনায় আসে, তাহলে সুশীল সমাজের দু’চারজন সদস্যের একপেশে মতামতের উপর নির্ভর না করে, সংশ্লিষ্ট সকল বিষয়ের বিশেষজ্ঞদের নিয়ে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেয়াটা যথার্থ হবে। একথা সত্য, আর্মির অতি নগণ্যসংখ্যক কিছু সদস্য দু’জন রাষ্ট্রপতিকে হত্যা করেছে। অবশ্যই এটা বিরাট নিন্দনীয় অপরাধ। যার পেছনে ছিলো গভীর দেশি ও বিদেশি ষড়যন্ত্র। একথা ভাবা ঠিক নয় যে, সে ষড়যন্ত্রে শুধুমাত্র সংশ্লিষ্ট সৈনিকরা সম্পৃক্ত ছিলো। ষড়যন্ত্রকারী সৈনিকদের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে অবশ্যই কিছু রাজনীতিবীদ জড়িত ছিলেন। ষড়যন্ত্রকারী সৈনিকদের বিচার অনুষ্ঠিত হলেও, কোনো বেসামরিক সরকার আজ পর্যন্ত প্ররোচনাকারী ও পৃষ্ঠপোষক রাজনীতিবিদদের বিচার করলো না। মূল ষড়যন্ত্র উদ্খাটিত হলো না। যদি শুরুতেই তা করা হতো, তাহলে এসব রাজনৈতিক হত্যাকান্ড এড়ানো সম্ভব হতো। আমার মনে হয় না শেষ পর্যন্ত আমি ভদ্রলোককে বিষয়টি বোঝাতে পেরেছিলাম। <br /><br />২৭। যেসব জেনারেল মার্শাল ল’ জারি করেন তাঁদের পেছনে থাকা প্ররোচনাকারী ও পৃষ্ঠপোষক রাজনীতিবিদদের বিচারের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে উচ্চ আদালতের, এবং একের পর এক রাজনৈতিক সরকারের, নীরবতা কাম্য হতে পারে না। এমনকি মার্শাল ল’র সময়ে যেসব জেনারেল দুর্নীতি করেছেন তাঁদের বিচার করার উদ্যোগও কোনো রাজনৈতিক সরকার আজ পর্যন্ত নেয়নি। একথা সত্যি, দুর্নীতির দায়ে জে: এরশাদ আদালত কর্তৃক দন্ডিত হয়ে জেল খেটেছেন। তবে তা একজন জেনারেল হিসেবে নয়, একজন রাজনীতিবীদ হিসেবে দুর্নীতি করার জন্য। দেশের সর্বোচ্চ পর্যায়ের রাজনৈতিক নেতৃত্ব যদি এসব বিষয়ে মনোযোগী না হন তাহলে দেশ থেকে রাজনৈতিক হত্যা এবং মার্শাল ল’র সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যাবে না। আর এজন্য জনগণের উচিত্ হবে দুর্নীতিপরায়ণ, অযোগ্য এবং ব্যর্থ রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে প্রত্যাখ্যান করে নির্বাচনের সময় সুশিক্ষিত, মেধাবী, দক্ষ, প্রজ্ঞাবান, সত্ ও দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে ভোট দিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব প্রদান করা। নতুন নেতৃবৃন্দকে সুযোগ করে দেওয়া। তবে যতদিন পর্যন্ত রাজনৈতিক নেতৃত্বের ধারা নিজ-রক্ত-নিজ-বংশের গন্ডী পেরিয়ে বাইরে না আসছে ততদিন এমনটি হবার সম্ভাবনা নেই। <br /><br />২৮। একথা অপ্রিয় হলেও সত্য, বাংলাদেশে আর্মির সাথে জনগণের ভুল বুঝাবোঝি সৃষ্টি করা এবং তা বজায় রাখার পেছনে একশ্রণীর সংবাদ মাধ্যম ক্রমাগত অবদান রেখে আসছে। বাংলাদেশের অধিকাংশ সংবাদপত্র ও বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলের মালিকানা এমন সব বড় বড় ব্যবসায়ীদের হাতে যাঁরা প্রশ্নবিদ্ধ উপায়ে অগাধ ধনসম্পদের মালিক হয়েছেন। দুর্নীতিপরায়ণ রাজনীতিবীদদের সক্রিয় সাহায্য ও সমর্থন ছাড়া এসব অসৎ ব্যবসায়ী নিজেদের ধনসম্পদ অর্জন ও ভোগ করতে পারেন না। আর্মির সাধারণ সৈনিকরা স্বভাবতই দুর্নীতিপরায়ণদের প্রচন্ড ঘৃণা করেন। যেকারণে দুর্নীতিপরায়ণ রাজনীতিবীদদের পৃষ্ঠপোষক একশ্রণীর সংবাদ মাধ্যমের অসত্ মালিক এসব রাজনীতিবীদদের পক্ষ নিয়ে নিজেদের পত্রিকা এবং টেলিভিশন চ্যানেলে আর্মির বিরুদ্ধে প্রপাগান্ডা চালান। শোনা যায়, বিদেশি বৈরী এজেন্সির অর্থে পরিচালিত দু’য়েকটি সংবাদপত্র ও টেলিভিশন চ্যানেলও একাজে নিয়োজিত আছে। ২০০৯ সনে বিডিআর বিদ্রোহের সময় বিষয়টি প্রকটভাবে সবার নজরে আসে। <br /><br />২৯। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে জাতীয় আর্মিকে অন্যায্য সমালোচনা থেকে রক্ষা করার জন্য দেশপ্রেমিক রাজনীতিবীদ ও গণমাধ্যম এগিয়ে আসেন। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, বাংলাদেশে এমনটা লক্ষ্য করা যায় না। সমালোচনার জবাব দেওয়ার জন্য আর্মির নিজস্ব কোনো মঞ্চ নেই, সুযোগ নেই, থাকার কথাও নয়। সে সুযোগ নিয়ে কিছু লোক উদ্দেশ্যমূলকভাবে যখন তখন আর্মিকে যা খুশি তাই বলে সমালোচনা করবে, এটা দেশের জন্য কখনও মঙ্গলজনক হতে পারে না। আর্মির একজন প্রাক্তন সৈনিক হিসেবে এই ভেবে আনন্দ ও গর্ব অনুভব করি যে, বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ অনেক বৈরী প্রপাগান্ডা সত্বেও অতীতের সব সময়ের মত আজও সৈনিকদের আপনজনের মত ভালবাসে, সকল বিপদে-আপদে বন্ধু হিসেবে নিজের পাশে দেখতে চায়। আমার বিশ্বাস, বর্তমান সৈনিকরাও সেজন্য আনন্দ ও গর্ব অনুভব করেন। এই লেখাটির মূলে রয়েছে সেই আনন্দ ও গর্বের তাড়না। <br /><br />৩০। আমার এ লেখাটি পড়ে কেউ কেউ হয়তো মনে করতে পারেন, আমি রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে রাজনীতিবীদদের ভূমিকাকে অবমূল্যায়ন করার চেষ্টা করেছি। কথাটা ঠিক নয়। অন্য যেকোনো একজন সচেতন নাগরিকের মত আমিও বিশ্বাস করি একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় রাষ্ট্র পরিচালনার কাজ শুধুমাত্র রাজনীতিবীদদের, অন্য কারো নয়। অন্যরা সবাই একাজে রাজনীতিবীদদের নির্দেশনা এবং চাহিদা অনুযায়ী তাঁদেরকে সাহায্য ও সহযোগিতা প্রদান করবেন। রাজনীতিবীদরা রাষ্ট্রের সকল নীতি প্রনয়ণ, নিয়ন্ত্রণ এবং পরিচালনা করেন। স্বভাবতই এজন্য প্রয়োজন এমন রাজনীতিবীদের যাঁর রয়েছে অতি উন্নত মানের দেহ, মন এবং আত্মার গুণাবলী। এমন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বভার অসত্, অকর্মণ্য, নির্বোধ এবং দেশপ্রমিক নন এমন ব্যক্তিদের হাতে অর্পণ করা হলে তা দেশের জন্য মহাবিপর্যয় ডেকে আনে। দেশের সাধারণ জনগণ যতদিন এ সত্য অনুধাবনে ব্যর্থ হয়ে তাঁদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করে অযোগ্য ব্যাক্তিদের নির্বাচিত করে সংসদে পাঠাবেন ততদিন সামরিক-বেসামরিক প্রশাসন, বিচারালয়, শিক্ষাঙ্গন, চিকিত্সালয়, ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্প, কোনো ক্ষেত্রেই সত্ ও যোগ্য ব্যক্তিরা সিনিয়র পজিশনে ঠাঁই পাবেন না। আমি বিশ্বাস করি, দেশের সচেতন জনগোষ্ঠি, বিশেষ করে ছাত্ররাজনীতির সাথে জড়িত নন এমন শিক্ষিত তরুণ-তরুণীরা এবং দেশপ্রেমিক গণমাধ্যম যদি এগিয়ে আসেন তাহলে দেশের সাধারণ জনগণকে ভোটাধিকার প্রয়োগের ক্ষত্রে সচেতন করে তোলা কঠিন হবে না। দেশবাসী সেই আশাতই প্রহর গুণছে। <br /><br /> *********Ashraf's columnhttp://www.blogger.com/profile/16382744974160016625noreply@blogger.com0tag:blogger.com,1999:blog-29831725.post-86830697551596900122010-03-14T23:40:00.000-07:002010-03-14T23:41:27.507-07:00Another ugly face of student politicsI felt thunderstruck with shock and sorrow when I went through the reports published in our daily newspapers on March 12 and 13, 2010 on what is currently going on in the name of student politics in the residential hostels of Eden College and Badrunnessa College in Dhaka. These two are among the most leading educational institutions for our female students. For decades we have been sending our daughters to these institutions to pursue higher education in a well protected and safe environment. Poor parents from villages need not have to worry about their daughters’ education, safety and welfare after they sent their daughters, usually in their late teens, to these girls’ colleges. Now it is reported in the newspapers that our daughters there are being sexually exploited by the female leaders of the Bangladesh Chhatra League (BCL) units of these two colleges. Girls from the hostels are being forced by the “Bara Apas” (elder sisters) to go out of the hostels to render sexual service to senior male students of BCL, political leaders, ministers and businessmen. Those girls who refuse to oblige them are mercilessly beaten up, or are branded as supporters of Jamat-Shibir and thrown out of the hostel. In return the “Bara Apas” get political, financial and other worldly benefits from the persons so entertained. My head hung in shame when I read those reports. All this is happening when the nation has a female prime minister at the helm. If I remember correctly our present prime minister herself was a student of one of these colleges.<br /><br />I write this letter to urge upon the honorable prime minister not to let this matter go without any action as the case of “centurian Manik” of Jahangirnagar University went during her party’s rule from 1996 to 2001. The prime minister may please order for a judicial inquiry into the allegations raised in the newspaper reports, and then ruthlessly deal with the concerned guilty female student leaders of Eden Collge and Badrunnessa College, their patrons in the political parties and BCL Central Committee. The principals of the said colleges and other officials including the hostel superintendents have disgracefully failed to perform their official and sacred duties. They must also be taken to task for their failure to protect our daughters.<br />I would also like to draw the attention of our intellectuals, members of the civil society, and leaders of the human rights organizations and others who are working for the rights of the women, irrespective of their party affiliations, to come out openly and forcefully with demands to save our daughters’ dignity and honor.<br /><br />In the past on many occasions our honorable Supreme Court took suo moto actions in public interest when the court found the government was not doing its duties to the people. In this particular case may we expect the Supreme Court to take necessary legal actions to protect the dignity and honor of our girls, if it finds that the government is not taking any or sufficient action.<br />So far we have been hearing about many crimes like extortion, terrorism, violence, rioting, hijacking, mugging etc being committed by our superannuated student leaders and their followers. Now the newspapers have done a yeomen’s job by bringing to light another ugly facet of our student politics. Our major political parties shall be failing in their obligation to the people if they do not still get rid of the so called student leaders. It is not really understood why a decent political party has to maintain bunches of goons in the name of student leaders, as they are doing it now. In an election people, and not these goons, vote for them. Long gone are those days when student leaders could influence the ordinary voters. The situation is totally different now. People are now afraid of student leaders.Ashraf's columnhttp://www.blogger.com/profile/16382744974160016625noreply@blogger.com0tag:blogger.com,1999:blog-29831725.post-77179494929655910472010-03-12T10:26:00.000-08:002010-03-12T10:28:52.124-08:00Col Taher, Sheikh Mujib, Gen Zia and politics -a letterDear Mr. Abid Rahman,<br /><br />Thanks for your letter. I have gone through your write up attached with it. I do appreciate your frustration for the absence of democracy and misrule by our politicians and generals in Bangladesh. I am sure there are many Bangladeshis like me who share your feelings. But now it seems, at least for the time being, we have no choice but to bear with the two Rahman families, that is, the family members of Sheikh Mujibur Rahman, and Gen Ziaur Rahman.Long time ago when (1962-1966) I was a student of Dhaka University the president of the then Pakistan Field Marshall Ayub Khan published a book called “Friends not Masters”. After so many years I do not remember his exact words. At one place in his book he said that the people of “East Pakistan” were not politically matured enough to practice democracy. Even after 44 years I honestly feel his words still hold good. If it is so, one may question how, then, the Muslims of Bangladesh did not make mistakes in casting their votes in 1946 in favor of establishing Pakistan, in 1954 in favor of the United Front and finally in 1971 in favor of Awami League. The truth lies in the fact that in those days, before 1971, the ordinary voters and their village elders and leaders were very simple people, as they are even now. But their leaders at the national level like the Sher-e-Bangla, Suhrowardy, Bhashani, Sheikh Mujibur Rahman and others alike were, beyond any doubt, patriotic, honest, efficient and pro people. Our people blindly put their trust in them and cast the vote in their favor to bring in the desired change in their life. They were never betrayed by these great leaders, though at times visible contradictions and disagreements among themselves were not uncommon.One may ask why democracy is not taking roots in Bangladesh even long after 39 years of its independence. I am not a student of political science. I would like to explain it in my own way in a layman’s language. In spite of its certain shortcomings democracy is considered to be the best way of governance. But there are some preconditions for the success of democracy. In Bangladesh we do not still fulfill those preconditions. Being poor and uneducated vast majority of our people fail to understand the importance of practice of democracy at all levels of political leadership. We have not yet been able to come out of our past feudal mindset totally. That is why our people still blindly follow the members of some ‘royal’ families. They overlook or ignore the incompetence, inefficiency, corrupt practices and even moral turpitude of the members of these ‘royal’ families. They think it is alright with the political high ups, even though sometimes some of them are convicted by the court for corruption. Our people are still so naïve that in an election they still vote for the members of these ‘royal’ families, and their cronies, sycophants and henchmen against an honest and competent candidate from an ordinary family. This has driven out almost all the good people from our politics. A good man or woman is rarely appreciated in an election. When honest and patriotic people come to power, naturally, they do not yield to internal anti state elements like the corrupt businessmen and bureaucrats, and the external enemies of the nation who want to subjugate us politically and economically. We have both these types of national enemies who feel comfortable while dealing with the members of the ‘royal’ families. As a result they always support and finance the ‘royal’ families mostly from behind the screen. Had there been real democracy and people’s power you could not have raised the complaints against the politicians, as you have done in your write up. In 1971 we got a great political leader in the person of Sheikh Mujibur Rahman. His patriotism, physical and moral courage, honesty and love for the ordinary people were unquestionable. Had there been no Sheikh Mujib there would not have been the Liberation War of Bangladesh in 1971. Without Shekh Mujib’s leadership, probably, it would have taken few more decades to achieve an independent and sovereign Bangladesh. But unfortunately misfortune and trouble started after Sheikh Mujib returned from Pakistani jail to his dreamland of independent and free Bangladesh in January 1972 and took over the administration of the country in his own hands. His failures in political leadership and running the administration of a newly independent and war ravaged country like that of Bangladesh soon disappointed the people. People’s frustration spiraled up. The rest is a very sad and well known part of our national history. Here it may not be out of place to quote a similar situation from the history of China. Chairman Mao Tse Dong, another great leader of the people who fought a liberation war and established the PRC in October, 1949. He personally took over the administration of China and continued to remain its political leader too. He proved to be a bad administrator and messed up the administration in the name historic “Cultural Revolution”. But the Chairman and his people were lucky to have a very wise, pragmatic and efficient prime minister like Zhou En Lai. Zhou En Lai immediately took steps to pull China out of the mess created by Chairman Mao himself and soon put the country on the right track. Chairman Mao, realizing his mistakes, accorded his silent approval to Premier Zhou. Unfortunately for Sheikh Mujib himself and for the people of Bangladesh there was none like Zhou En Lai to bring Sheikh Mujib out of the administrative mess he created. Those of his lieutenants who could play that role were separated from him by the interested quarters soon after he returned to Bangladesh in January, 1972. Who all did it and why did they do so, that being altogether a different story, we leave the subject here. (Interested readers are referred to two books on this subject. One is the “Legacy of Blood” by Anthony Mascarenhas, the other is a Bengali book called “Mooldhara 71” by Moudud Hassan.)You have correctly stated in your attached write up the circumstances under which Sheikh Mujib was brutally killed in 1975 and the way people in general accepted it without any visible signs of sorrow or regret. It took long 21 years for Awami League to rise in 1996 from its ashes. So severe was the damage done to this once popular party during its misrule from 1972 to 1975.Coming to Gen Ziaur Rahman, it can be said that when he was made to assume power he was politically an orphan. He was a professional soldier without any political ambition. If he had any political ambition he could have left the army and joined politics when he was superseded and his junior Gen Shafiullah was made the army chief. Instead, he like a disciplined soldier accepted the order of his political boss and continued to serve as the deputy chief of army staff directly under Gen Shafiullah. It was only after the tragedy of August 15, 1975 he was appointed as the army chief by the political government of a faction of the Awami League headed by Khondoker Mustaq Ahmed. On November 07, 1975 ordinary soldiers, who mutinied against the newly appointed army chief Brig Gen Khaled Mosharraf, rather forced Gen Zia to become the army chief. There being no government in existence in those tumultuous days Gen Zia had no choice but to proclaim himself as the CMLA too. Later he had to become the president under circumstances beyond his control. At that time I was posted as a staff officer in the AHQ. I am an eye witness to many of the incidents that took place in those days in the army. Those who blame Gen Zia for usurping power are not correct. Let me also add here that at that critical time there was no other senior armed forces officer who was acceptable as a commander and leader to the unruly armed soldiers. Gen Zia was acceptable because of his clean and courageous image as a sector commander in the Liberation War, and for his personal honesty, integrity, efficiency and, above all, his charismatic leadership qualities. There was no one else who could beat him in this regard. I was personally present in the meeting in 2nd Field Regiment Artillery in Dhaka Cantonment wherein the armed soldiers (officers present were unarmed and without badges of rank) were insisting upon Gen Zia (the only officer with badges of rank on) to take the command of the army. Gen Zia was not willing to do so. Finally the senior officers present also requested Gen Zia to take over. Gen Zia in his usual way bullied the soldiers for being unruly. He also admonished the officers for failing to exercise command over their respective troops. Finally he came out with some preconditions both for the soldiers and the officers. His preconditions were accepted by all. Gen Zia became the army chief. The army started getting back into discipline. Finally chain of command was restored. If Gen Zia had refused to be the army chief on that day only God knew what would have been the fate of the army and the country. Why and who assassinated Gen Zia in 1981 is a different story which may be told separately.Now, let’s come to Col Taher about whom you mentioned in your write up. Undoubtedly, he was a great soldier, patriot and a revolutionary. Politically he was a disciple of Mao Tse Dong and believed in armed struggle for the emancipation of the people. Theoretically he was probably right. But practically he was not. Chairman Mao’s strategy was, as we all know, to work among the rural people and raise a people’s army with peasants and workers, and then isolate the urban areas by adopting guerilla warfare to defeat the conventional armies of the ruling class. But Col Taher started the other way round. He wanted to start revolution from the top and then pass it down to mass level by force. He wanted to capture the state power by force by capturing the capital city of Dhaka by soldiers of the army only. He could not put his trust on the officers and decided to get them physically eliminated by the soldiers. He organized secret revolutionary cells in the army units with soldiers and some NCOs. They held secret meetings and were waiting for an opportune moment to go for the operation. In some countries such a procedure did work. But in a country like Bangladesh where the soldiers and the officers come from almost the same social class the procedure was not workable. The class contradictions among the soldiers and officers were not too big. It was not a sufficient condition to precipitate a revolution. On the other hand, our soldiers are not trained to go for any military operation without having officers over them as commanders. It is a centuries old practice and belief among the soldiers that soldiers all by themselves are not good enough to fight. Col Taher also did not consider another very pertinent cultural objective condition before he went with his plan. In a country where 100 percent of its people believe in some religion or the other, specially where 90 per cent of the population is Muslim, it was hardly possible to make a Maoist revolution acceptable to the people. Soon after the members of his revolutionary soldiers’ cells went into operation they came to their sense and realized that they, under no circumstances, could kill their own officers. It soon dawned upon them that without officers command they were nothing more than an armed mob. Senior JCOs and NCOs prevailed upon them and brought them back to the barrack. But unfortunately by this time some officers were killed by the unruly soldiers on personal grounds.After Gen Zia assumed the command of the army, naturally, the cases of those soldiers who took leading parts in the mutiny, and who killed the officers could not be ignored by him in the interest of restoring discipline and order in the army. No one else in his place could do so. Without dispensing justice to the mutineers and the killers the army could not be reorganized as a disciplined force. Inquiries were held. Col Taher was found as one of the conspirators and instigators. As a retired officer he was still under some provisions of the army act that dealt with serious crimes like mutiny. He was tried in a military court and was given death sentence that was executed by hanging. Some other soldiers were also given death sentence and rigorous imprisonment for life and other terms by military courts. It is because of this stern lawful action taken by Gen Zia that there has not been any mutiny by the soldiers thereafter. It required guts to take such a strong action. Gen Zia had that guts. Some politicians these days criticize Gen Zia for taking these stringent actions without realizing what service he did to the nation by quelling that, and other mutinies that followed in quick succession, with an iron hand. After that there has been no mutiny in the army, though at times the soldiers faced enough provocations. Consequently our rulers, however good or bad they may be, have been ruling the country without thinking of any threat from the cantonments. Many of our civilian brothers often forget that army is not a political organization. There is no room for “Zindabad-Murdabad”or “Manina-Manina” in the army. In the army one is under solemn oath to carry out all lawful commands of his superior even to the peril of one’s life. One cannot reason why. One is to do or die. It was, and still is, an article of professional faith in all the armies of the world. It is not the function of an army to make or unmake a government. It is the function of the army to carry out the orders of the government. In spite that sometimes unfortunately the army takes over the state power in a country. Sometimes back in 2008 I tried to explain the reason for and the ultimate consequence of military rule in one of my writings. I sent it for publication to an English daily newspaper published from Dhaka. The editor of the paper did not publish it. May be, he did not want to annoy the army top brass! I quote the same hereunder for you. It explains why and how we had martial law and quasi martial law (like Gen Moyeen U Ahmed’s rule) rules in our country.<br />In your write up you have mentioned about harboring and political rehabilitation of razakars by Gen Zia. It is very unfortunate that being a valiant and decorated freedom fighter himself Gen Zia had to rehabilitate infamous razakars like Shah Azizur Rahman, Abdul Alim and others. When Gen Zia was catapulted to state power he was politically an orphan, as I already mentioned earlier. He had no political party or supporters to back him up. He could neither rely on the army’s support indefinitely to hold the highest political appointment in the country. To earn internal and international political respectability and recognition he had to become an elected president. For that he needed a political party at his back. Awami League, though smashed into small splinter groups without any leadership, could not accept Gen Zia as an ally. Other parties were so insignificantly small and unimportant that they did not matter at all. Gen Zia not only needed a party but also some senior leaders with ample parliamentary experience to run the party and to translate his political visions, which he developed by that time, into reality to reconstruct the war ravaged country. At that stage he could not give up. There was no one available who could successfully take over the political leadership from him. So he had to carry on. For the prevailing international and regional geopolitical realities too, the country could not be left to the hands of the laymen. Under these circumstances, Gen Zia had to welcome razakars who were senior and experienced politicians to help him run the affairs of the state. But he never handed over the command and control to them. It is easy to blame Gen Zia politically, now, for doing so. But the question as to what else, under the circumstances, he could do in the national interest remains unanswered. In your write up you have catalogued our present political maladies. If such maladies continue, in the next general election to be held in 2013/14 a member from Gen Ziaur Rahman’s family (BNP) will probably be elected as the “King” or the “Queen”. After another five years a member from Sheikh Mujibur Rahman’s family (AL) will in the similar way be elected as the “King” or the “Queen”. In the name of democracy we shall continue to have “Kings” and “Queens” for years to come. They will rule over us unchallenged as worst dictators, as they are doing now without being accountable to anyone. Anti Corruption Commission will never be able to touch them. The arm of law will never be long enough to reach them. They will nominate people with questionable ability, honesty and integrity and vulgar tongue to the parliament. They will relish listening to eulogies sung in their honor and vulgar exchanges made to glorify them in the parliament, as it is being done now. They do not believe in having supporters for their political ideologies, they believe in having slaves only. They will continue to divide all national organizations, government employees and professionals on political basis. The guiding principle will be, as it is now, either you belong to my party with the loyalty of a slave, or you are my enemy. There will be no room for anyone with nonpartisan views. You could have come out with some suggestions to get out of it. I have my own ideas. I feel, our cup of sorrows should be full by this time. We had enough of it. A time may come within next 10 to 15 years when there may be a popular uprising against the corrupt and inefficient political leadership. The leadership for such a revolutionary uprising might come from any unexpected quarters. Or, as I guess, educated and enlightened young men and women like you who are now working abroad will start coming back home, as the expatriate Chinese and the Indians are doing now, within next 5 to 10 years. These young people with their knowledge and experience gathered in various advanced countries will make contributions to raise the political awareness of our people through a slow but steady evolutionary process. This process, over a time, might bring in the desired changes in our national political environment.Or, in a worst scenario, we may be branded as a failed state like Somalia by the interested global and regional powers. In that case some regional power might take the opportunity to send its troops to physically occupy Bangladesh on behalf of the UN to discipline us. God forbid, if that happens we may have to fight another war of liberation. You may do some brainstorming on how the people of Bangladesh could get out of the present situation and share your ideas with your readers. That would, I am sure, make your write up more interesting.I have already taken enough of your time. I must stop here now. With best wishes and regards.Syed AshrafuzzamanAshraf's columnhttp://www.blogger.com/profile/16382744974160016625noreply@blogger.com0tag:blogger.com,1999:blog-29831725.post-50748063213725299532010-03-10T00:12:00.000-08:002010-03-10T00:14:49.836-08:00Pet Kata Bibek -On our doctorsTo: Mr. Abid Rahman<br />Copy to: Mr. Nayyemul Islam Khan <br />Editor, The Daily Amader Shomoy.<br /><br />Dear Mr. Abid Rahman,<br /><br />I write this letter to thank you for your well written and thought provoking write up on the present day Bangladeshi medical practitioners ("Pet Kata Bibek") published in the Daily Amader Shomoy on March 08, 2010. You have very rightly and precisely painted the picture of various malpractices committed by most of our doctors. Like many of my compatriots I consider these doctors as one of the most corrupt professional groups among the highly educated ones in our society. You have mentioned most of their major corrupt practices in your write up. From my personal experience I would like to add three more. Firstly, most of our doctors do not keep themselves abreast with the latest developments in their respective fields of knowledge. In this age of Internet communication it is so easy and convenient to keep track of developments taking place in any branch of science and technology including medical science. But where is the time for our doctors to study and update their professional knowledge? They earn so much of money with their outdated and rusted knowledge. Why should they care to waste (?) time on further study ? Secondly, in the recent past under compulsive circumstances I had to go to medical practitioners in India, Singapore and the US for the treatment of my wife and myself. Leave aside the best possible treatment and courtesy we received from the doctors there, every time I made a payment to each of them I was given a proper money receipt without asking for it. I do not know if any private medical practitioner does so in Bangladesh. Thirdly, we are not aware of any case wherein a medical practitioner was punished by the BMDC (Bangladesh Medical and Dental Council) or by a court of law for committing malpractice, professional misconduct, negligence of duty or bribery. <br /><br />To overcome the above mentioned three serious problems the following actions need to to be taken: a. BMDC should not issue licence to a medical practitioner for life to practice. It should issue the licencefor five years only. After every five years a medical practitioner should be made to undertake a professional test by the BMDC before his/her licence is renewed for another term of five years. This practice will compel all our doctors, young and old, to spend at least some time of the day or week for professional studies. b. It should be mandatory by law for a medical practitioner to issue a proper money receipt to every client for the money s/he receives for services rendered in his/her private capacity. This will help income tax authorities to keep a track of the huge personal income the doctors make. c. Presently BMDC or the courts of law cannot, as they claim, take actions against recalcitrant doctors due to lack of legal provisions. All relevant laws, rules and regulations must be updated so that appropriate legal actions can be taken against a wrongdoing medical practitioner. All non professional organisations like SCP, DAB etc should be banned by law. Only Bangladesh Medical Association (BMA) should be allowed to function strictly as a professional organisation of the medical practitioners. d. Young students who study medicine in government medical colleges should be reminded by their teachers that the medical colleges are established and run by the money paid by the poor tax payers of Bangladesh. They should be motivated to serve the people. For that the teachers have to be patriotic and professionally honest first. It is only the government by passing necessary laws in the parliament and issuing executive orders can ensure the accountability of the medical practitioners. But unfortunately, on being guided by their ill motives to cheat our people unabashedly, our medical practitioners, by and large, have so far been successful in refraining all our governments of the past and the present from passing such laws and executive orders. Leaving aside their professional matters our doctors are now more busy in doing raw politics. Both the two major political parties AL and BNP have been giving indulgence to our doctors in this regard. AL is patronising Swadhinota Chikitshok Parishod (SCP) and BNP is patronizing Doctors' Association of Bangladesh (DAB). (I understand Jamat-I-Islami has also floated its own medical front.) It is because of this pampering by the top political leaders the doctors are totally spoilt. It is never the doctors who decisively vote the politicians to power. Rather, the doctors are a very microscopic cross section of our population. Because of their lack of acceptability in the society they do not and cannot have any political influence upon our voters. It is not understood why our top politicians always give such indulgence to the greedy doctors. Even in the present government of AL there is a cabinet minister, a state minister and an advisor with cabinet status in the ministry of health who all are medical practitioners and SCP leaders. Does the prime minister really need three doctors to run this ministry ? If yes, then she should send home all her non technical ministers from ministries like communication, shipping, works, livestock, environment etc and replace them with technical people having academic degrees in the relevant subjects. To give leadership at a political level, as our ministers are required to do, one need not be a professional expert. Instead, one should be a good politician to feel the pulse and problems of the people. The rest is done by the technical experts in the relevant ministry. Doctors as a professional group has been having a joy ride on the shoulders of our politicians at the cost of the interest of our people. This anti people practice must be brought to an end. Doctors must be disciplined. For that our top political leaders must take all necessary actions including enactment of laws. As long as that does not happen the people of Bangladesh will continue to be exploited by their own doctors. It may not be out of place to state here that it is not only the politicians, our media have also been not doing enough to eradicate this national malady. In the past I sometimes wrote to some English newspapers on the subject. In most cases the editors found it wise not publish anything that went against the doctors. Others edited my writings before publication in such a manner that the doctors did not feel offended.<br /><br />The media people also need to come out of their present shyness to expose the weaknesses in this sector. Here I must thank Mr. Nayeemul Islam Khan for taking initiative in this regard by publishing your present write up. He has certainly shown enough guts in doing so. I am also sending a copy of this letter to him for his kind information. I do agree that there are some very dedicated doctors in our country. Generally we do not know their names as they are not active members of SCP or DAB , and they do not care for cheap popularity. We always salute them. But the fact remains that a few white dots, however bright they may be, cannot make a blackboard white. I would have certainly been happier if I could write this letter to you in our mother tongue Bengali. I cannot do so for two reasons. Firstly, presently I do not have the software necessary to write in Bengali. Secondly, my Bengali is very poor. I wish I could have a strong pen like you. I would request you to kindly write more and more on this subject to initiate a popular movement so that our politicians are compelled to pay heed to it. I am sure more media giants like Mr. Nayeemul Islam Khan will come forward to join the movement.Ashraf's columnhttp://www.blogger.com/profile/16382744974160016625noreply@blogger.com0tag:blogger.com,1999:blog-29831725.post-24127539927117234532009-10-23T19:26:00.000-07:002009-10-23T19:27:40.091-07:00Quota for war heroes’ childrenIt is reported (DS October 18) that the government is taking an initiative to grant 30 per cent quota to the children of our war heroes in the ensuing selection of assistant judges. I would request the government to give a second thought to the idea. A judge must possess a very high level of IQ, profound knowledge and integrity. A war hero’s son or daughter may not necessarily have those qualities of head and heart and may not qualify in the selection tests. There is nothing wrong in that. Everybody is not cut for everything. If one does not qualify in the tests for the selection of judges one may try to do something elsewhere where s/he might excel. If a wrong candidate who does not have the required intellectual ability, knowledge and integrity is appointed as a judge s/he will be failing to apply her/his judicial mind correctly. People who will be going to such a judge for justice will be deprived of justice. People will suffer in the hands of such an incompetent judge for about 30 years or so till s/he retires. Merit and competence should be the only criteria while selecting candidates for posts like those of judges, and nothing else. It is said that as shadows of God judges dispense justice on His behalf. People who will deliberately select wrong kind of people as judges will surely be held responsible by God on the Great Day of Judgment. That is what we all believers believe in. <br /><br />Our war heroes are the greatest sons and daughters of our country. Their children deserve our highest consideration. They must be looked after by the state. Everything possible must be done to ameliorate their hardships. But nothing should be done, which ultimately goes against the interest of the people of the country. They may be given free education in educational institutions run by the government; they may be given free medical treatment in all government hospitals, the deserving ones may be given ration at subsidized rates, they may be given bank loans on very soft terms to do business; they may be given government khas land for farming; or they may be given priority in appointment in such jobs which are not as sensitive as that of a judge.Ashraf's columnhttp://www.blogger.com/profile/16382744974160016625noreply@blogger.com0tag:blogger.com,1999:blog-29831725.post-5194541864083067302009-10-23T19:20:00.000-07:002009-10-23T19:21:43.254-07:00Our doctors need to be disciplinedRecently some surgeon(s) at the Dhaka Medical College Hospital stitched up a patient after surgery with a scalpel blade in the patient’s abdomen (DS October 22). A small schoolgirl lost her life in the same hospital due the negligence of the doctor(s) on duty (TV news October 22). Almost everyday many such incidents of criminal negligence, indifference, malpractice and incompetence by the doctors in Bangladesh are taking place in government and non-government hospitals. For obvious reasons it is not possible for the media to report all these unfortunate incidents. Since the liberation of Bangladesh we have not heard of any single case wherein any recalcitrant medical practitioner has been taken to task either by the government (ministry of health) or by the Bangladesh Medical and Dental Council (BMDC), the two guardians of our national healthcare system. In some cases, after the incidents were reported in the media, inquiry committees were constituted. Reports and recommendations submitted by these committees were never made public, nor did we ever hear that any actions were taken against any wrongdoing doctor. Some cases were taken to the court of law by those aggrieved parties who could afford such litigation, but with no result. Because the relevant laws in our country do not protect the rights of the patients. Whenever the health ministry or the BMDC is asked about such an incident the bosses who run these offices always come out with the pet reply that they have not received any such complaint in writing from the aggrieved patient or his/her next of kin. The other very common reply to such a query is that the existing laws in this regard are not adequate to take a recalcitrant doctor to task.<br /><br />Be that as it may, the fact remains that the people of our country, even after 38 years of our independence, are still helpless hostages in the hands of our doctors. Our present health minister, the health advisor to the honorable prime minister and the state minister for health are all from the medical profession. (It is not understood why so many doctors are necessary to run one single ministry like the health ministry. The appointing authority might be reminded of the old proverb: Too many cooks spoil the broth.) The leading bureaucrats at the health ministry and the health directorate are all doctors. Being doctors themselves, all these (doctors turned) politicians and medical bureaucrats probably do not see anything wrong or unethical in the professional activities of their brothers and sisters in the medical profession. Their track record bears testimony to the fact that, for decades, they have so far been giving protection to the wrong doing doctors. Otherwise, the situation could not turn so bad, as it is today. The senior doctors who are running the affairs of the health ministry and BMDC as ministers, advisors or bureaucrats cannot escape the responsibility. Very often these leading doctors tell us in TV talk shows that they are handicapped by fund constraint to run the affairs of the health ministry effectively. It is only the half-truth, not the whole truth. What fund constraint stops a surgeon from taking the scalpel blade out of the abdomen before the patient is stitched up ? What fund constraint makes a government doctor leave his/her place of duty and indulge in private practice during the time when s/he is supposed to serve tax payers free of cost ? It is not always a question of availability of fund. In most cases our people are not getting proper attention of the doctors because of their greed for money. Most of our doctors conveniently forget that the medical colleges wherefrom they graduated were established and are run by the taxpayer’s money. The pay and allowances paid to the government doctors also come from the same source. Certainly they owe an obligation to our people. It is, therefore, primarily a question of attitude on the part of our doctors. <br /><br />The present ministers and the advisor are very active leaders of the pro Awami League trade union of the doctors called Shwadhinota Chikitshok Parishod (SCP). Senior health officials, like DG health, are also leaders of SCP. Similarly, when BNP was in power the leaders of the Doctors’ Association of Bangladesh (DAB), the trade union of the pro BNP doctors ran the health care system of Bangladesh. It is these SCP and DAB leaders who for their personal aggrandizement are spoiling the health care system in our country. Otherwise, with all its shortcomings and fund constraints our government and non-government hospitals could offer much better service to our people.<br /><br />Finally, I would like to draw the attention of the honorable prime minister and the members of our parliament to kindly look into the matter before one of their dear ones falls victim to the indifferent attitude of, or corrupt practice by, a doctor. It may so happen that one day, when they will no more be ministers or MPs, a dishonest doctor may victimize one of them. It is in their own interest, and the interest of the people whom they serve. We had enough of it. The nation can no more bear with the irresponsible and unethical activities of our doctors and their leaders. It is high time the government takes necessary actions to discipline the doctors before it is too late. The existing laws relating to medical profession are, no doubt, anti people. The present lawmakers may please make them pro people immediately. The parliament must make necessary laws to ban all trade unions like organizations like SCP and DAB. Bangladesh Medical Association (BMA) is good enough to look after and promote the professional interest of our doctors.<br /><br />Before I finish I must apologize to those of our doctors who have been rendering dedicated service to our people. This letter is not meant for them. Surely they are the honorable exceptions. But the fact remains that however bright some white spots may appear on a blackboard, those cannot make the board look white.Ashraf's columnhttp://www.blogger.com/profile/16382744974160016625noreply@blogger.com0tag:blogger.com,1999:blog-29831725.post-64981544895298414142009-10-18T12:00:00.000-07:002009-10-18T12:05:35.350-07:00ACC: The toothless tigerThe respectable Chairman of the Anti Corruption Commission (ACC), after having worked in the organization for about three months, has expressed his helplessness in dealing with the corrupt people. He called the ACC a “toothless tiger”. He did so not quietly, but loudly in a press conference. Our media people took it as a bombshell and treated it as such in their respective newspapers and TV channels. The present Chairman of ACC, Mr. Ghulam Rahman, is known for his personal honesty and efficiency, which is a rare quality among our present day bureaucrats. I do not believe a responsible officer like him has not called his own organization ACC for a gimmick. He must have done it, I believe, to let the countrymen know why he cannot do his job. It’s a wakeup call to the present government of Sheikh Hasina. <br /><br />If we take a close look at the history of the ACC we find that since its inception it has been getting a very shabby deal from the people who ruled us from time to time. It has always been a paper tiger. Many of our political leaders, senior bureaucrats, and leading businessmen who in connivance with one another have been sucking the blood of our people for decades never allowed ACC to have its biting teeth and claws. These people and their representatives who sit in the parliament would never, as it appears, pass laws necessary to make ACC an effective organ of the state. The reason is not far to fetch. An effective ACC would verily stand on the way of these people to indulge in rampant corruption.<br /><br />During the last two years rule of the caretaker government (CT) the people of Bangladesh witnessed with awe and horror how deep rooted and wide spread corruption was in our country. The ACC at that time unearthed many cases of corruption involving trillions of taka and took the corrupt ones to the court of law for trial under some ordinances passed by the CT. It is true that while doing so some ACC officials committed some avoidable excesses, and some innocent people were harassed. But the public perception at that time was, and still is, that most of those who were caught by the ACC were highly corrupt. People of Bangladesh are shocked and surprised to see that almost all the persons indicted by the ACC came out, and are still coming out, of the courts totally unscathed. Many such people are audaciously showing ‘V’ sign to their supporters while embarking on or disembarking from the prison van. Our media are also showing such pictures with a kind of fanfare to glorify these people. Still there are others who were accused of corruption are now trying to be heroes in TV talk shows and also in the parliament. It happened so, not for the fact that all these people were not corrupt, but because of the loopholes in the relevant laws, and shortage of efficient manpower in the ACC. If the laws were pro people, instead of being pro corrupt, and the ACC were equipped with competent officers, if not all, many of those who were caught by the ACC would have been punished by the court. It all happened so because the honourable members of the parliament who were elected in the general election held in December, 2008 were all united in not ratifying the anti corruption ordinances promulgated by the former CT. If the Establishment Division could be made to post suitable officers to the ACC things would have been different. But unfortunately the senior civil servants who head the Establishment Division, like their political counterparts, do not want to see an independent and strong ACC for reasons well known to us. <br /><br />It now all depends on the honorable Prime Minister Sheikh Hasina who in her party’s pre election manifestoes promised to the nation that she and her party would fight tooth and nail against corruption. No less a person than the Chairman of the ACC has now publicly expressed his helplessness by calling the ACC as a “toothless tiger”. Notwithstanding what her political and bureaucratic advisors tell her on the subject, history will hold Sheikh Hasina personally and solely responsible for not doing enough to make the ACC a tiger with teeth. Her party will also have to pay a heavy price in future elections. There is no good reason to think why should Sheikh Hasina take the responsibility for such a bad consequence. Let’s have no more of rhetoric from our leaders.Ashraf's columnhttp://www.blogger.com/profile/16382744974160016625noreply@blogger.com0