Ashraf’s Column

Saturday, May 24, 2014

ক্যাডেট কলেজের টুকরো স্মৃতি: ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজ: পর্ব ৭

If you fail to keep the boys busy, they will keep you busy ! উপরের কথাটি যে কোনো আবাসিক স্কুল, তা ছেলেদের বা মেয়েদের যাদের জন্য হোক না কেনো, সবার জন্য একটি পরীক্ষীত পুরাতন সত্য কথা। এ জন্য ক্যাডেট কলেজে দৈনিক কর্মসূচিতে নিয়মিত লেখাপড়া ও খেলাধুলা ছাড়া আরও অনেক রকমের কাজকর্ম ক্যাডেটদের জন্য নির্ধারন করা হয়ে থাকে। বিশেষ করে উইকএন্ডে এবং সরকারি ছুটির দিনে ক্যাডেটদের ব্যাস্ত রাখার জন্য নানা প্রকার ফিল্ড এক্টিভিটি যেমন আউটডোর খেলাধুলা, ক্রসকান্ট্রি দৌড়, হাইকিং, এডভেঞ্চার ট্রিপ, পিকনিক, আর্মি, নেভী এবং এয়ারফোর্সের ইউনিট ভিজিট, নিকটবতর্তী ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ স্থান ও যাদুঘর ভিজিট; স্টেইজ একটিভিটি যেমন কারেন্ট এফেয়ার্স ডিসপ্লে, বক্তৃতা-আবৃত্তি-বিতর্ক প্রতিযোগিতা, নাটক মঞ্চায়ন, সঙ্গীতানুষ্ঠান ইত্যাদির ব্যবস্থা করা হয়। ক্যডেট কলেজের শিক্ষকদের অবস্থা অনেকটা আমাদের দেশের মায়েদের মতো। যতোক্ষণ সন্তান বাড়িতে আছে ততোক্ষণ মায়ের কোনো সাপ্তাহিক, বাৎসরিক বা সরকারি ছুটি নেই। হরতাল-ধর্মঘট নেই। চিন্তার কোনো শেষ নেই। সময়মতো তাঁকে সন্তানের খাবারের আয়োজন করতে হয়, অন্যান্য দেখভাল করতে হয়। বরং ছুটির দিনগুলোতে ক্যাডেট কলেজের শিক্ষকরা তুলনামূলকভাবে বেশি ব্যাস্ত থাকেন। আমি এমন ঘটনা বহুবার প্রত্যক্ষ করেছি যেখানে একজন হাউস মাস্টার বা হাউস টিউটর বাসায় নিজের সন্তানকে অসুস্থ ফেলে রেখে কলেজে এসে অসুস্থ ক্যাডেটের দেখাশুনা করছেন। যুক্তি একটাই। বাসায় রখে আসা নিজ সন্তানকে দেখার জন্য তার মা রয়েছেন। অসুস্থ ক্যাডেটকে তিনি ছাড়া তো আর কেউ দেখার নেই। এসব কারণে পাকিস্তান আমলে প্রতিষ্ঠার সময় থেকে ক্যাডেট কলেজের শিক্ষকদের জন্য বিশেষ বেতন স্কেল ছিলো। যা সরকারি কলেজের শিক্ষকদের চাইতে বেশি ছিলো। তাছাড়া অতিরিক্ত ভাতাসহ কিছু সুযোগসুবিধা দেওয়া হতো। তা না হলে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করে আসা মেধাবী চৌকশ তরুনদের ক্যাডেট কলেজে শিক্ষকতার পেশায় আকর্ষণ করা সম্ভব ছিলো না। এখানে উল্লেখ্য যে, ক্যাডেট কলেজের শিক্ষকরা অতীতে কখনও প্রাইভেট পড়ানো বা কোচিং সেন্টার চালানোর সময়, সুযোগ অথবা অনুমতি পেতেন না। বর্তমানেও পান না। ১৯৭১ সনে দেশ স্বাধীন হবার পর দুর্ভাগ্যবশত: তৎকালীন শাসকরা, আরও অনেক সূক্ষ বিষয়ের মতো, এই বিষয়টিও অনুধাবন করতে ব্যর্থ হন। কিছু হিংসুটে মতলববাজ লোক তাঁদেরকে বুঝালেন, যেহেতু সরকারি কলেজ এবং ক্যাডেট কলেজ উভয়ের ফ্যাকাল্টির সর্বনিম্ন পদের নাম লেকচারার, সুতরাং উভয়ের বেতনের স্কেল অভিন্ন হতে হবে। নইলে সরকারি কলেজের শিক্ষকরা নারাজ হবেন। যেমন বলা হতো, সড়ক ও জনপথ বিভাগের জংগলের মধ্যে অবস্থিত রেস্ট হাউসে কর্মরত বাবুর্চি এবং বঙ্গভবনে কর্মরত মহামান্য প্রেসিডেন্টের বাবুর্চি, দু’জনই বাবুর্চি। সুতরাং দুই বাবুর্চির বেতন স্কেল অভিন্ন হতে হবে ! আরও বুঝানো হলো, যেহেতু ক্যাডেট কলেজে প্রধানত: স্কুল পর্যায়ে শিক্ষাদান করা হয়, সেহেতু সেখানে সরকারি কলেজের পে-স্কেল প্রদান করা যুক্তিযুক্ত নয়। শাসকগণ একথা বিবেচনায় নিলেন না, কেনো প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে ক্যাডেট কলেজকে বিশেষ প্রতিষ্ঠান হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছিলো। কাজটি করা হয়েছলো জাতীয় স্বার্থে। ফলশ্রুতি হিসেবে, মেধাবী এবং চৌকশ তরুনরা বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়ে ক্যাডেট কলেজে শিক্ষকতা করতে আসতেন। স্বাধীনতার পর ক্যাডেট কলেজের শিক্ষকদের বেতনভাতা ডাউনগ্রেইড করা হলে পরিণতিতে যা হবার তাই হলো। অনেক দক্ষ শিক্ষক ক্যাডেট কলেজ ছেড়ে চলে গেলেন। মধ্যপ্রাচ্য এবং আফ্রিকার কিছু দেশ এসব শিক্ষকদের ভালো বেতন-ভাতা দিয়ে লুফে নিলো। তারপরও কিছু অভিজ্ঞ শিক্ষক রয়ে গিয়েছিলেন যাঁরা ১৯৮০এর দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত কাজ করে চাকুরি থেকে স্বাভাবিক অবসর নেন। তার পরের কথা না বলাই ভালো হবে। যাঁদের শক্তিশালী হাতে বিধাতা রাষ্ট্র পরিচালনার ভার দেন তাঁরা যদি দয়া করে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা সম্পর্কে একটা কথা মনে রাখেন তাহলে দেশ ও জাতির উপকার হবে। নইলে যা হয় তা তো চোখের সামনে দেখছি। কথাটা হলো, যে কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মেরুদন্ড হলো তার শিক্ষকমন্ডলী। ইংরেজিতে যাকে বলা হয় ফ্যাকাল্টি। মাথাভারি ম্যানেজিং কমিটি, বড় বিল্ডিং, সুন্দর বাগান সব কিছু প্রাণহীন হয়ে যায় যদি শিক্ষকরা কাজের না হন। কোনো অফিসে দশজন কেরানি বা অফিসারের মধ্যে এক বা দু’জন কমজোর বা অযোগ্য হলে কাজ চালিয়ে নেয়া যায়। কিন্তু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে একটি ক্লাসরুমে মাত্র একজন শিক্ষক পাঠদান করেন। কোনো কারণে তিনি ব্যর্থ হলে সেই ক্লাসের সকল শিক্ষার্থীর একটা পিরিয়ড অযথা নষ্ট হয়ে যায়। এমন করে একজন ব্যর্থ শিক্ষক বছরের পর বছর শতশত ছাত্রের শতশত ঘন্টা নষ্ট করেন। আর এজন্য সে শিক্ষককে দায়ী করা যায় না। তিনি নিজেকে নিজে নিয়োগ দনে না। যাঁরা রাস্ট্র বা কমিউনিটির পক্ষ থেকে এসব শিক্ষক সিলেকশন এবং নিয়োগ দান করে থাকেন তাঁরাই এ ব্যর্থতার জন্য পুরোপুরি দায়ী। শতশত শিক্ষার্থীর শিক্ষা জীবন ক্ষতিগ্রস্ত করার জন্য অবশ্যই তাঁদেরকে, ভোটারদের কাছে না হোক, বিধাতার কাছে জবাবদিহি করতে হবে বলে আমি বিশ্বাস করি। যাহোক, এবার আগের কথায় ফিরে আসি। আমি লক্ষ্য করলাম, ক্যাডেটরা সব সময় কেনো জানি কাজেকর্মে উৎসাহ ধরে রাখতে পারছে না। সব কিছু চলছে যেনো মেশিনের মতো। নির্ধারিত কাজ কলেজের নিয়মানুযায়ী করতে হবে, তাই করে যাচ্ছে। তাতে নেই কোনো প্রাণের ছোঁয়া। আমার ভাগ্য ভালো, তখন পর্যন্ত পাকিস্তান আমলে নিয়োগ পাওয়া সিনিয়র শিক্ষক মি: করিম, মি: আশরাফ আলী এবং মি: মন্ডলের মতো দক্ষ ও অভিজ্ঞ ব্যক্তিরা হাউস মাস্টারের দায়িত্ব পালন করছিলেন। ভাইস প্রিন্সিপাল মি: এফ এম আব্দুর রব একজন অতি দক্ষ এবং সক্রিয় পেশাদার শিক্ষক ছিলেন। চমৎকার সহকর্মী এবং বন্ধু ছিলেন। আর্মি থেকে ডেপুটেশনে আসা এডজুটেন্ট মেজর মঈন ছিলেন ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজের প্রাক্তন ক্যাডেট। অত্যন্ত ডেডিকেটেড এবং পেশাদার আর্মি অফিসার। প্রিন্সিপাল হিসেবে আমি কী প্রত্যাশা করি তা কখনও বিস্তারিতভাবে বলতে হতো না। ইশারাই যথেষ্ট ছিলো। ক্যাডেট মেসের ভারপ্রাপ্ত অফিসার ছিলেন আর্টস এন্ড ক্রাফ্টসের শিক্ষক মি: কামাল মাহমুদ। অত্যন্ত পরিশ্রমী, সৎ ও নিরহংকার মানুষ। আর্মি মেডিকেল কোর থেকে ডেপুটেশনে আসা মেজর (পরে লে: কর্নেল, বর্তমানে মরহুম) কফিলউদ্দিন আহমদ (বিখ্যাত অভিনেতা তৌকীর আহমদের পিতা) ছিলেন মেডিকেল অফিসার। অল্প দিনের মধ্যে এঁদের সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় ক্যাডেটদের কর্মচাঞ্চল্য নতুন উচ্চতায় পৌছতে পেরেছিলো। ক্যাডেটদের মধ্যে শৃংখলা ভংগের ঘটনা উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেলো। লেখাপড়া, খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডসহ সকল ক্ষেত্রে ক্যাডেটরা জাতীয় পর্যায়ে উৎকর্ষের স্বাক্ষর রাখতে লাগলো। প্রশাসনের শৈথিল্য বা ব্যর্থতার কারণে কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা যদি শৃংখলা ভংগ করে, এবং সেজন্য তাদেরকে শাস্তি দেওয়া হয়, তাহলে সেটা খুব পরিতাপের বিষয়। ব্যাপারটা অনেকটা এরকম: কাউকে আপনি একদিকে কাতুকুতু দিলেন, অন্যদিকে তাকে হাসতে বারণ করে বললেন, খবরদার ! হাসবে না, হাসলে সাজা দেবো ! কিন্তু সে হেসে দিলো, আপনি তাকে সেজন্য সাজা দিলেন। এমন অযোগ্য প্রশাসক, তা যে কোনো প্রতিষ্ঠানের হোক না কেনো, কখনও কল্যাণ বয়ে আনতে পারে না। কোনো জাতির ভবিষ্যতকে অন্ধকারে ঠেলে দিতে হলে তার সহজতম উপায় হলো সে জাতির শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে অযোগ্য প্রধান এবং অযোগ্য শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া।