ক্যাডেট কলেজের টুকরো স্মৃতি: ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজ: পর্ব ৮: দুষ্টামির পক্ষে ওকালতি !
ক্যাডেট কলেজের টুকরো স্মৃতি: ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজ: পর্ব ৮
দুষ্টামির পক্ষে ওকালতি !
আমাকে যাঁরা ব্যক্তিগতভাবে চেনেন তাঁরা হয়তো এই লেখার শিরোনাম দেখে বলবেন, বুঝেছি, নিজে দাদা-নানা হয়েছো তো, তাই ছোটোদের হয়ে ওকালতি করতে এসেছো ! কথাটা পুরো না হলেও অনেকটা সত্যি। বিষয়টি গভীরে গিয়ে বুঝার জন্য আমাকে কিছুটা বুড়ো হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছে বৈ কি! কিছুটা নিজের নাতিনাতনিদের দেখে, কিছুটা মাস্টারি জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে এবং বাকিটা পড়াশুনা করে যা জেনেছি, আজকে তা-ই পাঠকদের সাথে শেয়ার করতে চাই।
ছোটোদের যে ক’টি সহজাত প্রবৃত্তি আছে তার মধ্যে দুষ্টামি অন্যতম। মোটামুটি পাঁচ বছর বয়স থেকে শিশুদের বুদ্ধিবৃত্তির বিকাশ ঘটে। এজন্য শিক্ষা মনোবিজ্ঞানীরা পাঁচ বছর বয়স হবার আগে বাচ্চাদের আনুষ্ঠানিক শিক্ষাদান অনুমোদন করেন না। পাঁচ বছর বয়স থেকে শিশুরা অল্পঅল্প ভালোমন্দ, কী করলে কী হতে পারে এসব বুঝতে শেখে। আর তখন থেকে দুষ্টামি করা শুরু হয়। দুষ্টামি করার নানা উদ্দেশ্য হতে পারে। নির্দোষ আনন্দ বা তামাসা করার জন্য হতে পারে। কোনো কঠিন কাজ বা চালাকি করে নিজের বাহাদুরি দেখাবার জন্য হতে পারে। কখনও বড়দের উপর রাগ প্রকাশ করার জন্য, বা প্রতিশোধ নেবার জন্য হতে পারে। মায়ের উপর রাগ করে সব আচার খেয়ে ফেলে বয়াম খালি করে ফেলা আমাদের ছোটোবেলায় খুব কমন দুষ্টামি ছিলো। উদ্দেশ্য যা-ই হোক, দুষ্টামি করতে হলে বুদ্ধি লাগে। দুষ্টামি করতে হলে লক্ষ্য নির্ধারণ করতে হয়। প্ল্যান করতে হয়। প্ল্যান কার্যকর করার একাধিক পন্থা থেকে সবচাইতে কার্যকরটি বেছে নিতে হয়। এসব কিছু করার জন্য চিন্তাধারার মধ্যে সংগতি (coherence) ও ধারাবাহিকতা (continuity) রাখতে হয়। দুষ্টামির পরিণতি দেখার জন্য বা উপভোগ করার জন্য অবশ্যই কাউকে না কাউকে টার্গেট বা লক্ষ্য স্থীর করা হয়। বোকারা দুষ্টামি করতে পারে না। করলেও তা দুষ্টামি না হয়ে বোকামি হয়। ছোটোদের মধ্যে যার যতো বেশি বুদ্ধি তার দুষ্টামি ততো তীক্ষ্ন ও ফলপ্রসূ হয়। বড়দের উচিত হবে, দুষ্টামি যাতে নিরাপত্তা ও ভদ্রতার সীমার মধ্যে থাকে সে সম্পর্কে ছোটোদের সচেতন করা। এজন্য মারধর বা বকাঝকা না করে বন্ধুর মতো প্রয়োজনীয় পরামর্শ ও উৎসাহ দেওয়া। একটা কথা মনে রাখা জরুরি, দুষ্টামি বখাটে হবার লক্ষণ নয়, বুদ্ধিমত্তার লক্ষণ। ইস্, আমাদের ছোটো বেলায় মাবাবারা যদি বিষয়টা জানতেন! তাহলে অনেক মারপিট থেকে রক্ষা পেতাম ! ছোটোবেলায় লেখাপড়ার জন্য মারপিট খেতে হয়নি। যা খেয়েছি তার সবটাই ছিলো দুষ্টামি করার জন্য।
এখন কথা হলো, ছোটোরা কতো বয়সে বড় হয় ? এ প্রশ্নের কোনো সুনির্দিষ্ট উত্তর নেই। স্থান, কাল, সমাজ ভেদে ছোটোদের মধ্যে বুদ্ধি বিকাশের তারতম্য ঘটে। বাংলাদেশের বারো বছর বয়সী একটি ছেলে একটি নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে সাধারনভাবে যে প্রতিক্রিয়া দেখাবে, ইউরোপ, আমিরিকা বা আফ্রিকার একই বয়সী একটি ছেলে অভিন্ন পরিস্থিতিতে সে প্রতিক্রিয়া দেখাবে না। আমাদের সমাজে বর্তমানে ছোটোদের বয়স কমবেশি ১৫/১৬ বছর হয়ে গেলে তারা দুষ্টামির বয়স পার করে ফেলে বলে মনে করা হয়।
এবার আসা যাক দুষ্টামির সীমানা কতদূর গিয়ে শেষ হয়ে সেটা বদমাশির পর্যায়ে চলে যায়। দুষ্টামির উদ্দেশ্য যদি হয় কাউকে শারীরিক বা মানসিকভাবে কষ্ট দেওয়া বা ক্ষতিগ্রস্ত করা তাহলে সেটা আর দুষ্টামি থাকে না, বদমাশি হয়ে যায়। বদমাশিকে কখনও হাল্কাভাবে নেবার উপায় নেই। কেউ বদমাশি করলে তাকে সেজন্য কমবেশি সাজা পেতে হবে। সে সাজা সামান্য ভর্ৎসনা থেকে শুরু হতে পারে। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর থেকে আমাদের উঠতি বয়সের ছেলেরা অনেকে একটি বিশেষ ধরনের বদমাশি কাজ করে আসছে। আর তা হলো মেয়েদের নানাভাবে উত্যক্ত করা। এমনকি রাস্তাঘাটে প্রকাশ্যে মেয়েদের কাছে জোর করে প্রেম নিবেদন করা, তাদের গায়ে হাত দেওয়া, মেরে জখম করা, ডিজিটাল টেকনোলজির মাধ্যমে ইন্টারনেটে আপত্তিকর ছবি প্রকাশ করা ইত্যাদি। আমাদের সময়ের দেখেছি, উঠতি বয়সের ছেলেরা কেউকেউ খেলাধুলা, লেখালেখি, গানবাদ্য, নাটক-থিয়েটার, বিতর্ক-আবৃত্তি প্রতিযোগিতা, এসব বিভিন্ন কর্মকান্ডসহ নানা সৃজনশীল কর্মে অংশ গ্রহণ করে এবং তাতে উৎকর্ষ অর্জন করে সমবয়সী মেয়েদের মন জয় করার চেষ্টা করতো। তাতে কপাল ভালো হলে কোনো কোনো মেয়ে পটে যেতো, প্রেমে পড়ে যেতো। কোনো একজন মেয়ে প্রেমে না পড়তে চাইলে, তার পিছে ঘুরে সময় নষ্ট না করে, ছেলেটি অন্য মেয়ের কাছে প্রেম নিবেদন করতো। কিন্তু প্রেমের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করার কারণে একটি মেয়ের সর্বনাশ করা, জীবননাশ হোক এমন বদমাশি করা তো দূরের কথা, কাউকে এমন ভাবতেও দেখিনি। একটি ছেলে যদি নিজের ব্যক্তিগত সাফল্য এবং অর্জন দিয়ে কোনো মেয়ের মন জয় করার যোগ্যতা লাভ করে তাহলে তাকে কোনো মেয়ের মন পাবার জন্য মেয়েদের স্কুল-কলেজের গেইটে তীর্থর কাকের মতো দাঁড়িয়ে থাকতে হতো না। অথবা, মোটর সাইকেলে চড়ে মেয়েদের রিক্সার পেছনে ঘুরঘুর করতে হতো না, রিক্সার ফাক দিয়ে বেড়িয়ে আসা মেয়েদের ওড়না ধরে টানাটানি করতে হতো না। এসব কারণে আমরা বড়রা শুধু ছেলেদের মন্দ বলি, গালাগালি করি। কিন্তু বয়সের কারণে জাগ্রত তাদের প্রেমের বাসনা চরিতার্থ করার কোনো সুস্থ শালীন আউটলেটের বা পথের সন্ধান দিতে পারছি না। যাঁরা রাষ্ট্র ও সমাজ পরিচালনার দায়িত্বে আছেন, আশা করি, বিষয়টি ভেবে দেখবেন। স্কুল-কলেজগুলিকে শুধুমাত্র জিপিএ ফাইভ পাবার কারখানা না বানিয়ে সেখানে যাতে সকল প্রকার কো-কারিকুলার এক্টিভিটির চর্চা করা হয় তার ব্যবস্থা করলে এসব বদমাশি বহুলাংশে কমে যাবে। তারুণ্যের অমিত শক্তি ও সম্ভাবনাকে শুধু লেখাপড়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে তাকে চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ার সুযোগ করে দিতে হবে।
ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজে আমার থাকাকালীন সময়ে সংঘটিত ছেলেদের একটি দুষ্টামির ঘটনা বলে এবারের লেখা শেষ করতে চাচ্ছি। ক্যাডেট মেসের সামনে একটি ছোট্ট সবুজ লন ছিলো। ক্যাডেটদের মনোরঞ্জনের জন্য তাতে বিভিন্ন রংয়ের কিছু গার্ডেন লাইট লাগিয়েছিলাম। একদিন সকাল বেলা হঠাৎ রিপোর্ট পেলাম কে বা কারা সবগুলো লাইট ভেংগে ফেলেছে। বুঝতে অসুবিধা হলো না, ছেলেরা প্রশাসনের কারো কোনো কথায় বা কাজে রুষ্ট হয়ে এমনটি করেছে। ছেলেরা ভাবলো, প্রিন্সিপাল সাহেব নিশ্চয়ই রেগেমেগে ভয়ংকর কিছু একটা করবেন। পক্ষান্তরে আমি কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালাম না। ভাবখানা এমন দেখালাম যে কিছুই হয়নি। খবর পেলাম, একাদশ শ্রেণীর ক্যাডেটরা মেসের ভারপ্রাপ্ত অফিসারকে অনুরোধ করেছিলো মেনুর বাইরে কিছু খাবার আইটেম দেওয়ার জন্য, যা তিনি যথার্থ কারণে দিতে অস্বীকার করেন। যাহোক, পরবর্তী সাপ্তাহিক সমাবেশে আমি বিষয়টি উল্লেখ করে ক্যাডেটদের উদ্দেশ্যে বললাম, আমি তোমাদের মনোরঞ্জনের জন্য মেসের লনে গার্ডন লাইট লাগিয়েছিলাম। তোমাদের কেউকেউ সেটা পসন্দ করোনি। তাই ভেংগে ফেলেছো। কষ্ট করে ভাংগার দরকার ছিলো না। আমাকে বললে আমিই খুলে ফেলতাম। আর যদি তোমাদের মধ্যে কারো আত্মীয়ের ঝিনাইদহ শহরে ইলেকট্রিক সরঞ্জামের দোকান থেকে থাকে, এবং তার পৃষ্ঠপোষকতা করার জন্য কেউ লাইটগুলো ভেংগে থাকো, তাহলে জেনে রাখো, আমি নতুন করে আর এসব লাইট লাগাবো না। তাছাড়া নতুন লাইট লাগাবার জন্য যে টাকা খরচ হবে সে টাকা নতুন করে সরকার কলেজকে দেবে না। বাজেটে যা টাকা দেওয়া হয়েছে সেখান থেকে এ অতিরিক্ত খরচ মেটাতে হবে। তাতে তোমাদের অন্যান্য প্রয়োজন মেটাবার জন্য যেমন খাবার, জামাকাপড়, বইপত্র, খেলার সামগ্রী ইত্যাদি ক্রয়ের জন্য যে টাকা বরাদ্দ আছে সেটাতে টান পড়বে। কোনোরকম চমক ছাড়া সেদিনের সমাবেশ শেষ হলো।
তিনচার দিন পরের কথা। একাদশ শ্রেণীর পক্হ থেকে পাঁচছ’জন ক্যাডেট এলো আমার অফিসে দেখা করতে। তারা বললো, স্যার, গার্ডেন লাইটগুলো আমরা ভেংগেছি। মেসের ভারপ্রাপ্ত আফিসারকে আমরা একটা অনুরোধ করেছিলাম। তিনি তা রাখেননি। আমরা খুব ক্ষুদ্ধ হয়ে লাইটগুলো ভংগেছি। কাজটি করা আমাদের উচিত হয়নি। আমরা দু:খিত। এবারের মতো আমাদের মাফ করে দিন। দয়া করে লাইগুলো লাগিয়ে দিন। ভবিষ্যতে আর এমন হবে না। আমি ছেলেদের চোখেমুখে আন্তরিক অনুতাপের ছায়া দেখলাম। হেসে দিয়ে বললাম, বিষয়টি বুঝতে পারার জন্য ধন্যবাদ। মন্দ কাজ করার পর নিজ থেকে অনুতপ্ত হওয়ার পর আর বলার কিছু থাকে না। এবার ক্লাসে যাও। আগামীকালের মধ্যে লাইটগুলো যাতে লেগে যায় সে ব্যবস্থা করা হবে।
এ ঘটনার পর কোনো ক্যাডেট সচেতনভাবে কলেজের কোনো সম্পত্তি বিনষ্ট করেছে বলে শুনিনি।
0 Comments:
Post a Comment
Subscribe to Post Comments [Atom]
<< Home