Ashraf’s Column

Monday, June 13, 2011

সৈনিকের কৈফিয়ত

১। ১৯৮৩ সনের কথা। জে: এরশাদের মার্শাল ল’র জমানা। আমি তখন ঢাকায় আর্মি হেডকোর্য়াটার্সে কাজ করি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র হিসেবে প্রাণের টানে প্রায়ই বিশ্ববিদ্যালয় পাড়ায় বেড়াতে যেতাম। উদ্দেশ্য, আমার শ্রদ্ধেয় স্যারদের সালাম জানানো আর পুরানো বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেওয়া। তাঁদের মধ্যে অনেকে আর্মি, মার্শাল ল’, সিভিল-মিলিটারি সম্পর্ক, দেশের রাজনৈতিক অবস্থা, এসব নিয়ে আমাকে প্রশ্ন করতেন। আমার মাধ্যমে সম্ভবত সৈনিকদের মনোভাব জানার চেষ্টা করতেন। একদিন আমার অত্যন্ত শ্রদ্ধেয় স্যার কেমেস্ট্রি ডিপার্টমেন্টের প্রফেসর আব্দুল জব্বার মিয়ার সাথে দেখা হলো। ক’দিন আগে আর্মির সৈনিকরা (এই লেখায় অফিসার এবং সিপাহিদের এক কথায় সৈনিক বলে উল্লেখ করা হয়েছে।) অরাজক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ঢুকে ছাত্র ও শিক্ষকদের বেধড়ক মারপিট করেন। দেখা মাত্রই স্যার মুখ কালো করে অত্যন্ত মর্মাহতভাবে আমাকে বললেন, “ তোমাকে, এবং অন্যান্য পরিচিত যারা আর্মিতে কাজ করে তাদেরকে, যখন সিভিল ড্রেসে ডিউটির বাইরে সামাজিক পরিবেশে দেখি, তখন তোমরা সবাই কথায় ও কাজে এত ভদ্র ও বিনয়ী। অথচ সেই তোমরাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ঢুকে কেমন করে এমন নারকীয় তান্ডব ঘটালে ? কেমন করে ছাত্রদেরকে, যারা তোমাদের ছোট ভাইয়ের মত তাদেরকে, এমন নিমর্মভাবে পেটালে ? কেমন করে সম্মানিত শিক্ষকদের গায়ে হাত তুলতে পারলে ? ১৯৭১ সনের আগে পাকিস্তান আর্মির সৈনিকরা এমন করতো। তখন বুঝতাম, ওরা বর্বর ভিনদেশি শাসক, এমনটা করতেই পারে। কিন্তু আমি কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছিনা, কেমন করে তোমরা, আমাদের নিজেদের ছেলেরা, এসব করতে পারো ?”

২। সেদিন আমার প্রিয় জব্বার স্যারকে তাঁর প্রশ্নের জবাব খোলাখুলি দিতে পারিনি। কিছু কৈফিয়ত অবশ্য দিয়েছিলাম। বলেছিলাম, “ স্যার, ব্যক্তিজীবনে আমরা সৈনিকরা প্রত্যেকে একেকজন মানুষ। কারও ছেলে, কারও বাবা, কারও ভাই বা কারও স্বামী। ইউনিফর্ম পরে কর্তব্য করতে আসলে এসব কথা মনে রাখা যায় না। তখন যেকোনো মূল্যে, জীবন দিয়ে হলেও, কমান্ডারের হুকুম আমাকে পালন করতে হয়। যথাযোগ্য কর্তৃপক্ষ না ডাকলে আর্মি নিজ থেকে কখনও দাঙ্গা দমনের কাজে নিজকে নিয়োগ করতে পারে না। অন্য সকল সরকারি বাহিনী যখন ব্যর্থ হয় শুধু তখনই উন্মত্ত জনতা নিয়ন্ত্রণ করার জন্য ‘ ইন এইড অব সিভিল পাওয়ার ’ সরকারের আর্মি ডাকার আইনি আধিকার আছে। তাই এ কাজসহ অন্য যেকোনো কাজে আর্মির পক্ষে ব্যর্থতা মেনে নেয়া সম্ভব নয়। আর্মি ব্যর্থ হলে সরকারের হাতে শক্তি প্রয়োগের আর কোনো হাতিয়ার অবশিষ্ট থাকে না। একথা মনে রেখেই সৈনিকরা অর্পিত কর্তব্য পালন করেন। এর মধ্যে রাজনৈতিক বা অন্য কোনো ভাবনা কাজ করে না। সৈনিকের হাতে লাঠি বা ব্যাটন রাখার প্রাধিকার নেই, রেওয়াজও নেই। উন্মত্ত এবং মারমুখী জনতা নিয়ন্ত্রণ করার জন্য তাঁকে বাধ্য হয়ে হাতের রাইফেল ব্যবহার করতে হয়। তা সে পেটানোর জন্য হোক, বা গুলি করার জন্য হোক। কোথায় কখন পুলিশি কাজ করার জন্য আর্মি ডাকা হবে সে বিচারের ভার আর্মির উপর বর্তায় না। তাই, কখনও কখনও আর্মির কাজে বাড়াবাড়ি পরিলক্ষিত হতে পারে। তাছাড়া আর্মি কোনো রাজনৈতিক সংগঠন বা ক্লাব নয় যেখানে ভোটাভোটি করে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। আর্মিতে কমান্ডারের কথাই শেষ কথা। রাষ্ট্রর স্বার্থে এবং পেশাগত প্রয়োজনে সৈনিকের এমন হতে হয়।” জানি, স্যার আমার কৈফিয়তে সন্তুষ্ট হতে পারেননি। স্যার হয়ত বুঝতে পেরেছিলেন, আর্মির একজন কর্মরত অফিসার হিসেবে আমার পক্ষে মন খুলে জবাব দেওয়া সম্ভব ছিলো না। (একজন কর্মরত আর্মি অফিসারের পক্ষে আজও তা সম্ভব নয়।) তাই তিনি সেদিন এ নিয়ে আর কথা বাড়াননি। চাকুরি জীবনে, এবং তারপরে, সিভিলিয়ান বন্ধুবান্ধব ও আত্মীয়স্বজনরা আমাকে ঘুরিয়েফিরিয়ে বহুবার জব্বার স্যারের মত, সিভিল-মিলিটারি সম্পর্ক নিয়ে, অনেক গুরত্বপূর্ণ প্রশ্ন করেছেন। এখনও করে থাকেন। এসব প্রশ্ন আজও মাঝেমাঝে আমাকে তাড়া করে।

৩। লক্ষ্য করা গেছে, আমাদের সমাজের বেশ কিছু দায়িত্বশীল ব্যক্তি আর্মি এবং এর সদস্যদের বিরুদ্ধে প্রায়শ: অত্যন্ত দায়িত্বজ্ঞানহীনভাবে মন্তব্য করে থাকেন। এসব মন্তব্য অনেক সময় জ্ঞান ও যুক্তি তো দূরের কথা সভ্যতা-ভব্যতা এমনকি সুরুচির সীমানা অতিক্রম করে যায়। যেমন, বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন নামকরা সিনিয়র অধ্যাপককে জানি যিনি তাঁর লেখায় আর্মির সদস্যদের কখনও সৈনিক বা অফিসার বলে উল্লেখ করেন না। অত্যন্ত তুচ্ছভাবে তাঁদেরকে তিনি “বুটওয়ালা”, “বন্দুকওয়ালা”, “উর্দিওয়ালা” ইত্যাদি বলে উল্লেখ করেন। (এখন অবশ্য তাঁর পসন্দের দল সরকারে আছে বলে এসব বলা আপাতত বন্ধ রেখেছেন।) ১৯৮৩ সালে কোনো এক বিকেলে আমার এক ভাবীর (বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসরের স্ত্রী) বাসায় গেলে তিনি রাগান্বিতভাবে এই বলে আমাকে চার্জ করলেন, “ ভাই, আপনারা (সৈনিকরা) কেমন লোক ? আর্মির সেপাইরা সেদিন মিছিল থেকে ছাত্রদের ধরে নিয়ে ব্লেড দিয়ে হাত-পা কেটে তাতে লবন লাগিয়ে দিয়েছে! কেমন করে আপনারা এত নিষ্ঠুর হতে পারেন ?” শান্তভাবে ভাবীকে জিজ্ঞাসা করলাম, “ আপনি নিজ চোখে দেখেছেন ?” তিনি বললেন, “ না, অন্য একজন বলেছেন।” আবার জিজ্ঞাসা করলাম, “তিনি কি নিজ চোখে দেখেছেন ?” ভাবী জবাব দিলেন, তা তিনি জানেন না। যাহোক, ভাবীকে বললাম, “কোনো সৈনিকের পক্ষে এ ধরনের কাজ ইচ্ছে করলেও করা সম্ভব নয়। কারণ, কাজটা শুধু বেআইনি নয়, অমানবিকও বটে। এমন কাজ করতে গেলে তাঁর কমান্ডার এবেং সঙ্গী সৈনিকরা অবশ্যই বাধা দিবেন। তর্কের খাতিরে যদি ধরে নেয়া যায়, কোনো একজন সৈনিক পাগল বা অমানুষ। তাই বলে সব সৈনিক তা নয়। তাছাড়া এমন কাজের জন্য সৈনিকটিকে ব্যারাক থেকে আসার সময় ব্লেড এবং লবন সাথে করে আনতে হবে !” পরিশেষে ভাবীকে বিষয়টি বোঝাতে পেরেছিলাম। তারপরও বাংলাদেশে এমন লোক দেখেছি যাঁরা এসব উদ্ভট গল্পে বিশ্বাস করে থাকেন।

৪। দেশে যখন মার্শাল ল’ জারি থাকে, অথবা তথাকতিত গণতান্ত্রিক বেসামরিক সরকার আর্মির উপর নির্ভর করে দেশ শাসন করে, যখন আর্মিকে শোষণ ও নিপীড়ণের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হতে দেখে, তখন স্বাবাভাবিকভাবে মানুষ আর্মির উপর ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে। সৈনিকদের সর্ম্পকে অনেক ঢালাও বিরূপ মন্তব্য করে থাকে যা বহুলাংশে সঠিক ও তথ্যনির্ভর নয়। জে: এরশাদের মার্শাল ল’র জমানায় আমার নিজ কানে এমন অনেক মন্ত্ব্ব্বব্য শুনতে হয়েছে। আর্মি সর্ম্পকে বহুল প্রচলিত একটি ভুল ধারণা হলো, আর্মির অফিসার ও সৈনিকরা অশিক্ষিত বা অল্প শিক্ষিত। হয়তো একশ’ বা দু’শ’ বছর আগে, যখন সমাজের প্রায় সবাই অশিক্ষিত ছিলো, এমনটা বলার সুযোগ ছিলো। কিন্তু আজকের পরিন্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন। স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশ আর্মির সকল কোরে (শাখায়) সিপাহি পদে ভর্তির সর্বনিম্ন শিক্ষাগত যোগ্যতা এসএসসি অথবা এইচএসসি পাশ। অনেকে তার চাইতে বেশি শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে সিপাহি পদে ভর্তি হন। এদের মধ্যে যেসব সিপাহি এএমসি (আর্মি মেডিক্যাল কোর), এডিসি (আর্মি ডেন্টাল কোর), (সিভিল) ইন্জিনিয়ার্স কোর, ইএমই (ইলেকট্রিক্যাল এবং মেকানিক্যাল ইন্জিনিয়ার্স কোর) এবং অন্যান্য টেকনিক্যাল কোরে ভর্তি হন তাঁদেরকে তিন-চার বছর মেয়াদি পেশাগত ট্রেইনিং কোর্স সম্পন্ন করতে হয়। এসব কোর্স বাইরের প্যারামেডিক্যাল কোর্স, ডিপ্লোমা ইন্জিনিয়ারিং কোর্স, সার্ভেয়ার কোর্স ইত্যাদির সমতুল্য বলে সরকারিভাবে স্বীকৃত। এখানে বলে নেয়া ভালো, আধুনিক আর্মিতে সত্যিকার অর্থে ননটেকনিক্যাল কোর বলে কিছু নেই। বর্তমান যুগে তথাকথিত ননটেকনিক্যাল ইনফ্যানাট্রি কোরের একজন সিপাহিকেও গাইডেড মিসাইল, এক্সপ্লোসিভস, বাতাসের গতিবেগ দেখে অস্ত্রের নিশানা সংশোধণ ইত্যাদি অনেক বিষয়ে তাত্বিক ও প্রায়োগিক জ্ঞান লাভ করতে হয়।

৫। এএমসি, এডিসি, ইন্জিনিয়ার্স, ইএমই’সহ সকল টেকনিক্যাল কোরে অফিসার পদে যোগদানের পূর্বযোগ্যতা সংশ্লিষ্ট বিষয়ে গ্রাজুয়েশন ডিগ্রি। অথবা, যোগদানের পর, কোনো কোনো কোরে, নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে গ্রাজুয়েশন ডিগ্রি অর্জন। আর্মি এডুকেশন কোরে (এইসি) কমিশন লাভের জন্য দরখাস্ত করতে হলে প্রার্থীকে কমপক্ষে অনার্সসহ দ্বিতীয় শ্রেণীর মাস্টার্স ডিগ্রি থাকতে হয়। অপরদিকে ননটেকনিক্যাল কোরের অফিসারগণকে বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমি যোগদানের পূর্বশর্ত হিসেবে কমপক্ষে দ্বিতীয় বিভাগে এইচএসসি পাশ হতে হয়। আইএসএসবি (ইন্টার সার্ভিসেস সিলেকশন বোর্ড) নামক প্রতিষ্ঠান থেকে নেতৃত্বের যোগ্যতা সংক্রান্ত কঠিন পরীক্ষায় অবশ্যই কৃতকার্য হতে হয়। মিলিটারি একাডেমিতে দীর্ঘ দু’বছরের ট্রেইনিং শেষে কমিশন লাভের সাথেসাথে আবশ্যিকভাবে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আর্টস বা সাইন্সে গ্রাজুয়েশন ডিগ্রি অর্জন করতে হয়। অনেকে হয়ত জানেন না, বেসামরিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্রাজুয়েশন ডিগ্রি লাভের জন্য একজন প্রার্থীকে ন্যুনতম যে কয়টি বিষয় পড়তে হয় বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমি থেকে গ্রাজুয়েশন ডিগ্রি লাভের জন্য, তার চাইতে কম সময়ে, সব মিলিয়ে তার চাইতে অনেক বেশি মিলিটারি এবং একাডেমিক বিষয়ে পরীক্ষা দিয়ে পাশ করতে হয়। আজকাল ডিফেন্স সার্ভিসেস কমান্ড এন্ড স্টাফ কলেজ এবং ন্যাশনাল ডিফেন্স কলেজ থেকে বাংলাদেশ আর্মির বহু সংখ্যক অফিসার পেশাগত ঊচ্চতর ডিগ্রি ছাড়াও বিভিন্ন একাডেমিক বিষয়ে দেশি ও বিদেশি ইউনিভার্সিটি থেকে মাস্টার্স ও পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করছেন। বেসামরিক জীবনে একজন ডাক্তার, ইন্জিনিয়ার বা একাউন্ট্যান্ট যেমনভাবে বেসিক একাডেমিক যোগ্যতা এইচএসসি পাশ করে নিজস্ব পেশাগত বিষয়ে গ্রাজুয়েশন ডিগ্রি অর্জন করেন, ঠিক একইভাবে একজন কমিশনপ্রাপ্ত আর্মি অফিসার এইচএসসি পাশ করে সমরবিদ্যাসহ অন্যান্য বিষয়ে গ্রাজুয়েশন ডিগ্রি অর্জন করেন। এর পর, আশা করি, যাঁরা সৈনিকদের অশিক্ষিত বলে অবজ্ঞা করেন তাঁরা নিজেদের ভুল বুঝতে পারবেন।

৬। তিন-চার দশক, বা তারও আগে, যাঁরা জনগণকে নেতৃত্ব দিতেন তাঁরা আর্মি বা অন্য কোনো পেশাকে অবজ্ঞা করতেন না, অন্তত প্রকাশ্যে নয়। অনেক বছর যাবত আমাদের আর্মির সদস্যরা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে শান্তি রক্ষার কাজে নিয়োজিত আছেন। সেসব দেশে তাঁরা অত্যন্ত সুনামের সাথে কর্তব্য পালন করে আন্তর্জাতিক মহলে অজস্র প্রশংসা কুড়িয়ে আসছেন। কিন্তু, অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, নিজ দেশে তাঁরা সমালোচিত হয়ে আসছেন। যাঁরা রাজনীতি করেন তাঁদের মধ্যে অনেককে আর্মি অফিসারদেরকে, বা পুরেো আর্মিকে লক্ষ্য করে প্রকাশ্যে অবজ্ঞাসূচক মন্তব্য করতে শোনা যায়। এসব রাজনীতিবীদদের পৃষ্ঠপোষক একশ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ী, সুশীল সমাজের সদস্য বলে পরিচিতে এঁদের কিছু অন্ধ স্তাবক এবং লেজুড় হিসেবে পরিচিত কিছু ছাত্রনেতা একাজে রাজনীতিবীদদের চাইতেও এককাঠি এগিয়ে থাকেন।

৭। দেশে একাধিকবার মার্শাল ল’ জারি হবার কারণে একশ্রেণীর রাজনীতিবীদ হয়তো আর্মির উপর সহযবোধ্য কারণে বেজায় ক্ষেপে থাকতে পারেন। ক্ষ্যাপার আরও একটা কারণ হতে পারে ঈর্ষা। আজকালকার অধিকাংশ রাজনীতিবীদদের শিক্ষা ও মেধাগত যোগ্যতা, দক্ষতা, সততা, নেতৃত্বের গুণাবলী এবং ছাত্র জীবনে বেআইনি কাজকর্মের রেকর্ড ইত্যাদি বিবেচনা করলে তাঁদের বেশিরভাগই বাংলাদেশ আর্মির একজন নবীণ বা প্রবীণ চৌকশ অফিসারের মুখোমুখি দাঁড়াবার মত নৈতিক যোগ্যতা ও আধিকার রাখেন কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। অথচ এঁদের মধ্য থেকেই সংসদ সদস্য এবং মন্ত্রী নির্বাচন করা হয়। অত্যন্ত পরিতাপের সাথে লক্ষ্য করা যাচ্ছে, দলে অনেক শিক্ষিত, মেধাবী, দক্ষ, সত্ এবং সম্মানিত নেতা-কর্মী থাকা সত্বেও আজকাল বড় বড় রাজনৈতিক দলের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে তাঁদের নির্বাচনে নমিনেশন দেওয়া হয় না। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে নমিনেশন দেওয়া হয় অসাধু ব্যবসায়ী এবং চিহ্নিত ও দুর্নীতিপরায়ণ সন্ত্রাসীদের। রাজনৈতিক দলের সর্বোচ্চ পর্যায়ের নেতা-নেত্রীরা কেনো এমন করেন, তা বলার প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না।

৮। যেকোনো দেশের আর্মি সে দেশের নিজস্ব উজ্জ্বল তরুণ নাগরিক দ্বারা সংগঠিত, নিজস্ব অর্থসম্পদ দ্বারা পরিচালিত এবং দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের অতন্দ্র প্রহরী। সম্পূর্ণ রাজনীতিমুক্ত একটি প্রতিষ্ঠান। যেকোনো সংগঠনের মত এর মধ্যও দুষ্ট লোক থাকতে পারে, সাবির্কভাবে সংগঠনের দুর্বলতাও থাকতে পারে। গালাগাল করে, বা বদনাম রটিয়ে এসবের সমাধান হয় না। নেতৃত্বে পরিবর্তন এনে, আইনে যথাযথ সংষ্কার এনে এবং প্রয়োজনবোধে দুষ্ট সদস্যকে সংশোধণ বা বহিষ্কার করে, অবস্থার উন্নতি করা অবশ্যই সম্ভব। যেসব ব্যক্তি কারনে-অকারণে, কথায়-কথায় জাতীয় সেনাবাহীনিকে অন্যায়ভাবে দোষারোপ করে থাকেন তাঁরা দেশের কী উপকার করছেন, জানিনা। তবে, দেশের বহি:শত্রু, যারা আমাদের দেশকে সামরিকভাবে দুর্বল দেখতে চায়, তাদের তাঁরা পরম সেবা করে আসছেন, একথা সহজে অনুমান করা যায়। দেশের ভিতর থেকে জেনেশুনে এ জঘণ্য কাজটি যাঁরা করে আসছেন তাঁরা আর যাই হোন দেশের হিতাকাংখী নন। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যেতে পারে, দুর্নীতির (এবং শৃঙ্খলা ভঙ্গের) কারণে আর্মিতে মাঝারি পর্যায়ের অফিসার ও সৈনিকদের শাস্তি প্রদান নিয়মিত ঘটনা। কিন্ত বাংলাদেশ আর্মিতে সিনিয়র অফিসারদের এসব কারণে শাস্তি দেওয়ার নজির নাই বললেই চলে। যেমন করে তাঁদের সিভিলিয়ান কাউন্টারপার্টরা দুর্নীতির অপরাধ থেকে সদা দায়মুক্ত থাকেন। এর কারণ একটাই। দুর্নীতিপরায়ণ রাজনীতিবীদরা সিনিয়র পদে নিজেদের দুর্নীতির কাজে সহায়ক হিসেবে এসব দুর্নীতিপরায়ণ সামরিক ও বেসামরিক অফিসারদের নিয়োগ দিয়ে থাকেন।

৯। আমার বারবার মনে হয়েছে, আর্মি সম্পর্কে মানুষের ভুল ধারণা দূর করতে, এবং আর্মির বিরুদ্ধে প্রচারণার জবাব দেওয়ার জন্য উপরি উক্ত গুরত্বপূর্ণ প্রশ্নেসমূহের জবাব দেওয়া প্রয়োজন। আর্মিতে ৩২ বছর চাকুরি করার পর ১১ বছর আগে অবসর নিয়েছি। মনে হচ্ছে, জীবনের পরন্ত বেলায় এসে এখন নিরাসক্ত মনে ঠান্ডা মাথায় এসব প্রশ্নের উত্তর নির্মোহভাবে দেওয়া আমার জন্য সহজ হবে। একজন কর্মরত সৈনিকের পক্ষে এসব প্রশ্নের জবাব দেওয়া সম্ভব নয়। আর্মি অ্যাক্ট তাঁকে সে অনুমতি দেয় না। তাঁর পক্ষ থেকে জনগণকে সকল প্রশ্নের জবাব দেওয়ার একমাত্র এখতিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রনালয়ের অধীন আইএসপিআর (আন্ত:বাহীনি গণসংযোগ পরিদপ্তর) নামক একটি সরকারি অফিসের। প্রতিরক্ষামন্ত্রী স্বয়ং অফিসটি সরাসরি নিয়ন্ত্রণ করেন। গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় এমনটি হওয়া ন্বাভাবিক এবং কাম্য। কিন্তু সমস্যা হয় যখন শাসন ব্যবস্থা সত্যিকারের গণতান্ত্রিক না হয়ে অন্য কিছু হয়। দেশে যখন সামরিক শাসন থাকে, অথবা গণতন্ত্রের আবরণে স্বৈরতান্ত্রিক শাসন ব্যবন্থা কায়েম থাকে তখন প্রতিরক্ষামন্ত্রী (উল্লেখ্য, বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক সরকারের প্রধানমন্ত্রীরা গত দু’দশক ধরে একের পর একে প্রতিরক্ষা মন্ত্রনালয়টি নিজের হাতে রেখে আসছেন।) আর্মির, তথা রাস্ট্রের, স্বার্থ ও সুনামের চাইতে নিজের রাজনৈতিক ফায়দাকে বেশি প্রাধান্য দিয়ে থাকেন। এধরনের শাসকগোষ্ঠি আর্মিকে সবসময় অত্যাচার, শোষণ ও নিপীড়ণের হাতিয়ার হিসেবে যথেচ্ছ অপব্যবহার করে সবশেষে সব দোষ আর্মির ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে থাকেন। আর্মিকে জনগণের বিপক্ষে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে নিজেদের হীন রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিল করতে এরা কুন্ঠা বোধ করেন না। আইএসপিআরকে আর্মির অনুকূলে ব্যবহার না করে নিজেদের উদ্দেশ্য হাসিলে ব্যবহার করেন। বৃটিশ শাসকরা এবং পরে পাকিন্তানিরা সহজবোধ্য কারণে তাই করেছে। কিন্তু প্রশ্ন উঠে, যখন দেখি ইংরেজ ঔপনিবেশিক শাসকরা বৃটিশ ইন্ডিয়ান আর্মিকে অন্যয়ভাবে দাবিয়ে রাখার জন্য যে আইন প্রনয়ণ করেছিলো (ওদের নিজের দেশের আর্মির জন্য স্বাধীন দেশের উপযোগী আইন সব সময়ই ছিলো, এবং আজও আছে) সেই একই আইন ১৯৭১ সনের ৪০ বছর পর আজও প্রয়োগ করা হচ্ছে বাংলাদেশ আর্মি পরিচালনার জন্য। এ প্রশ্নের উত্তর খুব সহজ। স্বাধীন বাংলাদেশের শাসকশ্রেণী সামরিক, বেসামরিক স্বৈরাচারী অথবা গণতান্ত্রিক যে নামেই দেশ শাসন করুন না কেন, তাঁরা সবাই স্বৈরতান্ত্রিক শাসনে বিশ্বাস করেন। সে কারণে তাঁরা আজ পর্যন্ত বৃটিশ ইন্ডিয়ান আর্মির আইনের শুধু শিরোনাম পাল্টে আসছেন। ভিতরের ধারা-উপধারা সংশোধণ করছেন না। একটি স্বাধীন গণতান্ত্রিক দেশের আর্মির জন্য নতুন করে উপযোগী আইন ইচ্ছাকৃতভাবে প্রনয়ণ করছেন না। আজও যদি আর্মির একজন সৈনিককে অন্যায়ভাবে বা ভুল করে সামরিক আদালতে শাস্তি, এমনকি মৃত্যুদন্ড, দেওয়া হয় তিনি তার বিরুদ্ধে দেশের সব্বোর্চ্চ আদালতে কোনো আপিল করতে পারেন না।

১০। আমি যেসব বেসামরিক ব্যক্তির সাথে এসব বিষয় নিয়ে আলাপ করেছি তাঁরা প্রায় সবাই একটি বিষয়ে ভুল করেন বলে আমার মনে হয়েছে। তাঁরা ভুলে যান, পৃথিবীতে আর্মি হচ্ছে একমাত্র রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান যেখানে কিভাবে দ্রুত এবং অধিক হারে মানুষ (নামক শত্রু সৈন্য) হত্যা করা যায় তার কৌশল আইনানুগভাবে শেখানো হয়। উপরওয়ালার আদেশ জীবন দিয়ে হলেও পালন করবো, প্রতিটি সৈনিককে এইমর্মে শপথ গ্রহণ করতে হয়। রাষ্ট্রের আর কোনো বিভাগের কর্মচারিকে, প্রয়োজন নেই বলে, এমন ট্রেইনিং নিতে হয় না, এমন শপথ নিতে হয় না। ধরা যাক, দেশের কোথাও শত্রু সৈন্য দ্বারা আক্রান্ত হলো। সেখানকার বেসামরিক নাগরিক, সরকারি কর্মচারি, ডিসি-এসপি সবাই প্রাণ বাঁচাতে ঐ এলাকা ছেড়ে স্বেচ্ছায় চলে যেতে পারেন, কেউ বাধা দেবে না। কিন্তু আর্মির একজন কর্তব্যরত সৈনিক উপরওয়ালার হুকুম ছাড়া এক পা পিছিয়ে আসতে পারেন না। যদি আসেন, কোর্টমার্শালে তার মৃত্যুদন্ড পর্যন্ত হতে পারে। শত্রুর গুলি খেয়ে মরণ অবধারিত জেনেও তাঁকে তাঁর পজিশনে অটল থাকতে হয়। অন্যান্য পেশার সাথে সৈনিকের পেশার মূল পার্থক্য এখানেই। সৈনিকের পেশাগত প্রয়োজনে শুরু থেকে এই পার্থক্যের সৃষ্টি, যা আজ অব্দি পৃথিবীর সব দেশের সব আর্মিতে বিরাজ করছে। আর্মি অথবা এর কর্মরত সদস্যদের নিয়ে বাংলাদেশে যাঁরা চিন্তাভাবনা করেন, মন্তব্য করেন তাঁরা অনুগ্রহ করে আর্মির এই বৈশিষ্ট্যটি মনে রাখলে অনেক ভুল বুঝাবোঝি থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে।

১১। এখানে প্রাসঙ্গিকভাবে প্রশ্ন উঠে, উপরওয়ালার সকল আদেশ কি মানতে হবে ? না। আইন বলে, শুধুমাত্র ল’ফুল অর্থাত্ আইনি আদেশ মানা বাধ্যতামূলক, আনল’ফুল বা বেআইনি আদেশ নয়। তত্ত্বগতভাবে কথাটা ভালোই শোনায়। কিন্তু ইতিহাস বলে, বান্তবে এমনটা অনেক সময় হয় না। সৈনিক তো দূরের কথা, উচ্চ আদালতের বিচারকরা পর্যন্ত স্বেচ্ছায় অথবা পরিস্থিতির চাপে নিজেদের নেয়া শপথ ভঙ্গ করে বেআইনি আদেশ পালন করেছেন, এমন নজির আমাদের দেশে বিরল নয়। বেআইনিভাবে আগত শাসককে তাঁরা শুধু শপথ বাক্য পাঠ করান না, তাঁর সকল আদেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করেন। এমন ঘটনা যখন ঘটে তখন একবারে চুপ থাকলেও পরবর্তিকালে সুবিধামত সময়ে একশ্রণীর বুদ্ধিজীবী শপথ ভঙ্গকারিদের বিরুদ্ধে উচ্চকন্ঠে কঠোর সমালোচনা করেন। একবার ভেবেও দেখেন না, ঘটনা ঘটার সময় চুপ করে থেকে তাঁরা নিজেরা নৈতিক অপরাধ করেছিলেন কিনা।

১২। সাধারণ সৈনিকরা কোনো দেশে মার্শাল ল’ জারি করেন না। একটি দেশে প্রধানত তিনটি কারণে জেনারেলগণ মার্শাল ল’ জারি করে থাকেন। এক, ক্ষমতাসীন সিভিলিয়ান সরকারের সাময়িক দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে সুযোগসন্ধানী ও উচ্চাভিলাষী জেনারেলগণ মার্শাল ল’ জারি করেন । দুই, যখন সিভিলিয়ান সরকারের একপক্ষীয় চরম ব্যর্থতার কারণে রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, অভ্যন্তরীণ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, প্রশাসন এবং অর্থনীতি ধ্বংসের মুখোমুখি হওয়া সত্বেও ক্ষমতাসীন সরকার বিকল্প রাজনৈতিক শক্তির কাছে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ক্ষমতা হস্তান্তরে অস্বীকার করেন, তখন জেনারেলগণ দেশ, রাষ্ট্র ও জনগণের স্বার্থে মার্শাল ল’ জারি করেন। তিন, যখন শুধুমাত্র নিজেদের ক্ষুদ্র ব্যক্তিগত এবং দলীয় স্বার্থে ক্ষমতাসীন এবং বিরোধী পক্ষের রাজনৈতিক দলসমূহ এমনভাবে পরষ্পর দাঙ্গাহাঙ্গামায় লিপ্ত হয় যে রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, অভ্যন্তরীণ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, প্রশাসন এবং অর্থনীতি ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে এসে দাঁড়ায় তখন জেনারেলগণ দেশ, রাষ্ট্র ও জনগণের স্বার্থে মার্শাল ল’ জারি করেন। যখন দ্বিতীয় বা তৃতীয় কারনে মার্শাল ল’ জারি করা হয় তখন তার পেছনে সহজবোধ্যে কারণে দৃশ্যমানভাবে সর্বস্তরের জনগণের এবং সৈনিকদের অকুন্ঠ সমর্থন থাকে।

১৩। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করা যেতে পারে, বাংলাদেশে আর্মি চীফরা দেশের সরকার প্রধান কর্তৃক নিয়োজিত হয়ে থাকেন। একাজটি সম্পূর্ণভাবে সরকার প্রধানের ব্যক্তিগত এখতিয়ার। দেখা গেছে, আমাদের দেশে পেশাগত দক্ষতা ও যোগ্যতার চাইতে নিয়োজিত জেনারেলের ব্যক্তিগত আনুগত্য, বাড়ি কোন জেলায়, কার আত্মীয় ইত্যাদিকে সবার উপরে স্থান দেওয়া হয়ে থাকে। বাংলাদেশে এমন নজিরও আছে যেখানে অবসরে যাওয়া একজন মেজর জেনারেলকে অবসর অবস্থা থেকে আর্মিতে ফিরিয়ে এনে প্রমোশন দিয়ে আর্মি চীফ বানানো হয়েছিলো। কারণ, তিনি ছিলেন তৎকালীন গণতান্ত্রিক সরকার প্রধানের নিকটাত্মীয়। পেশাগত দক্ষতা, যোগ্যতা এবং সত্যানুরাগিতার বিচারে যখন যে জেনারেলের আর্মি চীফ হওয়া উচিত ছিলো, অনেক ক্ষেত্রে, তাঁকে চীফ করা হয়নি। জানিনা, একটা কথা আমাদের দেশের সিনিয়র রাজনীতিবীদরা আজও কেনো বুঝতে পারছেন না যে, রাজনৈতিক বিবেচনায় আর্মি চীফ নিয়োগ দিয়ে আর্মিকে পলিটিসাইজ করার চেষ্টা করা কতো বড় ভ্রান্ত ধারণা, কতো বড় দেশবিরোধী কাজ। পেশাগতভাবে দক্ষ, রাজনৈতিক আনুগত্য মুক্ত, সত্ এবং দেশপ্রেমিক একজন আর্মি চীফ যতটা আনুগত্য নিয়ে একটি নির্বাচিত সরকার ও তার প্রধানকে রক্ষা করবে, একজন অদক্ষ ও রাজনৈতিকভাবে অনুগত আর্মি চীফের পক্ষে তা করা সম্ভব নয়। কারণ, যখন ক্রান্তিকাল উপস্থিত হয়, তখন সাধারণ সৈনিকরা কোনো অদক্ষ ও রাজনৈতিকভাবে অনুগত আর্মি চীফের কমান্ড মানতে চান না। সাম্প্রতিকালে মিশর এবং তিউনিসিয়া এর জ্বলন্ত নজির।

১৪। ১৯৯০ সনের পর থেকে চালু হওয়া নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকারগুলো আর্মিকে নিয়ে একটি সর্বনাশা আত্মঘাতী খেলায় মেতে আছেন। যখন কোনো বড় একটি রাজনৈতিক দল নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতায় আসীন হয়, তখন পূর্ববর্তী (বর্তমানে বিরোধী দলের) সরকারের আমলে যেসব আর্মি অফিসার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর পদে (যেমন প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত স্টাফ অফিসার, বিভিন্ন সিকিউরিটি ইউনিট এবং গোয়েন্দা সংগঠনের প্রধানসহ তাঁদের ঘনিষ্ঠ সহকর্মী) নিয়োজিত ছিলেন তাঁদের সবাইকে অপ্রকাশিত প্রশাসনিক কারণে অকালীন অবসর দিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দেন। অপ্রকাশিত কারণটি হলো, যেহেতু এসব অফিসার আগের সরকারের আমলে (বর্তমান) বিরোধী দলীয় রাজনৈতিক নেতাদের আস্থাভাজন ছিলেন, সুতরাং বর্তমান সরকারের রাজনৈতিক নেতাদের পক্ষে এসব অফিসারকে বিশ্বাস করা আদৌ নিরাপদ নয়। ১৯৯০ সনে স্বৈরাচারী সরকারের পতনের পর প্রথম নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকার ক্ষমতায় এসে প্রায় ৬০ জন পেশাগতভাবে দক্ষ ও অভিজ্ঞ আর্মি অফিসারকে এভাবে অবসর দিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দেন। ফলে, একদিকে যেমন সংশ্লিষ্ট আফিসারগণ ব্যক্তিগতভাবে নির্যাতিত হলেন, অপর দিকে জাতি বঞ্চিত হলো বহু অর্থ-সম্পদ ব্যয়ে গড়ে তোলা ৬০ জন পেশাদার অফিসারের সেবা থেকে। কিছুদিন হলো এই খেলাতে নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে। নির্বাচিত নতুন গণতান্ত্রিক সরকার ক্ষমতায় এসে আগের সরকারের আমলে অবসরে পাঠানো এমন অফিসারদেরকে অবসরের তারিখ (বা তার আগ) থেকে প্রমোশন দিয়ে উচ্চতর অবসর ভাতা মন্জুর করছেন। প্রতিবার সরকার বদলের সময় যদি আর্মিকে এভাবে কমবেশি অফিসার হারাতে হয় তাহলে একটা সময় অচিরে আসবে যখন মেধাবী প্রার্থীরা আর্মিতে আর যোগ দেবে না। অন্যদিকে আর্মি মারাত্মকভাবে পলিটিসাইজড হয়ে যাবে। যা কারো কাম্য হতে পারে না। আর্মি অফিসাররা প্রজাতন্ত্রের কর্মচারি হিসেবে একমাত্র রাষ্ট্র ও সংবিধানের প্রতি অনুগত থাকতে বাধ্য। একজন অফিসারকে সরকার যে পদেই নিয়োগ দিক না কেনো সে পদে তিনি কর্তব্য পালনে বাধ্য। এধরনের কোনো নিয়োগকে রাজনৈতিক নিয়োগ হিসেবে দেখা আইন এবং নৈতিকতাবিরোধী। আর্মি অফিসারদের কাছ থেকে রাজনৈতিক বা দলগত আনুগত্য কামনা করা যেমন অপরাধ, একজন অফিসারের পক্ষে তেমন আনুগত্য পোষণ এবং প্রকাশ করাও অপরাধ। আমাদের বর্তমান প্রজন্মের রাজনীতিবীদরা এবং আর্মি অফিসাররা দেশের সর্বোচ্চ স্বার্থের কথা বিবেচনা করে একথা মনে রাখলে নিজেদের জন্য এবং দেশের জন্য মঙ্গল হবে।

১৫। সম্প্রতিকালে বাংলাদেশের মাননীয় সর্র্বোচ্চ আদালত ১৯৭২ সালের মূল সংবিধান পুন:স্থাপন করার জন্য আদেশ প্রদান করতে গিয়ে বিভিন্ন সময়ে সামরিক শাসকগণ কর্তৃক নির্বাহী আদেশবলে প্রবর্তিত এবং মার্শাল ল’র অধীনে নির্বাচিত জাতীয় সংসদ কর্তৃক অনুমোদিত সংবিধানের সকল সংশোধণ (দু’য়েকটি বাদে) এবং আইন রহিত করেছেন। মার্শাল ল’ জারিকারী সকলকে বিচারের আওতায় আনার জন্য প্রশাসন ও সংসদকে পরামর্শ দিয়েছেন। মাননীয় সর্র্বোচ্চ আদালত মার্শাল ল’র চাইতে কম জনগুরুত্বপূর্ণ অনেক বিষয়ে স্বত:প্রণোদিত হয়ে (সুয়ো মটো) হস্তক্ষেপ করে অপরাধীদের বিচার করে দন্ড দিয়ে সাধারণ মানুষের প্রশংসা কুড়াচ্ছেন। কিন্তু যেসব জেনারেল বা রাজনৈতিক ব্যাক্তি মার্শাল ল’ জারি করে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে গুরুতর অপরাধ সংঘটিত করেছেন তাঁদেরকে বিচারের আওতায় আনার জন্য মাননীয় সর্র্বোচ্চ আদালত কেন সুয়ো মটো ব্যবস্থা এযাবত নেননি তা বোধগম্য নয়। যেসব জেনারেল বা ব্যক্তি মার্শাল ল’ জারি করেছেন তাঁদের অবশ্যই বিচার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করা উচিত। তবে যদি উপরিউক্ত ১২ অনুচ্ছেদে বর্ণিত দ্বিতীয় বা তৃতীয় কারনে মার্শাল ল’ জারি করা হয়ে থাকে তাহলে সংশ্লিষ্ট জেনারেলদের বিচার করা নৈতিক দিক থেকে কতটা সমর্থনযোগ্য, সে প্রশ্ন উঠতেই পারে। আমরা জানি, আইন এবং নৈতিকতার মানদন্ড সবসময় অভিন্ন হয় না। আইনের চোখে দন্ডনীয় কাজ কখনও কখনও নৈতিকতার বিচারে শুদ্ধ ও প্রশংসনীয় হয়। যেসব মার্শাল ল’ জারির পেছনে জনগণের স্বত:স্ফুর্ত সমর্থন থাকে সেসব মার্শাল ল’ জারিকারীদের বিচার করতে হলে সমর্থনকারী জনগণেরও তো বিচার করা উচিত। সে বিচার কোন আদালতে হবে ? যেসব রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীর অবিমৃষ্যকারিতার কারণে রাষ্ট্রের প্রশাসনযন্ত্র ভেঙ্গে পড়েছিলো, মার্শাল ল’ জারি করা অপরিহার্য হয়ে পড়েছিলো সেসব রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীর বিচার করা সম্পর্কে মাননীয় আদালত কেন চুপ থাকলেন, তা বোঝা গেলো না। যেসব রাজনৈতিক নেতা-নেত্রী মার্শাল ল’কে (অথবা আধা-মার্শাল ল’কে) আসতে প্রকাশ্যে নিমন্ত্রণ জানালেন, পরবর্তীকালে মার্শাল ল’র অধীনে নির্বাচিত সংসদের সদস্য হয়ে যাঁরা সামরিক শাসকগণ কর্তৃক নির্বাহী আদেশবলে প্রবর্তিত সকল ফরমান এবং সংবিধানের সকল সংশোধণ এবং আইন অনুমোদন করলেন তাঁদের সর্ম্পকে মাননীয় আদালতের নীরবতা বোধগম্য নয়। যে জেনারেল মার্শাল ল’ জারি করেছেন তিনি অপরাধ করে থাকলে সেই জেনারেলকে একাজে যাঁরা প্ররোচণা দিয়েছেন, সক্রিয় সমর্থন যুগিয়েছেন তাঁরা সবাই, তা তাঁরা রাজনীতিবীদ হোন বা অন্য কেউ হোন, কমবেশি দোষী।

১৬। আলোচনার খাতিরে ধরা যাক, একজন আর্মি কমান্ডার কোনো এক মধ্যরাতে তাঁর অধীনস্তদের কোথাও অভিযান চালাতে আদেশ করলেন, যার ফলে দেশের আইনানুগ সরকারের পতন ঘটবে। বলা বাহুল্য, নৈতিকতার বিচারে যাই হোক না কেনো, আদেশটি অবশ্যই আনল’ফুল বা বেআইনি। আদেশ মান্য করে সরকারের পতন ঘটালে ব্যক্তিগতভাবে আদেশ পালনকারীর কোনো ঝামেলা পোহাবার ভয় নেই। কিন্তু মনে করুন, কেউ একজন আনল’ফুল আদেশটি অমান্য করলো। একই সাথে অন্যরা আদেশটি পালন করলো এবং সরকারের পতন হলো। তখন আদেশ অমান্যকারী সৈনিককে কোর্টমার্শালে বিচার করে শাস্তি দেওয়া হবে খুবই সাধারণ ব্যাপার। তখন তাঁকে সাহায্য করার জন্য কোনো আইন, কোনো আদালত, কোনো ব্যারিস্টার, কোনো সুশীল সমাজ এগিয়ে আসেন না। তবে হ্যাঁ, যদি কেউ বিপ্লবী মনের অধিকারী হন তাহলে তিনি আনল’ফুল আদেশটি অমান্য করার ঝুঁকি নিতে পারেন। সে ক্ষেত্রে বিপ্লবী সৈনিকটি যদি একজন জেনারেল বা সিনিয়র অফিসার হন তাহলে আর্মির মধ্যে পারষ্পরিক হানাহানি এমনকি দেশে গৃহযুদ্ধ শুরু হতে পারে। ১৯৯৬ সনে বাংলাদেশ আর্মি, আল্লাহর অশেষ রহমতে, অল্পের জন্য তেমন একটি গৃহযুদ্ধ থেকে বেঁচে যায়। সে যাহোক, বাস্তব সত্য হলো, যাঁরা আর্মিতে যোগ দেন তাঁরা সবাই মূলত: ব্যক্তিগতভাবে কনফর্মিস্ট (বিনা বাক্যে উপরওয়ালার আদেশ মান্যকারী) হয়ে থাকেন, অথবা আর্মির কঠোর ট্রেইনিং তাঁদেরকে কনফর্মিস্ট বানিয়ে ছাড়ে। তাঁরা সচারচর রেভ্যুলিউশনারি বা বিপ্লবী হন না। যদিও দলগতভাবে রেভ্যুলিউশনারি হয়ে সৈনিকরা ল’ফুল আদেশ অগ্রাহ্য করে বিপ্লব সংঘটিত করেছেন, নিজ দেশ স্বাধীন করেছেন, এমন নজির ইতিহাসে অনেক আছে। আমাদের দেশেও আছে। তৎকালীন পাকিস্তান আর্মির বাঙ্গালি সৈনিকরা ১৯৭১ সনে একত্রে বিদ্রোহ করে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের সূচনা করেছিলেন। পরবর্তিতে ১৯৯০ সনের শেষভাগে বাংলাদেশ আর্মির র্যাং ক এন্ড ফাইল ঐক্যবদ্ধভাবে সর্বাধিনায়ক প্রেসিডেন্ট জে: এরশাদের আইনানুগ, কিন্তু অনৈতিক, আদেশ অগ্রাহ্য করে জনগণের কাতারে সামিল হয়ে দেশকে স্বৈরশাসন থেকে মুক্ত করেছিলো।

১৭। এবার দেখা যাক মার্শাল ল’ জারি ও প্রয়োগে সৈনিক কী ভূমিকা পালন করেন। দেশে যখন পূর্ণ গণতান্ত্রিক পরিবেশ বজায় থাকে, সুস্থ গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ক্ষমতার হাতবদল হয়, রাজনৈতিক দল ও নেতাদের মধ্যে কাঙ্খিত সৌহার্দ বিরাজ করে, সর্বোপরি দেশে যদি সুশাসন থাকে, সমাজে শান্তি ও প্রগতি থাকে তখন কোনো জেনারেলের পক্ষে মার্শাল ল’ জারি করা সম্ভব নয়। কিন্তু যখন গণতন্ত্রের সকল নিয়ম-নীতি পদদলিত হয়, পরষ্পর বিরোধী রাজনৈতিক দল ও নেতাদের মধ্যে সমঝোতার ও সহযোগিতার মনোভাব থাকে না, তাঁরা পরষ্পর হানাহানি ও হত্যায় উন্মত্ত থাকেন, কুশাসন, ঘুষ, দুর্নীতি, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি ও জুলুমে দেশের মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে উঠে, বিরাজমান শাসকগোষ্ঠির দিক থেকে জনগণ মুখ ফিরিয়ে নেয়, তখন জনগণ অত্যন্ত মরিয়া হয়ে আশা করেন কোথাও না কোথাও থেকে একজন ত্রাণকর্তা এসে তাদের রক্ষা করবেন। এমন সময়ে একজন জেনারেল দেশপ্রেম দ্বারা তাড়িত হয়ে মার্শাল ল’ জারি করে থাকেন। তিনি অঙ্গীকার করেন, দেশকে বিশৃঙ্খলা ও অরাজাকতা থেকে রক্ষা করে শান্তি পুন:প্রতিষ্ঠা করবেন, এবং যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নির্বাচন অনুষ্ঠান করে নির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা অর্পণ করে আর্মিকে ব্যারাকে ফিরিয়ে নিয়ে যাবেন। তবে মার্শাল ল’র শুরুতে এমন জেনারেল, বা তাঁর সঙ্গীসাথী অন্য জেনারেলদের, আসল নিয়ত বুঝা যায় না। ছ’মাস, এক বছর পার হলে আসল নিয়ত ধীরে ধীরে প্রকাশ পেতে থাকে। তখন ঘটনা অন্য দিকে মোড় নিতে পারে। সেকথা পরে বলছি।

১৮। যেকোনো কারণে দেশে যখন কুশাসন, দুর্নীতি, অবিচার ও জুলুম সহ্যের সীমা অতিক্রম করে, অতিষ্ঠ দেশের মানুষের পিঠ যখন দেয়ালে ঠেকে যায় তখন স্বাভাবিকভাবে আর্মির মধ্যেও তার বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। নিজ বাড়ির দেয়াল যত উঁচু হোক না কেনো, গ্রামে আগুন লাগলে বাড়ির ভিতরে আগুন না আসলেও উত্তাপ আসে। ক্যান্টনমেন্টকে বাকি দেশ থেকে আলাদা করে দেখার সুযোগ তথ্য প্রযুক্তির এ যুগে আর নেই। একজন সাধারণ সৈনিক ছুটিতে গ্রামের বাড়িতে গিয়ে যদি দেখতে পান: তাঁর বাড়ির পাশের কৃষক পরিবার অর্থাভাবে দু’বেলা খেতে পারছে না, বাবা জমির ফসলের ন্যায্য মূল্য পাচ্ছেন না, চাচার জমি সরকারি দলের স্থানীয় কোনো গুন্ডা জবরদখল করে আছে, পাশের বাড়ির স্কুল পড়ুয়া মেয়েটি সরকারি দলের স্থানীয় কোনো গুন্ডার অত্যাচারের ভয়ে স্কুলে যেতে পারছে না এবং এসব অপরাধীর বিরুদ্ধে থানা বা ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে বিচার চেয়ে লাভ হয় না, তখন তাঁর মনেও, আর দশজন নাগরিকের মত, শাসকের বিরুদ্ধে ঘৃণার আগুন জ্বলে উঠে। দেখা গেছে, সহ্য করতে না পেরে, কোনো সৈনিক যদি এমন অভিযোগ নিয়ে থানার ওসি বা ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে গিয়ে নিজ পরিচয় দিয়ে প্রতিকার চান, অনেক সময় প্রতিকার তো পানই না, বরং কখনও কখনও অপমানিত হয়ে ফিরতে হয়। শান্তির সময়ে একটি অপারেশনাল ইউনিটের প্রায় ২০% সৈনিক ছুটিতে ইউনিটের বাইরে অবস্থান করেন। ছুটি শেষে তাঁরা ইউনিটে ফিরে এসে সহকর্মী সৈনিকদের কাছে বাইরের জগতের দেখে আসা নিজের শোচনীয় অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেন। এভাবে সারা দেশের জনগণের সাথে আর্মি ইউনিটেও অসন্তোষ ধুমায়িত হতে থাকে।

১৯। আর্মিতে মেজর থেকে নিচের দিকে সিপাহি পর্যন্ত সকল র্যাং কে পদোন্নতি হয় জ্যেষ্ঠতা, যোগ্যতা ও মেধা বিচার করে। এখানে রাজনীতি বা অন্য কোনো কিছুর প্রভাব থাকে না। লেফটেন্যান্ট কর্নেল পদে পদোন্নতির ক্ষেত্রেও অনুরূপ মানদন্ড। তবে কতৃপক্ষ ইচ্ছে করলে এক্ষেত্রেও রাজনৈতিক বিবেচনা প্রয়োগ করতে পারেন, যদিও তেমনটা করা হবে সম্পূর্ণ অনৈতিক। কর্নেল থেকে জেনারেল পদে পদোন্নতির ক্ষেত্রে আমাদের মত দেশে, অন্য যা কিছুই বলা হোক না কেন, বাস্তবে প্রার্থীর রাজনৈতিক ও ব্যক্তিগত আনুগত্যকে সর্বোচ্চ বিবেচনায় নেয়া হয়। কৌতুক করে বলা হয়, রাজনৈতিক সরকারের সদিচ্ছাই এখানে সর্বোচ্চ বিবেচ্য বিষয়। অথচ, সংবিধান অনুযায়ী আর্মির সকল সদস্যকে দেশ, রাস্ট্র ও সংবিধানের প্রতি অনুগত থাকার শপথ নিতে হয়, কোনো রাজনৈতিক বা অরাজনৈতিক ব্যক্তি বা দলের প্রতি নয়।

২০। আগেই বলা হয়েছে, দেশে যখন শাসক ব্যক্তি, গোষ্ঠি বা দলের কুশাসন, দুর্নীতি, অবিচার, জুলুম এবং দেশের স্বার্থবিরোধী কাজকর্ম সহ্যের সীমা অতিক্রম করে, দেশের মানুষ যখন অতিষ্ঠ হয়ে উঠে, তখন স্বাভাবিকভাবে আর্মির মধ্যে তার প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। প্রধানত এই প্রতিক্রিয়া প্রকাশ্যে পরিলক্ষিত হয় মেজর এবং তার নিচের র্যাং কের সদস্যদের মধ্যে। ইউনিটগুলোতে দেখা দেয় একধরনের অস্থিরতা। আর্মির প্রতিটি ইউনিট খুব কঠিন বুনটে গ্রথিত সামাজিক সংগঠন। পারষ্পরিক সহমর্মিতা, ঐক্য ও সহযোগিতা যার ভিত্তি। ছুটি থেকে ফিরে আসা সৈনিকের কাছ থেকে গ্রামের সাধারণ মানুষের দু:খ-দুর্দশার কথা শুনে অন্যরাও বিচলিত বোধ করেন। দেশ যখন দু:শাসনের কবলে নিপতিত হয় তখন তার খবর দেশি-বিদেশি খবরের কাগজ, রেডিও, ইন্টারনেট এবং টেলিভিশনের মাধ্যমেও সৈনিকরা বিস্তারিতভাবে জানতে পারেন। নিম্নপদস্থ অফিসার এবং সাধারণ সৈনিকদের মধ্যে এক ধরনের অস্থিরতা ও চাপ সৃষ্টি হয়। একটা পর্যায় পর্যন্ত তাঁরা এই অস্থিরতা ও চাপ সহ্য করতে পারলেও, শেষ অব্দি, যখন কেউ আর্মির ভিতর বা বাইরে থেকে সরকার উৎখাতের আহ্বান জানায় তখন তারা চেইন অব কমান্ড ভেঙ্গে বেড়িয়ে আসার জন্য অস্থির হয়ে উঠেন। এমন সময়ে লে: কর্নেল থেকে জেনারেল র্যাং কের অফিসারদের পক্ষে নিস্ক্রীয় হয়ে থাকা আর সম্ভব হয়ে উঠে না। শাসকের প্রতি ব্যক্তিগত আনুগত্য তুচ্ছ করে নিজের অধীনস্ত সৈনিকদের সাথে যোগ দিয়ে সরকার উৎখাতের প্রক্রিয়ায় অংশ নেন। জনগণের এবং অধীনস্ত সৈনিকদের ইচ্ছার প্রতি সম্মান জানাতে তাঁরা এটা করে থাকেন। চূড়ান্ত ফলশ্রুতিতে দেশে নতুন বেসামরিক সরকার আসে, অথবা মার্শাল ল’ জারি হয়। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, ১৯৯০ সনের শেষভাগে প্রেসিডেন্ট জে: এরশাদের পতনের সময় তাঁরই নিয়োজিত বিশ্বস্ত আর্মি চীফ তাঁকে (জে: এরশাদকে) রক্ষা করতে এগিয়ে আসতে পারেননি। একইভাবে, ২০০৬ সালে প্রসিডেন্ট প্রফেসর ইয়াযউদ্দিনের আদেশ অমান্য করে তৎকালীন আর্মি চীফ সরকার পরিবর্তন করেছিলেন, যদিও একই রাজনৈতিক নেত্রী প্রেসিডেন্ট ও আর্মি চীফ উভয়ের নেতা ও নিয়োগকর্তা ছিলেন। এখানে আরও একটি বিষয় গুরুত্বের সাথে উল্লেখের দাবি রাখে। যখন কোনো জেনারেল এভাবে মার্শাল ল’ জারি করেন তখন তাঁকে দেশের অভ্যন্তরীণ এক বা একাধিক সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দল পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষভাবে স্বাগত জানায়, সমর্থন করে। বাংলাদেশে ১৯৭৫ ও ১৯৮২ সনে যখন মার্শাল ল’ জারি হয়, এবং ২০০৬ সনে যখন আধা-মার্শাল ল’ জারি হয়, প্রতিবারেই কোনো না কোনো বিরোধী রাজনৈতিক দল বা ব্যাক্তি বিরাজমান শাসকের বিরুদ্ধে জেনারেলদের প্রকাশ্যে স্বাগত জানিয়ে সমর্থন করেছিলেন।

২১। এখন দেখা যাক, মার্শাল ল’ জারি হবার পর আর্মির অভ্যন্তরে কী ঘটে। বাংলাদেশে যাঁদের বয়স আমার মত সত্তরের কাছাকাছি তাঁদেরকে এ বিষয়ে নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। তাঁরা ১৯৫৮ সন থেকে ১৯৯০ পর্যন্ত জারিকৃত সকল মার্শাল ল’র, এবং ২০০৬ সনে চালুকৃত আধা-মার্শাল ল’র সব ঘটনা নিজ চোখে দেখেছেন। তবে নতুন প্রজন্মের নাগরিকদের জানার জন্য এ বিষয়ে বলার প্রয়োজন আছে বলে মনে করি। সেনাবাহিনী প্রধান নিজেকে চিফ মার্শাল ল’ এডমিনিস্ট্রেটর (সিএমএলএ) নিয়োগ করে মার্শাল ল’ জারি করেন। একইসাথে নৌবাহিনী প্রধান এবং বিমানবাহিনী প্রধানদ্বয়কে ডেপুটি চিফ মার্শাল ল’ এডমিনিস্ট্রেটর (ডিসিএমএলএ) নিয়োগ করা হয়ে থাকে। ফরমেশন কমান্ডারদের (সাধারণত জেনারেল র্যাং কের অফিসার) জোনাল মার্শাল ল’ এডমিনিস্ট্রেটর (জেডএমএলএ) নিয়োগ করা হয়। তার নিচে বিগেডিয়ার জেনারেল র্যাং কের অফিসারদেরকে সাব জোনাল মার্শাল ল’ এডমিনিস্ট্রেটর (এসজেডএমএলএ) নিয়োগ করা হয়। মাঠ পর্যায়ে ইউনিট কমান্ডারদের (লে: কর্নেল) ডিস্ট্রিক্ট মার্শাল ল’ এডমিনিস্ট্রেটর (ডিএমএলএ) নিয়োগ করা হয়। ডিএমএলএ’রা তৃণমূল পর্যায়ে জেলার ডেপুটি কমিশনারসহ আর সব সিভিল অফিসারদের কাজ তদারক করে থাকেন, আদেশ-নির্দেশ দিয়ে থাকেন। কেন্দ্রে সিএমএলএ, ডিসিএমএলএ এবং সিনিয়র জেনারেলগণ বিভিন্ন মন্ত্রনালয়ের দায়িত্ব নিয়ে সরকার পরিচালনা করেন। মার্শাল ল’ জারি হবার সাথেসাথে পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী অপারেশনাল ইউনিটগুলো ক্যান্টনমেন্ট থেকে দ্রুত বেরিয়ে এসে সকল জেলাসদরসহ দেশের আনাচেকোনাচে কমিউনিটি সেন্টার, ক্লাবঘর, স্টেডিয়াম ইত্যাদি স্থানে অবস্থান গ্রহণ করে।

২২। মার্শাল ল’ কর্তৃপক্ষ সর্বপ্রথম যে কাজটি করে থাকে তা হলো দ্রুত দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা। কুখ্যাত সন্ত্রাসী, অপরাধী, গুন্ডাবদমাশ, দুর্নীতিবাজ রাজনীতিবীদ, এবং তাদের দোসর মুনাফাখোর ও মজুতদার ব্যবসায়ীদের আটক করে জেলে পুরা হয়। তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত ও মামলা শুরু হয়। সাধারণ আইন অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে তরিৎ ব্যবস্থা নেয়া হয়। স্পেশাল ও সামারি মিলিটারি কোর্ট গঠণ করে এসব অপরাধীদের দ্রুত বিচার করে শাস্তি প্রদান করা হয়। মাঠ পর্যায়ে জুনিয়র অফিসাররা সন্ত্রাসী, অপরাধী ও দুর্নীতিবাজ ও গুন্ডাবদমাশ বলে পরিচিত লোকদের শায়েস্তা করার জন্য আর্মি ক্যাম্পে ধরে এনে শারীরিক সাজা দিয়ে থাকেন। কাজটা বেআইনি হলেও জনগণ খুব পসন্দ করে এসব ধরিবাজ লোকদের পিটুনি খাওয়া। যেসব সিনিয়র দুর্নীতিবাজ রাজনীতিবীদ, সরকারি আমলা এবং ধনী ব্যবসায়ী এতদিন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ও টাকার জোরে নিজেদেরকে সবসময় আইনের ঊর্ধে মনে করে এসেছেন, তাঁরা যখন শাস্তি পেয়ে জেলে যেতে থাকেন তখন সাধারণ মানুষ সন্তুষ্টি প্রকাশ করে থাকেন। মিটিং-মিসিল ও ধর্মঘটসহ সবরকম রাজনৈতিক কর্মকান্ড নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। আফিস-আদালত, কলকারখানা এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে নিয়মিত কাজ হতে থাকে। পুরো সংবিধান, অথবা সংবিধানের মানবাধিকার সংক্রান্ত ধারাগুলো, সাময়িকভাবে রহিত করা হয়। দেশে শান্তির পরিবেশ প্রতিষ্ঠিত হয়। আদালতগুলো অবশ্য কোনো হস্তক্ষেপ ছাড়া নিজ নিজ কাজ চালিয়ে যায়। তবে বেশি দিন এমন অবস্থা থাকে না।

২৩। জারি হবার ছ’মাস থেকে এক বছরের মধ্য মার্শাল ল’তে পচনের লক্ষণ দেখা দেয়। সাধারণভাবে আর্মিতে মধ্যম ও নিম্ন পর্যায়ের অফিসারদের দুর্নীতি করার সুযোগ একবোরে নেই বললেই চলে। তবে প্রকিউরমেন্ট, পারচেইজ এবং কনস্ট্রাকশনের সাথে যাঁরা জড়িত, বিশেষ করে সিনিয়র অফিসাররা, ইচ্ছে করলে ব্যাপক আর্থিক দুর্নীতি করতে পারেন। কেউ কেউ করেও থাকেন। এসব অফিসাররা মার্শাল ল’ এলে চুটিয়ে আর্থিকসহ অন্যান্য দুর্নীতি করেন, এমন নজির দুর্লভ নয়। মার্শাল ল’ জারি হবার সাথেসাথে সিভিল আমলারা, বিশেষ করে সিনিয়ররা, একেবারে ঘাপটি মেরে যান। তাঁরা ভালো করেই জানেন, দেশ চালানো আর্মির কাজ নয়। প্রত্যেক মন্ত্রনালয় এবং ডিপার্টমেন্টের নিজস্ব কিছু জটিল এবং ষ্পর্শকাতর কাজ আছে যা প্রশিক্ষণ ও অভিজ্ঞতা ছাড়া করা যায় না। আর্মির অফিসারদের সেটা জানা নেই। স্বাভাবিকভাবেই মার্শাল ল’র দায়িয়ত্বপ্রাপ্ত অফিসাররা একটা সময়ে বুদ্ধিপরামর্শ ও সিদ্ধান্তের জন্য অভিজ্ঞ আমলাদের শরণাপন্ন হন। দুর্নীতিপরায়ণ আমলারা মনেমনে হাসেন আর এই সুযোগের জন্য দিন গুণেন। সুযোগ এসে গেলে দ্বিগুণ-তিনগুণ দুর্নীতি করেন। আগে ফাইল আটকে রেখে যেখানে মক্কেলদের কাছ থেকে, ধরা যাক, এক লক্ষ টাকা ঘুষ নিতেন, মার্শাল ল’র পর সেখানে তিন লক্ষ টাকা দাবি করেন। বলেন, দেশে এখন মার্শাল ল’ চলছে তাই রিস্ক অনেক বেড়ে গেছে, টাকা বেশি দিতে হবে। দেখা গেছে পুলিশ বিভাগের নিম্নস্তরের একশ্রণীর কর্মকর্তা-কর্মচারি মার্শাল ল’র নাম করে স্বাভাবিকের চাইতে অনেক বেশি ঘুষ নিয়ে থাকেন। কারণ, অভিযুক্তদের বিচার মার্শাল ল’ কোর্টে হলেও তদন্ত করা, চার্জশিট দেওয়া ইত্যাদি কাজগুলো বরাবরের মত থানা-পুলিশই করে থাকে। এসব ক্ষেত্রে একশ্রণীর উকিল-এডভোকেট সাহেবরাও কম যান না। মার্শাল ল’ কোর্টের নাম বলে, এমনকি মার্শাল ল’ কোর্টের বিচারককে ঘুষ দিতে হবে বলে, মক্কেলদের কাছ থেকে অবিশ্বাস্য রকমের বেশি টাকা নিয়ে থাকেন। এভাবে মার্শাল ল’র মধ্যেই দুর্নীতি, শোষণ, অত্যাচার এবং সেইসাথে কুশাসন বাড়তে থাকে। সাধারণ মানুষ আবার অতিষ্ঠ হয়ে উঠতে থাকে। তখন তারা মার্শাল ল’ থেকে মুক্তির পথ খুঁজতে শুরু করে। পুরানো রাজনীতিবীদরা আবার ধীরে ধীরে ময়দানে নেমে আসর গরম করতে শুরু করেন।

২৪। অন্য সবার মত মার্শাল ল’ জারিকারী জেনারেলগণ একথা ভালোভাবে জানেন যে ক্ষমতা কারো জন্য চিরস্থায়ী নয়। ভবিষ্যতে নিজেদের জীবন, ধন ও মানের নিরপত্তার কথা তাঁদের ভাবিয়ে তুলে। ক্ষমতা গ্রহণের পরপরই তাঁরা ক্ষমতা থেকে বেড়িয়ে যাবার নিরাপদ নির্গমণ পথ, বা সেইফ এক্সিট, খুঁজতে থাকেন। এই লক্ষ্যে তাঁরা হয় পেছনে থেকে নতুন রাজনৈতিক দল গঠণ করেন, অথবা পুরনো রাজনৈতিক দলের সাথে আঁতাত গড়ে তোলেন। নতুন নতুন নামে তল্পিবাহক যুবকশ্রেণী ও পেশাজীবীদের সংগঠণ গড়ে তোলেন। একাজে সরকারি অর্থ ও প্রশাসনকে যথেচ্ছ ব্যবহার করার নজির আছে।

২৫। মার্শাল ল’ জারিকারী জেনারেলগণ যদি দুর্নীতিপরায়ন ও ক্ষমতালোভী হন তাহলে নিজেদের ক্ষমতার প্রতি আর্মির ভিতর থেকে যাতে কোনো হুমকি সৃষ্টি না হয় সেজন্য তাঁরা উল্লেখযোগ্য কিছু পদক্ষেপ নিয়ে থাকেন। প্রথমেই সৎ, দেশপ্রেমিক ও রাজনীতিতে উৎসাহ নেই এমন জেনারেলদের আর্মির ভিতরের সকল স্পর্শকাতর পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। দেশের ভিতরে সিভিল পদে, যেমন কপোর্রেশনের চেয়ারম্যানের পদে, নিয়োগ দেওয়া হয়। দেশের বাইরে রাস্ট্রদূত হিসেবে পাঠানো হয়। তাঁদের যায়গায় এমন সব অপেক্ষাকৃত জুনিয়র, অদক্ষ এবং অনেক ক্ষেত্রে লোভী ও অসৎ অফিসারদের প্রমোশন ও নিয়োগ দেওয়া হয় যাঁরা নিজেরাও কখনো ভাবেননি যে তাঁরা একদিন জেনারেল হতে পারবেন। এঁদের মধ্যে অনেককে মার্শাল ল’র সময়ে আর্থিক দুর্নীতি করার সুযোগও দেওয়া হয়। এর সবই করা হয় আর্মিকে সৎ ও সুযোগ্য নের্তত্ব থেকে বঞ্চিত করে ফাইটিং মেশিন হিসেবে তার কর্মক্ষমতা হৃাস করার জন্য। অন্যদিকে সাধারণ সৈনিকদের পেশাগত প্রশিক্ষণ থেকে দূরে সরিয়ে রাখার জন্য নানা চতুর পদক্ষেপ নেয়া হয়। যেমন, ১৯৮২ সনে মার্শাল ল’ জারির পর বাংলাদেশ আর্মিতে সৈনিকদের জন্য আন্ত:ফরমেশন আজান ও ক্বেরাত প্রতিযোগিতা এবং সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা নামক দু’টি প্রতিযোগিতা চালু করা হয়। যা এখনও চালু আছে বলে পত্রিকার পাতায় দেখে থাকি। পৃথিবীতে পঞ্চাশের বেশি মুসলিমপ্রধান রাস্ট্র আছে। তার কোনোটিতে সৈনিকদের জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে আজান ও ক্বেরাত প্রতিযোগিতা অনুষাঠিত হয় কিনা আমার জানা নেই। পৃথিবীর কোনো আর্মিতে সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতার নামে প্রশিক্ষণের অমূল্য সময় ও অর্থ ব্যয় করা হয় বলে আমার জানা নেই। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, যখন যুদ্ধ থাকে না, অর্থাৎ শান্তির সময়ে, সৈনিকদের একমাত্র কাজ যুদ্ধের জন্য অধিকতর প্রস্তুত থাকার জন্য নিরন্তর পেশাগত প্রশিক্ষণ চালিয়ে যাওয়া। একমাত্র ব্যতিক্রম হয় প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময়। যখন উপদ্রুত এলাকায় ত্রাণ ও পুনর্বাসন কাজের জন্য আর্মিকে নিয়োগ করা হয়। সাধারণ সৈনিকদের মার্শাল ল’ ডিউটির নামে, কখনো কখনো নেশন বিল্ডিং ওয়ার্ক বা জতিগঠণমূলক কাজের নামে, ট্রাফিক কন্ট্রোলের মত বিভিন্ন বেসামরিক ফালতু প্রশাসনিক কাজে ব্যস্ত রাখা হয়।

২৬। ১৯৯১ সনের কথা। আমি তখন পেইচিংয়ে বাংলাদেশ দূতাবাসে কাজ করি। দেশ থকে একজন অতি তুখোড় এবং নামকরা নাট্য ব্যাক্তিত্ব পেইচিং বেড়াতে এলেন। কোনো এক ডিনার পার্টিতে তাঁর সাথে আলাপ হলো। আলাপের এক পর্যায়ে তিনি মন্তব্য করে বসলেন, বাংলাদেশে আর্মির কোনো প্রয়োজন নেই। যে সম্ভাব্য শত্রুর বিরুদ্ধে এত অর্থসম্পদ ব্যয় করে বাংলাদেশ আর্মি পোষা হচ্ছে তা এত বড় ও শক্তিশালী যে যুদ্ধক্ষেত্রে বাংলাদেশে আর্মি তার বিরুদ্ধে ছ’ঘন্টা দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে কিনা সন্দেহ। তাছাড়া, বাংলাদেশ আর্মি দু’দুজন রাষ্ট্রপতিকে হত্যা করেছে। বারবার মার্শাল জারি করে দেশে গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রা স্তব্ধ করেছে। আর্মি উঠিয়ে দেওয়া দেশের জন্য ভালো হবে। তিনি আরও জানালেন, বাংলাদেশের সুশীল সমাজের অনেক সদস্য এব্যাপারে তাঁর সাথে একমত পোষণ করেন। সুশীল সমাজের সদস্য হিসেবে তিনি একজন প্রখ্যাত অর্থনীতিবীদের নাম উল্লেখ করলেন। জবাবে অত্যন্ত বিনয়ের সাথে বলেছিলাম, শত্রু বড় কি ছোট, শক্তিশালী কি দুর্বল, এসব কথা বিবেচনা করে কখনও কোনো সৈনিক যুদ্ধে যান না। তিনি যুদ্ধে গমন করেন মাতৃভূমির স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য প্রাণ উৎসর্গ করতে। সৈনিকের মনে যদি এই প্রত্যয় থাকে যে তিনি যুদ্ধে শহীদ হলে তাঁর পুত্র হাতে রাইফেল তুলে নেবে, পুত্র শহীদ হলে তার পৌত্র হাতে রাইফেল তুলে নেবে, যেমন করছে যুগ যুগ ধরে ফিলিস্তিনিরা, তাহলে শত্রুর আকার ও শক্তির ভয় দেখিয়ে তাঁকে পদানত করে রাখা যায় না। বরং এমন তেজস্বী জাতির বিরুদ্ধে কোনো আগ্রাসী শত্রু আক্রমণ করতে সাহস পায় না। এমন প্রত্যয়ী ও তেজস্বী জাতি অগ্নিপিন্ড বা ফায়ার বলের মত। শত্রু তাকে গিলে খেতে পারলেও হজম করতে পারে না। শত্রুর নাড়িভুড়ি পুড়িয়ে সে বেড়িয়ে এসে নিজের স্বাধীন সত্ত্বায় দ্রুত প্রত্যাবর্তন করে। জাতীয় শৌর্য, প্রত্যয় ও তেজস্বীতা বহাল রাখার জন্য স্বাধীনতা ও সার্বভৌমতাবের প্রতীক জাতীয় সেনাবাহিনীর প্রয়োজন কখনই অস্বীকার করা যায় না। দখলদার শত্রুর বিরুদ্ধে দীর্ঘস্থায়ী জনযুদ্ধের নিউক্লিয়াস হিসেবে কাজ করার জন্যও একটি সুপ্রশিক্ষিত আর্মির প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করা যায় না। আর্মি থাকা বা না থাকা একটি অত্যন্ত জটিল বিষয়। এর সাথে শুধু নিজ দেশ নয়, আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক ভূ-রাজনীতি, রাজনীতি, সমরনীতি, সামরিক ইতিহাস, অর্থনীতি, সমাজবিজ্ঞান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, নৃবিজ্ঞান, ঐতিহ্য ইত্যাদি অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় জড়িত। যদি একান্তই আর্মি রাখা বা না-রাখার প্রশ্ন কখনও সরকারের গভীর বিবেচনায় আসে, তাহলে সুশীল সমাজের দু’চারজন সদস্যের একপেশে মতামতের উপর নির্ভর না করে, সংশ্লিষ্ট সকল বিষয়ের বিশেষজ্ঞদের নিয়ে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেয়াটা যথার্থ হবে। একথা সত্য, আর্মির অতি নগণ্যসংখ্যক কিছু সদস্য দু’জন রাষ্ট্রপতিকে হত্যা করেছে। অবশ্যই এটা বিরাট নিন্দনীয় অপরাধ। যার পেছনে ছিলো গভীর দেশি ও বিদেশি ষড়যন্ত্র। একথা ভাবা ঠিক নয় যে, সে ষড়যন্ত্রে শুধুমাত্র সংশ্লিষ্ট সৈনিকরা সম্পৃক্ত ছিলো। ষড়যন্ত্রকারী সৈনিকদের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে অবশ্যই কিছু রাজনীতিবীদ জড়িত ছিলেন। ষড়যন্ত্রকারী সৈনিকদের বিচার অনুষ্ঠিত হলেও, কোনো বেসামরিক সরকার আজ পর্যন্ত প্ররোচনাকারী ও পৃষ্ঠপোষক রাজনীতিবিদদের বিচার করলো না। মূল ষড়যন্ত্র উদ্খাটিত হলো না। যদি শুরুতেই তা করা হতো, তাহলে এসব রাজনৈতিক হত্যাকান্ড এড়ানো সম্ভব হতো। আমার মনে হয় না শেষ পর্যন্ত আমি ভদ্রলোককে বিষয়টি বোঝাতে পেরেছিলাম।

২৭। যেসব জেনারেল মার্শাল ল’ জারি করেন তাঁদের পেছনে থাকা প্ররোচনাকারী ও পৃষ্ঠপোষক রাজনীতিবিদদের বিচারের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে উচ্চ আদালতের, এবং একের পর এক রাজনৈতিক সরকারের, নীরবতা কাম্য হতে পারে না। এমনকি মার্শাল ল’র সময়ে যেসব জেনারেল দুর্নীতি করেছেন তাঁদের বিচার করার উদ্যোগও কোনো রাজনৈতিক সরকার আজ পর্যন্ত নেয়নি। একথা সত্যি, দুর্নীতির দায়ে জে: এরশাদ আদালত কর্তৃক দন্ডিত হয়ে জেল খেটেছেন। তবে তা একজন জেনারেল হিসেবে নয়, একজন রাজনীতিবীদ হিসেবে দুর্নীতি করার জন্য। দেশের সর্বোচ্চ পর্যায়ের রাজনৈতিক নেতৃত্ব যদি এসব বিষয়ে মনোযোগী না হন তাহলে দেশ থেকে রাজনৈতিক হত্যা এবং মার্শাল ল’র সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যাবে না। আর এজন্য জনগণের উচিত্ হবে দুর্নীতিপরায়ণ, অযোগ্য এবং ব্যর্থ রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে প্রত্যাখ্যান করে নির্বাচনের সময় সুশিক্ষিত, মেধাবী, দক্ষ, প্রজ্ঞাবান, সত্ ও দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে ভোট দিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব প্রদান করা। নতুন নেতৃবৃন্দকে সুযোগ করে দেওয়া। তবে যতদিন পর্যন্ত রাজনৈতিক নেতৃত্বের ধারা নিজ-রক্ত-নিজ-বংশের গন্ডী পেরিয়ে বাইরে না আসছে ততদিন এমনটি হবার সম্ভাবনা নেই।

২৮। একথা অপ্রিয় হলেও সত্য, বাংলাদেশে আর্মির সাথে জনগণের ভুল বুঝাবোঝি সৃষ্টি করা এবং তা বজায় রাখার পেছনে একশ্রণীর সংবাদ মাধ্যম ক্রমাগত অবদান রেখে আসছে। বাংলাদেশের অধিকাংশ সংবাদপত্র ও বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলের মালিকানা এমন সব বড় বড় ব্যবসায়ীদের হাতে যাঁরা প্রশ্নবিদ্ধ উপায়ে অগাধ ধনসম্পদের মালিক হয়েছেন। দুর্নীতিপরায়ণ রাজনীতিবীদদের সক্রিয় সাহায্য ও সমর্থন ছাড়া এসব অসৎ ব্যবসায়ী নিজেদের ধনসম্পদ অর্জন ও ভোগ করতে পারেন না। আর্মির সাধারণ সৈনিকরা স্বভাবতই দুর্নীতিপরায়ণদের প্রচন্ড ঘৃণা করেন। যেকারণে দুর্নীতিপরায়ণ রাজনীতিবীদদের পৃষ্ঠপোষক একশ্রণীর সংবাদ মাধ্যমের অসত্ মালিক এসব রাজনীতিবীদদের পক্ষ নিয়ে নিজেদের পত্রিকা এবং টেলিভিশন চ্যানেলে আর্মির বিরুদ্ধে প্রপাগান্ডা চালান। শোনা যায়, বিদেশি বৈরী এজেন্সির অর্থে পরিচালিত দু’য়েকটি সংবাদপত্র ও টেলিভিশন চ্যানেলও একাজে নিয়োজিত আছে। ২০০৯ সনে বিডিআর বিদ্রোহের সময় বিষয়টি প্রকটভাবে সবার নজরে আসে।

২৯। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে জাতীয় আর্মিকে অন্যায্য সমালোচনা থেকে রক্ষা করার জন্য দেশপ্রেমিক রাজনীতিবীদ ও গণমাধ্যম এগিয়ে আসেন। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, বাংলাদেশে এমনটা লক্ষ্য করা যায় না। সমালোচনার জবাব দেওয়ার জন্য আর্মির নিজস্ব কোনো মঞ্চ নেই, সুযোগ নেই, থাকার কথাও নয়। সে সুযোগ নিয়ে কিছু লোক উদ্দেশ্যমূলকভাবে যখন তখন আর্মিকে যা খুশি তাই বলে সমালোচনা করবে, এটা দেশের জন্য কখনও মঙ্গলজনক হতে পারে না। আর্মির একজন প্রাক্তন সৈনিক হিসেবে এই ভেবে আনন্দ ও গর্ব অনুভব করি যে, বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ অনেক বৈরী প্রপাগান্ডা সত্বেও অতীতের সব সময়ের মত আজও সৈনিকদের আপনজনের মত ভালবাসে, সকল বিপদে-আপদে বন্ধু হিসেবে নিজের পাশে দেখতে চায়। আমার বিশ্বাস, বর্তমান সৈনিকরাও সেজন্য আনন্দ ও গর্ব অনুভব করেন। এই লেখাটির মূলে রয়েছে সেই আনন্দ ও গর্বের তাড়না।

৩০। আমার এ লেখাটি পড়ে কেউ কেউ হয়তো মনে করতে পারেন, আমি রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে রাজনীতিবীদদের ভূমিকাকে অবমূল্যায়ন করার চেষ্টা করেছি। কথাটা ঠিক নয়। অন্য যেকোনো একজন সচেতন নাগরিকের মত আমিও বিশ্বাস করি একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় রাষ্ট্র পরিচালনার কাজ শুধুমাত্র রাজনীতিবীদদের, অন্য কারো নয়। অন্যরা সবাই একাজে রাজনীতিবীদদের নির্দেশনা এবং চাহিদা অনুযায়ী তাঁদেরকে সাহায্য ও সহযোগিতা প্রদান করবেন। রাজনীতিবীদরা রাষ্ট্রের সকল নীতি প্রনয়ণ, নিয়ন্ত্রণ এবং পরিচালনা করেন। স্বভাবতই এজন্য প্রয়োজন এমন রাজনীতিবীদের যাঁর রয়েছে অতি উন্নত মানের দেহ, মন এবং আত্মার গুণাবলী। এমন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বভার অসত্, অকর্মণ্য, নির্বোধ এবং দেশপ্রমিক নন এমন ব্যক্তিদের হাতে অর্পণ করা হলে তা দেশের জন্য মহাবিপর্যয় ডেকে আনে। দেশের সাধারণ জনগণ যতদিন এ সত্য অনুধাবনে ব্যর্থ হয়ে তাঁদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করে অযোগ্য ব্যাক্তিদের নির্বাচিত করে সংসদে পাঠাবেন ততদিন সামরিক-বেসামরিক প্রশাসন, বিচারালয়, শিক্ষাঙ্গন, চিকিত্সালয়, ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্প, কোনো ক্ষেত্রেই সত্ ও যোগ্য ব্যক্তিরা সিনিয়র পজিশনে ঠাঁই পাবেন না। আমি বিশ্বাস করি, দেশের সচেতন জনগোষ্ঠি, বিশেষ করে ছাত্ররাজনীতির সাথে জড়িত নন এমন শিক্ষিত তরুণ-তরুণীরা এবং দেশপ্রেমিক গণমাধ্যম যদি এগিয়ে আসেন তাহলে দেশের সাধারণ জনগণকে ভোটাধিকার প্রয়োগের ক্ষত্রে সচেতন করে তোলা কঠিন হবে না। দেশবাসী সেই আশাতই প্রহর গুণছে।

*********