Friday, October 24, 2014
ক্যাডেট কলেজের টুকরো স্মৃতি: ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজ পর্ব : ৮
Tuesday, June 10, 2014
ক্যাডেট কলেজের টুকরো স্মৃতি: ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজ: পর্ব ১১: কিছু উল্লেখযোগ্য ঘটনা
Monday, June 02, 2014
ক্যাডেট কলেজের টুকরো স্মৃতি: ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজ: পর্ব ৮: দুষ্টামির পক্ষে ওকালতি !
ক্যাডেট কলেজের টুকরো স্মৃতি: ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজ: পর্ব ১০: ক্যাডেটের কান্না
ক্যাডেট কলেজের টুকরো স্মৃতি: ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজ: পর্ব ৯
Saturday, May 24, 2014
ক্যাডেট কলেজের টুকরো স্মৃতি: ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজ: পর্ব ৭
Sunday, March 30, 2014
ক্যাডেট কলেজের টুকরো স্মৃতি: ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজ: পর্ব ৬: ঠিকাদারের চ্যালেঞ্জ
Tuesday, March 25, 2014
ক্যাডেট কলেজের টুকরো স্মৃতি: ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজ: পর্ব ৫: ক্যাডেট কলেজে অশান্তি এড়াতে হলে
ক্যাডেট কলেজের টুকরো স্মৃতি: ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজ: পর্ব ৪: সেকুলারিজম নিয়ে বিভ্রান্তি
ক্যাডেট কলেজের টুকরো স্মৃতি: ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজ: পর্ব ৩: মায়ের মন মানে না মানা
ক্যাডেট কলেজের টুকরো স্মৃতি: ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজ: পর্ব ২: প্রিন্সিপাল তো নয় যেনো আই জি প্রিজন !
ক্যাডেট কলেজের টুকরো স্মৃতি: ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজ: পর্ব ১: প্রিন্সিপাল পদে যোগদান
Monday, November 11, 2013
২০০০ সনের জানুয়ারিতে অবসরে যাবার আগ পর্যন্ত তেত্রিশ বছর সেনাবাহিনীতে চাকুরি করেছি। এর মধ্যে প্রায় পাঁচ বছর ক্যাডেট কলেজে কাজ করেছি। চাকুরির একেবারে শুরুতে এক বছর পাকিস্তানের মিলিটারি কলেজ ঝেলামে জুনিয়র একাডেমিক ইন্সট্রাক্টর হিসেবে চাকুরি করেছি। পরে চাকুরির ১১/১২ বছরের মাথায় চার বছর একনাগারে ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজ এবং ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজের প্রিন্সিপালের দায়িত্ব পালন করেছি। এ সময়ে অনেক কিছু দেখেছি, শুনেছি, শিখেছি, অনুভব করেছি, কিছুটা অভিজ্ঞতাও হয়েছে। তার কিছু কিছু অংশ পাঠকদের সাথে শেয়ার করার তাগিদ অনুভব করছি। গল্পচ্ছলে যখন আত্মীয়স্বজন বা বন্ধুবান্ধবদের কাছে এসব দিনের কোনো ঘটনা বলি, তখন কেউ কেউ সেগুলো লিখে প্রকাশ করার জন্য অনুরোধ করেন। তাঁদের যুক্তি: এগুলো বাস্তব জীবনের অভিজ্ঞতা। ভবিষ্যতের আভিভাবক, শিক্ষক, এমনকি ক্যাডেটরা পড়ে উপকৃত হতে পারে। সামরিক বাহিনীতে চাকুরি করার সময়ে রোজনামচা বা ডাইরি লেখার অভ্যাস বজায় রাখা নিরাপদ নয়, বিশেষ করে আমাদের মতো দেশে। স্বাধীনভাবে চিন্তা করতে পারলেও স্বাধীনভাবে বলা বা লেখা খুব ঝুঁকিপূর্ণ। ১৯৭১ সনের পূর্বে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে চাকুরি করার সময়ে একজন বাংগালি অফিসারের জন্য কাজটি যারপরনাই বিপজ্জনক ছিলো। তাই চাকুরি জীবনের শুরু থেকে ডাইরি লেখার অভ্যাস গড়ে উঠেনি। যা কিছু লিখছি তার সবটাই স্মৃতি থেকে। দিন, তারিখ, সময়ের হেরফের হতে পারে। লোকজনের নাম ভুল হতে পারে। বোধগম্য কারণে কোনোকোনো লোকের সঠিক নাম আড়াল করে ছদ্মনাম ব্যবহার করতে হয়েছে।
আমি ইতিহাস লিখতে বসিনি। আমি লিখছি আমার নিজের জীবনে ঘটে যাওয়া কিছু ঘটনা। সাধারণ বিবেচনায় এগুলো নৈমিত্তিক ঘটনা হলেও আমার কাছে, তখন মনে না হলেও, এখন মনে হয় এর মধ্যে কিছু অসাধারণ ঘটনা ছিলো। যদিও সব ঘটনার নায়ক বা ভিলেন আমি নিজে নই। কখনও কখনও পার্শ্ব চরিত্র হিসেবে ঘটনার স্বাক্ষী ছিলাম। তাই বর্ণনাতে ‘আমি’র আধিক্য থাকাটা স্বাভাবিক হলেও উদ্দেশ্য আত্মপ্রচার নয়। আশা করি পাঠক ক্ষমা করবেন। প্রয়োজনে যাতে সহজে উল্লেখ করা যায় সেজন্য বর্ণিত ঘটনাগুলোকে একটি করে শিরোনাম ও ক্রমিক নম্বর দিয়ে বর্ণনা করা হয়েছে।
মিলিটারি কলেজ ঝেলাম: পর্ব ১ বাংগালির উর্দু শেখা১৯৬৭ সনের আগস্ট মাসের ২৭ তারিখে পি এম এ’র (পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমি) ট্রেইনিং শেষ করে পাকিস্তান আর্মির এডুকেশন কোরে সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট হিসেবে পার্মানেন্ট রেগুলার কমিশন লাভ করি। পাসিং আউটের পর ছুটি কাটিয়ে সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি আমার জীবনের প্রথম ইউনিট মিলিটারি কলেজ ঝেলামে যোগদান করি। এখানে মিলিটারি কলেজ ঝেলাম সম্পর্কে কিছু বলাটা আশা করি অপ্রাসংগিক হবে না। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে বৃটিশ গভর্নমেন্টের পক্ষে অনেক ভারতীয় সৈনিক যুদ্ধ করে প্রাণ হারিয়েছিলো। প্রধানত: সেসব নিহত সৈনিকদের ছেলেদেরকে সরকারি খরচে লেখাপড়া শিখিয়ে সৈনিক বানাবার লক্ষ্যে বৃটিশ সরকার ১৯২২ সনে (পাকিস্তানের) ঝেলামে মুসলমানদের জন্য এবং (ভারতের) দেরাদুনে অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের জন্য দু’টি পৃথক আবাসিক স্কুল প্রতিষ্ঠা করে। নাম দেওয়া হয় কিং জর্জ রয়েল মিলিটারি স্কুল। ১৯২৫ সাল থেকে স্কুল দু’টোর কার্যক্রম শুরু হয়। সাধারণ বেসামরিক স্কুলের সিলেবাস অনুযায়ী ক্লাস এইট পর্যন্ত পাঠদানের পাশাপাশি এলিমেন্টারি মিলিটারি ট্রেইনিং দেবার ব্যবস্থা রাখা হয়। অত্যন্ত পারদর্শিতা অর্জনকারীকে কমিশন প্রদানের জন্য নির্বাচন করা হতো। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর ঝেলামের স্কুলটির নাম পাল্টে মিলিটারি কলেজ ঝেলাম রাখা হয়। প্রচলিত বোর্ডিং স্কুলের মত এটিকে একটি ইন্টারমিডিয়েট কলেজে (দ্বাদশ শ্রণী পর্যন্ত) উন্নীত করা হয়। অনেকটা বর্তমানের ক্যাডেট কলেজের মত। পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর ইতিহাসে এই কলেজের প্রাক্তন ছাত্ররা আজ পর্যন্ত অতি গৌরবময় দেশপ্রেম, আত্মত্যাগ ও শৌর্যবীর্যের স্বাক্ষর রেখে আসছে। পাকিস্তানের একাধিক আর্মি চীফ, নেভি চীফ ও এয়ার চীফ এই কলেজের প্রাক্তন ছাত্র। পাকিস্তানের বর্তমান (২০১৩) আর্মি চীফ জেনারেল আশফাক পারভেজ কায়ানী এই কলেজের একজন প্রাক্তন ছাত্র, যাকে ১৯৬৭ সনে ক্লাসরুমে পড়াবার সুযোগ আমার হয়েছিলো।
আমি যখন যোগদান করি তখন মিলিটারি কলেজ ঝেলামে ছাত্র, যাদেরকে সরকারিভাবে ক্যাডেট বলা হতো তাদের, সংখ্যা ছিলো কমবেশি ৩০০। হাউস (হোস্টেল) ছিলো ৪টি। এর মধ্যে শের শাহ নামক একটি হাউসে একেবারে নতুন আসা ক্লাস এইটের ক্যাডেটদের রাখার ব্যবস্থা ছিলো। অন্য তিনটি হাউসে বাকি ক্লাসের ক্যাডেটদের মোটামোটি সমানভাবে ভাগ করে রাখা হতো। অমি যখন ছিলাম তখন এই প্রতিষ্ঠানে বাংগালি আর কোনো অফিসার বা কর্মচারি ছিলো না। ক্যাডেট ছিলো মাত্র চারজন। এর মধ্যে দু’জন আপন ভাই নিচের ক্লাসে পড়তো, যাদের বাবা ছিলেন সিলেটি, মা ইউরোপিয়ান। দু’জনের কেউ বাংলা এক শব্দও বলতে পারতো না। বাকি দু’জন পড়তো ক্লাস টুয়েলভে। ভালো বাংলা বলতে পারতো। ওদের বাবারা পাকিস্তান আর্মিতে অফিসার ছিলেন। সুযোগ পেলে কখনও কখনও লুকিয়ে ওদের সাথে বাংলায় দু’য়েক কথা বলতাম। যথাসময়ে ওরা দু’জন আর্মিতে কমিশন লাভ করেছিলো। বাংলাদেশে এসে অবসরে যাবার আগে একজন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল অন্যজন লেফটেন্যান্ট কর্নেল হতে পেরেছিলো। যাহোক, আমার দায়িত্ব ছিলো ক্লাসরুমে আমার নিজের সাবজেক্ট কেমিস্ট্রি এবং সাধারণ বিজ্ঞান পড়ানো। সেইসাথে শের শাহ হাউসের এসিস্ট্যান্ট হাউস টিউটরের দায়িত্ব পালন করা। এছাড়া ফটোগ্রাফি ক্লাব, মিউজিক ক্লাব এবং ফুটবল আর সাঁতারের ভারপ্রপ্ত অফিসার করা হলো আমাকে। হাইকিং ক্লাবের সাথেও আমাকে যুক্ত করা হলো। মজার কথা হলো, এসবের মধ্যে শুধু ফটোগ্রাফি ও সাঁতার সম্বন্ধে আমার কিছু ধারণা ছিলো। তারপরও মিউজিক আর ফুটবলের দায়িত্ব এড়ানো গেলো না। পাকিস্তানিদের বিশ্বাস ছিলো, তখনকার পূর্ব পাকিস্তানের সকল তরুন জন্মগতভাবে গান আর ফুটবলের বিশেষজ্ঞ হয়ে থাকে ! সকল দায়িত্ব পালনে দেহমন উজাড় করে দিয়ে লেগে গেলাম, যেমনটা সকল সেকেন্ড লেফটেন্যান্টরা করে থাকে।
প্রথমেই হোচট খেতে হলো ভাষা নিয়ে। ক্লাসরুমে পড়ানোসহ ক্যাডেটদের সাথে, এবং অফিসারদের সাথে সকল ফর্মাল কথাবার্তা ইংরেজিতে করতে হয়। অনানুষ্ঠানিক দু’য়েক কথা উর্দুতেও বলা যায়। বাংলা সম্পূর্ণ অচল। বাংলা বলাটা ছিলো গুনায়ে কবিরা। ভুলে দু’য়েক কথা মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেলে আসেপাশের সবাই ‘কেয়া বোলা, কেয়া বোলা তুমনে’ বলে হৈহৈ করে উঠতো। আমার ইংরেজি উচ্চারণ পদ্মাপাড়ের উচ্চাড়ণ। বিশেষ করে ইংরেজি অক্ষর ‘জে’ (এবং জিওমেট্রির ‘জি’) এবং ‘জেড’ এর উচ্চারণ নিয়ে মহাবিপদে পড়েছিলাম। বাংলা ভাষায় তফাৎ না থকলেও উর্দু ভাষায় এ দু’টোর উচ্চারণগত পার্থক্যের কারণে অর্থের পার্থক্য ইংরেজির মতোই প্রবল। পাকিস্তানি এক সহকর্মী যিনি ইংরেজি ভাষার শিক্ষক ছিলেন বুদ্ধি ও অভয় দিয়ে বললেন, ছোট একটি রেডিও কিনে নাও। বেশি করে রেডিওতে বিবিসি শোন। টেইপ রেকর্ডার কিনে নিজের কথা বারবার বাজিয়ে শোন। উচ্চারণে কোথায় ভুল হচ্ছে লক্ষ্য করো। তাহলেই দেখবে ইংরেজি বলাটা রপ্ত হয়ে যাবে। তাছাড়া, তোমার লেখা পড়ে মনে হয়, ইংরেজি ভাষাটা তো তুমি ভালোই জানো। সমস্যা হবে না। কথা ঠিক। অল্প দিনের মধ্যে ওস্তাদের কথামত সমস্যা বহুলাংশে কেটে গেলো।
মহা সমস্যা হলো উর্দু নিয়ে। সৈনিকদের সাথে, বেয়ারা-বাবুর্চির সাথে, বাজারে দোকানদারের সাথে, রাস্তায় টাংগাওয়ালার সাথে উর্দু অথবা পাঞ্জাবি ছাড়া উপায় নাই। পাঞ্জাবি শেখা বাদ দিয়ে উর্দু শেখার উদ্যোগ নিলাম। এর অন্য আরও একটা গুরুত্বপূর্ণ কারণ ছিলো। যেসব তরুণ রেগুলার কমিশন্ড অফিসারের মেট্রিক পর্যায়ে উর্দু ভাষা ছিলো না, তাদের জন্য চাকুরির প্রথম দু’বছরের মধ্যে আর্মি পরিচালিত সমমানের পরীক্ষায় পাশ করা জরুরি ছিলো। যতদিন পাশ না করতো ততদিন চাকুরি স্থায়ী করা হতো না। আর্মির পরীক্ষায় লিখিত এবং মৌখিক আলাদা আলাদা দুই পেপার ছিলো। টেনেটুনে লিখিত পেপারে পাশ করলেও ৯৫% পরীক্ষার্থী, তা সে বাংগালি, পাঞ্জাবি, পাঠান যে জাতিরই হোক না কেনো, মৌখিক পেপারে ফেল করতো ! বলা হতো, পরীক্ষা নেয়ার ফী হিসেবে অনেক বেশি টাকা আয় করার জন্য পরীক্ষকরা এমনটা করতেন। যাহোক, আমি সর্বশক্তি দিয়ে উর্দু বলা, পড়া ও লেখা শেখার চেষ্টা শুরু করে দিলাম। কারণ, মেট্রিকে আমার উর্দু পড়া হয়নি, তার বদলে পড়েছিলাম আরবি। এতে একটা সুবিধা হয়েছিলো। উর্দুর অক্ষরগুলো নতুন করে চিনতে হয়নি। তবে বাধার হিমালয় ছিলো অন্যখানে। বাজারি উর্দু বলা খুবই সহজ। ইংরেজি, হিন্দি মিলিয়ে গ্রামারের পরোয়া না করে জগাখিচুরি কিছু একটা বলে ফেললেই হলো। কেউ মাইন্ড করে না। কিন্তু কেতাবি উর্দু বলা যে কতো কঠিন, তা একমাত্র ভুক্তভোগী জানে। একদিকে বড় কাফ-ছোট কাফ, আইন-গাইন, জ্বীম-জাল-জে-জোয়া, বড় হে-ছোট হে, তে-তোয়া ইত্যাদি বর্ণসমূহের মধ্যে উচ্চারণগত সূক্ষ পার্থক্য আয়ত্ব করার চাইতে পাথর চিবিয়ে খাওয়া সহজ। তার পরেও কথা আছে। উচ্চারণ হয়তবা ঠিক হলো, ব্যাকরণ ? সেটা তো প্রায় কুকুরের লেজ সোজা করার মতো কঠিন। মনে আছে, একবার ক্যাডেটদের নিয়ে বাইরে কোথাও গিয়েছিলাম। ফেরত আসার সময় বাস এলো। আমি ছেলেদের লক্ষ্য করে যেইনা বলেছি, চলো, বাস আগিয়া, অমনি সবাই এতো জোরে অট্টহাসি করে উঠলো যে আমি মহাআহাম্মক বনে গেলাম। আমার আপরাধ, বলা উচিত ছিলো, বাস আগেয়ি। যার কারণ আমি আজও বুঝি না। বাস তো প্রাণী নয় যে এর জেন্ডার খুঁজতে হবে ! কর্তার টেন্স, জেন্ডার, নাম্বার ভেদে বাক্যের ভিতর ক্রিয়াপদের যে রূপান্তর হয়, যাকে ইংরেজিতে কনজুগেশন বলে, তার হদিস রাখা, মানুষ তো দূরের কথা, দেবতার পক্ষেও হয়তো সম্ভব নয় ! এর পর রয়েছে ভোক্যাব্যুলারি অর্থাৎ নতুন নতুন শব্দ শেখার সমস্যা। ঝেলাম বাজারে মাগুর মাছ দেখে খাবার শখ জাগলো। মেসে এসে বাবুর্চিকে বললাম মাগুর মাছ এনে রান্না করতে। বুড়ো পাঞ্জাবি বাবুর্চি লাল খান চোখ কপালে তুলে বললো, সাব, হাম মাগর মাছ নেই খাতে। উয়োহ তো হারাম হায়। বাংগাল মে তোমলোগ খাতেহো ? পরদিন সকালে অফিসে গিয়ে এক পাঞ্জাবি কলিগের কাছ থেকে বুড়োর অবাক হবার কারণ বুঝলাম। উর্দুতে মাগর মাছ মানে কুমির ! সে সময় ঢাকা শিক্ষা বোর্ড মহাত্রাতা হিসেবে আবির্ভূত হয়। তারা বাংগালি আর্মি অফিসারদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা হিসেবে শুধুমাত্র উর্দু ভাষার মেট্রিক পরীক্ষা নেবার ব্যবস্থা রেখেছিলো। কেবলমাত্র লিখিত পরীক্ষা যাতে বেশিরভাগ প্রশ্নের উত্তর বাংলায় লিখে সহজে পাশ করা যেতো। অবশেষে আমি আরও অনেক বংগসন্তানের মতো ঢাকায় এসে সেই পরীক্ষা দিয়ে পাশ করে নিজের মান রক্ষা করি।
------------- মিলিটারি কলেজ ঝেলাম: পর্ব ২ লেফটেন্যান্ট ফিশ!আগেই বলেছি, মিলিটারি কলেজে জয়েন করার পরপরই আমাকে ক্লাসরুমে নিজের সাবজেক্ট পড়ানো ছাড়া ফটোগ্রাফি, মিউজিক, ফুটবল ও সুইমিং ক্লাবের অফিসার-ইন-চার্জ (ও আই সি) নিয়োগ দেওয়া হয়। ছাত্রজীবনে ছবি তোলার শখ ছিলো। তখন ছিলো সাদাকালো ছবির জমানা। ফিল্ম ডেভেলপ ও প্রিন্ট করা সম্বন্ধে কিছু ধারণা ছিলো। কলেজ লাইব্রেরিতে ফটোগ্রাফির উপর ভালোভালো বই ছিলো। সেসব পড়ে মোটামুটি কাজ চালিয়ে নিলাম। সাঁতার ভালোই জানতাম। সেকথায় পরে আসছি। মিউজিক ক্লাবে বেশিরভাগ ছেলে ছিলো কলেজ ব্যান্ডের সদস্য। যার জন্য আর্মি থেকে আসা ব্যান্ড ইন্সট্রাক্টর ছিলো। এছাড়া বাহির থেকে একজন সিভিলিয়ান গানের মাস্টার সপ্তাহে একদিন এসে ছেলেদের সা-রে-গা-মা শেখাতেন। এই বৃদ্ধ ভদ্রলোককে আমি কখনও হারমনিয়াম আর ঢোল ছাড়া অন্য কিছু বাজাতে দেখিনি। আর্মি স্কুল অব ফিজিক্যাল ট্রেইনিং এন্ড স্পোর্টস থেকে পাশ করে আসা হাবিলদাররা ফুটবলসহ অন্যান্য গেইম ও সাঁতার শেখাতো। আমার কাজ ছিলো এসবের সমন্বয় ও তত্বাবধান করা।
এবার আসি সাঁতারের কথায়। আমার বয়স যখন সাত কি আট বছর তখন মামা বাড়ি গেলে আমার ছোটো মামা আমাকে একটি বিশেষ সাঁতারের কৌশল শেখান, যা মামা নিজেও খুব ভালো জানতেন। দুই হাত পিঠের পেছনে নিয়ে কব্জি বরাবর একটি ছোটো রশি বা গামছা দিয়ে একসাথে বেঁধে দিতেন। তারপর দুই পা’র গোড়ালি বরাবর একসাথে গামছা দিয়ে বেঁধে আমাকে দু’তিনজন মিলে ঘাড়ে করে নিয়ে পুকুরে ছেড়ে দিতেন। আমি বহাল তবিয়তে ধীরেধীরে সাঁতার দিয়ে দূরত্ব অতিক্রম করতাম। কখনও চিৎসাঁতার, কখনও বুকসাঁতার দিতাম। হাত-পা বাধা অবস্থায় মাঝেমাঝে চিৎ হয়ে বুকের উপর চারখানা থান ইট নিয়ে সাঁতার দিয়ে বন্ধুদের চমৎকৃত করে দিতাম। ইউনিভার্সিটিতে পড়াকালীন সময় পর্যন্ত এই বিশেষ সাঁতাররে চর্চাটা অব্যাহত রেখেছিলাম।
মিলিটারি কলেজে আমার সহকর্মী বেশ ক’জন অবাংগালি অফিসার ছিলেন যাঁরা সাঁতার জানতেন না, পানিকে যমের মতো ভয় করতেন। একদিন কথাচ্ছলে তাঁদেরকে সাহস যোগাবার জন্য বললাম, সাঁতরানো কোনো কঠিন কাজ নয়। আমাকে হাত-পা বেঁধে পানিতে ছেড়ে দিলেও সাঁতরাতে পারি। কথাটা ওরা মোটেও বিশ্বাস করলেন না। বললেন, জানি তোমরা ইস্ট পাকিস্তানিরা পানির দেশের মানুষ। সবাইকে সাঁতার জানতে হয়। তাই বলে অতটা বাহাদুরি করো না। কথাটা আমি পরে ভুলে গেলেও ওরা ভুলেননি। এর ক’দিন পর কিছু ক্যাডেট নিয়ে আমরা মংলা ড্যামে বেড়াতে গেলাম। আমাকে অবাক করে দিয়ে সেই সহকর্মীরা দু’টুকরা রশি বের করে বললো, এবার তোমার কথা রাখো। আমরা তোমার দু’হাত পেছনে বেঁধে দেবো, সেই সাথে দু’পা গোড়ালিতে একসাথে বেঁধে দিয়ে লেকের পানিতে ছেড়ে দেবো। ভয় পেয়ো না, আটজন দক্ষ সাঁতারু হাবিলদার এবং ক্যাডেট তোমাকে ঘিরে রাখবে, তুমি যাতে ডুবে না মরো। তোমাকে মেরে আমরা কোর্টমার্শালে যেতে চাই না। বাংগালি পৌরুষের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছোড়া হয়েছে ! বললাম, কবুল ! তা-ই করো। ভয় নেই, আমি ইনশাল্লাহ মরবো না। তোমরা বিপদে পড়বে না। কথামতো প্রায় চল্লিশ মিনিট সাঁতরালাম, তার মধ্যে কিছুক্ষণ বুকের উপর চারখানা থান ইট নিয়ে। যখন আমাকে পানি থেকে টেনে তোলা হলো, তখন সে কী আনন্দ আর চিৎকার। রাতারাতি হিরো হয়ে গেলাম। বিশেষ করে ক্যাডেটদের কাছে।
ঝেলাম এবং নিকটস্থ খাড়িয়া ক্যান্টনমেন্টে খবরটা বাতাসের বেগে ছড়িয়ে গেলো। এরিয়া কমান্ডার শুনতে পেয়ে ভাবলেন, তাঁর এরিয়াতে বহু অবাংগালি অফিসার আছেন যাঁরা সাঁতার জানেন না। পানিকে যমের মতো ভয় পান। কিছুদিন আগে এক্সারসাইজের সময় প্রায় হাটু পানিতে ডুবে একজন ইনফ্যান্ট্রির ক্যাপ্টেইন মারা যান। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, অসাতারুদের ভয় ভাংগানোর জন্য, পরবর্তী রবিবার (সাপ্তাহিক ছুটির দিন) বিকেলে মিলিটারি কলেজের সুইমিং পুলে লে: আশরাফের সুইমিং প্রদর্শণীর ব্যবস্থা কর হোক। সকল অফিসার সস্ত্রীক আমন্ত্রিত। বাচ্চারা বিশেষভাবে আমন্ত্রিত। নির্ধারিত দিনে সুইমিং পুলে মহাআয়োজন। চর্তুদিকে সামিয়ানা টাংগানো হয়েছে। সকল বয়সের অফিসার, তাঁদের স্ত্রী-পুত্র-কন্যাগণ, কলেজের ক্যাডেটগণ, স্টাফ, সব মিলিয়ে অনেক লোকের সমাগম। কলেজের ব্যান্ড বাদ্য বাজাচ্ছে। কাবাব, স্যান্ডউইচ, সামুসাসহ নানা ধরনের মুখরোচক স্ন্যাকস। সাথে চা, কফি, সোডা। সেই সাথে চলছে মাইকের ঘোষণা। নির্ধারিত সময়ে চারজন তাগড়া হাবিলদার, যেমন করে লাশ কাঁধে করে বহন করে তেমন করে, আমাকে কাঁধে বয়ে নিয়ে আসলো। আমার পরনে শুধু একটি জাংগিয়া, যাকে ভদ্র ভাষায় বলে সুইমিং কস্টিউম। মনে হচ্ছিলো আমি যেনো সার্কাসের কোনো জন্তু ! আমাকে দেখামাত্র উপস্থিত সবাই, বিশেষ করে মহিলা ও বাচ্চারা উত্তেজনায়, আনন্দে এবং আতংকে চিৎকার হাততালি দিতেদিতে দাঁড়িয়ে গেলো। আমি নিজেও হাবিলদারদের কাঁধে শুয়ে কেমন যেনো শিহরণ অনুভব করছিলাম। হাবিলদাররা ধীরেধীরে স্লো মার্চ করে পুলরে পারে এসে আমাকে ঝুপ করে পানিতে ফেলে দিলো। অন্য সময় সাথেসাথে পানি থেকে মাথা বের করে নি:শ্বাস নেই, সাঁতার করি। এবার একটু সাসপেন্স করার জন্য বেশ কিছুক্ষণ পানির নিচে মাথা ডুবিয়ে রাখলাম। পরে শুনেছি, যতক্ষণ আমি ডুব মেরে ছিলাম ততক্ষণ উপস্থিত দশর্করা সবাই ভয়ে, আতংকে নির্বাক হয়েছলো। তারপর যখন মাথা বের করলাম তখন কী গগনবিদারী চিৎকার। সাবাস, আশরাফ। সাবাস, বাংগালি। কেউ একজন বলে উঠলেন, ইয়ে তো ইনসান নেহি হায়, মছলি হায়। ব্যাস, সেদিন থেকে আমার নিকনেইম হয়ে গেলো লেফটেন্যান্ট ফিশ ! ওভারনাইট হিরো হয়ে গেলাম। শনিবার সন্ধ্যায় অফিসার্স ক্লাবে গেলে শুনতে পেতাম আমাকে দেখিয়ে লোকজন বলাবলি করছে, দেয়ার গো’জ লে: ফিশ।
--------------- মিলিটারি কলেজ ঝেলাম: পর্ব ৩ শাসন করা তারই সাজে ---“ফায়ার ! ফায়ার ! আগ লাগি হ্যায় ! সব বাহার আ-যাও!” পড়াশুনা করে, রেকর্ডপ্লেয়ারে গান শুনে সবে ঘুমিয়েছি। রাত্রি দু’টা-তিনটা হবে। চারদিক থেকে আসা হঠাৎ এমন তীব্র চিৎকারে ঘুম ভেংগে গেলো। অফিসার মেসে নিজের রুমে একা ছিলাম। ( কখনও একরুমে দু’জন সিংগল ফিসারকেও থাকতে হতো।) ধরফরিয়ে উঠে কাপড় পাল্টে দরজা খুলে বাইরে এলাম। পূব-পশ্চিমে টানা কলেজের মেইন রোড ধরে অনেক লোক, যার মধ্যে কোনো ক্যাডেট ছিলো না, পশ্চিম দিকে ছুটছে। সবার মুখে এক চিৎকার, আগ লাগি হ্যায়। পশ্চিম দিকে তাকিয়ে দেখলাম আকাশে আগুনের সুউচ্চ লেলিহান শিখা। ওদিকে ক্যাডেটদের আবাস হিসেবে বাবর হাউস এবং গজনবি হাউস নামে দু’টি হাউস রয়েছে। বলা তো যায় না ! স্লিপার পায়েই ছুটলাম পশ্চিম দিকে। পথে কলেজের কম্যানড্যান্ট কর্নেল মর্তুজাকে (লে: কর্নেল মর্তুজা হোসেন, এ ই সি) খুড়িয়েখুড়িয়ে একই দিকে যাচ্ছেন। পড়নে স্লিপিং স্যুট (বৃটিশ এটিকেট অনুযায়ী স্লিপিং স্যুট পড়ে বেডরুমের বাউরে আসা মহা গুনাহের কাজ !)। দেখামাত্র আমি ফৌজি তরিকায় ‘উইশ’ করলাম, অর্থাৎ “স্লামালেকুম, স্যার” বলে চিৎকার করে উঠলাম। তিনি আতংকিত কন্ঠে বললেন, “ভাই, কওন হো তোম ? ম্যায় জলদি মে আয়নাক (চশমা) ভুল গেয়া। তোম মুঝে যারা সাথ লে চলো।” ইতোমধ্যে কেউ একজন দৌড়ে এসে যা বললো তার সারাংশ হলো: কলেজের পশ্চিম প্রান্তে সীমানা প্রাচীর ঘেঁসে যে গো-খামার রয়েছে সেখানকার খরের গাদায় কে বা কারা আগুন লাগিয়েছে। কম্যানড্যান্টকে নিয়ে আস্তে আস্তে সেখানে গিয়ে দেখলাম আগুন ততক্ষণে নিভে গেছে। কিছু লোক ভীড় করে আছে। গেইটের বাইরে ফায়ার ব্রিগেডের গাড়ি এসে গেছে। অন্য সময় লাইটস আউটের পর সব হাউসে দু’য়েকজন ক্যাডেটকে টয়লেটে যাওয়াআসা করতে দেখা গেলেও সেদিন রাতে একজন ক্যাডেটকেও রুমের বাইরে দেখা গেলো না। হাউসগুলো মনে হচ্ছিলো জনমানবহীন ভূতের বাড়ির মতো।
ক্যাডেট কলেজের মতো মিলিটারি কলেজেও সপ্তাহে একদিন ক্লাস শুরুর আগে এসেম্বলি বা সমাবেশ হতো। তাতে সকল ক্যাডেট ও শিক্ষককে উপস্থিত থাকতে হতো। অগ্নিকান্ডের পরের দিন নরমাল এসেম্বলি ছিলো না, বিশেষ এসেম্বলি ডাকা হলো। সবার মুখ গম্ভীর। চতুর্দিকে থমথমে ভাব। কী জানি, কম্যানড্যান্ট তাঁর বক্তৃতায় অপরাধীদের জন্য কী কঠোর শাস্তি ঘোষণা করেন। যথারীতি কুর’আন থেকে আবৃত্তির পর কম্যানড্যান্ট মঞ্চে উঠলেন। ধীর-স্থিরভাবে চারদিকে একবার চোখ ফিরিয়ে নিলেন। চেহারা বা কন্ঠে রাগ বা উত্তেজনার লেশমাত্র নেই। তারপর বললেন: My dear boys, I understand last night some of you wanted to cut a joke with me. I do appreciate your sense of humor. It is only the intelligent people who can cut good jokes. But, my boys, I have a request to make. Before you cut a joke you should also consider the age of the person concerned. For an old man like me a joke like the one you had last night might be too dangerous to bear with. Next time when you cut such a joke, please keep my age in mind. Thank you. College Captain, carry on, please.এসেম্বলি শেষ। ক্যাডেটরা ক্লাসে চলে গেলো। আমরা ইয়ং আফিসাররা খুব হতাশ হলাম। ক্যাডেট কলেজে সাধারণত ক্লাস ইলেভেনের ছেলেরা, যারা প্রায়শ ইয়ং ইন্সট্রাক্টরদের কর্তৃত্ত মানতে চায় না, বড় ধরনের কান্ড ঘটিয়ে থাকে। এরা কোনো কারণে বড় শাস্তি পেলে ইয়ং ইন্সট্রাক্টররা মনেমনে পুলকিত হয়। যাহোক, আমরাও হতাশ হয়ে যারযার কাজে ফিরে গেলাম।
কম্যানড্যান্ট কর্নেল মর্তুজা ব্যক্তি জীবনে চিরকুমার ছিলেন। প্রথম যৌবনে প্রেমে ব্যর্থ হবার পরিণতি। ছেলেমেয়ে একদম পসন্দ করতেন না বলে রটনা ছিলো। যা সঠিক ছিলো না। যাহোক, সপ্তাহখানেক পরের কথা। ক্লাস ইলেভেনের চারপাঁচজন ক্যাডেট নিয়মানুযায়ী এডজুট্যান্টের অফিসে গিয়ে কম্যানড্যান্টের সাক্ষাৎকার চাইলো। এডজুট্যান্ট কারণ জানতে চাইলেন। ছেলেরা বললো, আপনাকে কারণ বলা যাবে না। যা বলার সরাসরি কম্যানড্যান্টকে বলবো। কম্যানড্যান্ট ছেলেদেরকে তাঁর অফিসে আসার অনুমতি দিলেন। সাথে এডজুট্যান্টকে থাকতে বললেন। বলা তো যায় না, পরিস্থিতি কোন দিকে গড়ায়। ছেলেগুলো কম্যানড্যান্টের অফিসের দরজায় গিয়ে ‘উইশ’ করে হুড়মুড় করে, কেউ চেয়ারের তল দিয়ে, কেউ টেবিলের তল দিয়ে কম্যানড্যান্টের পায়ের উপর হুমরি খেয়ে পড়লো। সবাই উচ্চস্বরে কাঁদতেকাঁদতে বললো: স্যার, উই ডিড ইট। উই পুট দি হে স্ট্যাক অন ফায়ার। প্লিজ ফরগিভ আস। উই আর রিয়ালি ভেরি সরি ফর দি ট্রাবল উই গেইভ ইউ। উই শ্যাল নেভার ডু ইট এগেইন। প্লিজ ফরগিভ আস দিস টাইম। কম্যানড্যান্ট চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে সবাইকে বুকে জড়িয়ে ধরে নিজেও কাঁদতে লাগলেন। হাপুস নয়নে সবার সে কি কান্না ! কিছুক্ষণ কান্নাকাটির পর কম্যানড্যান্ট কিছুটা স্থির হয়ে বললেন: বয়েজ, ইউ আর মাই চিল্ড্রেন। আই ফরগেইভ ইউ দি ডে আই এড্রেসড ইউ। আই এম হ্যাপি টু সি দ্যাট ইউ আর রিপেন্ট্যান্ট। দ্যাট’স লাইক গুড বয়েজ। আই এম প্রাউড অব ইউ। কাম অন মাই সান্স, নাউ স্মাইল ! ছেলেরা তাঁর পা ছুঁয়ে সালাম করে চোখে পানি, ঠোটে হাসি নিয়ে বেরিয়ে আসলো। তারপর কর্নেল মর্তুজা যতদিন ছিলেন ততদিন মিলিটারি কলেজে ছেলেরা তেমন কোনো বড় ঘটনা ঘটিয়েছে বলে শোনা যায়নি।
সেদিনের সে ঘটনা আমার জীবনে গভীর রেখাপাত করেছিলো। সারা জীবনের জন্য আমাকে যেনো চোখে আংগুল দিয়ে শেখালো: “শাসন করা তারই সাজে সোহাগ করে যে গো।” ------------- মিলিটারি কলেজ ঝেলাম: পর্ব ৪ আমার গুরু কর্নেল মর্তুজাআগেই বলেছি, মিলিটারি কলেজে জয়েন করার সাথেসাথে আমাকে প্রশাসনিক কাজের জন্য শের শাহ হাউসে এসিট্যান্ট হাউস টিউটর নিয়োগ করা হলো। শের শাহ হাউসের হাউস মাস্টার ছিলেন মি: ফজলুল হক হায়দ্রি। সিনিয়র সিভিলিয়ান ইন্সট্রাক্টরদের মধ্যে অন্যতম একজন। বাচ্চ্দের জন্য চমৎকার একজন ইংরেজির শিক্ষক ছিলেন। সমবয়সী হবার কারণে কম্যানড্যান্ট কর্নেল মর্তুজার ব্যক্তিগত বন্ধু ছিলেন। প্রশাসনিক অনেক সিদ্ধান্ত নিতে কম্যানড্যান্টের উপর প্রভাব বিস্তার করতেন। পরে বুঝতে পেরেছিলাম হায়দ্রী সাহেবের একান্ত আগ্রহে আমাকে ওনার অধীনে শের শাহ হাউসে এসিট্যান্ট হাউস টিউটর নিয়োগ করা হয়েছিলো। এর আগে আর কোনো আর্মি অফিসারকে ওনার আন্ডারে নিয়োগ করা সম্ভব হয়নি। কারণ, হায়দ্রী সাহেবের অফিসিয়াল স্ট্যাটাস ছিলো ক্লাস টু গেজেটেড অফিসার। একজন আর্মি অফিসারকে ক্লাস ওয়ান গেজেটেড অফিসার হবার কারণে হায়দ্রী সাহেবের অধীনে নিয়োগ করা সম্পূর্ণ বেআইনি। হায়দ্রী সাহেব আমার জুনিয়রিটির সুযোগ নিয়েছেন। অল্প দিনের মধ্যে বিষয়টি বুঝতে পারলাম। একজন বন্ধু ভাবাপন্ন সিনিয়র পাঞ্জাবি কলিগের সাথে বিষয়টি নিয়ে কথা বললাম। তিনি বললেন, কাজটি অবশ্যই বেআইনি হয়েছে। তোমার প্রতি অবিচার করা হয়েছে। আমি তাঁকে প্রশ্ন করলাম, কেনো তাঁরা কম্যানড্যান্টকে একাজ থেকে বিরত থাকতে বললেন না। জবাবে তিনি যা বললেন তা আমার সারা জীবনের জন্য শিক্ষা হয়ে আছে। তনি বলেছিলেন, প্রথমত: কাজটি করার আগে কম্যানড্যান্ট কোনো আর্মি অফিসারের পরামর্শ চাননি। দ্বিতীয়ত: আর্মিতে আগ বাড়িয়ে কেউ কারও জন্য কথা বলে না। যার কথা তাকেই বলতে হয়। আমরা ভাবলাম, তুমি যদি ব্যাপারটা মেনে নেও তাহলে আমরা বলার কে ? আর, তুমি যদি না মানো তাহলে প্রচলিত আইনই তোমাকে বলে দিবে তোমার কী করতে হবে।
ক’দিন ভেবেচিন্তে অবশেষে একদিন হায়দ্রী সাহেবকে বিনয়ের সাথে বললাম যে, আমার পক্ষে আর তাঁর হাউসে কাজ করা সম্ভব নয়। তিনি যেনো বিকল্প ব্যবস্থা করেন। বিষয়টি ব্যাখ্যা করে আরও বললাম, বয়স্ক লোক হিসেবে আপনাকে আমি সব সময় সম্মান করি। এটি একটি নীতির প্রশ্ন। দয়া করে ব্যক্তিগতভাবে নিবেন না। হায়দ্রী সাহেব কোনো জবাব না দিয়ে আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন।
পরদিন টী-ব্রেকের সময় স্টাফ রুমে সকল আর্মি এবং সিভিলিয়ান অফিসারের সামনে হায়দ্রী সাহেব আমাকে উদ্দেশ্য করে চিৎকার করে বলে উঠলেন, লে: আশরাফ, গতকাল থেকে কেনো আপনি হাউসে ডিউটি থেকে অনুপস্থিত থাকছেন ? এটা খুব অন্যায় কাজ। আপনার বুঝা উচিৎ। আমি বুঝলাম, হায়দ্রী সাহেব এতো লোকের সামনে আমাকে উল্টাপাল্টা কিছু বলার জন্য প্ররোচিত করছেন। রাগের মাথায় মুখ ফসকে অন্যায় কিছু যদি বলে ফেলি তাহলে আমার কোর্ট মার্শাল করতে সাক্ষীর অভাব হবে না। আমি ধীরস্থিরভাবে জবাব দিলাম, আমার যা বলার তা গতকাল আপনাকে বলেছি। আমার আর কিছু বলার নেই। তুমি কম্যানড্যান্টের আদেশ অমান্য করছো, হায়দ্রী সাহেব এবার গর্জে উলেন। আমি বললাম, বিষয়টি তা’হলে আপনি কম্যানড্যান্টকে বলুন। তিনি যা করার করবেন।
এর পরদিন, যা ভেবেছিলাম, কম্যানড্যান্ট আমাকে তাঁর অফিসে ডেকে পাঠালেন। অফিসে ঢুকে স্যাল্যুট করতে না করতেই শুরু হলো বজ্রের গর্জন। ইংরেজি, উর্দু মিলিয়ে আর্মিতে যত গালি ও মন্দ কথা আছে তা প্রবল বেগে আমার উপর বর্ষিত হতে লাগলো। যার বেশিরভাগ ছাপার অযোগ্য। ‘শান’ পজিশনে দাঁড়িয়ে থেকে তাতে অবগাহন করা ছাড়া আমার তখন কিছু করার ছিলো না। তিনি বললেন: তুমি লে: আশরাফ ‘টিট অব এ সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট’ হয়ে আমার আদেশ অমান্য করার ‘অডাসিটি’ কোথায় পেলে ? প্রথম সুযোগেই বিড়াল মারার জন্য আমি খুব আস্তে করে বললাম: স্যার, আপনার আদেশটি এমপিএমএল (ম্যানুয়াল অব পাকিস্তান মিলিটারি ল’) অনুযায়ী বৈধ ছিলো না। তাই মানা সম্ভব নয়। একজন ক্লাস ওয়ান অফিসার হয়ে আমার পক্ষে একজন ক্লাস টু অফিসারের অধীনে কাজ করা সম্ভব নয়। কাজ হলো না। বিড়াল তো মরলোই না, বরং তিনি আরও রেগে গিয়ে বললেন: হতে পারে মি: হায়দ্রী একজন ক্লাস টু অফিসার। কিন্তু আমি আমার ওথরিটি তাঁকে ডেলিগেইট করেছি। তুমি তার হুকুম মানতে বাধ্য। আমি কোনো প্রকার আবেগ না দেখিয়ে বললাম: আপনি আপনার ওথরিটি একজন হাবিলদারের কাছে ডেলিগেইট করতে পারেন। তাইবলে একজন হাবিলদারের কম্যান্ড আমি মানতে পারি না। পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমি আমাকে এমন শিক্ষা দেয়নি। বরং আমাকে বলেছে, কমিশনের প্রতীক হিসেবে তোমার কাঁধে যে ‘পিপ’ দেওয়া হয়েছে, সেটা দেশের মহামান্য প্রসিডেন্ট দিয়েছেন। এটা দেশ ও জাতির গৌরব ও সার্বভৌমত্বের প্রতীক। প্রাণ দিয়ে হলেও এর সম্মান রক্ষা করা তোমার পবিত্র কর্তব্য। এ পর্যন্ত শুনে কম্যানড্যান্ট আরও ক্ষেপে গেলেন। যেনো আগুনে ঘি পড়লো। চিৎকার করে বললেন: ইউ ডাকা ইউনিভার্সিটি চ্যাপস, ইউ ওনলি নো হাউ টু আরগু। বছরের পর বছর তোমার মতো রটেন মাল বের করে ঢাকা ইউনিভার্সিটি দেশের সর্বনাশ করছে। তোমরা শুধু শিখেছো কিভাবে গন্ডগোল পাকাতে হয়। আমি বিনয়ের সাথে বললাম: প্লিজ ক্রিটিসাইজ মি ইফ আই এম রং। বাট, স্যার, প্লিজ ডু নট ক্রিটিসাইজ মাই ইউনিভার্সিটি। ইট ইজ বিক’জ অব ডাকা ইউনিভার্সিটি হোয়াট আই এম টু’ডে। ইট টট মি হাউ টু কীপ মাই হেড হাই এগেইনস্ট অল অডস। ইট ওয়াজ বিক’জ অব ডাকা ইউনিভার্সিটি আই ওয়াজ ফাউন্ড ফিট ফর কমিশন বাই দি আইএসএসবি। আমার প্রাণপ্রিয় ইউনিভার্সিটির সমালোচনা সহ্য করতে না পেরে বেশ কিছুটা ইমোশনাল হয়ে পড়েছিলাম। সব শেষে তিনি গর্জে উঠলেন: ইউ ব্লাডি চ্যাপ, ইউ ডোন্ট নো হোয়াট ইজ অর্মি। আই উইল কিক ইউ আউট অব দি আর্মি। আর্মি ডাজ নট নীড এন ইনডিসিপ্লিড রো’গ লাইক ইউ। নাউ গেট আউট। স্মার্ট একটা স্যাল্যুট দিয়ে বেরিয়ে এলাম।
সেদিন সারাদিন কোনো কাজে মন বসলো না। অবশেষে একাএকাই সিদ্ধান্ত নিলাম, আর্মিতে আর চাকুরি করবো না। মান-ইজ্জত বিসর্জন দিয়ে চাকুরি করার কোনো মানে হয় না। যা হয় হবে, চাকুরি থেকে ইস্তফা দেবো। তখনকার দিনে কম্প্যুটার ছিলো না। ব্যক্তিগত টাইপরাইটারও ছিলো না। সারারাত জেগে আর্মি চীফকে এড্রেস করে, যথাযোগ্য কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে পাঠানোর জন্য, নিজ হাতে রেজিগনেশন লেটার লিখলাম। দরখাস্তে পুরো ঘটনা সংক্ষেপে বর্ণনা করলাম। সবশেষে লিখলাম: আমি ঠিক বুঝতে পারছি না কোনটা আর্মির আসল শিক্ষা। একজন আর্মি অফিসারের মর্যাদা সম্পর্কে পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমি যা আমাকে শিখিয়েছে, নাকি আমার বর্তমান কম্যানড্যান্ট যা শেখাতে চাচ্ছেন। যদি কম্যানড্যান্ট যা শেখাতে চাচ্ছেন তা-ই কারেক্ট হয়, তবে আমি এই আর্মিতে আর চাকুরি করতে চাই না। আমার এই চিঠিকেই পদত্যাগপত্র বলে বিবেচনা করতে সবিনয় অনুরোধ জানাচ্ছি।
আর্মি বিধি অনুযায়ী এধরনের চিঠিকে ‘রিড্রেস অব গ্রীভেন্স’ (দুর্দশার প্রতিকার) চেয়ে চিঠি বলা হয়। কম্যান্ড চ্যানেলের প্রতিজন কম্যান্ডারের হাত হয়ে সর্বশেষে চিঠিটিকে অবশ্যই আর্মি চীফের হাতে পৌছাতে হবে। প্রত্যেক কম্যান্ডারের জন্য নির্ধারিত সময়সীমা বেধে দেওয়া আছে। যদি কোনো কম্যান্ডার নির্ধারিত সময়ের চাইতে বেশি সময় ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় দরখাস্তটি ফেলে রাখেন, তবে আবেদনকারী সরাসরি পরবর্তী সিনিয়র কম্যান্ডারের কাছে তার চিঠি পাঠাতে পারবেন। তবে হ্যাঁ, যদি মাঝ পথে কোনো কম্যান্ডার প্রার্থিত প্রতিকার করে দিতে পারেন, এবং আবেদনকারী অফিসার যদি তাতে সন্তুষ্ট হন, চিঠিটি পরবর্তী সিনিয়র কম্যান্ডারের কাছে আর পাঠনো হয় না। বিষয়টি ওখানেই শেষ হযে যায়। মিলিটারি কলেজ ঝেলামে আমার কম্যান্ড চ্যানেলে প্রথম অফিসার ছিলনে চীফ ইন্সট্রাক্টর মেজর বি এ (বশীর আহমদ) মালিক, এইসি। পরদিন সকাল বেলা তাঁর অফিসে গিয়ে আমার চিঠিটি তাঁর হাতে দিলাম। মুখ দেখে মনে হলো তিনি এমন কিছু আন্দাজ করেছিলেন। আমার জন্য কফির অর্ডার দিয়ে তিনি চিঠিটি মনেমনে পড়তে লাগলেন। পড়া শেষ করে ছোট্ট করে মন্তব্য করলেন, ওয়েল ড্রাফটেড। রেখে যাও। দেখি কী করতে পারি।
দু’তিন দিন পরের কথা। ঊর্দ্ধতন কম্যান্ডারের কাছে আমার দরখাস্তখানা পাঠাবার সময়সীমা তখনও পার হয়নি। একদিন সকাল দশটার দিকে ডাক এলো কম্যানড্যান্টের কাছ থেকে। যেতেযেতে ভাবলাম, যা হবার হবে। নীতির প্রশ্নে আপোষ করবো না। কম্যানড্যান্টের অফিসে পা দিয়ে স্যাল্যুট করতে না করতেই তিনি আন্তরিক কন্ঠে আহ্বান জানালেন, হাঁ ভাই আশরাফ, আ যাও। টেইক এ সীট। হাউ আর ইউ ? ঘরওয়ালে (বাড়ির সবাই) কেয়সে হ্যায় ? কেয়া পিউগে, চায় ইয়া কফি ? একজন সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট স্বঅভাবিক অবস্থায় তাঁর কমান্ডিং অফিসারের কাছ থেকে স্বপ্নেও এমন আচরণ আশা করতে পারে না। আমার বুঝতে বাকী রইলো না, দেয়ার হ্যাজ বীন এ চেইঞ্জ অব হার্ট ! বসতেবসতে বললাম, থ্যাংক ইউ স্যার। এজ ইউ প্লীজ। কম্যানড্যান্ট অর্ডার্লিকে চা আনতে বললেন। তারপর তিনি বললেন: আশরাফ, আই এম সরি। দি আদার ডে আই ওয়াজ হার্শ উইথ ইউ। ইট কুড বি এভয়ডেড। আই শুড হ্যাভ টেকেন ইওর পয়েন্ট। এনি ওয়ে, লেট’স ফরগেট এন্ড ফরগিভ। ফ্রম টু’ডে আই হ্যাভ পুট ইউ ইন টিপু হাউস। দি হাউস মাস্টার ইজ এ সিনিয়র আর্মি অফিসার। এ নাইস ম্যান। ইউ উইল নট হ্যাভ এনি প্রবলেম ইউথ হিম। আমার চা তখনও শেষ হয়নি। থ্যাংক ইউ, থ্যাংক ইউ ভেরি মাচ স্যার বলে দাঁড়িয়ে স্যাল্যুট করে অত্যন্ত খুশিমনে কম্যানড্যান্টের অফিস থেকে বেরিয়ে এলাম। আল্লাহকে শুকরিয়া জানালাম।
এরপর থেকে কর্নেল মর্তুজা যেনো আমার ব্যক্তিগত বন্ধু হয়ে গেলেন। আমাকে নিজের গাড়িতে বসিয়ে প্রায় উইকএন্ডে ক্লাবে নিয়ে যেতেন। ভালো ছবি হলে ঝেলাম বা রাওয়ালপিন্ডি শহরে সিনেমা দেখাতে নিয়ে যেতেন। গাড়ি চালাতেচালাতে কলেজের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করতেন। প্রায় দিন, রাত্রি বার’টার পর আমার রুমের দরজায় টোকা দিয়ে আমাকে বিছানা থেকে উঠিয়ে বলতেন, আশরাফ, চলো যারা চক্কর লাগাতে হে। বাকী সব লোগ (অন্য অফিসাররা) তো বিবি-বাচ্চা লে কে সোগিয়া হ্যায়। এক তরফ (জুনিয়রদের মধ্যে) তোম হো ব্যাচেলর, দু’সরি তরফ (সিনিয়রদের মধ্যে) ম্যায় হুঁ বাচেলর। ঘর মে কোই কাম নেহি হ্যায়। চলো চক্কর লাগাতে হে। আমাকে সাথে নিয়ে হাউসগুলোতে, কলেজ হাসপাতালে রাউন্ড দিতেন। দেখতেন, ছেলেরা ঠিকমত ঘুমাচ্ছে কিনা। কারও গা থেকে কম্বল পড়ে গেলে একজন মায়ের মতো তা ঠিক করে দিতেন, যেনো ঘুমন্ত ছেলেটি জেগে না উঠে। বাথরুমগুলো পরিষ্কার আছে কিনা, পানির কল সব কাজ করছে কিনা, ইত্যাদি। দু’জনের পায়ে থাকতো রাবার সোলের জুতা, যাতে বাচ্চাদের ঘুমের ব্যাঘাত না হয়। গো-খামারের গরুগলো কেমন আছে তা-ও তিনি দেখতে ভুলতেন না। বলতেন, এটি খুব গুরুত্বপূর্ণ কাজ। গরুগুলো ঠিক না থাকলে ছেলেদেরকে খাঁটি দুধ কেমন করে দেবো ? সারা দিন কাজকর্ম, খেলাধুলা করে আমি খুব ক্লান্ত থাকতাম। রাত জেগে কম্যানড্যান্টের সাথে এভাবে ঘুরতে আমার কষ্ট হতো। ছেলেদের প্রতি কতটা মায়া থাকলে একজন প্রিন্সিপাল এতটা নিবেদিতপ্রাণ হতে পারেন, সত্য বলতে কি, তখন বুঝতে পারিনি। হয়তো বয়স কম হবার কারণে। পরবর্তীকালে যখন আমি নিজে ক্যাডেট কলেজের প্রিন্সিপাল হয়েছিলাম তখন পর্যন্ত আমাকে অপেক্ষা করতে হয়েছিলো একথা বুঝতে যে, কেনো কর্নেল মর্তুজা এমন করতেন। বিষয়টি কাউকে বোধ হয় বুঝিয়ে বলা যায় না, ফুলের ঘ্রাণের মতো উপলব্ধি করতে হয়। সত্যিকার অর্থেই কর্নেল মর্তুজাকে আমি গুরু মানি।