Ashraf’s Column

Sunday, August 12, 2012

বন্ধ হোক গায়ের জোরে গুরুগিরি

১। বহু বছর আগে, আধাশতাব্দিরও বেশি হবে, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের লেখায় একটা কথা পড়েছিলাম। কোনোকোনোগুরুজনের আচরণে মাঝেমধ্যে কথাটা যে মনে হয়নি, তা নয়। কিন্তু বাংলাদেশেরশিক্ষাঙ্গণের, বিশেষ করে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালসমূহের বতর্মান হালহকিকত দেখে কথাটাভীষণভাবে মনে পড়ছে। উচ্চ শিক্ষার এসব প্রতিষ্ঠানগুলোতে দু’তিন দশক ধরে যেনৈরাজ্যকর অবস্থা বিরাজ করছে তাতে যে কোনো বিবেকবান ব্যব্ক্তি দেশের ভবিষ্যতচিন্তা করে বিচলিত বোধ করবেন। বহুদিন আগে পড়েছি বলে কবিগুরুর কথাটা স্মৃতি থেকেহুবহু উদ্ধৃত করতে পারছি না। পারিবারিক কারণে দেশ থেকে অনেক দূরে যুক্তরাস্ট্রেবাস করতে হচ্ছে। হাতের কাছে বাংলা রেফারেন্স বই নেই। তাই পাঠকের কাছে ক্ষমা চেয়েনিয়ে ঘুণেধরা স্মৃতিশক্তিকে ভরসা করছি। কবিগুরু যা বলেছিলেন তার মর্মকথা হলো,গায়ের জোরে আর সব হওয়া গেলেও গুরু হওয়া যায়না। আমার বিশ্বাস, বাংলাদেশের মানুষ,বিশেষ করে যাঁদের ছেলেমেয়ে স্কুল, কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করে, গত দু’তিনদশক ধরে কথাটা হাড়েহাড়ে টের পাচ্ছেন। প্রাইমারি স্কুলের শিশু থেকে বিশ্ববিদ্যালয়েরতরুণ পর্যন্ত সকল বয়সের শিক্ষার্থীদের উপর এমন সব লোকদের গুরু হিসেবে চাপিয়ে দেওয়াহচ্ছে যাঁদের বেশির ভাগেরই, শিক্ষাগত যোগ্যতা থাকলেও, গায়ের জোর ছাড়া শিক্ষক হবারমত আর কোনো যোগ্যতা নেই। এখানে গায়ের জোর বলতে শারীরিক শক্তিকে বোঝানো হচ্ছেনা। (যদিওএমন উদাহরণ বিরল নয় যেখানে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের কোনোকোনো শিক্ষকশিশুকিশোর ছাত্রছাত্রীকে শারীরিক শক্তি প্রয়োগ করে রক্তাক্ত করছেন, এমনকি হাসপাতালেপাঠাচ্ছেন।) কোনোকোনো অধ্যক্ষ এবং উপাচার্য সারাক্ষণ বাড়িতে এবং অফিসে পুলিশিপ্রহারায় আবৃত থেকে নিজ প্রতিষ্ঠানের স্বার্থবিরোধী কর্মকান্ড চালাচ্ছেন। এমনকিকেউকেউ নিজ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষককে অমর্যাদাকারী, ছাত্রের হত্যাকারী কিংবা ছাত্রীরনির্যাতনকারীদের পৃষ্ঠপোষকতা করছেন। প্রতিবাদী ছাত্র ও শিক্ষকদের উপর নির্যাতনচালাচ্ছেন, কখনও অতি লজ্জাজনকভাবে পুলিশের সাহায্য নিয়ে। ছাত্রদেরকে শাসন ওপরিচালনা করার জন্য প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব কিছু বিধিবদ্ধ আইনকানুন এবংবিধিবিধান অবশ্যই থাকা দরকার, এবং তা আছেও। প্রতিষ্ঠানের মহাগুরু, যাকে আমরাপ্রধান শিক্ষক, অধ্যক্ষ অথবা উপাচার্য বলে থাকি, তিনিসহ সকল গুরু বা শিক্ষকপ্রয়োজনবোধে এসব আইনকানুন এবং বিধিবিধান, যাকে অন্যভাবে গায়ের জোর বলা যায়, প্রয়োগকরতে পারেন। কিন্তু সমস্যা হলো, একজন শিক্ষক চাইলেও একজন থানার দারোগার মত শুধুমাত্রআইনকানুনের ডান্ডা দেখিয়ে, গায়ের জোরে, ছাত্রদেরকে সুশিক্ষিতরূপে আলোকিত করে গড়েতুলতে পারেন না। একাজ নিষ্ঠা, সততা এবং দক্ষতার সাথে করতে হলে একজন মহাগুরু অথবাগুরুকে, আনুষ্ঠানিক ডিগ্রি ছাড়া, আরও কিছু অত্যাবশ্যকীয় মানবিক ও মানসিক গুণাবলীসম্পন্নহওয়া অপরিহার্য। আমার বিশ্বাস, কবিগুরু তাঁর কথায় সে দিকেই ইঙ্গিত করেছেন।

২। বর্তমানে আমাদেরপাবলিক বিশাববিদ্যালয়গুলোতে ভয়াবহ অনিয়ম, দাঙ্গা, সন্ত্রাস, অগ্নিসংযোগ ওছাত্রীনির্যাতনসহ যেসব দুষ্কর্ম চলছে তা এককথায় নজিরবিহীন। ইতোপূর্বে জাহাঙ্গীরনগরবিশ্ববিদ্যালয়ও অশান্ত, অরাজক হয়ে উঠেছিলো। সরকার অযথা দীর্ঘ কালক্ষেপণের পর,শিক্ষার্থীদের লেখপড়ার প্রভূত ক্ষতি সাধনের পর পুরানো উপাচার্যকে বিদায় করে একজননতুন উপাচার্য নিয়োগ করেছেন। মনে হয় না, তাতেও সমস্যার সমাধান হবে। কিছুদিন যাবত বুয়েটেরভিসি এবং প্রোভিসির প্রশাসনিক যোগ্যতা এবং সততা প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ায় সাধারন শিক্ষক এবংছাত্ররা তাঁদের পদত্যাগ দাবি করে ধর্মঘট করছেন। রাজশাহি বিশ্ববিদ্যালয়ে চাঁদারটাকা ভাগাভাগি নিয়ে একই ছাত্র সংগঠনের দুই অংশের মধ্যে সংঙ্ঘর্ষে একজন ছাত্র নামধারীচাঁদাবাজ নিহত হয়েছে। ২২ বছর যাবত ডাকসুর ইলেকশন না হওয়াতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরসাধারণ ছাত্রসমাজ অস্থির হয়ে উঠছে। সিলেটের ঐতিহ্যবাহী এমসি কলেজে একদল দাঙ্গাবাজছাত্র একটি ছাত্রাবাস আগুন লাগিয়ে ভস্মীভূত করেছে। সাম্প্রতিক কালের ইতিহাসসাক্ষ্য দেয়, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে হত্যাকান্ড সংঘটিত হয়, কিন্তু তার কোনোবিচার হয় না। অন্য কারণ থাকলেও, এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মহাগুরুদের অযোগ্যতা,অদক্ষতা এবং অনেক ক্ষেত্রে অসততা এমন পরিস্থিতির জন্য বহুলাংশে দায়ি। অথচ তাঁদেরকেউই নিজ অক্ষমতা স্বীকার করে আত্মমর্যাদা নিয়ে স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেন না। পরিস্থিতিরচরম অবনতি হবার পর সরকার কর্তৃক অপসারিত না হওয়া পর্যন্ত বেহায়ার মত পদ আকড়েথাকেন। তাঁরা ভুলে যান যে, তাঁরা সরকার কর্তৃক নিয়োজিত আর দশজন কর্মকর্তার মত নন।ডিসি, এসপি বা দারোগার মত সরকারি কর্মকর্তারা আত্মমর্যাদার তোয়াক্কা না করেও চাকরিকরেন, বা করতে হয়। কিন্তু একজন শিক্ষকেরপক্ষে আত্মমর্যাদা বিসর্জন দিয়ে নিজ দায়িত্ব পালন করা কখনও সম্ভব নয়।আত্মমর্যাদাহীন কোনো ব্যক্তি আর যা-ই হোন না কেন, তাঁর পক্ষে গুরু হওয়া সম্ভব নয়।তিনি কখনও শিক্ষার্থীদের মাঝে উন্নত মানুষ হবার জন্য প্রয়োজনীয় আলোক ছড়াতে পারেননা। একজন মহাগুরুর কী কী গুণ থাকলে তাঁকে যোগ্য, দক্ষ, সৎ এবং আত্মমর্যাদাসম্পন্নবলা যাবে সে সম্বন্ধে পরে আলোচনা করছি। তার আগে নবীণ পাঠকদের সাথে আমার নিজেরবিশ্ববিদ্যালয় জীবনের দু’টি অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে চাই।

৩। ১৯৬২ সনেরফেব্রুয়ারি মাস। ঢাকা কলেজ থেকে সবে আইএসসি পরীক্ষা দিয়েছি। তখনও রেজাল্ট আউটহয়নি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তুমুল আয়ুববিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলছে। পরীক্ষার পরপড়াশুনা বা ক্লাশ নেই। তাই প্রতিদিন সকাল বেলা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে এসেমিটিং-মিছিলে যোগ দিতাম। তখনও আমি কোনো ছাত্র সংগঠনের সদস্য হইনি। নিজের বিবেকেরতাড়নায় বাসা থেকে ফাঁকি দিয়ে এসে মিটিং-মিছিলে যোগ দিতাম। একদিন, সঠিক তারিখ মনে নেই,সকাল দশটা-এগারটার দিকে কার্জন হল এলাকার উত্তরপূর্ব দিকের মেইন গেটের ভিতরেদাঁড়িয়ে আমরা বেশ কিছু ছাত্র বিক্ষোভ করছিলাম। সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ। হঠাৎসামনের বড় রাস্তা ধরে উত্তর (হাই কোর্টের) দিক থেকে একটি ইপিআর-এর জিপগাড়ি দ্রুতদক্ষিণ দিকে যাবার সময় চালকের পাশে বসে থাকা পাকিস্তানি অফিসারটি তাঁর পিস্তল দিয়েবিক্ষোভরত ছাত্রদের দিকে এক রাউন্ড গুলি করে বসলো। আমারই পাশে দাড়ানো একজনবিক্ষোভরত ছাত্রের উরুতে গুলিটি লাগার ফলে সে রক্তাক্ত হয়ে মাটিতে পড়ে গেলো।তিন-চার জন ছাত্র মিলে দ্রুত আহত ছাত্রটিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়েগেলো। তুমুল উত্তেজনাকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হলো। কয়েক মিনিটের মধ্যে উপাচার্য ড.মাহমুদ হোসেন (ভারতের প্রয়াত রাষ্ট্রপতি ড. জাকির হোসেনের ভাই) পরিস্থিতি সামালদেওয়ার জন্য অকুস্থলে হাজির হলেন। জীবনে এই প্রথম একজন উপাচার্যকে সামনাসামনিদেখলাম। এতদিন দূর থেকে শুধু তাঁর নিজ বিষয় ইতিহাসের উপর অগাধ পান্ডিত্য, প্রশাসনিকদক্ষতা, সততা, সবোর্পরি ছাত্রদের প্রতি অপার ভালোবাসা ইত্যাদি মানবিক ও মানসিকগুণাবলীর কথা শুনে এসেছি। আজকে সামনাসামনি হয়ে আর সবার মত আমারও মাথা এমনিতেশ্রদ্ধায় নত হয়ে এলো। তিনি কার্জন হল ভবনের উত্তরমুখি প্রধান ফটকের সামনের বারান্দায়এসে দাঁড়ালেন। পেছনে অন্যান্য অধ্যাপকবৃন্দ। তাঁর চোখ বেয়ে অঝরে পানি ঝরছিলো। মনেহলো, একজন স্নেহময় পিতা তাঁর রক্তাক্ত পুত্রের জন্য কাঁদছেন। অথচ তিনি বাঙ্গালিসমাজের কেউ ছিলেন না। উর্দুভাষী এই পন্ডিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়োজিতহবার পূর্বে করাচি বিস্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করছিলেন। মনে হলো, একজন দেবদূতের সামনেদাঁড়িয়ে আছি। ডান হাত সামান্য উচু করেসবাইকে শান্ত হতে ইশারা করলেন। মুহূর্তে পিনপতন নিস্তব্ধতা। ছাত্রদের উদ্দেশ্য করেতিনি যা বললেন তার মর্মার্থ হলো, তাঁর একজন প্রিয় ছাত্র আহত হওয়াতে তিনি অত্যন্ত ব্যথিতএবং ক্ষুদ্ধ। ছাত্ররা বিশ্ববিদ্যালয়ের সীমানার মধ্যে থেকে শান্তিপূর্ণভাবে বিক্ষোভকরছিলো। সরকারি বাহিনীর কোনো প্রয়োজন ছিলো না তাদের প্রতি গুলি করার। তিনি বিষয়টিনিয়ে জরুরিভিত্তিতে মাননীয় চ্যান্সেলরের (কুখ্যাত গভর্নর মোনেম খানের) সাথে আলাপকরবেন। সন্তোষজনক জবাব না পেলে তিনি পদত্যাগ করবেন। একই বছর আমি বিশ্ববিদ্যালয়েভর্তি হবার কিছুদিন পর শুনলাম ড. মাহমুদ হোসেন পদত্যাগ করে চলে গেছেন। মোনেম খানেরমত নোংরা রাজনীতিবিদের সাথে ড. মাহমুদের মত আত্মমর্যাদাসম্পন্ন ভদ্রলোকের মানিয়েচলা সম্ভব ছিলো না।

৪। এর পরের ঘটনা ১৯৬৫সনের সেপ্টেম্বর মাসের। ততদিনে ময়মনসিংহের ড. ওসমান গনি ড. মাহমুদ হোসেনের পরউপাচার্য হয়ে এসেছেন। ড. ওসমান গনিকে গুটিকয়েক এনএসএফ-পন্থী ছাত্র ও মুসলিমলীগপন্থী শিক্ষক ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের কেউই মনেপ্রাণে গ্রহণ করতে পারেননি। আমিওপারিনি। হঠাৎ সেপ্টেম্বর মাসের ৬ তারিখ সকালে আমি যে হলে থাকতাম সে হলে একদুর্ঘটনা ঘটে। আমি ওয়েষ্ট হাউসে তিন তলার যে রুমে থাকি তার পাশের গোসলখানার লেট্রিনেরমধ্যে একজন আগন্তুক অতিথি ব্লেড দিয়ে নিজের গলার একপাশ ও শরীরের অন্যান্য কিছুঅঙ্গ কেটে আত্মহত্যা করে। ঠিক একই সময়ে আমি এবং আরও দু’জন ছাত্র পাশের গোসলখানায়শাওয়ার নিচ্ছিলাম। একজন ছাত্র শেভ করছিলো। স্বাভাবিকভাবেই হৈচৈ ও চাঞ্চল্য হলো।পুলিশ এলো, কেইস হলো। এসব কেইসে আজকের অনেক পুলিশের মত তখনকার পুলিশও আমরা যারাঘটনার সময় গোসলখানায় ছিলাম তাদেরকে আসামি বানিয়ে হত্যা মামলা ঠুকে দিলো। শুরু হলোপুলিশি হয়রানি। কথাটা প্রভোস্টের মাধ্যমে উপাচার্য ড. ওসমান গনির কানে গেলো। উপাচার্যনিজ উদ্যোগে ঢাকার তৎকালীন বাঙ্গালি পুলিশ সুপারের সাথে বিষয়টি নিয়ে আলাপ করেন। আরক’দিন বাদেই আমাদের অনার্স ফাইনাল পরীক্ষা। থানার দারোগারা যেন আমাদের হয়রানি নাকরে সেদিকে নজর রাখার জন্য তিনি পুলিশ সুপারকে অনুরোধ করেন। একদিন সন্ধ্যাবেলাপুলিশ সুপার সিভিল কাপড়ে আমাদের হলে এসে আমাদের সাথে দেখা করলেন। উপাচার্য তাঁকেকি বলেছেন, তা জানালেন। দারোগারা কোনো হ্যারাস করবে না বলে নিশ্চয়তা দিলেন।নিশ্চিন্তভাবে পরীক্ষার পড়া চালিয়ে যাবার জন্য বড় ভাইয়ের মত উপদেশ দিয়ে চলে গেলেন।এরপর মামলার কি হয়েছিলো জানি না, তবে দারোগারা আর আমাদের ধারেকাছে আসেনি। রাজনৈতিকবিবেচেনায় ড. ওসমান গনিকে ভিসি হিসেবে মেনে নিতে না পারলেও আভিভাবক হিসেবে তাঁরঅবদান কখনও অস্বীকার করা যাবে না।

৫। পৃথিবীর সকলপ্রাণীর সন্তান জন্ম নেবার পর খাদ্য ও নিরাপত্তা পেলে নিজেনিজে বেড়ে উঠে বাবামারমত প্রাণীতে পরিণত হয়। একমাত্র মানুষের সন্তান এর ব্যতিক্রম। সে জন্ম নিয়ে একাএকাবড় হয়ে ‘মানুষ’ হতে পারে না। তাকে মানুষ হতে হলে খাদ্য ও নিরাপত্তা ছাড়া আরও কিছুরপ্রয়োজন। জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে এই আরও কিছুর কিছুটা সে পায় তার বাবামার কাছথেকে, অনেকটা পায় শিক্ষক বা গুরুর কাছ থেকে, আর কিছুটা পায় সমাজ ও পরিবেশ থেকে।প্রাচীণ গ্রীক দার্শনিক এরিস্টটল বলেছেন: “Those who educate children well are more to be honored thanthey who produce them; for these only gave them life, those the art of livingwell.” (যাঁরা মানবসন্তানকে সুশিক্ষা প্রদান করেন তাঁদেরকে সন্তানের জন্মদাতাদের চাইতে বেশি সন্মানকরতে হবে। কেননা, জন্মদাতরা সন্তানকে কেবল জীবন দান করেন, শিক্ষকরা দান করেন উন্নতজীবন যাপনের কৌশল।) এজন্যই আদিকাল থেকে আজপর্যন্ত পৃথিবীর সব সমাজে গুরুর কাজটি এত কঠিন, গুরুত্বপূর্ণ এবং মর্যাদাসম্পন্ন। একজনছাত্র, তা সে প্রাথমিক অথবা বিশ্ববিদ্যালয় যে পর্যায়ের হোক না কেন, নিজের গুরুনিজে নির্বাচন করে না। পিতামাতা, সমাজপতি এবং রাষ্ট্র তার জন্য কাজটি করে দেয়। আমাদেরদেশে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যে বিশৃঙ্খল অবস্থা বিরাজ করছে তার সবগুলোরউপাচার্যকে চূড়ান্ত পর্যায়ে সরকার নিয়োগ দিয়ে থাকেন। পিতামাতা, অভিভাবক ও সমাজেরপক্ষ থেকে সরকার এ রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালন করেন। দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, আমাদেরনির্বাচিত সরকার প্রধানরা, অন্য প্রায় সব রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে যেমন,পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রধান নির্বাচনের ক্ষেত্রেও তেমন নিজ দলীয় প্রভাব থেকেনিজেকে মুক্ত রাখতে পারছেন না। দেশের স্বার্থের উপর নিজের দলের স্বার্থকে স্থানদিচ্ছেন। নিজ দলের সমর্থক যোগ্য, দক্ষ এবং আত্মমর্যাদাসম্পন্ন বিশ্ববিদ্যালয়েরসিনিয়র অধ্যাপক, যাঁরা সফল উপাচার্য হতে পারতেন, থাকতেও অযোগ্যদের একের পর একউপাচার্য নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। এর একটাই কারণ হতে পারে। আর তা হলো, প্রত্যেক সরকারপ্রধানই (যিনি নিজ দলেরও প্রধান বটেন) চান একমাত্র দলবাজ, তল্পিবাহক, মোসাহেব জাতীয়অধ্যাপকরা উপাচার্য নিযুক্ত হন। যাতে করে তাঁরা উপাচার্যদের মাধ্যমে পাবলিকবিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র রাজনীতি এবং শিক্ষক রাজনীতি নিজ দলের নিয়ন্ত্রণে রাখতেপারেন।

৬। সকল সিনিয়র অধ্যাপকউপাচার্য হবার জন্য উপযুক্ত নন। তবে সকল উপাচার্যকে অবশ্যই মেধাবী অধ্যাপক, গবেষকএবং পন্ডিত হতে হয়। কথাটার একটু ব্যাখ্যা দেওয়া প্রয়োজন, নইলে ভুল বোঝাবুঝি হতেপারে। একটি বিশ্ববিদ্যালয় অন্য যেকোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে আলাদা ভূমিকা পালনকরে। অন্য সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কাজ প্রধানত: জ্ঞান বিতরণ করা, শিক্ষার্থীকেআলোকিত করা। অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ প্রথমত: গবেষণার মাধ্যমে জ্ঞান সৃষ্টিকরা, সভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। দ্বিতীয়ত: শিক্ষার্থীকে জ্ঞান বিতরণের মাধ্যমে শিক্ষিতকরা, এবং আলোকিত করে গড়ে তোলা। এসব কাজে একজন অধ্যাপক চমৎকার নৈপুণ্য অর্জন করতেপারেন। তারপরও তিনি উপাচার্য হবার জন্য উপযুক্ত না-ও হতেপারেন। একজন উপাচার্যকেসফল অধ্যাপক হবার পাশাপাশি একজন দক্ষ প্রশাসক হতে হয়। তাঁর পক্ষে একদিকেবিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা কার্যে একাডেমিক নেতৃত্ব প্রদান করে জ্ঞান সৃষ্টিতে ভূমিকাপালন করা জরুরি। তিনি যদি তা না পারেন, বা না করেন, তাহলে তাঁর অধীনস্ত শিক্ষকরাএবং ছাত্ররা তাঁর নেতৃত্ব মন থেকে মেনে নিবেন না। অন্যদিকে তাঁকে বিশ্ববিদ্যালয়েরসার্বিক প্রশাসনকর্ম তদারকি করার জন্য একজন দক্ষ প্রশাসক হতে হয়। না হলে,বিশৃঙ্খলা এবং অব্যবস্থা বিশ্ববিদ্যালয়ের অগ্রযাত্রার দ্বার রুদ্ধ করে দেয়। একজনউপাচার্যকে তাই পান্ডিত্য এবং প্রশাসন উভয় ক্ষেত্রেই দক্ষ হওয়া প্রয়োজন। এযুগেএকজন সফল প্রশাসককে একজন সফল নেতা হতে হয়। সফল নেতা হবার জন্য কী কী গুণ থাকাপ্রয়োজন তা ম্যানেজমেন্টের যেকোনো পাঠ্য বইয়ে পাওয়া যাবে। দক্ষতা, যোগ্যতা ওঅভিজ্ঞতার পাশাপাশি জ্ঞান-বুদ্ধি, বিবেক-বিবেচনা, সততা-সত্যশীলতা,মহানুভবতা-উদারতা এসব গুণের অন্যতম।

৭। আজকাল সরকার বা দলপ্রধানরা মনে করেন, যেসব শিক্ষক তাঁর দলের প্রতি অনুগত থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকরাজনীতিতে সফলতা দেখিয়ে শিক্ষক সমিতির সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক ইত্যাদি পদেনির্বাচিত হন তাঁরা তাঁদের নেতৃত্বের গুণে সফল উপাচার্য হবেন। বিশ্ববিদ্যালয়েশিক্ষক রাজনীতি করে নেতা হতে গেলে যে কতটা দলবাজী,ধোকাবাজী ও মোসাহেবী করতে হয়, তাতাঁরা বিবেচনায় রাখেন না। তাই আমরা দেখতে পচ্ছি, সকল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে একরেপর এক আত্মমর্যাদাহীন দলবাজ, মোসাহেব শিক্ষক উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পাচ্ছেন।ফলশ্রুতিতে অনেক অধ্যাপক পেশাগত কাজে মনোনিবেশ না করে উপাচার্য হবার আশায় শিক্ষকরাজনীতিতে মত্ত হয়ে থাকছেন। যাঁদের বিরুদ্ধে পাঠদান এবং গবেষণাকর্মে ফাঁকি দেওয়া,থিসিস নকল করা, ছাত্রদের পরীক্ষার রেজাল্ট হেরফের করা, ছাত্রী নির্যাতন করাইত্যাদি অভিযোগ শোনা যায়, তাঁদের বেশিরভাগই এমন দলবাজ শিক্ষক। এদের মধ্য থেকে যারাউপাচার্য হন তাঁরা নিজ দলের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের, যাঁরা এসব অপরাধ করেন তাঁদের,কোনো বিচার তো করেনই না, বরং দেখা যায় প্রশ্রয় দিচ্ছেন। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেদিনদিন বিশৃঙ্খলা, নৈরাজ্য ও অপরাধ বেড়ে চলছে।

৮। একটা সময় ছিলো যখনকিছুকিছু গুরুত্বপূর্ণ সরকারি পদে, যেমন হাইকোর্টের বিচারপতি, রাষ্ট্রদূত,উপাচার্য ইত্যাদি পদে, নতুন নিয়োগ পাওয়ালোকদের সংক্ষিপ্ত জীবনবৃত্তান্ত সরকারি উদ্যোগে পত্রিকায় ছাপা হতো। আজকাল তেমনটাআর চোখে পড়ে না। হয়তো আজকাল যাঁরা এসব পদে নিয়োগ পাচ্ছেন তাঁদের পক্ষে রাজনৈতিকবিবেচনা ছাড়া আর কিছুই কাজ করে না। তাঁদের না আছে তেমন যোগ্যতা, গৌরব বা সৌরভ যাজানতে পেরে জনগণ তুষ্টি লাভ করতে পারে। অন্যদের বেলায় না হোক, অন্তত: উচ্চ আদালতেরবিচারপতি ও উপাচার্যদের জীবনবৃত্তান্ত এখনও পত্রিকায় প্রকাশ হওয়া উচিত বলে আমি মনেকরি। বিচারপ্রার্থী ও শিক্ষার্থীদের বিশ্বাস ও আস্থা বাড়াবার জন্য এটার প্রয়োজনকখনও ফুরিয়ে যাবে না।

৯। আমাদের সমাজেআবহমানকাল ধরে সিনিয়র শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের কাছে পিতামাতার মত পূজনীয়। পিতামাতাতাঁর সন্তানকে কোন আইনের বলে শাসন করবেন তা কোনো আইনের বইতে লেখা নেই। এ নিয়েপার্লামেন্টেও আইন পাশ হয় না। তাই বলে কোনো পিতামাতা প্রয়োজনে সন্তানকে শাসন করাথেকে বিরত থাকেন না। কোনো সুসন্তানও সে শাসনের অবাধ্য হয় না এই বলে যে, কোন আইনেলেখা আছে যে তোমরা আমায় শাসন করবে? একইভাবে শিক্ষকরা আমাদের যুগযুগ ধরে আদরেরসাথেসাথে প্রয়োজনে শাসন করে আসছেন। শিক্ষক দু’ভাবে এ শাসন করতে পারেন। পিতামাতারজন্য আইনের বই না থাকলেও, শিক্ষকের জন্য রাষ্ট্র আইনের বই বানিয়ে দিয়েছে। তিনিইচ্ছে করলে আইনের বই দেখিয়ে, গায়ের জোরে, শিক্ষার্থীকে শাসন করতে পারেন। অথবা,তিনি পিতামাতার মত আইন না দেখিয়ে শাসন করতে পারেন। এজন্য পিতামাতা যে কর্তৃত্ববলেসন্তান শাসন করেন শিক্ষককে সে কর্তৃত্ব অর্জন করতে হয়। এ কর্তৃত্ব হচ্ছে পিতামাতারমরাল অথারিটি। অনেকে বলেন ডিভাইন অথারিটি। যা প্রবাহিত হয় পিতামাতার নৈতিক অবব্থান থেকে। একজন শিক্ষক যদি নিজ মানবিকগুণের বলে সে অবস্থানে পৌছতে পারেন, তাহলে শিক্ষার্থী শাসন করার জন্য তাঁকে আইনেরবইয়ের পাতা ঘাটতে হয় না, যেমনটি আজকাল হচ্ছে। আমার সৌভাগ্য, প্রাথমিক বিদ্যালয়থেকে বিশ্ববিদ্যালয জীবনে নৈতিক কর্তৃত্ববান অনেক শিক্ষক আমি পেয়েছি, যাঁরা আমাকেপিতামাতার মত আদর দিয়ে শাসন করেছেন। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, আজও তেমন শিক্ষক আমাদেরবিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আছেন। তবে তাঁরা আত্মমর্যাদা বিসর্জণ দিয়ে দলবাজী করেন না, পদও পদবীর লোভে রাজনৈতিক নেতাদের মোসাহেবী করেন না। কোনো সরকার প্রধান যদি, দলবাজীরউর্ধে উঠে, দলের উপর দেশের স্বার্থকে স্থান দিয়ে, যথাযথ সম্মানের সাথে তাঁদেরকেবিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হবার জন্য আহ্বান করেন তাহলে, সবাই না হলেও, দেশেরস্বার্থের কথা বিবেচনা করে অনেকেই এগিয়ে আসবেন। একমাত্র এভাবেই আমাদেরবিশ্ববিদ্যালয়গুলো বর্তমান অচলাবস্থা থেকে মুক্তি পেতে পারে। বর্তমান ও ভবিষ্যতেরসকল সরকার প্রধানদের কাছে বিনীত প্রার্থনা, যথেষ্ট হয়েছে, আর না। যাঁর কাজ তাঁকে করতেদিন। উপযুক্ত ব্যক্তিদেরকে উপাচার্য নিয়োগ দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে রক্ষা করুন।জনগণের নির্বাচিত সরকার প্রধান হিসেবে কেবল আপনারাই পারেন দেশটাকে পচন থেকে, ধ্বংশথেকে রক্ষা করতে। (লেখক ঝিনাইদহ ক্যাডেটকলেজ এবং ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষ)